রনবীর কার্টুনে ঈদুল আজহা: মধ্য আশি থেকে নব্বইয়ের শুরু
টোকাইকে দেখেছিলেন রনবী তাদের নারিন্দার বাসার সামনে। চেকের খাটো লুঙ্গি পরা পেটমোটা ছেলেটি হাসছিল, খেলছিল বা গাইছিল। বারান্দায় বসে তার সঙ্গে টুকটাক গল্পও করতেন রনবী; কিন্তু তখনো ভাবেননি এর নাম রাখবেন টোকাই আর সে হয়ে উঠবে বাংলাদেশের প্রথম কার্টুন চরিত্র। ওর ছোট মুখ দিয়েই তিনি বলালেন বড় বড় কথা, যেগুলো রসালো অথচ ধারালো।
ডাস্টবিনের ধারে তাকে পাওয়া যায়। দোস্তি তার কাক, ছাগল, মশা আর কুকুরের সঙ্গে। দুর্নীতি, সন্ত্রাস, রাজনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি বিষয়ক সমস্যা নিয়ে কথা বলেছে টোকাই, কখনো কখনো দিয়েছে সমাধান। টোকাই প্রথম আত্মপ্রকাশ করে ১৯৭৮ সালের মে মাসে সাপ্তাহিক 'বিচিত্রা'য়। ক্ষমতার পালাবদলের এক নিদারুণ অস্থির সময় ছিল সেটি, ভয়ংকরও বলা যায়। সময়টার বৈশিষ্ট্য ছিল- দেখছি, শুনছি কিন্তু সইতে পারছি না। এ প্রেক্ষাপটে শিল্পী রফিকুননবী ওরফে রনবীর মুখপাত্র হয়ে উঠল টোকাই। টোকাই বলতে থাকল ছাত্রের, চাকুরিজীবীর, কৃষকের, শ্রমিকের, ক্ষুধার্তের, দোকানদারের- অর্থাৎ যাদের কষ্ট আছে তাদের কথা। দুর্নীতিবাজ, মওজুদদার, ঘুষখোর তার বাক্যবাণে ঘায়েল হতে থাকল।
ঈদুল আজহা এলে আবার টোকাই বলল গরুর কথা। গরুর ক্রেতা আর বিক্রেতাকেও সে ছাড় দিল না। বুঝল মধ্যবিত্ত নামের দুঃখী মানুষগুলোর বেদনা; যাদের সাধ বড় কিন্তু সাধ্য ছোট। ১৯৮৪ সালে ঈদুল আজহা এসেছিল সেপ্টেম্বর মাসে। বিচিত্রা প্রকাশ করেছিল ঈদুল আজহা সংখ্যা। সম্পাদকীয় পেরিয়েই টোকাইয়ের দেখা মিলল।
রনবী একই ফ্রেমে কাছের ও দূরের দুটি দৃশ্য এঁকেছেন। দূরের পটে দেখা যাচ্ছে কালো স্যুট-প্যান্ট পরা মোটাতাজা এক লোক, তার চেয়েও অধিক স্ফীত এক গরু রাখালের হাতে ধরিয়ে বাড়ির পথ ধরেছেন। তা দেখে সম্মুখ পটে এক পথচারী টোকাইকে বলছে, উনি না সবচে বেশি পয়সার গরুটা কিনেছেন! টোকাই উত্তর দিচ্ছে, 'হ্যাঁ টাকার কোরবানী করতেছে আর কী'।
আশির দশকে স্বৈরাচারী সরকারের আমলে কিছু লোক হঠাৎই আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে যায়। তাদের বিত্ত প্রদর্শনের একটা ক্ষেত্র ছিল গরুর হাট। সবচেয়ে বড় গরুটা সবচেয়ে বেশি টাকায় কিনে তারা নাম করতে চাইত। টোকাই তাই বলতে ছাড়ছে না, এসব লোকেরা কেবল টাকাই কোরবানী দিচ্ছে। না করছে ধর্ম পালন, না পারছে রিপুর তাড়না থেকে মুক্ত হতে।
চুরাশিতেও বাংলাদেশ বন্যায় প্লাবিত হয়েছিল। দেশের প্রধান তিন নদী পদ্মা, যমুনা, মেঘনার প্রবাহ বিপৎসীমা অতিক্রম করেছিল। ঈদুল আজহা সংখ্যার বিচিত্রা সম্পাদক সে বিষয়ে স্বচ্ছল ব্যক্তিদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিলেন। সম্পাদকীয়তে যেমন লেখা ছিল, 'বর্তমান বছরে এমন এক সময়ে ঈদ এসেছে যখন সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বন্যাগ্রস্ত। বানের জলে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের জীবনে ঈদ কোনো আনন্দ বয়ে আনবে না, উপরন্তু বন্যার কারণে যত পশুর প্রাণহানি ঘটেছে তাতে এসময়ে সংযমের পরিচয় না দিলে জাতীয়ভাবে আমাদের আরো ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে। আজকের এ জাতীয় দুর্যোগে যারা এখনো স্বচ্ছল, যারা এখনো দুর্গত নন তাদের প্রতি আমাদের আবেদন বন্যাগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ান, উৎসবের আনন্দের অংশীদার করুন'।
ওই ঈদ সংখ্যার বিশেষ আয়োজন ছিল 'রনবীর চোখে ঈদ'। তিন পাতা জুড়ে প্রতি পাতায় ৪টি করে ১২টি ভিন্ন ভিন্ন কার্টুন ছাপা হয়েছিল। গরুর ব্যাপারী, রাখাল, নতুন পয়সাওয়ালা, মেয়ের জামাই সন্ধানকারী শশুর ইত্যাদি। কার্টুনে রনবী বরাবরই মিনিমালিস্ট। কালি ও কলমে খুব অল্প রেখায় তিনি পরিবেশ ও চরিত্রগুলোকে উপস্থাপন করেন। তাতে চরিত্রের বয়স, সামাজিক অবস্থান, পেশা, ধর্ম এমনকি সংস্কৃতি সহজেই ফুটে ওঠে। আর সংলাপগুলোতে তিনি সময়ের সংকট, সংঘাত ও দাবী কথ্য ভাষায় উপস্থিত করেন।
'রনবীর চোখে ঈদ' শিরোনামের ওই বিশেষ আয়োজনের প্রথম কার্টুনটিতে যেমন গরুর ব্যাপারী ও রাখালকে দেখা যায় গরুর পালের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। রাখালকে ব্যাপারী বলছে, 'সব কয়টারেই কোরবানীর হাটে লওনের কাম নাই, ইলেকশনের হাটের লাইগ্যাও কিছু রাখিস।' উল্লেখ্য '৮৫ সালের মার্চে এইচএম এরশাদ তার সামরিক শাসনকে বৈধতা দিতে গণভোটের আয়োজন করে। আর সে নির্বাচন উপলক্ষে নেতারা যে মচ্ছবে মাতবেন তা রনবীর জানা ছিল।
পরের কার্টুনটিতে রনবী গরু-ছাগলের মুখে ভাষা যুগিয়েছেন; যেখানে ছাগলকে গরু বলছে, 'সবতে কইতাছি মাছ-মুরগী, তরি তরকারির দাম নাকি আমাগো দামের থে বেশি দূরে নাই…।' এই সংলাপ দিয়ে বন্যায় শাক সবজী নষ্ট হওয়ায় তা যে মহার্ঘ্য হয়ে উঠছে সে ইঙ্গিত করছেন রনবী। আবার সব চাপ গরু ছাগলের ওপর পড়ায় তাদের কষ্টের দিকটাও তুলে ধরছেন।
ঈদযাত্রায় পরিবহন ভোগান্তি সে সময়ও যে ছিল তার নমুনা দেখা যাচ্ছে তৃতীয় কার্টুনটায়। এতে হাট থেকে ছাগল কিনে ফেরার পথে দুইজন পথচারীর একজন আরেকজনকে বলছে, 'জ্বী না কোরবানীর ঈদে দেশে যাই না, বাসে ট্রেনে কোরবান হওয়ার চান্স হান্ড্রেড পারসেন্ট তো, তাই…।'
পরের কার্টুনটিতে বিদ্রুপ করা হচ্ছে এক নব্য ধনীকে। তাতে দুটি গরু সামনে দাঁড়ানো কালো স্যুট কোট পরা এক ব্যক্তিকে দেখে বলছে, 'তারে দেইখাই বুঝছি, আমাগো কিননের তাকৎ তার ইদানিং হইছে…।' আরেকটি কার্টুনে দেখা যাচ্ছে, গরুর হাটে এক বয়স্ক ব্যক্তি পাশেরজনকে বলছে, আরে না ভাই গরু পছন্দ করতে নয়, পয়সাওয়ালা জামাই পছন্দ করতে এসেছি, হাটে নাকি পয়সাওয়ালাগোই ভীড়…।'
শেষ দিকের দুটি কার্টুনে দুটি চরিত্র চিত্রন করা হয়েছে। একটির শিরোনাম কোরবানী ফ্যাশন, তাতে এক যুবককে দেখা যাচ্ছে যার গেঞ্জিতে গরুর মাথা ও ছুরি-চাকু দেখা যাচ্ছে। পরেরটির শিরোনাম, মাংস বিলাসী। তাতে দেখা যাচ্ছে, ভারী চেহারার এক লোকের ওপরের পাটির দুটি দাঁত কাঁটা চামচের মতো বেড়িয়ে এসেছে।
ঈদুল আজহা ১৯৮৫
সম্পাদকীয়তে (বিচিত্রা) লেখা, 'এবারের কোরবানী উপলক্ষে ঢাকা শহরের এক পরিবারের কয়েক শরীক মিলে কোরবানীর দুটি বলদ দান করেছেন জনৈক এক দরিদ্র কৃষককে। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এভাবে কোরবানীর গরু দান করা নিশ্চয়ই উৎসর্গের এক প্রয়োজনীয় মাত্রা হিসাবে বিবেচিত হবে। বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে এ জাতীয় উৎসর্গকে অভিনন্দন জানাই'।
টোকাই কার্টুনে দেখা যাচ্ছে এক পথচারী টোকাইয়ের কাছে জানতে চাইছে, এবারের ঈদে গরু-ছাগলের দাম কেমন হবে বলতে পারবি? টোকাই উত্তর দিচ্ছে, 'নিজের দামই জানি না, ওইটা কমু কেমনে'।
রনবীর চোখে ঈদ শিরোনামের বিশেষ আয়োজনে এবার আছে দুটি পুরো পৃষ্ঠা। মোট ৬টি কার্টুন অভাব অনটনকে কেন্দ্র করে। প্রথমটায় স্বামী ফিরেছেন হাট থেকে গরুর লেজ হাতে করে। বলছেন, 'গিন্নী ওই পয়সায় কেবল লেজটা পাওয়া গেল'। পরের কার্টুনে দুটি মোরগের একটি আরেকটিকে বলছে, 'হ্যারে গরু ছাগলের ব্যবস্থা না করতে পেরে শেষে সবাই আমাদের দিকে নজর করবে না তো?' তৃতীয় কার্টুনটিতে দেখা যাচ্ছে, একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নিজের কক্ষে উপবিষ্ট, কক্ষের দরজায় গরুর রশি হাতে আরেক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে। সে বলছে, 'স্যার আনছি, এবার ফাইলটা…'।
চতুর্থ কার্টুনে হাড় জিড়জিড়ে গরুটি নিজেই বক্তা। ক্রেতাকে বলছে, 'স্যার এবার মাফ কইরা দেন, অভাবে পইড়া মনিব নিজেই আমার খাওন খাইয়া ফেলাইছিল তো, তাই গায়ে গোশত জমে নাই, আগামীবারে…'। শেষদিকের একটা কার্টুনে গরুর তাড়া খেয়ে দুইজনকে পালাতে দেখা যাচ্ছে। তাদের একজন আরেকজনকে বলছে, 'তখনই কইছিলাম কম পয়সা লইয়া গরুর হাটে যাওনের কাম নাই'।
ভয়াবহ বন্যার বছর
১৯৮৭, ১৯৮৮ আর ১৯৯৮ এর বন্যা আখ্যা পেয়েছে ভয়াবহ বন্যা হিসাবে। এর মধ্যে আটাশির বন্যায় দেশের ৬০ ভাগ স্থলাভূমি প্লাবিত হয়েছিল। সে বছর জুলাই মাসে প্রকাশিত বিচিত্রার ঈদ উল আজহা সংখ্যার সম্পাদকীয়তে লেখা ছিল, 'কোরবানীর গোশত তিন ভাগে ভাগ হওয়ার বিধান – এক ভাগ ফকির মিসকিনদের জন্য, এক ভাগ দরিদ্র আত্মীয় স্বজনের জন্য এবং বাকী অংশ নিজের। এই বিধানের মধ্য দিয়ে সমাজের সর্বস্তরে খুশি বণ্টন হয়, সবাই ভাগীদার হন আনন্দের। আমরা আশা করি সবাই এই বিধান যথাযথভাবে মেনে চলবেন'।
টোকাই কার্টুনে টোকাই গরুর সঙ্গে কথোপকথনে লিপ্ত।
টোকাই: হাসস ক্যা?
গরু: হাসুম না! কোরবানীর ঈদে আমাগো ব্যাপারীরা গাহাকদের (ক্রেতা) একেবারে গরু বানাইয়া ফেলে।
এই ঈদ সংখ্যাতেও 'ঈদ কার্টুন ৮৮' শিরোনামে দুই পাতা জুড়ে রনবীর কার্টুন ছাপা হয়েছে। প্রতি পাতায় ৪টি করে মোট ৮টি। এবারের আয়োজনের প্রধান সুর- অস্বচ্ছলতা, অসামর্থ্য। কার্টুনগুলোর পাত্র-পাত্রী হলো স্বামী-স্ত্রী, কাক ও কুকুর, বিক্রেতা ও ক্রেতা। একটি কার্টুনে দেখা যাচ্ছে, গরুর বাঁধাই করা ছবি একটি খুঁটিতে বাঁধা আর তার সামনে দুই ভদ্রলোক কথা বলছেন, 'ভেবেছিলাম গরু কিনে এখানে বেঁধে রাখব, তা আর সাধ্যে কুলালো না বলে এই ব্যবস্থা'।
আরেকটি কার্টুনে দেখা যাচ্ছে, বাড়ির কর্তা ঘুমাচ্ছে আর গিন্নি খাটের ধারে দাঁড়িয়ে বলছেন, 'কি এই অসময়ে ঘুমাচ্ছ?' কর্তা ঘুমাতে ঘুমাতে উত্তর দিচ্ছেন, 'না ঈদে গরু ছাগল তো কিনতে পারব না তাই স্বপ্নেই ব্যাপারটা সেরে ফেলার চেষ্টা করছি'। পরের কার্টুনে দেখা যাচ্ছে, বন্যায় দুটি গরু ভাসছে। পেছনেরটি সামনের গরুটিকে বলছে, 'মনে হয় বন্যা আমাদের এ দফা বাঁচিয়ে দিলো'।
নব্বই ছিল বিশ্বকাপের বছর
১৯৯০ সালের জুন মাসে এসেছিল ঈদুল আজহা। ইতালিতে ফুটবল বিশ্বকাপের ১৪তম আসরও বসেছিল একই সময়ে। দুইয়ে মিলেই তাই বিচিত্রার ঈদুল আজহার সংখ্যা প্রকাশিত হয়। টোকাই কার্টুনেও তা দেখা গেল।
টোকাই পথের ধারে বসেছিল, ভদ্রঘরের আরেকটি শিশুও ফুটবল নিয়ে ছিল তার পাশে। শিশুটি টোকাইয়ের কাছে জানতে চাইছে, 'তুই ঈদের দিন কোন দলের সাপোর্টার থাকবি?' টোকাই উত্তর দিল, 'গোশত টোকানের (দলে)'।
ঈদুল আজহা ও বিশ্বকাপ নামে ওই সংখ্যায় রনবীর চার পাতা ভরা বিশেষ কার্টুন ছাপা হয়েছিল। ঈদের সঙ্গে ম্যারাডোনা, রাতভর খেলা দেখা ও ফাইনাল খেলা ছিল কার্টুনগুলোর বিষয়। প্রথম কার্টুনটিতেই দেখা যাচ্ছে রাতের বেলা গরুর হাটে একটা টিভিতে গরু, পাইকার, বেপারী সবাই মিলে খেলা দেখছে। তৃতীয় কার্টুনটিতে চারটি চরিত্র-ক্রেতা, বেপারী, রাখাল ও গরু। রাখাল ক্রেতাকে বুদ্ধি দিচ্ছে, 'স্যার বেপারী সাব কইলাম আর্জেন্টিনার পক্ষে, দাম কমাইতে ওই লাইনে কথা কইয়েন'।
পরের কার্টুনের স্থান ভিতরবাড়ি। সেখানে স্বামী স্ত্রীকে বলছে, 'যে বাজেট তাতে গরুর ব্যাপারীরা লাল কার্ড দেখাইয়া হাট থেকে বের করে দিবে নির্ঘাৎ'। আরেকটি কার্টুনে গরুকে ঝিমাতে দেখা যাচ্ছে, তা দেখে ক্রেতা জানতে চাইছে বিক্রেতার কাছে, 'কী ব্যাপার তোমার গরু তো ঝিমাচ্ছে, অসুখ-বিসুখ নাকি?' বিক্রেতা উত্তর দিচ্ছে, 'জ্বী না রাইতভর খেলা দেখছে তো তাই…'। শেষ দিকের একটা কার্টুনে দেখা যাচ্ছে, ছুটে আসছে এক তেজী গরু আর তা দেখে একজন বলছে, 'আরে এ দেখি ম্যারাডোনার মতো ঠেইল্যা আইতাছে'।
স্বৈরাচার পতনের পরের বছর
একানব্বইয়ের বিচিত্রা ঈদুল আজহা সংখ্যাও প্রকাশিত হয়েছিল জুন মাসেই। সম্পাদকীয়তে এমনটা লেখা হয়েছিল, 'সাইক্লোন, টর্নেডো আর বন্যাবিধ্বস্ত বাংলাদেশে উদযাপিত হচ্ছে এবারের ঈদুল আজহা। গত কয়েক বছরে নব্য ধনীদের বিত্ত প্রতিযোগিতার এক অলিখিত ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে এই ঈদ। দুর্যোগজনিত কারণে এবারে পশুর দাম বেশি হলেও বিত্তবানদের অসুস্থ প্রতিযোগিতায় উৎসাহের অভাব হবে বলে মনে হয় না। এবারের সাইক্লোনে সরকারি হিসাবে সাড়ে আট লক্ষ গবাদি পশুর মৃত্যু হয়েছে। বিধ্বস্ত এলাকার লক্ষ কৃষক পরিবারে হালের গরু নেই, দ্বীপগুলোর পরিবহন ব্যবস্থা সম্পূর্ণ অচল হয়ে গেছে, গরু মহিষের অভাবে আমাদের দফতরে বহু চিঠি এসেছে কোরবানীর জন্য ক্রীত গবাদিপশু সাইক্লোন বিধ্বস্ত মানুষদের দান করার আবেদন জানিয়ে। দুর্গত মানুষদের জন্য সমবেদনা প্রকাশের এই আর্তি যে কোনো বিবেকসম্পন্ন মানুষকে বিচলিত করবে'।
এ সংখ্যায় টোকাই হাজির গরুর হাটে, সঙ্গে একজন বয়স্ক ব্যক্তি। ব্যক্তিটি টোকাইকে জিজ্ঞেস করছে, 'গরুর হাটে তোর কি কাজ?' টোকাই উত্তর দিল, 'গরুর লগে নিজের দাম যাচাই করি'।
রনবীর ঈদ কার্টুন নামে ৪ পাতার বিশেষ আয়োজন আছে এ সংখ্যাতেও। স্বৈরাচারের বিদায়, গরুর হাটে যাওয়ার প্রস্তুতি, ভীড়ের মাঝে ঈদযাত্রা ইত্যাদি এবারের কার্টুনগুলোর বড় বিষয়। প্রথম কার্টুনটিতে একজনকে দেখা যাচ্ছে গরুর হাটে যাওয়ার জন্য বিশেষ রকম পোশাক পরিহিত; যার মাথায় হেলমেট আর গায়ে বর্ম। পাশে লেখা 'গরুর হাটে যাওয়ার প্রস্তাবিত পোশাক, (এর মাধ্যমে) গরু, যানবাহন আর হাইজ্যাকারদের গুঁতো থেকে বাঁচুন'।
পরেরটিতে একজন রোগীকে দেখা যাচ্ছে ডাক্তারের চেম্বারে গিয়েছেন প্রেশার মাপাতে, পাশে লেখা, 'গরু কিনতে যাওয়ার আগে ব্লাড প্রেশার মেপে নিন'। আরেকটি কার্টুনে দেখা যাচ্ছে, ভীষণ বেগে তেড়ে আসছে এক গরু, পাশে দাড়ানো পথচারী বলছেন, 'খাইছে স্বৈরাচারী আচারে বিশ্বাসী হয়ে পড়ছে এই কয় বছরে মনে হইতাছে'।
পরের কার্টুনটিতেও রাজনৈতিক পালাবদলের প্রসঙ্গ এসেছে। সেখানে গরুর ক্রেতা বিক্রেতাকে বকা দিচ্ছে এই বলে, 'কী কারবার তুমি এই ভরা গণতন্ত্রের আমলে স্বৈরতন্ত্রী দাম চাইতেছ কেন?' বিক্রেতা উত্তরে বলছে, 'গরুটা ওই আমলে বড় হইছে তো তাই…'। তার পরেরটিতে গবাদিপশুর হাটে পাইপ মুখে কালো স্যুট পরিহিত এক ব্যক্তিকে দেখে একটা ছাগল বলছে, 'উনারে গত বছর যেখন দেখছি এই এখন এত কিছুর পরও দেখছি একইরকম'।
বিরানব্বই সালের ঈদ উল আজহা সংখ্যাও প্রকাশিত হয়েছিল জুন মাসে। এতেও চার পাতা জুড়ে রনবীর ঈদ কার্টুন ছাপা হয়েছে। প্রথম পৃষ্ঠার বিষয় ছিল গরুর হাটে যাবার প্রস্তুতি, দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় ছিল বিড়ম্বনা আর পরের দুই পৃষ্ঠা জুড়ে ছিল বিবিধ। আঁকা ও লেখায় রনবী ছিলেন বরাবরের মতোই ধারালো ও দীপ্তিমান। সময়ের প্রতিফলন ছিল তাতে যেমন ছিল আগেরগুলোয় আর আশা করা হয়েছিল, বিত্তবানরা গরু কেনার অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে অবসর নেবেন এবং আশাহীন মানুষদের পাশে দাঁড়াবেন।