জ্বালানি খরচ বাঁচাতে সাইকেল!
"কাঁদিস না খোকা, পেট্রোলের দাম কমে গেলেই বাবা তোর সাইকেল ফেরত দিয়ে দেবে"- ফেসবুক স্ক্রল করতে গিয়ে কার্টুনটায় চোখ আটকে গেল। খোকার ছোট্ট সাইকেল চেপে কাজে যাচ্ছেন বাবা আর ক্রন্দনরত খোকাকে আটকে রেখে তার মা বলছেন এই কথা।
দফায় দফায় জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধিতে পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ায় সব ধরনের যানবাহন ছেড়ে, এবার বাইসাইকেলে ঝোঁকার কথা ভাবছেন এমন অনেকেই। কেউ কেউ তো নিজেদের মোটরবাইকের সাথে বাইসাইকেল এক্সচেঞ্জও করতে চাচ্ছেন!
গত বছরের নভেম্বর থেকে দুই দফায় জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে ৭৫ শতাংশ। ফলে দেশে ৫৫ শতাংশ বেড়েছে পরিবহন খরচ। গণপরিবহনে কিংবা নিজস্ব মোটরসাইকেল-গাড়িতে যাতায়াতকারী সব শ্রেণীর মানুষই সরাসরি ভুক্তভোগী এই মূল্যবৃদ্ধির। এই সময়ে নিত্যপণ্যের দামও বেড়েছে অন্তত ৪০ শতাংশ। মৌলিক প্রয়োজনীয় জিনিসগুলোতে কাটছাঁট করেও যখন খরচের হিসেব মেলাতে পারছেন না, তখন তেলবিহীন নিজস্ব যানবাহন বাইসাইকেলে স্বস্তি খুঁজছেন সাধারণ মানুষের একাংশ।
পরিবহন ব্যয়ের আকাশচুম্বী অবস্থার লাগাম টানতে সম্প্রতি সাইকেলে করে অফিস-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাতায়াত শুরু করেছেন এমন কয়েকজন তাদের অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে। অন্যদিকে মূল্যবৃদ্ধির অনেক আগে থেকেই যারা নিজেদের পছন্দে সাইকেলকে বেছে নিয়েছেন যাতায়াতের নিয়মিত মাধ্যম হিসেবে, তাদের অভিজ্ঞতা থেকেও জানা গেছে এর সুবিধা-অসুবিধা।
খরচ কমাতে সাইকেলে ঝুঁকেছেন নানা পেশার মানুষ
ঢাকার ডেমরা থানার সারুলিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা এমরান হোসেন টিপু। পেশায় ব্যাংকার। বাড়ি থেকে অফিসের দূরত্ব প্রায় ১১.৫ কিলোমিটার। উত্তরা ব্যাংকের ফুলবাড়িয়া শাখায় কর্মরত তিনি। অফিসে যাতায়াতে সুবিধার জন্য মোটরসাইকেল কিনেছিলেন এমরান। কিন্তু হুট করেই জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় পড়েন বিপাকে।
মাঝে কিছুদিন চেষ্টা করেছেন পাবলিক বাসে যাতায়াত করার। কিন্তু সেখানে বাড়তি ভাড়া নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই যাত্রীদের ঝগড়া বাধতো হেল্পার-চালকদের সঙ্গে। পাশাপাশি অসহ্য জ্যামে বাস আটকে থাকা, ফাঁকা রাস্তায় বারবার থেমে যাত্রী নেওয়া, বাসে দাঁড়ানো যাত্রীর উপচে পড়া ভিড় তো রোজকার সঙ্গী ছিলই। সব ধরনের ঝামেলা থেকে মুক্তি পেতে প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে তিনি অফিস যাতায়াত করছেন সাইকেলে।
সাইকেলে অফিস যাতায়াত করার দশম দিনে বাংলাদেশি সাইক্লিস্টদের জনপ্রিয় ফেসবুক গ্রুপ 'বিডিসাইক্লিস্ট'-এ নিজের অভিজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, "আজ ১০ দিন, আমি অফিসে আসা যাওয়া করছি বাইসাইকেলে। ১০ দিনের হিসাব করে দেখলাম, আমার বাসা থেকে অফিস এর দূরত্ব ১১.৫০ কিলোমিটার। আমি যদি বাসে আসি তাহলে আসা যাওয়া আমার খরচ হয় ৯০ টাকা। তাহলে এই ১০ দিনে আমার খরচ হতো ১০×৯০ =৯০০ টাকা। বাইসাইকেলে আসাতে এই ৯০০ টাকা আমার বেঁচে গেছে। বাইসাইকেল শুধু টাকা বাঁচায় না, শরীরও সুস্থ রাখে। তাই আমরা যদি চেষ্টা করি গণপরিবহন ত্যাগ করে সাইকেলে অভ্যস্ত হওয়ার তাহলে আমাদের টাকাও বাঁচবে, শরীরও সুস্থ থাকবে। আর বাসের ভাড়া নিয়ে কন্ট্রাক্টর এর সঙ্গে ঝামেলাও হবে না।"
ডেমরা থেকে বাসে যাতায়াত করতে এমরানের সময় লাগতো প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা। কিন্তু সাইকেলে তিনি অফিস পৌঁছে যান ২০-৩০ মিনিটেই। "সাইকেলে যেমন টাকা লাগে না তেমন জ্যামেও পড়তে হয় না। সিগন্যালে আটকে থাকলে সাইকেল নিয়ে হেঁটে চলে যাওয়া যায়। আগে মোটরসাইকেলে যাতায়াতেও কাছাকাছি সময়ই লাগতো। কিন্তু রাস্তাঘাটে নানাধরনের পুলিশি ঝামেলা হতো প্রায়ই। তেলের দাম বাড়ার পর মোটরসাইকেল এড়িয়েই চলি যতটা সম্ভব," বলেন এমরান।
আগে থেকেই সাইক্লিংয়ের অল্পবিস্তর অভিজ্ঞতা ছিল তার। কিন্তু হঠাৎ করেই নিয়মিত যাতায়াত করায় শুরুতে কয়েকদিন গা-ব্যথায় ভুগতে হয়েছিল তাকে। অভ্যস্ত হয়ে গেলে অবশ্য এই সমস্যা আর থাকে না। অফিসের সহকর্মীরাও সাইকেল যাত্রায় উৎসাহ দেন এমরানকে। তাকে দেখে অনেকেই নতুন করে আগ্রহীও হচ্ছেন, জানালেন তিনি।
প্রায় কাছাকাছি গল্প ঢাকার মিরপুরের বাসিন্দা আবির হাসান সিমান্তেরও। পেশায় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার আবিরের অফিস বনানীতে। বাস ভাড়া বৃদ্ধি, বাসের বিশৃঙ্খলা, ভিড় আর ঝগড়াঝাটি এড়াতে তিনিও সপ্তাহখানেক যাবত শুরু করেছেন সাইকেলে যাতায়াত।
বাসা থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার দূরত্বের অফিসে যেতে রিকশা ভাড়া আর বাস ভাড়া মিলে আবিরের রোজ খরচ হতো প্রায় ১০০ টাকা। সাইকেলে যাতায়াত শুরু করায় সে টাকা প্রায় সবটাই বেঁচে যাচ্ছে এখন। প্রতিবার যাতায়াতে সময়ও বাঁচে ২০-৩০ মিনিট। স্বাস্থ্যগত দিকেও হচ্ছেন লাভবান। আবিরের ভাষ্যে, "বাসের উপর খুবই বিরক্ত আমি। এখন সেই বাসের অস্বস্তি, জ্যাম সব থেকে দূরেও আছি আবার সাইকেলে শারীরিক পরিশ্রম হওয়ায় রাতে ঘুমও ভালো হচ্ছে। সবদিক দিয়েই উপকৃত হচ্ছি। আমি চাই অনেক মানুষ যেন সাইকেলে নিয়মিত যাতায়াত করতে আগ্রহী হন। এটা যাতায়াতের বেস্ট অপশন। কেউ নিজে না শুরু করলে আসলে এর উপকারীতা বুঝবে না।"
তবে আবির জানান, ঢাকার রাস্তা সাইকেলে যাতায়াতের জন্য বেশ রিস্কি। কোথাও আলাদা সাইকেল লেন নেই। বাস বা অন্যান্য বড় যানবাহনের চলাচলও বেপরোয়া। তাই যাতায়াতে সবসময় ভালো মানের হেলমেট ব্যবহার করার পরামর্শ দেন তিনি।
আবিরের মতে নিয়মিত যাতায়াতের জন্য খুব বেশি দামের সাইকেলের দরকার নেই। ১০-১২ হাজার টাকা দামের সাইকেল দিয়েই শুরু করা যেতে পারে। সবজায়গায় সাইকেল পার্কিং এর সুবিধা না থাকায় সাইকেল চুরি হয়ে যাওয়ার ভয়টাও রাখতে হয় মাথায়।
এদিকে পুরান ঢাকার ফরিদাবাদের বাসিন্দা মাহাবুব আলম সাইকেলের শরণাপন্ন হয়েছেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাতায়াতের জন্য। মৌচাকে আইইএলটিএস পরীক্ষার জন্য কোচিং করছেন তিনি। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পর নিজস্ব মোটরবাইক রেখে প্রায় তিন সপ্তাহ যাবত যাতায়াত করছেন বাইসাইকেলে।
দাম বাড়ায় মাহাবুবের রোজকার যাতায়াতে মোটরবাইকে তেল বাবদ খরচ হতো প্রায় ১৩৫ টাকা। সাথে পার্কিং খরচ, কিছুদিন পরপর বাইক মেরামত খরচ তো ছিলোই। ছাত্র থাকাকালীন বাইকের পেছনে এত খরচ মেটানো বেশ কঠিনই হয়ে গিয়েছিল তার জন্য। এসব সমস্যা থেকে বেশ খানিকটাই রেহাই মিলেছে নিয়মিত সাইকেল যাতায়াতে।
মাহাবুব বলেন, "সাইক্লিংয়ের প্রতি ভালোবাসা ছিলো আগে থেকেই। তেলের দাম অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ায় আবার নতুন করে শুরু করা। সাইকেল যেমন পরিবেশবান্ধব তেমনি শরীরের ফিটনেস ঠিক রাখতেও সাহায্য করে। বাইকে যাতায়াতে আমার ওজন বেড়ে গিয়েছিলো অনেক। সাইক্লিং করতে গিয়ে এটা কমে যাচ্ছে। যানজটের কারণে বাইকে সময়টাও বেশি লাগতো। আমার কোচিং পর্যন্ত ৮-৯ কিলোমিটার রাস্তা যেতেই বাইকে লাগতো ৪৫ মিনিট। এখন যেখানে লাগে সর্বোচ্চ ৩০ মিনিট। এখন কাছাকাছি দূরত্বের সব জায়গাতেই সাইকেলে যাতায়াত করি আমি।"
মাহাবুব আলমের ব্যবহৃত সাইকেলটির বাজারমূল্য ৩০ হাজার টাকা। তার মতে, কয়েকদিন পরপর সার্ভিসিং এর ঝামেলায় না যেতে চাইলে মোটামুটি ভালো দামের সাইকেলই কেনা উচিত। সাইকেলের বিভিন্ন পার্টস বাইরে থেকে আমদানি করতে হয় বলে এর মেরামত খরচ অনেক বেড়ে যায়। তাই সরকারের কাছে মাহাবুবের আবেদন পরিবেশবান্ধব এই যানের উপর থেকে ভ্যাটের হার যেন অবিলম্বে কমানো হয়।
জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির পর মাহাবুবের পরিচিত আরো অনেকেই সাইকেলের প্রতি আগ্রহী হয়েছে বলে জানান তিনি।
রোজকার যাতায়াতে 'সাইক্লিং থেকে সেরা কোনো সলিউশন নেই'
যাতায়াতে দীর্ঘমেয়াদী সাইক্লিং অভ্যাসের ভালো-খারাপ দিক জানতে কথা হয়েছে কমিউটিংয়ে অভিজ্ঞ সাইক্লিস্টদের সাথে।
নারায়ণগঞ্জের সাইক্লিস্ট সুলতানা লিয়া তিন বছর ধরে নিয়মিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাতায়াত করছেন সাইকেলে। এলাকার মেয়েদের সাইকেল শেখার স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান 'নভেরা'-র সাথে তিনি যুক্ত আছেন ট্রেইনার হিসেবে। লিয়া বলেন, "সাইকেলে নিজের ব্যক্তিস্বাধীনতা বজায় থাকে। গণপরিবহনে মেয়ে-ছেলে নির্বিশেষে সবাইকেই হ্যারাসমেন্টের শিকার হতে হয় প্রায়ই। সাইকেলে এই সমস্যা নেই। শারীরিক কসরতের কারণে সাইক্লিং করলে মনও ভালো থাকে। আমার অন্যান্য বন্ধুদের চেয়ে অনেক কম ডিপ্রেশনে ভুগি আমি। সাইকেলে চড়ার সময় মনে হয় আমি যেন হাওয়ায় উড়ছি। পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ায় ৫০ বছর বয়সী এক দাদীও তার কর্মক্ষেত্রে যাতায়াতের জন্য নতুন করে সাইক্লিং শিখছেন আমার কাছে।"
বিডিসাইক্লিস্ট গ্রুপে পরিচিত মুখ আরিফুর রহমান খান। পেশায় কর্পোরেট অফিসার এই সাইক্লিস্ট ১৬ বছর ধরে নিয়মিত যাতায়াতে সাইক্লিং করে অভ্যস্ত। ছাত্রাবস্থায় টিউশন পড়ানোয় যেতে সময় বাঁচাতে কিনেছিলেন সাইকেল। এরপর কর্মজীবনের নানা ধাপ পাড়ি দিয়ে মোটরবাইক কিনলেও ছাড়েননি সাইকেলের হ্যান্ডেল। তার মতে, শারীরিক, মানসিক, আর্থিক, পরিবেশগত যেকোনো সমস্যায় সাইক্লিং থেকে সেরা কোনো সলিউশন নেই।
"গবেষণায় দেখা গিয়েছিলো ঢাকায় ছুটির দিন বাদে অফিস-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের 'পিক আওয়ারে' একটা গাড়ির গড় গতিবেগ ৫-৬ কিলোমিটার, মোটরবাইকের ৮-১০ কিলোমিটার আর বাইসাইকেলের ১৭-১৮ কিলোমিটার। সাইকেল নিয়ে জ্যামে আটকে থাকতে হয় না কখনো। সময় সাশ্রয়ে এরচেয়ে বড় সহায় আর নেই তাই। নিয়মিত সাইক্লিং করেন যারা তাদের ঠান্ডা-জ্বর, সর্দি-কাশির মতো রোগ হয়না বললেই চলে। সাইক্লিস্টদের হার্ট সবচেয়ে ভালো থাকে। সাইকেল ব্যয়সাশ্রয়ী তো অবশ্যই। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পর অনেকেই আমাকে ইনবক্স করে সাইকেল কেনার সাজেশন, সাইক্লিং এর সুবিধা-অসুবিধা জানতে চেয়েছে," বলেন আরিফুর।
শরীরের আকার-আকৃতির সাথে সাইকেলের মাপের গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আছে বলে জানান এই সাইক্লিস্ট। প্রত্যেকের শরীরের গঠন অনুযায়ী সাইকেল না ব্যবহার করলে দীর্ঘদিন পর পিঠ ব্যথা, কোমর ব্যথার মতো নানা সমস্যায় পড়তে পারেন।
সুলতানা লিয়া আর আরিফুর রহমান উভয়েই দেশের রাস্তায় সাইকেলের লেন না থাকায় অসুবিধার আক্ষেপ জানিয়েছেন। রাস্তায় বড় গাড়ির বেপরোয়া ড্রাইভিং এড়িয়ে সাবধানে চলাচলের পরামর্শ দেন তারা।
সাইক্লিং করে অফিস যাতায়াতের ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় খেয়াল রাখতে বলেন আরিফুর। যাতায়াতের জন্য প্রয়োজনীয় সময়ের কিছু আগে বের হতে হবে রাস্তায়, সাইক্লিং জার্সি পরে যাতায়াত করতে হবে, সাইকেল থামানোর পর অতিরিক্ত ঘাম এড়াতে বাতাসযুক্ত স্থানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে হবে, সম্ভব হলে অফিসের জামা-কাপড় লকারে রাখা বা সাথে বহন করে নিয়ে যাওয়ার অভ্যাস রাখতে হবে। এই কয়েকটি দিক মেনে চললে অফিসে ফিটফাট থাকার ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি হতে দেয় না সাইক্লিং।