নীলক্ষেতে কেনা প্রোগ্রামিং বই থেকে যেভাবে দেশের প্রথম গেম ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানের জন্ম
১৯৯৮ সাল। তানভীর আহমেদ ছিলেন নটরডেম কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। কলেজে সবে 'কম্পিউটার বিজ্ঞান' নামের নতুন একটি সাবজেক্ট চালু হয়েছে। পরিসংখ্যান ও জীববিদ্যার বাইরে ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে তা নেওয়া যাবে। নতুন সাবজেক্ট সম্পর্কে খুব বেশি ধারণা না থাকলেও সেটই বেছে নিলেন তানভীর।
এক মাস যেতে না যেতে শুনলেন নগরে কম্পিউটার মেলার আয়োজন হবে।
'মেলায় যেকোনো উপায়ে একটি প্রজেক্ট নিয়ে অংশ নিব বলে ঠিক করলাম। কিন্তু আমার না ছিল প্রোগ্রামিং দক্ষতা, না ছিল কোনো ব্যক্তিগত কম্পিউটার,' বলেন দেশের প্রথম মোবাইল গেম ডেভলপার প্রতিষ্ঠান ফ্রি পিক্সেল গেমস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর আহমেদ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপের মতো দেশে খেলা হয় ফ্রি পিক্সেলের নির্মিত মোবাইল গেম।
সেসময় তানভীরের মাথায় ঢুকেছিল এক নতুন চিন্তা। কমলাপুরে এক চাচার ছিল সেকেন্ড হ্যান্ড কম্পিউটার হার্ডওয়্যারের দোকান, নাম 'ওয়েল-ডান কম্পিউটারস'। চাচার কাছ থেকেই এক মাসের জন্য কম্পিউটার ধার নিলেন। কিন্তু কম্পিউটার নিলে কী হবে কোডিং-এর পর্যাপ্ত জ্ঞানই তো নেই। আর তাই এবার তিনি গেলেন নীলক্ষেতে কোডিংয়ের বই খুঁজতে।
'ফুটপাতের একটি দোকান থেকে ভিজ্যুয়াল জাভা++ প্রোগ্রামিংয়ের একটি বই কিনলাম। এক মাস ধরে পড়লাম সেই বই। সেটা পড়েই ডায়নামিক একটি ওয়েবসাইট তৈরি করি। মেলায় অংশ নেওয়াটাই ছিল আমার একমাত্র লক্ষ্য', বলছিলেন ৪০ বছর বয়সী তানভীর যিনি ২০০৯ সালে ফ্রি পিক্সেল গেমস লিমিটেড প্রতিষ্ঠান করেন। সেই সময় বাংলাদেশের স্রেফ হাতেগোনা কয়েকজন মানুষ স্মার্টফোন ব্যবহার করতেন।
অন্যান্যদের সঙ্গে মেলায় অংশ নিয়ে নিজের প্রজেক্ট উপস্থাপন করেন তানভীর। তাকে বিস্মিত করে দিয়ে পুরস্কার জিতে নেয় তার প্রজেক্ট। এর ছয় মাস পর তানভীরের বাবা তাকে তার জীবনের প্রথম কম্পিউটারটি কিনে দেন। শিগগিরই তানভীর সব সফটওয়্যারের সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠে এবং প্রবেশ করে আউটসোর্সিং খাতে।
ফ্রি পিক্সেল গেমস লিমিটেডের জন্ম
'সময়ের সঙ্গে সফটওয়্যারের প্রতি আমার ভালো লাগা বাড়তে থাকে। কিন্তু আমি কখনো সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হতে চাইনি, হতে চেয়েছি একজন সফটওয়্যার ব্যবসায়ী,' বলেন তানভীর।
২০০১ সালে ই-লেন্সে একটি প্রোফাইল তৈরি করেন তানভীর। নিজের প্রফাইল থেকে অন্যান্য ফ্রিল্যান্সারের আউটসোর্সিং শুরু করেন। ততদিনে তানভীর ভর্তি হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে স্বনামধন্য বিজনেস স্কুল আইবিএ-তে। আউটসোর্সিং থেকে তিনি ডলারে আয় করতে শুরু করেন।
'২০০৪ সালে স্নাতক পাশের পর আমার বাবা চেয়েছিলেন আমি যেন আমাদের পারিবারিক টেক্সটাইল ব্যবসা দেখাশোনা করি। সেটি স্থানীয় উদ্যোগ হলেও আমার স্বপ্ন ছিল আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ করা,' বলেন তানভীর। তিনি টেক্সটাইল মিলেও ইন্টার্নশিপ শুরু করেন, কিন্তু সেখানে মানিয়ে নিতে পারেননি।
এক বছর পরে আউটসোর্সিংয়ের জন্য তানভীর একটি অফিস স্থাপন করেন। আটটি কম্পিউটার আর একটি ছোট দল নিয়ে শুরু হয় আইটিআইডব্লিউ। তিন বছরের মধ্যে কর্মীর সংখ্যা ৮ জন থেকে বেড়ে ৪৫ জনে দাঁড়ায়।
২০০৮ সালে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে কোম্পানির মুনাফা কমতে হতে থাকে। ৪৫ জন কর্মচারীকে বেতন দিয়ে প্রতিষ্ঠানের সঞ্চয় ফুরিয়ে যাচ্ছিল। অনেক কর্মীই আরও ভালো কোথাও যাওয়ার জন্য চাকরি ছাড়ছিলেন।
'ক্লায়েন্টরা আমাদের কাজ দিতে দ্বিধা বোধ করছিল কারণ মন্দার প্রভাব তাদের ওপরেও পড়েছিল', বলেন তানভীর। এখান থেকেই তানভীর অন্যের কাজ করে দেওয়ার পরিবর্তে নিজেদের পণ্য আনার কথা ভাবতে শুরু করেন।
'আমরা আবার ই-ল্যান্সে উদীয়মান সেক্টরগুলোর বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করলাম,' বলেন তিনি।
এবার তানভীর লক্ষ্য করেন সম্প্রতি মোবাইল অপারেটিং সিস্টেম আইওএস এসেছে এবং উত্তরোত্তর এর ব্যবহার বাড়ছে। ২০০৯ সালে তার প্রতিষ্ঠান একটি বিদেশি কোম্পানির জন্য প্রথমবারের মতো আইওএসের উপযোগী মোবাইল অ্যাপ তৈরি করে। আইওএস না আসা পর্যন্ত মানুষ ওয়েবসাইট-নির্ভর সফটওয়্যারগুলোর ওপর নির্ভরশীল ছিল।
তখন থেকেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় মোবাইল ফোন অ্যাপ্লিকেশন নিয়ে কাজ করার।
দ্য গেম থিওরি
তানভীর মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করা থেকে একই বছর মোবাইল গেমে চলে আসেন। বাংলাদেশে তখন মাত্র হাতেগোনা মানুষ স্মার্টফোন ব্যবহার করে। তবে অ্যাপলের অ্যাপ স্টোর জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেছে।
এবার সবাই মিলে একটি মোবাইল গেম তৈরির জন্য একটি প্রোগ্রামিং ভাষা খুঁজতে শুরু করেন। দেখা গেল এর জন্য একটি গেম ইঞ্জিন প্রয়োজন। কোকোসটুডি নামে একটি গেম ইঞ্জিনও পেয়ে যান তারা।
'গেমগুলো বোঝা সহজ এবং এর এক সার্বজনীন আবেদন রয়েছে,' বলেন তানভীর, যিনি নিজেও গেম খেলতে পছন্দ করেন।
'বাংলাদেশ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানে সুপার মারিও খেলা হয়। এর কোনো কাস্টমাইজেশনের প্রয়োজন নেই। কিন্তু অ্যাপ্লিকেশনের ক্ষেত্রে যে দেশে ব্যবহৃত হয় তার উপর ভিত্তি করে কাস্টমাইজেশনের প্রয়োজন হয়। জাপানের একটি ইউটিলিটি অ্যাপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো একই রকম হবে না।'
তানভীর জার্মানিতে অবস্থানরত কোকোসটুডি-র ডেভলপারের কাছ থেকে ৫০ ডলারের বিনিময়ে তা কিনেন।
'আমরা ইঞ্জিন ব্যবহার করে কিছু গেম বানিয়ে ২০০৯ সালে সেগুলো রিলিজ করি,' বলেন তানভীর। 'মাত্র দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে লক্ষ্য করি যে ই-ল্যান্সারের চেয়ে আমাদের আয় বেশি হচ্ছে। আর তাই এরপর সম্পূর্ণভাবে গেম ডেভলপমেন্টে মনোযোগ দিই।'
ফ্রি পিক্সেল গেমস এখনও তাদের কয়েকটি গেম ডেভলপ করতে কোকোসটুডি ব্যবহার করছে।
সফটওয়্যার আর গেম ডেভলপমেন্টের প্রতি তানভীরের নেশা ২০১০ সালে তাকে নিয়ে যায় সান ফ্রান্সিসকোতে অ্যাপলের ডেভলপার কনফারেন্স- ওয়ার্ল্ডওয়াইড ডেভলপারস কনফারেন্স (ডব্লিউডব্লিউডিসি)-তে যেখানে স্টিভ জবস উপস্থিত ছিলেন। সম্মেলনে যোগদানকারী প্রায় দুই হাজার মানুষের মধ্যে তিনি ছিলেন একমাত্র বাংলাদেশি।
এখন পর্যন্ত ফ্রি পিক্সেল গেমস লিমিটেড গুগল প্লে ও অ্যাপল স্টোরে ড্রাগন ভ্যালি (তাদের সবচেয়ে জনপ্রিয় মোবাইল গেম), হ্যালোইন ওয়ার্ল্ড ও ডিনো ভিলেজ টাইকুনের মতো ১৫টি আন্তর্জাতিক মানের গেম তৈরি ও লঞ্চ করেছে। রপ্তানিমুখী মোবাইল ডেভলপার প্রতিষ্ঠানটি মূলত রোল-প্লে ও রেসিং গেম তৈরি করে থাকে।
'একটি গেম তৈরি করতে আমাদের ছয় মাস থেকে ১২ বছর সময় লাগে,' বলেন তানভীর। 'এবং একটি সফল গেমের পিছনে প্রায় ১০০টি প্রোটোটাইপ থাকে।'
প্রতিষ্ঠানটিতে বর্তমানে ২৫ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা বেতনধারী ৮০ জন কর্মী রয়েছে। এখানে গড় বেতন ৬০,০০০ টাকা।
বিভিন্ন গেম তাদের কমপ্লেক্সিটি ও খেলার সময়ের ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ফেলা হয়। এর মধ্যে আছে হাইপার-ক্যাজুয়াল, ক্যাজুয়াল, মিড-কোর ও হার্ড-কোর।
তানভীরের প্রতিষ্ঠান ক্যাজুয়াল ও মিড-কোরের মাঝামাঝি ধরনের গেম ডেভলপ করে। তবে তানভীরের মতে, মিড-কোর গেম তৈরির জন্য সাহসের প্রয়োজন।
কোম্পানির অধিকাংশ আয় আসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে। তানভীর বলেন, বাংলাদেশে মোবাইল গেম ডেভেলপিং ইন্ডাস্ট্রি এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে।
'গেম ডেভেলপমেন্ট ইন্ডাস্ট্রি সারা বিশ্বে একইসঙ্গে উচ্চ-ঝুঁকির এবং উচ্চ-রিটার্নের শিল্প,' বলেন তিনি।
তানভীরের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হলো মোবাইল গেম ডেভলপিং সম্প্রসারণের পাশাপাশি একটি ভিডিও এডিটিং ও অ্যানিমেশন স্টুডিও স্থাপন এবং একই সঙ্গে একটি ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্ম নির্মাণ।