যেভাবে চুরি হয়ে যায় আইনস্টাইনের মস্তিস্ক!
মেধাবী মানুষের কথা ভাবলেই সবার আগে মনে আসে আলবার্ট আইনস্টাইন। অমিত প্রতিভাবান এই বিজ্ঞানী মানবকল্যাণে অনেক আবিষ্কার করেছেন।
আইনস্টাইনের প্রতিভা দেখে বহু মানুষ ভেবেছে, এই মানুষটির মস্তিষ্কের গঠন কেমন? তার মস্তিষ্ক কি সাধারণ মানুষের মস্তিষ্কের চেয়ে অন্যরকম? মস্তিষ্কের বিশেষ কোনো গঠনের কারণেই কি তিনি এত এত অসাধারণ সব আবিষ্কার করতে পেরেছেন?
এসব প্রশ্নের সত্যাসত্য নির্ণয়ের জন্য আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক চুরি করেছিলেন টমাস হার্ভি। হার্ভিই কিন্তু আইনস্টাইনের ময়নাতদন্ত করেছিলেন।
আইনস্টানের শেষ ইচ্ছে ছিল মৃত্যুর পর তার দেহ যেন সম্পূর্ণ দাহ করে ফেলা হয়। কিন্তু তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে হার্ভি এই মহান বিজ্ঞানীর মস্তিষ্কের ওপর কয়েক ধরনের পরীক্ষানিরীক্ষা চালান।
কী আবিষ্কার করেছিলেন হার্ভি? আইনস্টাইনের মস্তিষ্কের ভাগ্যে কী ঘটেছিল শেষ পর্যন্ত?
আইনস্টাইনের কীর্তি
আলবার্ট আইনস্টাইনের জন্ম ১৮৭৯ সালে, জার্মান সাম্রাজ্যের উরটেমবার্গ রাজ্যে। তার শৈশব কাটে মিউনিখে। আইনস্টাইনের পরিবার ১৮৯০-এর দশকের মাঝামাঝি ইতালিতে চলে আসে।
স্কুলে থাকতেই আইনস্টাইন গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানসহ অন্যান্য বিষয়ে দারুণ ফল করতে থাকেন। ১২ বছর বয়সে এক গ্রীষ্মেই বীজগণিত ও ইউক্লিডীয় জ্যামিতি দুটো সিলেবাসই শেষ করে ফেলেন তিনি। আইনস্টাইনের গৃহশিক্ষক ম্যাক্স টালমুড বলেছিলেন, আইনস্টাইন এত দ্রুত গণিত বই শেষ করে ফেলেছিলেন যে তিনি ছাত্রের প্রতিভার সঙ্গে তাল মেলাতে পারেননি।
গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানের পাশাপাশি দর্শনের প্রতিও আইনস্টাইনের গভীর আগ্রহ ছিল। ১৩ বছর বয়সি আইনস্টাইনের প্রিয় দার্শনিক ছিলেন কান্ট।
আইনস্টাইনের প্রথম স্ত্রী মিলেভা মারিচ ছিলেন তার সুইজারল্যান্ডের পলিটেকনিক স্কুলে গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানের কোর্স নেওয়া একমাত্র মেয়ে। এ কারণে তার প্রতি আইনস্টাইন দারুণ আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তারপর দুটি বিজ্ঞানবিষয়ক বিতর্ক অংশ নেওয়া ও একই কোর্সে পড়াশোনার সুবাদে দুজনের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
১৯০১ সালে আইনস্টাইন বার্নের সুইস পেটেন্ট অফিসে চাকরি পান। তার কাজ ছিল বিভিন্ন বৈদ্যুতিক ডিভাইসের জন্য পেটেন্ট আবেদনের মূল্যায়ন করা। এই কাজের অভিজ্ঞতা থেকে বিদ্যুৎ কীভাবে কাজ করে, তা সম্পর্কে তার অন্তর্দৃষ্টি আরও প্রখর হয়। এসব পেটেন্ট আবেদন যাচাইবাছাই করতে করতেই একসময় বিদ্যুৎ কীভাবে সঞ্চালিত হয়, এসব নিয়ে তার মনে প্রশ্ন জাগে।
এর কদিন আইনস্টাইন পরই কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে অলিম্পিয়া অ্যাকাডেমি নামে পরিচিত একটি একাডেমিক আলোচনা গোষ্ঠীতে যোগ দেন এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র প্রকাশ করতে আরম্ভ করেন।
১৯০৮ সাল নাগাদ তিনি বার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পান। পরে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসাবে পূর্ণকালীন নিয়োগ পান।
ল্যাবরেটরিতে প্রথাগত গবেষণা কখনোই করেননি আইনস্টাইন। মস্তিষ্কই ছিল তার ল্যাবরেটরি। আর যন্ত্রপাতি বলতে ছিল পেন্সিল আর কলম।
১৯২১ সালে ফটো ইলেকট্রিক ইফেক্ট আবিষ্কারের জন্য পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান আইনস্টাইন। যদিও তিনি সবচেয়ে বেশি খ্যাতি পেয়েছেন বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্ব দেওয়ার জন্য।
মগজ চোর
১৯৫৫ সালের ১৮ এপ্রিল মারা যান আলবার্ট আইনস্টাইন। মৃত্যুর পর তার মরদেহ নিয়ে কী করতে হবে, এ নিয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়ে গিয়েছিলেন তিনি।
আইনস্টাইন নির্দেশ দিয়েছিলেন তার মরদেহ যেন দাহ করে ভস্ম ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দেয়া হয়। এমনকি তার দেহভস্ম যেন গোপনে ছড়ানো হয়, সে নির্দেশও দিয়েছিলেন। তিনি চাননি তার শরীর নিয়ে মৃত্যুর পর পরীক্ষানিরীক্ষা হোক। তার মৃত্যু নিয়ে বেশি মাতামাতি হোক, তা-ও চাননি।
কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আইনস্টাইনের ইচ্ছা পুরোটা পূরণ করা হয়নি। তার মরদেহের ময়নাতদন্ত করা প্যাথলজিস্ট টমাস হার্ভি আইনস্টাইনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে গবেষণার জন্য তার মস্তিষ্ক সরিয়ে ফেলেন।
ময়নাতদন্তের কয়েকদিন পর হার্ভি আইনস্টাইনের পরিবারের কাছে স্বীকার করেন যে তিনি মস্তিষ্ক চুরি করেছেন। তার পরিবারের কাছে মস্তিষ্কটি রেখে দেওয়ার অনুমতি চান। অনিচ্ছা সত্ত্বেও হার্ভিকে মস্তিষ্ক রেখে দেওয়ার প্রাথমিক অনুমতি দেন আইনস্টাইনের ছেলে হ্যান্স। মগজ রাখার অনুমতি পেলেও হার্ভি প্রিন্সটন হাসপাতালের চাকরি হারান। তখন তিনি আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক নিয়ে এলাকা ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন।
আগের বাড়ি ছেড়ে, মহান বিজ্ঞানীর মস্তিষ্ক নিয়ে হার্ভি ফিলাডেলফিয়ায় চলে যান। এখানেই তিনি আইনস্টাইনের মস্তিষ্ককে ২৪০ টুকরো করেন। ভবিষ্যৎ কাজের জন্য হার্ভি জার দুটো তার বাড়ির বেজমেন্টে সংরক্ষণ করেন।
তবে হার্ভির স্ত্রী স্বামীর এই মস্তিষ্কের সংগ্রহটিকে খুব একটা পছন্দ করতে পারেননি। তিনি জারগুলো ফেলে দেওয়ার হুমকি দেন। এর ফলে হার্ভি জারগুলো নিয়ে মিডওয়েস্টে সফরে বের হন। ক্যানসাসে তিনি একটি বায়োলজি ল্যাবে মেডিকেল সুপারভাইজরের চাকরি নেন। সেখানেই তিনি প্রথম আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক নিয়ে গবেষণা শুরু করেন।
হার্ভি মস্তিষ্কের জারগুলোকে একটা ছোট সাইডার বাক্সে রেখেছিলেন। সেই বাক্স লুকিয়েছিলেন একটা বিয়ার কুলারের নিচে।
আইনস্টাইনের বিখ্যাত মস্তিষ্কের অংশ পেতে আগ্রহী বিশ্বের অন্যান্য গবেষকদের কাছে কিছু কিছু টুকরো পাঠাতে শুরু করেন তিনি।
মিসৌরিতে যাওয়ার পর হার্ভি ডাক্তারি প্র্যাকটিসের সময় মস্তিষ্ক নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যান। এরপর সারা জীবন যেখানে যেখানে গেছেন, তার সঙ্গে থেকেছে সেই মস্তিষ্ক। তার গবেষণা নিয়ে হাসিঠাট্টা করেছেন অনেকেই। কিন্তু তিনি তাতে পাত্তা দেননি। হার্ভির দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, ওই মস্তিষ্কের মধ্যে আছে কোনো এক রহস্য।
কিন্তু ১৯৮৮ সালে যোগ্যতা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ব্যর্থ হয়ে ডাক্তারির লাইসেন্স হারান হার্ভি। এরপর তিনি আবার ক্যানসাসে ফিরে যান। শেষজীবন কেটেছে বাড়িতেই, অলস বসে থেকে।
২০০৭ সালে মারা যান হার্ভি। মৃত্যুর আগে আইনস্টাইনের মস্তিষ্কের অবশিষ্টাংশ দান করে যান ন্যাশনাল মিউজিয়াম অভ হেলথ অ্যান্ড মেডিসিন ও ফিলাডেলফিয়ার মুটার মিউজিয়ামে।
আইনস্টাইনের মস্তিষ্কের অনন্যতা
৩০ বছর গবেষণার পর ১৯৮৫ সালে প্রথম আইনস্টাইনের মস্তিষ্কের গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। মস্তিষ্কটি কাটার আগে ওটার আকার ও ওজন কত ছিল, সেসব তথ্যও উপস্থাপন করা হয় গবেষণা নিবন্ধে।
হার্ভি ও অন্যান্য বিজ্ঞানীরা তখন দাবি করেন, আইনস্টাইনের মস্তিষ্কের গ্লিয়াল সেলের গঠন (যেমন বড় এস্ট্রোসাইট প্রসেস) অন্যদের চেয়ে আলাদা ছিল। তার মস্তিষ্কের নিউরন ও গ্লিয়াল সেলের অনুপাতও স্বাভাবিক নয়।
ছয়টি আলাদা গবেষণায় প্রথম দাবি করা হয় যে গড়পড়তা মানুষের তুলনায় আইনস্টাইনের মস্তিষ্কের কোষ বা টিস্যুর অনুপাত আলাদা। পরে আরেকটি গবেষণায় দাবি করা হয়, অন্যদের মস্তিষ্কের তুলনায় আইনস্টাইনের মস্তিষ্কের নিউরনসংখ্যা বেশি না হলেও তার টিস্যু পাতলা ছিল, যা কোষের মধ্যে যোগাযোগের গতি বাড়িয়ে তুলতে পারে।
এছাড়া এসব গবেষণায় দাবি করা হয়, সাধারণ মানুষের তুলনায় আইনস্টাইনের মস্তিষ্কের ওজন প্রায় ২০ গ্রাম কম। নয়। সাধারণ মানুষের প্যারাইটাল কর্টেক্সের মধ্যে যে গভীর খাঁজ থাকে, আইনস্টাইনের ক্ষেত্রে তা প্রায় নেই বললেই চলে।
তবে এসব গবেষণা নিয়ে বিস্তর সমালোচনা হয়েছে।
বিশেষ করে মনোবিজ্ঞানী টেরেন্স হাইনস দাবি করেছেন, গবেষণাগুলোতে তথ্যসমূহ অতিরঞ্জিত করে উপস্থাপন করা হয়েছে কিংবা যথাযথভাবে উপস্থাপন করা হয়নি।
আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, প্রতিটি গবেষণায় গড়ে মাত্র ১০টি কন্ট্রোল ব্রেইন ব্যবহার করা হয়েছিল। এসব কন্ট্রোল ব্রেইনের বয়স ছিল ৪৭ থেকে ৮০-র মধ্যে। অর্থাৎ আইনস্টাইনের মস্তিষ্কের এই অনুপাতকে তুলনা করা হয়েছিল গড় বয়স ৬৫ বছরের ১১ জন মৃত ব্যক্তির ব্রেইনের সঙ্গে। অন্যদিকে আইনস্টাইন মারা যান ৭৬ বছর বয়সে। মস্তিষ্কের বয়স এই গবেষণার ফলাফলগুলোকে উল্লেখযোগ্যভাবে বদলে দিতে পারে এবং এর প্রভাবে ফলাফলে ভুল হতে পারে।
এছাড়াও গবেষণায় ব্যবহৃত কন্ট্রোল ব্রেইনগুলো সংগ্রহ করা হয়েছিল সাম্প্রতিক সময়ে। কিন্তু আইনস্টাইনের কাটা মস্তিষ্ক ছিল কয়েক দশকের পুরনো ছিল। তাই মস্তিষ্কের অবশিষ্টাংশের গঠন সময়ের সাথে সাথে বদলে যেতে পারে।
এছাড়া আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক নিয়ে করা অনেক গবেষণা কেবল ছোট অংশ নিয়ে করা হয়েছে। তার মস্তিষ্ক যেহেতু ২৪০ টুকরা করা হয়েছিল, সম্পূর্ণ মস্তিষ্ক নিয়ে গবেষণা করা সম্ভব হয়নি। এটি অন্যদের সাথে তার মস্তিষ্কের তুলনা করার ক্ষেত্রে ফলাফলগুলোকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করতে পারে।
সম্পূর্ণ মস্তিষ্কের ওপর কেবল একটি গবেষণাই করা হয়েছিল। সেটিও করা হয়েছিল মস্তিষ্ক কাটার আগে তোলা একটি ছবির উপর ভিত্তি করে। কিছু বিজ্ঞানী দাবি করেন, আইনস্টাইনের মগজের প্যারাইটাল লোবের খাঁজগুলো অন্যদের চেয়ে আলাদা। আশপাশের খাঁজগুলো ছোট ছিল। পাশপাশি তার ব্রেইন ১৫ শতাংশ বেশি প্রশস্ত ছিল। তারা ধারণা করেন, এতে আইনস্টাইনের মস্তিষ্কের নিউরনগুলো কাজ করার জন্য যথেষ্ট জায়গা পেত, যা তার গাণিতিক ও স্থানিক চিন্তাশক্তিতে সাহায্য করত।
- সূত্র: এনশিয়েন্ট অরিজিন