মেয়ের শখ পূরণ থেকে উদ্যোক্তা, যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছে অর্পিতার হস্তশিল্পের পণ্য
২০২০ সালে মে মাস। সবাই তখন করোনা মহামারির আতঙ্কে ঘরবন্দী। গৃহিণী অর্পিতা বড়ুয়ার চার বছর বয়সী কন্যা আদ্রিকা বড়ুয়া পাশের বাসার দোলনা দেখে মায়ের কাছে বায়না ধরলো, তারও এমন একটা লাগবে। অর্পিতা ঠিক করলেন, তিনি নিজেই বাসায় এটি বানাবেন। স্বামী ব্যাংক কর্মকর্তা সুমন বড়ুয়াকে বলে দড়ি কিনে আনলেন। এরপর বাসায় বসে মেয়ের জন্য একটি দোলনা বানিয়ে ফেললেন। ছোট্ট আদ্রিকা তো দোলনা পেয়ে দারুণ খুশি।
নিজের বানানো দোলনার ছবি ও ভিডিও অনলাইন প্ল্যাটফর্ম উইতে পোস্ট করলেন অর্পিতা। কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে অনেক সাড়া পেলেন। অনেক অভিভাবক নক করতে থাকলেন। মাত্র ২৮ দিনে ৫০টি দোলনা বানিয়ে ডেলিভারি দিয়ে দেন অর্পিতা। স্বামী-স্ত্রী দু'জন মিলে ঘরবন্দী সময়কে এভাবেই কাজে লাগিয়ে ফেলেন। দোলনা বিক্রির দেড় লাখ টাকা আয় তাকে পুরোদমে উদ্যোক্তা বানিয়ে ফেলে।
অর্পিতা বড়ুয়া দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমি স্কুল-কলেজে স্কাউটিং করতাম। ওই সময় দড়ির কাজ শিখেছিলাম। আমাদের বাসায় উত্তরবঙ্গের কিছু মানুষ ভাড়া থাকতেন। তারা দড়ির কাজ জানতেন। সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে মেয়ের জন্য দোলনা বানিয়ে ফেলেছিলাম। করোনার কারণে সবকিছু বন্ধ ছিল। আমার স্বামী অনেক ঘুরে অক্সিজেন মোড়ের একটি হার্ডওয়্যার দোকান থেকে দড়ি কিনে এনেছিলেন। বাসায় বানানো দোলনাটি অনেক সাড়া ফেলেছিল।"
২০২০ সালে করোনা মহামারির পুরো সময় অর্পিতা দড়ি দিয়ে বানানো দোলনা, প্ল্যান্ট হ্যাঙ্গার, পর্দা, ওয়ালম্যাট তৈরি করে বিক্রি করেছেন। মূলত ২০১৮ সাল থেকে হাতে তৈরি গহনা অনলাইন প্ল্যাটফর্মে বিক্রি করতেন তিনি। মহামারির সময় দড়ির তৈরি সামগ্রী নট আর্ট বিডি নামে একটি ফেসবুক পেইজের মাধ্যমে বিক্রি করেন। দড়ির তৈরি এসব পণ্যই তাকে পুরোদমে উদ্যোক্তায় পরিণত করে।
গ্রাহকদের চাহিদা বাড়তে থাকে। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নগরীর খুলশী এলাকার জাকির হোসেন সড়কে একটি কারখানা স্থাপন করেন তিনি। সেখানে অংশীদার ভিত্তিতে একটি শোরুমও দিয়েছেন। সেখানে বাঁশ ও বেতের আসবাবপত্রসহ বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করেন।
একই বছর অনলাইন প্ল্যাটর্ফমের মাধ্যমে উদ্যোক্তা বিষয়ক প্রশিক্ষণে অংশ নেন তিনি। সেখানকার প্রশিক্ষক যক্তরাষ্ট্রের নাগরিক কাইল ব্যাক অর্পিতার পেজটি ঘুরে দেখেন। কাজ পছন্দ হওয়ায় প্রায় ২০০ পিস ফ্রুট হ্যামক অর্ডার করেন তিনি। ২০২১ সালের অক্টোবরে প্রায় দেড় লাখ টাকা মূল্যের এই অর্ডার শিপমেন্ট করেন। অর্পিতা ওই বছর প্রায় ১০ লাখ টাকা মূল্যের হাতে তৈরি পণ্য বিক্রি করেন তিনি। এরপর ব্যবসায়ের পরিসর বাড়াতে থাকেন। শুরুতে মাত্র ৫ জন শ্রমিক কাজ করলেও বর্তমানে ১০ জন নিয়োজিত রয়েছেন।
অর্পিতার কারখানায় দড়ি ছাড়াও বাঁশ, বেত ও বোর্ডের আসবাবপত্র তৈরি করা হয়। এজন্য উত্তরবঙ্গ থেকে দড়ি এবং বান্দরবান, হাটহাজারী ও কর্ণফুলী নদীর আশপাশের এলাকা থেকে বাঁশ ও বেতসহ কাঁচামাল আনা হয়। উৎপাদিত পণ্যের মধ্যে সোফা, খাট, ঝুড়ি, শোপিস, আয়নার ফ্রেম, ঝাড়বাতি, টেবিল ল্যাম্প শেড, টি-টেবিল, পর্দায় লাগানো বাঁশের শিক, বাচ্চাদের খেলনা ও বেবি ডাইনিং চেয়ার রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে ফ্রুটস হ্যামকের প্রথম চালানটি পাওয়ার পর ক্রেতা সন্তুষ্ট। এখন দড়ি দিয়ে তৈরি থ্রি স্ট্যান্ড প্ল্যান্ট হ্যাঙ্গার, বাঁশের তৈরি ল্যাম্প শেড, ট্রে ও ঝাড়বাতি কিনতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ওই ক্রেতা। এসব পণ্যের নমুনা তাকে পাঠানো হয়েছে।
চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সান্ধ্যকালীন এমবিএ সম্পন্ন করেছেন অর্পিতা। ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ের ওপর তিনি ডিপ্লোমা কোর্স সম্পন্ন করছেন। তার এই এগিয়ে চলার পেছনে রয়েছে স্বামীর অকুণ্ঠ সমর্থন। তিনি বলেন, "আমার বাবা-মা দু'জনই সরকারি চাকুরীজীবী। আমারও সরকারি চাকরির চিন্তা ছিল। কিন্তু বাচ্চা নিয়ে ঢাকায় গিয়ে পরীক্ষায় অংশ নেওয়া অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম নিজে কিছু করবো। করোনায় ওই দোলনার অর্ডার আমার জীবনের মোড় পরিবর্তন করে দেয়। আমার স্বামী ব্যাংকের কাজ শেষে এসে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেও সময় দিচ্ছেন। তিনি হিসাবটা দেখভাল করেন।"
অর্পিতার স্বামী সুমন বড়ুয়া বলেন, "বাচ্চা ও পরিবার সামলান আমার স্ত্রী। তিনি ক্যারিয়ার বির্সজন দিয়েছেন পরিবারের জন্য। তাই ব্যবসায়ে সহযোগিতা করার চেষ্টা করি। এই করোনায় যখন অনেকে চাকরি হারিয়েছেন, তখন স্ত্রীর আয়েই অনেক পরিবার চলেছে। নারীদের এখন আর পিছিয়ে থাকার সময় নেই।"