আমরা ফলের মোরব্বা পেয়েছি মোগলদের ফলপ্রীতির কারণে?
শেষ হতে চলেছে আমের মৌসুম। তাতে অবশ্য দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই। ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষ সারাবছর ধরেই আমের স্বাদ পেয়ে থাকে। ঐতিহ্যবাহী রন্ধন কৌশল অনুসরণ করে মৌসুমি এই ফল বছরজুড়ে সংরক্ষণ করতে জানে এখানকার মানুষ। টক কাঁচা আম শুকিয়ে হবে অম্বল রান্না। আবার বাজারে আম উঠবে অথচ টক-ঝাল-মিষ্টি আচার বানিয়ে বয়াম ভর্তি করা হবে না, এমন কথা এই অঞ্চলের মানুষ ভাবতেই পারে না। আবার কেউ যদি একটু ভিন্ন স্বাদ চায় তাহলে চিনির সিরায় সিদ্ধ করে বানিয়ে ফেলা যায় চকচকে মোরব্বা কিংবা আমসত্ত্ব। সেই আমসত্ত্ব মুখে দিলেই আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় ফেলে আসা স্মৃতিগুলো!
মোরব্বা হলো ফল, চিনি, মশলা দিয়ে তৈরি পেকটিন সমৃদ্ধ একটি খাবার। যে ফলের মোরব্বা বানানো হয় কখনো তা গোটাটাই নেওয়া হয়, আবার কখনো টুকরো টুকরো করে কেটে চিনির সিরায় রান্না করা হয়। সুনির্দিষ্ট তাপমাত্রায় রান্না করা এই মোরব্বা পানি ধরে রাখতে পারে অর্থাৎ বেশ শক্তিশালী হিউমেক্ট্যান্টে পরিণত হয়। সিরাপে ফলের আকার নষ্ট হয় না। এমনকি বাড়তি চিনি ফলের ভেতরেও প্রবেশ করে। শেষ ধাপে মশলার সঙ্গে গোলাপ জল কিংবা কেওরা জলের মতো সুগন্ধি যুক্ত করা হয়। পরিশেষে এমন এক খাবার তৈরি যা জ্যামও না আবার মিষ্টিও না, বরং দুটোর মাঝামাঝি ধরনের এক খাবার!
মোরব্বার উৎপত্তির গল্প বিশ্ব বাণিজ্য, রাজ্য অভিযান, অভিবাসন ও খাদ্যবিজ্ঞানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। ধারণা করা হয় ভারতে কয়েক হাজার বছর আগে বড় পরিসরে আখ থেকে চিনির উৎপাদন শুরু হয়। এখান থেকে চিনি যায় পারস্যে, যেখানে তা ঔষধি উপকরণ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। লেখক ও অ্যাওয়ার্ডজয়ী জ্যাম শিল্পী সারাহ বি উড ২০২১ সালে প্রকাশিত বই জ্যাম, জেলি এবং মারমালেড: এ গ্লোবাল হিস্ট্রিতে লিখেন, সাসানীয় পারস্যে সম্ভবত প্রথম জ্যাম তৈরি হয়।
আরবরা পারস্যে এসে চিনি আবিষ্কার করে। চিনি তৈরির শিল্পকে আরও পরিশীলিত করে তোলার পাশাপাশি চিনি দিয়ে রান্নার নতুন সব পদ্ধতি উদ্ভাবন করে তারা। মধ্যযুগীয় উচ্চমহলের রান্নাঘরে নিমিষেই তা জায়গা করে নেয়।
মোরব্বা শব্দটি আরবি থেকে এসেছে। ইবনে সায়ার আল-ওয়ারাকের দশম শতাব্দীর রান্নার বই খলিফার রান্নাঘরের ইতিহাস' বইয়ের একটি অধ্যায়ে সংরক্ষণ (মুরাব্বায়াত) এবং তরল আঠালো ইলেকচুয়ারি (জুওয়ারিশনাত) তৈরির পদ্ধতি বর্ণিত রয়েছে। এখানে আদা, খেজুর, শসা, কমলাজাতীয় সাইট্রনসহ নানা পদের মোরব্বার রেসিপি মিলে।
আরবরা তাদের মোরব্বায় বিভিন্ন ঔষধি গুণসম্পন্ন হার্ব ও মশলা ব্যবহার করত। ফল সংরক্ষণকে তারা আনবিজাত বলত। ফার্সি শব্দ আনবাহের পুরোনো আরবি সংস্করণ হলো আনবিজ, যা সংস্কৃত আমরা থেকে উদ্ভূত। সাধারণভাবে জ্যাম বোঝাতে আনবিজাত কথাটি ব্যবহৃত হতো। বিশেষজ্ঞদের মতে, মধুতে আম সংরক্ষণের প্রাচীন ভারতীয় পদ্ধতি থেকেই তা আরব বিশ্বে জনপ্রিয় হয়েছিল।
ঘটনাক্রমে লাহোরের গভর্নর দৌলত খান লোধি যখন দিল্লির সুলতান ইব্রাহিম লোধির সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য বাবরকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, তখন সেই আমন্ত্রণের সঙ্গে মধুতে সংরক্ষিত আধপাকা আমও ছিল। বাবর এটিকে শুভ লক্ষণ হিসেবে দেখেন এবং ভারত যাত্রার সিদ্ধান্ত নেন। নিজের স্মৃতিকথায় বাবর আমের প্রশংসা করে লিখেছেন, 'কাঁচা আম দিয়ে দুর্দান্ত মশলা তৈরি হয়, সিরাপেও এগুলো ভালোভাবে সংরক্ষণ করা যায়'।
উপমহাদেশের বাইরে থেকে আসা এক শিল্প
ভারতের মোরব্বা তৈরির কৌশল পশ্চিম এশিয়া থেকে আমদানিকৃত বলে মনে করা হয়। তবে বাবরের উপাখ্যান থেকে ধারণা করা যায় যে মোগলদের আগমনের আগে থেকেই এখানকার মানুষ চিনির সিরাপে ফল সংরক্ষণের কৌশলটি জানত।
উপমহাদেশে মোরব্বা বানানোর কৌশল কীভাবে আসে, এর পেছনে অবশ্য আরও কয়েকটি তত্ত্ব রয়েছে। এর মধ্যে জনপ্রিয় কয়েকটি অনুমান হলো, মোরব্বা বর্তমান জর্জিয়ার গুরজিস্তানের যাযাবর উপজাতিদের সঙ্গে এই অঞ্চলে আসে যারা নিপীড়ন থেকে বাঁচতে উপমহাদেশের উত্তরাঞ্চলে এসে বসতি স্থাপন করে।
অনেকে আবার এই কৌশলের জন্য পর্তুগিজদের কৃতিত্ব দেয়। খাদ্য বিষয়ক ইতিহাসবিদ মাইকেল ক্রন্ডলের মতে, চিনিতে ফল সংরক্ষণের কৌশলটি ছিল পর্তুগিজদের। ১৭ শতকে বাংলায় ভ্রমণের বিবরণ নিয়ে ফরাসি ইতিহাসবিদ ফ্রান্সিস বার্নিয়ারের লেখায় মিষ্টি ও মিষ্টিজাতীয় খাবারের এই কৌশল দেখা যায়।
বার্নিয়ার লিখেছেন, 'অন্যান্য ফলের মধ্যে তারা বড় সাইট্রনগুলো সংরক্ষণ করে, যেমনটা আমরা ইউরোপে করে থাকি। এছাড়া আম ও আনারস ছিল ভারতের সহজলভ্য দুটি ফল; এর বাইরে বরই, লেবু ও আদাও সংরক্ষণ করা হতো।'
ফল সংরক্ষণের উৎপত্তি নিয়ে ভিন্নমত থাকলেও বার্নিয়ারের মতো ভারতবর্ষে আগত অন্যরাও সংরক্ষণের বিষয়গুলো লক্ষ্য করেছিলেন। ১৮ শতকের গোড়ার দিকে স্কটিশ চিকিত্সক ও বোটানিস্ট ফ্রান্সিস হ্যামিল্টন লিখেন, মোরব্বার জন্য মালদহ বিখ্যাত ছিল। তিনি বলেন এটি 'ভারতের পশ্চিম থেকে আগত মুসলমানদের আনা একটি শিল্প। আমলকি, হরিতকি, আমড়া, জামরুল, শ্রীফল, চালকুমড়া, শতমূলী এবং তেঁতুল সংরক্ষণ করত তারা। তবে মুসলিমদের পতনের পর তাদের ফল সংরক্ষণ চর্চার স্বীকৃতি কমতে থাকে।'
তবে উৎপত্তি যাই হোক না কেন এটা অনস্বীকার্য যে মোগলদের কাছে মোরব্বা জনপ্রিয় ছিল বলেই তা দেশীয় রন্ধন শিল্পতে জায়গা করে নেয়। মোগল বাদশাহরা তাদের প্রিয় ফল সারা বছর উপভোগ করতে চেয়েছিলেন বলেই ফল সংরক্ষণ রীতি নিয়মিত বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। বিভিন্ন মশলাযুক্ত আচার ছাড়াও সুস্বাদু সব ফল আর দামি চিনি দিয়ে তৈরি মিষ্টি মোরব্বা রাজকীয় খাবারের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছিল।
জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে ভারতে ভ্রমণ করেন অ্যাংলিকান যাজক এডওয়ার্ড টেরি। তিনিও চিনিতে সংরক্ষিত ফলের কথা বলেন। এর কয়েক শতাব্দী পরে শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের শ্বশুর মির্জা মোহাম্মদ হিদায়াত আফজান তার বাজম-ই-আখিরে বাঁশ, করমচা, বীজ, আম, আপেল, তুরঞ্জ বা সাইট্রন, করোলা, লেবু, আনারস, বাদাম দিয়ে তৈরি মোরব্বার কথা উল্লেখ করেছেন।
মোরব্বা রাজকীয় উপহার এবং নৈবেদ্যগুলোর মধ্যে অন্যতম। ১৭৬৪ সালের সেপ্টেম্বরে মীর জাফর কলকাতায় আসলে ব্রিটিশরা তাকে অন্যান্য উপহারের সঙ্গে এক মণ মোরব্বা উপহার দেয় যার মূল্য ছিল ১৯ টাকা।
রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াও ফল সংরক্ষণ শিল্পের বিকাশের পেছনে যে বিষয়টি কাজ করেছিল তা হলো ফলের প্রাচুর্য। ইতিহাসবিদ বর্ষা গুপ্তা তার মোগল ভারতের বোটানিক্যাল কালচার বইয়ে বলেছেন, বর্তমান হরিয়ানার থানেশ্বর ছিল মোরব্বার জন্য জনপ্রিয়। এখানে প্রধানত আম ও আমলকির মোরব্বা তৈরি হতো।
এছাড়া ভারতের বর্তমান উত্তর প্রদেশের রামপুর, রোহিলখণ্ড ও লক্ষ্ণৌ ছিল তুরুঞ্জ কা মুরাব্বা (সিরাপে সংরক্ষিত সাইট্রনের খোসা)-র জন্য বিখ্যাত। দক্ষিণে বিদার জয়ফল মোরব্বার জন্য বিখ্যাত ছিল। রাই চাতার মান কায়থের ১৮ শতকের চাহার গুলশানে এর উল্লেখ করা হয়েছে।
বাংলায় সিউরী (যা এখন বীরভূম জেলার সদর) ছিল মোরব্বার জন্য বিখ্যাত। লোককথা অনুযায়ী, রাজনগরের নবাব বেনারস সফরে গিয়ে ফল থেকে তৈরি মিষ্টান্ন খেয়ে এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে তিনি সেই কারিগরদের বাংলায় নিয়ে আসেন। সেখান থেকেই এই অঞ্চলের মোরব্বার ঐতিহ্যের শুরু। ভারতীয় ঔষধী উদ্ভিদ্গুলোর মধ্যে শতমূলী অন্যতম। সিউরীর মোরব্বার মধ্যে শতমূলীর মোরব্বা ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয়।
ঘরোয়া প্রতিষেধক
অনেক মোরব্বাই ঘরোয়া ঔষধি হিসেবেও ব্যবহৃত হতো। যেমন, ডায়রিয়া বা আমাশয়ের মতো পেটের অসুখের জন্য বেলের মোরব্বা, ঠাণ্ডা ও কাশির জন্য আদার মোরব্বা এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি ও হজমে সহায়তার জন্য আমলার মোরব্বা খাওয়া হতো। এই তালিকায় আরও অনেক ধরনের মোরব্বা ছিল।
১৯০৪ সালে প্রকাশিত বাঙালি লেখক বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায়ের মিষ্টান্ন পাক বইয়ে কামরাঙা, অরবরই, আঁখ ও আনারসসহ বেশ কয়েকটি মোরব্বার রেসিপি মিলে। বইটিতে থোর (কলার কাণ্ড) মোরব্বারও একটি বিরল রেসিপি রয়েছে। সূক্ষ্মতার সঙ্গে রান্না করার আগে স্লেক চুন বা সোহাগা চুর্ণ (বোরাক্স পাথরের গুঁড়া) মিশ্রিত পানিতে থোর ভিজিয়ে রাখা হতো। এর বাইরে বইয়ে পেয়ারা ও জাম পাতা ব্যবহারের রেসিপিও মিলে যা ব্যাকটেরিয়া প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করত।
উত্তর ভারতে শীতকালীন একটি জনপ্রিয় খাবার হলো গাজরের মোরব্বা। খোসা ছিলিয়ে গাজরগুলোকে চিনি দিয়ে চকচকে মোরব্বা বানানো হয়। মৌসুমি কালো গাজর দিয়ে বানানো মোরব্বা মালাই দিয়ে পরিবেশিত হয়।
তবে সবচেয়ে সুপরিচিত মোরব্বা সম্ভবত চাল কুমড়োর মোরব্বা। আগ্রায় এটি পেঠা নামে পরিচিত। ভারতের কিছু অংশে একে ওল কা মোরব্বাও বলা হয়য়। চুন পানিতে ডুবিয়ে চিনির সিরাপে বানানো হয় এই মোরব্বা। কথিত আছে আগ্রার এই পেঠা শাহ জাহানের রান্নাঘরে তৈরি হতো। তবে খাদ্য বিশারদ পুষ্পেশ পান্তের মতে এটা হলো গরীবের মিষ্টি।
চালকুমড়ো ও করমচার মোরব্বা দেশীয় ফ্রুট কেকগুলোতে বহুল ব্যবহৃত। বাঙালি মুসলিম পরিবারে শাহী জর্দায় চালকুমড়োর মোরব্বা ও ছোট মিষ্টি দেওয়া হয় বলে জানান ফুড ব্লগার সায়ন্তনী মহাপাত্র। মহাপাত্র বাড়িতে দেখতেন কীভাবে মৌসুমি ফল দিয়ে মোরব্বা তৈরি করা হয়। তিনদিনের শ্রমসাধ্য প্রক্রিয়ার পর প্রস্তুত হতো মোরব্বা। 'ফলগুলোকে তিনদিন ধরে নির্দিষ্ট মাত্রার সিরাপে ডুবানো হবে। এই সময়ের মধ্যে আবার চিনিও যোগ করা হয়। তবে ফলাফল ছিল অসাধারণ', বলেন তিনি।
পেঁপে কিংবা তরমুজের খোসার তৈরি মোরব্বা ভারতে টুটি-ফ্রুটি হিসেবে চলে। এই টুটি ফ্রুটি হলো চিবানো যায় এমন কিছু রঙিন কিউব যা আইসক্রিম, বিস্কুট ও ফ্রুটকেকে ব্যবহার করা হয়। এছাড়া পটলের মোরব্বাও আছে যার ভেতরে খোয়া বা ক্ষীর ভরা হয় এবং ওপরটা সাজানো হয়য় বাদাম, কাজু ও পেস্তা দিয়ে। এর ওপর রূপোর তবক লাগিয়ে তৈরি হয় এক অভিজাত মিষ্টান্ন।
শেষ করা যাক একটি গল্প দিয়ে। দিল্লির এক রাজপুত্রকে একবার লক্ষ্ণৌর নবাব ওয়াজেদ আলী শাহের সঙ্গে ভোজনে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। নবাবের খানসামা রাজপুত্রকে মিষ্টি মোরব্বার মতো দেখতে একটি খাবার পরিবেশন করে যা আদতে ছিল মাংসের সুস্বাদু কোরমা। কথিত আছে আদতে তাকে পরিবেশিত পোলাও, রুটি, কোরমা, বিরিয়ানি এবং কাবাব সবই ছিল চিনিতে তৈরি। এমনকি যে থালাগুলোতে তা পরিবেশিত হয়েছিল সেগুলোও ছিল চিনির! ভারতের অভিজাত রন্ধনশৈলিতে মিষ্টান্ন হিসেবে মোরব্বার প্রচলন এখান থেকেই আন্দাজ করা সম্ভব।
মূল লেখক: প্রিয়দর্শিনী চ্যাটার্জি
স্ক্রল ডট ইন থেকে অনুবাদ: তামারা ইয়াসমীন তমা