গোখরার ফণা কেন সবচেয়ে বড়?
…যে সাপের চোখ্ নেই,
শিং নেই নোখ্ নেই,
ছোটে না কি হাঁটে না,
কাউকে যে কাটে না,
করে নাকো ফোঁস্ফাঁস্,
মারে নাকো ঢুঁশঢাঁশ,
নেই কোনো উৎপাত…
সুকুমার রায়ের লেখা এই বাবুরাম সাপুড়ে কবিতাটি ছোটবেলায় পড়েননি এমন পাঠক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। কী দারুণভাবে সুকুমার রায় সাপদের ব্যাপারে কিছু ভীতি ভাঙানোর প্রয়াস করেছিলেন এই ছড়ায়, তা আজও ভাবলে মুগ্ধ হতে হয়।
সাপ-সর্প-নাগ; বাংলাভাষায় তাদের যে নামেই ডাকা হোক না কেন, মানুষের মনে তা ভীতি সঞ্চার করতে যথেষ্ট। বিশ্বের সব দেশের মানুষই কম-বেশি সর্প আতঙ্কে ভুগে থাকে। অবশ্য তার কতটা বিষ দংশনের ভয়ে আর কতটা কুসংস্কারের জন্য, তা বলা মুশকিল।
সাপ! মানুষের মনের কোণে গেঁথে থাকা প্রাচীন ভয়গুলোর মধ্যে অন্যতম। কিন্তু প্রশ্ন জাগতেই পারে, মানুষ কেন সাপ ভয় পায়? দেখতে ভীতিকর বলে? তা হতে পারে—পা নেই, বুকে ভর দিয়ে এগিয়ে চলা, মাটির সাথে মিশে চলা প্রাণীরা মানুষের চোখে কিছুটা অস্বাভাবিক লাগতেই পারে। সেইসাথে রয়েছে সাপের বিষের ভয়—হ্যাঁ! এটা মূল কারণ বৈকি। এছাড়াও রয়েছে সাপ না চেনা, সাপের ব্যাপারে না জানার বিষয়। তা না হলে এদেশে সারা বছর মানুষের হাতে মারা পড়া সাপগুলোর অধিকাংশই যে নির্বিষ এবং অপরদিকে প্রতি বছর সাপের দংশনে গড়ে মারা যাওয়া সাড়ে ছয় হাজার মানুষের মধ্যে অধিকাংশই কুসংস্কার বা ভীতির কারণে হার্টঅ্যাটাক এবং ওঝাদের ভুল চিকিৎসা কিংবা অবহেলার কারণে মৃত্যু—এই ঘটনাগুলো মোটেই ঘটত না।
বনের সাপে কাটে না, মনের সাপে কাটে। হ্যাঁ, মনের ভয়টাই আমাদের বেশি দূর্বল করে তোলে। সাপের নাম শুনলেই আমরা ভয় পাই, সাপ দেখলে তো কথাই নেই। অথচ বাংলার বিস্তৃত নদী-নালা-সবুজ প্রকৃতির মাঝেই যে সাপের চির আবাস! তাকে এড়াবেন কী করে?
বিষধর সাপ ফণা তুলে এগিয়ে আসছে—এমন দুঃস্বপ্ন প্রায় প্রত্যেকেই দেখেছে, কারণ যা-ই হোক। সাপের ফণা তাই দুঃস্বপ্নেরই এক নাম বটে! আর সেই ভয় থেকেই ফণা তোলা গোখরা সাপ মানুষের চোখে ভীতির কারণ। চতুর সাপুড়েরাও এই সুযোগে গোখরার খেল দেখিয়ে, নানা কুসংস্কার ছড়িয়ে তাবিজ ইত্যাদি বিক্রির অজুহাতে টাকা কামাইয়ের উপায় খুঁজে নেয়।
অথচ বিষের তীব্রতা কিংবা যদি বিষ প্রয়োগের ক্ষেত্রেও ধরি, গোখরার চেয়েও অধিক বা এর কাছাকাছি অনেক বিপজ্জনক সাপ রয়েছে বাংলাদেশে। কেউটে বা কমন ক্রেইট, চন্দ্রবোড়া (রাসেলস ভাইপার), এমনকি সবুজ বোড়া (পিট ভাইপার)—এরাও কিন্তু মানুষের জন্য কোনো অংশে কম বিপজ্জনক নয়! সামুদ্রিক অনেক সাপই তো এর চেয়ে মারাত্মক বিষধর। সেগুলোর মধ্যে ইয়েলো বেলিড সি স্নেক, হুকনোজড স্নেক (বড়শি নাক সামুদ্রিক সাপ) এগুলো তো তীব্র বিষের অধিকারী। কিন্তু তারপরেও অধিকাংশ মানুষের মনে সাপ বলতেই চোখে ভাসে ফণা তুলে ফোঁসফোঁস করতে থাকা, রাজসিক ভঙ্গির এক প্রাণীর কথা।
অর্থাৎ, ভয়টা সাপের প্রতি তো রয়েছেই, সাপের ফণার প্রতিও রয়েছে আমাদের আলাদা ভীতি। সন্দেহ নেই, সাপের ফণাই সাপকে আরও ভীতিকরভাবে উপস্থাপন করে আমাদের কাছে।
সব সাপ কিন্তু ফণা তোলে না। আমাদের দেশে পাওয়া সাপগুলোর মধ্যে খৈয়া গোখরা (স্পেক্টিকল্ড কোবরা), গোখরা (পদ্ম গোখরা/মনোকল্ড কোবরা), রাজ গোখরা (কিং কোবরা—আদতে যে নিজেই এক সম্পূর্ণ আলাদা প্রজাতি, শুধু নামের শেষাংশে গোখরা বা কোবরা বলে আখ্যায়িত) আর রয়েছে মৃদু বিষধর ফলস কোবরা, যেটা বিপদ দেখলে বা আক্রমণের ঝুঁকিতে পড়লে গোখরা সাপের মতো অঙ্গভঙ্গি করে ফণা তোলে। (বাংলাদেশে এই সাপটির আবিষ্কার গত কয়েক বছর আগে, তাই এর বিষের ধরন সম্পর্কে খুব একটা তথ্য পাই না আমরা।) এছাড়া লাল ঘাড় ঢোঁড়া (বাংলাদেশের একমাত্র সাপ যেটা একইসাথে বিষধর এবং বিষাক্ত) সাপও নিজের ঘাড়ের মাংসপেশি বিস্তৃত করে বেশ ফণা তুলতে সক্ষম। তবে মানুষের চোখে সেই গোখরার চিরচেনা ফণাটাই ভাসে।
গোখরা সাপ কেন অত বড় ফণা তোলে? আদতে সবচেয়ে বড় ফণা তোলে এই সাপ। ফণা (হুড) বলতে যা বোঝায়, সেটি গোখরাই সবচেয়ে ভালো তোলে। এর পেছনে রহস্য কী? সব সাপ কেন ফণা তুলতে পারে না? তবে কি গোখরা আলাদা? জাদু জানে? এ ব্যাপারে অনেকের মনেই প্রশ্ন রয়েছে।
কয়েক বছর আগে এ বিষয়ে একটি গবেষণার ফল প্রকাশিত হয়েছে 'এক্সপেরিমেন্টাল বায়োলজি' সাময়িকীতে। মার্কিন গবেষকদের একটি দল দীর্ঘদিন কাজ করছিল এই 'হুড ফ্লেয়ার' বা গোখরা সাপের ফণা তোলার রহস্যের উন্মোচন করতে। এতেই জানা গেছে কিছু নতুন তথ্য।
এখন আমরা জানি, গোখরা সাপেরা ফণা তুলতে পাঁজরের হাড় ও মাংসপেশির ব্যবহার করে। বিবিসি অনলাইনে প্রকাশিত এ সম্পর্কিত ফিচারে জানা গেছে, সাপের ফণার এই রহস্য বের করতে সাপের গলার মাংসপেশীতে সূক্ষ্ম ইলেক্ট্রোড বসিয়েছিলেন গবেষকরা। সেইসাথে সাপের দেহে জটিল কিছু অস্ত্রোপচারও করতে হয়েছিল তাদের।
এর ফলে সাপের মাংসপেশি থেকে বৈদ্যুতিক সক্রিয়তার মাত্রার পরিমাপ বের করতে পেরেছেন গবেষকরা। গবেষণায় নিয়োজিত প্রাণীবিজ্ঞানী ও গবেষকদের দল জানিয়েছেন, গোখরা সাপ সূক্ষ্ম কিছু মাংসপেশিকে ফণা তোলার কাজে ব্যবহার করে। কেবল আটটি মাংসপেশি ফণা তোলার কাজ করে থাকে। তবে যে সাপ ফণা তোলে না, তাদের দেহেও এই মাংসপেশিগুলো থাকে। সেগুলো কাজে লাগিয়ে কিছু সাপ ফণা তোলার চেষ্টাও করে। যেমন জলঢোঁড়া (চেকার্ড কিলব্যাক), এনি (বাফ স্ট্রাইপড কিলব্যাক)-সহ আরও কিছু সাপও মাঝে মাঝে ঘাড় চ্যাপ্টা করে ফণা তোলার প্রয়াস চালায়।
এ বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটির প্রাণিবিদ্যার অধ্যাপক কেনিথ কারডং জানিয়েছেন, গোখরার হুড বা ফণা তোলার বিষয়টি এতদিন বিবর্তনমূলক প্রাণিবিদ্যার ক্ষেত্রে কৌতূহল জাগানোর মতোই এক বিষয় ছিল। গোখরা প্রজাতির সাপ পাঁজরের উভয় হাড় এবং মাংসপেশি একত্রে কাজ করে এই চমৎকার এই ফণা তৈরির জন্য।
'ফণা তোলার জন্য কীভাবে এর পাঁজরের হাড়গুলো কাজ করে, এই প্রক্রিয়াটার রহস্য আমরা বের করতে চেয়েছিলাম। কীভাবে মাংসপেশিগুলো আবার স্বাভাবিক ও শিথিল অবস্থায় ফিরে আসে, সেটাও ছিল এক রহস্য।"—জানিয়েছেন কারডং।
গোখরা প্রজাতির সাপগুলো ভয় পেলে বা আত্মরক্ষার্থে নিজের মাথা উঁচু করে ফেলে, ছোবল দেয়ার একদম পূর্বমুহূর্তেও এমন ভয়ানক মাথা তোলা ভঙ্গি নিয়ে শিকারের দিকে স্থির তাকিয়ে থাকে।
ম্যাসাচুসেটস লওয়েল ইউনিভার্সিটির প্রাণী গবেষক ব্রুস ইয়াং-এর বিবৃতিতে ব্যাপারটি আরও পরিষ্কার হয়।
'সাপের ফণা তোলার বিষয়টি পরীক্ষার সময় অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয়েছিল। এটাই ছিল গবেষণার সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অংশ। একটি গোখরা সাপকে অজ্ঞান করে সেটার মাথার চারপাশে ইলেক্ট্রোড বসানো হয়েছিল। ইলেক্ট্রোডগুলো যথাস্থানে লাগানোর পর মাংসপেশির এই বিস্তৃতির রহস্য উদঘাটন করতে পেরেছি আমরা।'
প্রফেসর ইয়াং আরও জানিয়েছেন, 'কেবল গোখরাই নয়, অনেক গোত্রেরই সাপ আছে যারা ফণা না তুললেও প্রায় একই ধরনের আত্মরক্ষামূলক আচরণ করে।'
অর্থাৎ, সাপের ফণা তোলা কোনো অতিপ্রাকৃত ঘটনা নয়, বরং সম্পূর্ণ প্রকৃতিগতভাবেই ব্যাপারটা ঘটে। তাই সাপ দেখে ভয় পেলেই তাকে মেরে ফেলা বা আহত করা কোনো সমাধান নয়। সাপকে অহেতুক ভয় না পেয়ে বরং সচেতন হোন, অন্যকে সচেতন করুন। সাপসহ যেকোনো বণ্যপ্রাণীকে বিরক্ত করা থেকে বিরত থাকুন। মনে রাখবেন, সকল প্রাণীরই রয়েছে বাঁচার অধিকার, প্রকৃতি রক্ষায় সবারই অবদান রয়েছে।
- বাপ্পী খান: লেখক, প্রাণীপ্রেমী