প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ১০ দিনে ৯ যুদ্ধবিমান ধরাশায়ী করেন ১৮ বছরের যে বাঙালি তরুণ
১৯১৭ সালের ডিসেম্বর। চলছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। তিনদিন আগে জার্মান এক যুদ্ধবিমান ব্রিটিশ এসইফাইভ বিমানে গুলি চালানোর পর সেটি নো ম্যানস ল্যান্ডে ভেঙে পড়েছে। বিমান থেকে উদ্ধার করে পাইলটের মরদেহ রাখা হয়েছে মর্গে। কিন্তু এরইমধ্যে ঘটে গেল এক ভূতুড়ে ঘটনা। মর্গের দরজায় দুমদাম শব্দ। ভূতের ভয়ে হাসপাতাল কর্মীদের দাঁতকপাটি লাগার জোগাড়। তবে কোনো ভূত নয়, দরজা ধাক্কাচ্ছিলেন ১৮ বছরের সেই তরুণ বিমানচালক যাকে ভুলবশত মৃত ঘোষণা করা হয়।
অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়া এই তরুণের নাম ইন্দ্রলাল রায়। বাঙালি নাম শুনে অবাক লাগছে তাই না? ভেতো বাঙালির এমন দুঃসাহসী অভিযানের কথা তো আগে বেশি শোনা যায়নি! আগে না শুনলেও জেনে রাখুন বাঙালি ঘরের সন্তান ইন্দ্রলাল রায়ই প্রথম ভারতীয় যুদ্ধবিমানচালক। এত বড় দুর্ঘটনাও ইন্দ্রকে থামাতে পারেনি। সুস্থ হওয়ার পর তাকে বিমান চালনার ছাড়পত্র দেওয়া হচ্ছিল না। কিন্তু ইন্দ্রের অদম্য ইচ্ছাশক্তি আর বারংবার অনুরোধে হার মানে কর্তৃপক্ষও। পরের বছর ১৯১৮ সালের ৯ জুলাই থেকে ১৯ জুলাই টানা দশদিনে নয়টি জার্মান যুদ্ধবিমান ধ্বংস করেন তিনি। ইন্দ্রলালই প্রথম ভারতীয় যিনি ১৭০ ঘণ্টা বিমানচালনার রেকর্ড গড়েছিলেন।
১৮৯৮ সালের ২ ডিসেম্বর কলকাতায় জন্ম ইন্দ্রলাল রায়ের। জন্ম কলকাতায় হলেও বাংলাদেশের সঙ্গেও কিন্তু তার যোগসূত্র রয়েছে। ইন্দ্রলালের বাবা প্যারীলাল রায় ছিলেন বরিশালের ধনী পরিবারের সন্তান। পেশায় প্যারীলাল ছিলেন নামী আইনজীবী এবং কলকাতার পাবলিক প্রসিকিউশন্স-এর ডিরেক্টর।
সাঁতার, খেলাধুলা, স্পোর্টস কার চালানো- সবকিছুইতেই সেরা ছিলেন ইন্দ্র
প্যারীলাল রায় ও তার স্ত্রী ললিতা রায়ের ছয় সন্তান। ১৯০১ সালে সপরিবারে আসেন লন্ডনে। পরেশ, ইন্দ্র ও ললিত এই তিন ছেলেকে ভর্তি করেন হ্যামারস্মিথের সেন্ট পল বয়েজ স্কুলে। অন্যদিকে লীলাবতী, মীরাবতী ও হীরাবতী তিন মেয়েকে ভর্তি করেন সেন্ট পল স্কুল অব গার্লসে। সংসার গুছিয়ে সন্তানদের স্ত্রীর তত্ত্বাবধানে রেখে প্যারী ফিরে যান কলকাতায়।
স্কুলে সাঁতার দলের ক্যাপ্টেন ছিলেন ইন্দ্রলাল। লন্ডনে অবশ্য ইন্দ্রলালের পরিবর্তে সবার কাছে তিনি 'ল্যাডি' হয়ে উঠেন। শুধু সাঁতার নয়, রাগবি খেলাতেও ছিলেন দক্ষ। স্পোর্টস কার চালানোরও দারুণ শখ ছিল তার। নিজের বড় শখের এক মোটরসাইকেলও ছিল।
ইন্দ্রের মা ললিতা রায়ের নিজস্ব একটি পরিচয় আছে। তিনি সেই সময় ব্রিটেনে নারীদের ভোটাধিকার আদায়ের আন্দোলনে যুক্ত হন। ললিতা ছিলেন সাফ্রাজেট আন্দোলনের অন্যতম মুখ। তবে বাড়িতে শেকড়টা কিন্তু তিনি ভুলতে দেননি। ওয়েস্টার্ন ক্লাসিকালের সঙ্গে বাড়ি থেকে ভারতীয় সংগীতের সুরও ভেসে আসত।
সমাজসেবা, পড়াশোনা, খেলা ও সঙ্গীতে দারুণ কাটছিল লন্ডনের দিনগুলো। কিন্তু এরপরই শুরু হলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধ।
১৯১৪ সালে সদ্য গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে বড় ভাই পরেশ যোগ দেন সেনাবাহিনীতে। অন্যদিকে স্কুল শেষে অক্সফোর্ডে উচ্চশিক্ষার বৃত্তি পেলেন ইন্দ্র।
কিন্তু তার চোখজুড়ে স্বপ্ন তখন আকাশে উড়ার। রয়্যাল ফ্লাইং কোরে যোগদানের আবেদন করলেও দৃষ্টিশক্তির পরীক্ষায় বাদ পড়লেন। কিন্তু ইন্দ্র কতটা অদম্য ছিলেন তা এতক্ষণে হয়তো পাঠক বুঝে গেছে। শখের মোটরসাইকেল বিক্রি করে সেই টাকায় সেসময়কার ব্রিটেনের সবচেয়ে নামী চোখের ডাক্তারের কাছে করালেন চিকিৎসা। এরপর পুনরায় আবেদন করে পাশও করে গেলেন ইন্দ্র।
মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখেও দমে যাননি
মায়ের কাছে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন যুদ্ধে। অক্সফোর্ডে ট্রেনিং শেষে ১৯১৭ সালের জুলাইয়ে ৫৬ নম্বর স্কোয়াড্রনে সেকেন্ড লেফট্যানেন্ট পদে যোগ দেন। পোস্টিং হয় ফ্রান্সের ভাদোমে। ইন্দ্রের ব্যক্তিত্ব বরাবরই আকর্ষণীয় ছিল। এয়ার ফোর্সে তিনি ছিলেন বেশ জনপ্রিয়। তার কথা শুনতে বন্ধু-সহকর্মীরা তো তাকে ঘিরেই থাকত।
মাত্র ১৮ বছর বয়সেই ইন্দ্রলাল কার্জিস, বিইটু, সপউইথ ক্যামেল, আভরো এবং এসইফাইভ এর মতো যুদ্ধবিমানে হাত পাকিয়ে ফেলেন। কিন্তু ১৯১৭ সালের ৬ ডিসেম্বর ঘটল সেই দুর্ঘটনা। জার্মান যুদ্ধবিমানের গুলিতে ইন্দ্রের বিমান ভেঙে পড়ে। তিনদিন অচেতন অবস্থায় সেখানেই পড়ে থাকেন। এরপর তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া হলে ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করে।
কিন্তু মর্গেই জ্ঞান ফিরে তার। আহত ইন্দ্র মর্গের দরজায় কড়াঘাত করে সাহায্য চান। শেষ পর্যন্ত বোঝাতে সক্ষম হন যে তিনি মারা যাননি। আবারও ফিরে আসেন শিবিরে। ইন্দ্রের ছবি আঁকার দক্ষতাও যে অসাধারণ ছিল তা এই সময় তার আঁকা স্কেচগুলো দেখলে বোঝা যায়। অসুস্থতার সময় যুদ্ধবিমানের অনেকগুলো স্কেচ আঁকেন তিনি।
সুস্থ হওয়ার পরেও বিমান চালানোর ছাড়পত্র দেওয়া হয়নি তাকে। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত মানতে পারলেন না ইন্দ্র। মেনে নিলে হয়তো এত অসময়ে তাকে চলেও যেতে হতো না। কিন্তু তার বারবার অনুরোধ ও জোরাজুরিতে শেষ পর্যন্ত মানতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ।
এবার আরও মন দিয়ে ট্রেনিং নিলেন ক্যাপ্টেন জর্জ ম্যাকরয়ের তত্ত্বাবধানে। ১৯১৮ সালের ২২ জুন ফ্রান্স থেকে ফিরে যোগ দেন ৪০ নম্বর কোয়াড্রনে।
সেবছরের ৬ জুলাই আবারও বিমান নিয়ে উড়ে যান যুদ্ধক্ষেত্রে। প্রথম দিনেই এক জার্মান বিমানকে পরাস্ত করেন। এই জয়ের ছবি নিজের আঁকার খাতাতেও এঁকে রেখেছিলেন।
সেই কৃতিত্বে প্রশংসার জোয়ারে ভেসে যান ইন্দ্র। এবার যেন আরও বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠলেন। ৯ জুলাই থেকে ১৯ জুলাই টানা দশ দিনে ৯টি জার্মান বিমানকে আকাশযুদ্ধে পরাস্ত করে ভূপাতিত করেন।
বাস্তবের এক অভিমন্যুর গল্প
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হতে তখন সবে চার মাস বাকি। লন্ডনে বসে ললিতা জানতে পারেন তার ছেলে ইন্দ্র 'মিসিং ইন অ্যাকশন'।
২২ জুলাই যেদিন ইন্দ্র হারিয়ে যান তার সপ্তাহখানেক একাই একাহাতে নয়টি যুদ্ধবিমান পরাস্ত করেছেন। কিন্তু এত দুর্ধর্ষ যুদ্ধবিমানচালক হয়েও তিনি কীভাবে পরাস্ত হলেন?
ঘটনার দিন ইন্দ্রলাল যখন শত্রুপক্ষের বিমান ধূলিসাৎ করার পরিকল্পনা কষছেন তখনই চার-চারটি জার্মান ফকার যুদ্ধবিমান তাকে ঘিরে ফেলে। অভিমন্যুর মতো একা ইন্দ্রকে ঘিরে ফেলে সবাই। চার বনাম একের এই লড়াইয়ে সর্বশক্তি দিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করেন ইন্দ্র। এমনকি দুটো জার্মান বিমানকে পরাস্তও করে ফেলেন। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। অপর একটি জার্মান বিমানের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে ধ্বংস হয় তার বিমান।
ইন্দ্রের কমান্ডিং অফিসার তার মাকে যুদ্ধের বর্ণনা দিয়ে এক চিঠিতে লিখেন, 'ইন্দ্রলাল রায় একাহাতে নয়টি জার্মান যুদ্ধবিমান পরাস্ত করেছেন। প্রত্যেক অফিসার তাঁর প্রশংসা করেছেন। তিনি সবার মাঝে খুব জনপ্রিয় ছিলেন। আমি নিশ্চিত এই সাহসীকতার জন্য তিনি পুরস্কৃত হবেন।'
১৯১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ইন্দ্রলাল রায়ের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করে রয়্যাল এয়ার ফোর্স। মরণোত্তর 'দ্য ডিসটিংগুইশড ফ্লায়িং ক্রস' সম্মানে ভূষিত হন ইন্দ্রলাল রায়। প্রথম ভারতীয় হিসেবে তিনি এই মর্যাদা পান। তার মানপত্রে লেখা হয়, '(ইন্দ্রলাল রায়) ভীষণ সাহসী ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ একজন অফিসার ছিলেন যিনি ১৩ দিনে ৯টি জার্মান বিমান পরাস্ত করেন। সামান্য সময়ের মধ্যেই তিনি অসাধারণ প্রতিভা দেখিয়েছেন'।
কলকাতার ভবানীপুরে ইন্দ্রলাল রায়ের নামে একটি সড়কও আছে যার নাম 'ইন্দ্র রায় রোড'। উত্তর ফ্রান্সের এসতেভেলেস কমিউনাল সেমেটরিতে গেলে এখনও ইন্দ্রলাল রায়ের সমাধির দেখা লিখবে। সমাধির ওপর স্মৃতিস্তম্ভে লেখা আছে এই কথাগুলো, 'নিজের আদর্শকে ভালোবেসে তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন'।