সুন্দরবনের বাস্তুসংস্থানে এই সব খুদে প্রাণীরা
বাংলাদেশ ও ভারত মিলিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বদ্বীপ সুন্দরবনের আয়তন প্রায় ১০ হাজার বর্গ কিলোমিটার। সুন্দরবনের প্রসঙ্গ উঠলেই আমাদের চোখের সামনে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের ছবি ভেসে ওঠে।
এছাড়া এ বনের আরও কিছু বিখ্যাত প্রাণী হচ্ছে লবণাক্ত পানির কুমির, মেছোবাঘ, হরিণ ইত্যাদি। কিন্তু বনটিতে আরও অসংখ্য ছোটছোট প্রাণীর আবাস রয়েছে।
জল, স্থল ও জোয়ার-ভাটার সঙ্গে মিতালি করে বাস করা এ প্রাণীগুলো ম্যানগ্রোভ বনটির ইকোসিস্টেমের (বাস্তুতন্ত্র) সঙ্গেও নিবিড়ভাবে জড়িত। এই প্রাণীগুলোর মধ্যকার মিথস্ক্রিয়ার ফলেই সুন্দরবনের বাস্তুতন্ত্র টিকে রয়েছে।
ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেইট ইউনিভার্সিটি'র প্রাণীবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. সিলঞ্জন ভট্টাচার্য সুন্দরবনকে 'উভচর গোষ্ঠী' হিসেবে অভিহিত করেছেন। এ বনে পানির ওপর ও নিচে বিভিন্ন প্রাণের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক রয়েছে।
ভূমি ও সমুদ্রের সীমানায় ইন্টারটাইডাল বন হিসেবে ম্যানগ্রোভ বনগুলো গড়ে ওঠে। এসব বনের গাছের শিকড় কাদামাটির গভীরে, আর শাখাপ্রশাখা ও পাতা থাকে পানির ওপরে। এর ফলে এ গাছগুলো যেমন নিজে থেকে টিকে থাকার প্রক্রিয়া শিখে নেয়, তেমনি এগুলোর প্রয়োজন হয় বনের অন্য জলজ-স্থলজ প্রাণী ও উদ্ভিদের সাহায্যও।
উদাহরণ হিসেবে গর্জন গাছের কথা ভাবা যাক। গর্জনের শিকড় মাটিতে জালের মতো ছড়িয়ে পড়ে। জোয়ারের সময় বিভিন্ন মাছ, শামুকের দল, ও বিভিন্ন অমেরুদণ্ডী প্রাণী এসব শিকড়ের সংস্পর্শে আসে।
গর্জন গাছের শিকড়ের ফাঁক থেকে খাবার সংগ্রহ করে জলজ ওই প্রাণীগুলো। ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদগুলো কাদামাটিতে বেড়ে ওঠার ফলে তারা মাটি থেকে অক্সিজেন কম পায়। কিন্তু খাবার খোঁজা ও গর্ত করার মাধ্যমে এসব কাদামাটিতে অক্সিজেন ও অন্যান্য গ্যাস সরবরাহ বাড়িয়ে তোলে জলজ প্রাণীরা। আর এভাবেই প্রাণী-উদ্ভিদের পারস্পরিক সহায়তার মাধ্যমে সুন্দরবনে গড়ে উঠেছে একটি স্বতন্ত্র বাস্তুতন্ত্র।
যেকোনো ম্যানগ্রোভ বাস্তুতন্ত্রের জন্য কাঁকড়া একটি অপরিহার্য উপাদান। মাটিতে গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানো, কাদা ও পলিমাটির স্তরের মধ্যে পরিবর্তন ঘটানো ও এসব স্তরের ভেতরে পুষ্টি উপাদান সরবরাহ ইত্যাদি কাজ করে থাকে কাঁকড়া।
এসব অবদানের কারণে কাঁকড়াকে প্রায়ই 'বাস্তুতন্ত্রের প্রকৌশলী' হিসেবে অভিহিত করা হয়। এছাড়া কাঁকড়া মাটিতে গর্ত করার মাধ্যমে অক্সিজেন সরবরাহ বৃদ্ধি করে।
সুন্দরবনের প্রধান দুই জাতের কাঁকড়া হলো ফিডলার ক্র্যাব ও গোস্ট ক্র্যাব। এগুলোর মধ্যে ফিডলার ক্র্যাবের একাধিক প্রজাতি রয়েছে। এ কাঁকড়াগুলো নিজেদের গর্তের সামনে দাঁড়িয়ে থাবা নেড়ে স্ত্রী কাঁকড়াকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে। কোনো স্ত্রী কাঁকড়া আগ্রহ দেখালে পুরুষ কাঁকড়াটি তাকে নিজের গর্তে নিয়ে যায়।
আরেক ধরনের কাঁকড়া হারমিট পাওয়া যায় সুন্দরবনে। শামুক বা সমজাতীয় প্রাণীর ফাঁপা খোলকের ভেতরে আশ্রয় নিয়ে হারমিট ক্র্যাব শিকারীর হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করে।
এ বনের কাঁকড়াগুলো বিভিন্ন মৃত জৈবিক উপাদান খেয়ে বনের ভূ-স্তর পরিষ্কার রাখে। টিকটিকি মাকড়সা, পোকামাকড়, ও অন্যান্য অমেরুদণ্ডী প্রাণী খায়। আর ঘাসফড়িং, ঝিঁঝিঁ পোকা, পঙ্গপাল ইত্যাদি প্রাণী সবুজ উদ্ভিদ খেয়ে জীবনধারণ করে।
'সুন্দরবনের ক্ষুদ্র প্রাণীগুলোকে নিয়ে খুব কম তথ্যই এখন পর্যন্ত জানা গেছে,' বলেন ভট্টাচার্য। মলাস্কা জাতীয় অনেক প্রাণী খাঁড়িতে বাস করে। জোয়ার বাড়লে বিভিন্ন গাছের ওপর এদেরকে বসে থাকতে দেখা যায়। এগুলোর মধ্যে আছে বিভিন্ন ধরনের গ্যাস্ট্রোপড প্রাণী। চিড়িং মাছ তথা মাডস্কিপার সুন্দরবনের একটি উভচর মাছ। এটাকে বায়ো-ইন্ডিকেটরও বলা হয়। কারণ একটি পরিবেশের দূষণের মাত্রা প্রকাশ করে এ মাছগুলো। গবেষকেরা সুন্দরবনে তামা, লোহা, দস্তা, ও সীসার দূষণের মাত্রা পরীক্ষা করার জন্য চিড়িং মাছের ওপর অনুসন্ধান চালিয়েছিলেন।
সুন্দরবনে প্রায় ৩৭ প্রজাতির সাপ পাওয়া যায়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে উপমহাদেশের সবচেয়ে বিষধর সাপ শঙ্খচূড়ও। লাল লেজের পিট ভাইপার সুন্দরবনে সচরাচর দেখতে পাওয়া যায়। তবে অজগর (ইন্ডিয়ান পাইথন) এর খুব একটা দেখা মেলে না।
সুন্দরবনে পাওয়া সরীসৃপজাতীয় অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে আছে রাসেল'স ভাইপার, পাতি কাল কেউটে, ও আরও কিছু সামুদ্রিক সাপ। তবে সুন্দরবনে সাপের সংখ্যা ক্রমশ কমছে। সাপের কামড়ে মানুষের মৃত্যু হওয়ায় মানুষও সাপকে মেরে ফেলে। এছাড়া সাপের আবাসস্থল ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কারণেও সুন্দরবনে সাপের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে।
ঔপনিবেশিক সময়ের শেষ দিক থেকে সুন্দরবনের আশেপাশের এলাকায় মানববসতি বাড়তে থাকে। বর্তমানে সুন্দরবনের নিকটবর্তী গ্রামগুলোতে লাখো মানুষ বসবাস করছেন। সুন্দরবন এলাকায় মানুষের তৈরি পুকুরগুলোতে রয়েছে বিচিত্র ধরনের সব ব্যাঙ। গেছো ব্যাঙ, কুনো ব্যাঙ ইত্যাদি এসব পুকুর, তার আশপাশে অহরহ দেখা যায়। তবে অনেক সময় এসব স্বাদুপানির জলাশয়ে অপরিচিত জলজ প্রাণীরও দেখা মেলে।
সুন্দরবনের খুদে প্রাণীগুলো খুঁজে পাওয়া বেশ চ্যালেঞ্জের কাজ। তবে বিচিত্র এই ইন্টারটাইডাল বন বিভিন্ন প্রাণের মধ্যকার আহার ও পুষ্টিজনিত সম্পর্ক আঁচ করার জন্য উপযুক্ত এক জায়গা।