দ্য লর্ড অভ দ্য রিংস-এর বিস্ময়কর নেপথ্য কথা!
'দ্য লর্ড অভ দ্য রিংস'-এর প্রিক্যুয়েল এনেছে অ্যামাজন স্টুডিও। ১ সেপ্টেম্বর মুক্তির পর ইতোমধ্যে দুইটি এপিসোড দেখতে পেয়েছেন দর্শকেরা। 'দ্য রিংস অভ পাওয়ার' নামক ওই প্রিক্যুয়েলে লর্ড অভ দ্য রিংস-এর ঘটনাপ্রবাহের আরও কয়েক হাজার আগের গল্প দেখানো হবে।
দ্য রিংস অভ পাওয়ার-এর চরিত্র গ্যালাড্রেইল ও এলরন্ড উভয়ই এলফ। আরও আছে হার্ফুটের দল। এরাই হবিটদের পূর্বপুরুষ। টোলকিনের লেখা বইয়ের নির্ঘণ্ট থেকে তৈরি হয়েছে প্রিক্যুয়েল এ সিরিজটি। সেখানে তিনি বর্ণনা করেছেন মিডল আর্থ-এর সেকেন্ড এইজ।
গল্পের সময়টা হচ্ছে যখন মহাশক্তিশালী, কিংবদন্তিতুল্য আংটিটি তৈরি করা হয়েছিল এবং ডার্কলর্ড সরন ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেছিলেন। একই সময়ে দ্বীপরাজ্য নুমেনরও প্রস্ফুটিত হয়েছিল সমৃদ্ধিতে। মিডল আর্থের আত্মার জন্য তখন এলফ ও মানুষেরা একত্রে যুদ্ধ করেছিল। তবে নতুন এ সিরিজের লেখকদের শো-এর স্বার্থে অনেক কিছুর পরিবর্তন আনতে হয়েছে।
দ্য রিংস অভ পাওয়ার প্রকাশের পর হয়তো এ নিয়ে বিতর্ক তৈরি হতে পারে; এমনটা আগেই ধারণা করা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত তা-ই হলো। টোলকিনের অনেক ভক্ত সিরিজটি পছন্দই করেননি। সমালোচকেরা এটির প্রশংসা করলেও ভক্তরা মনঃক্ষুণ্ণ। অনেকে দাবি করেছেন, মূল লর্ড অভ দ্য রিংস-এর নির্যাস ধরে রাখতে পারেনি রিংস অভ পাওয়ার। সিরিজের কয়েকজন অভিনেতার জাতিগত পরিচয় নিয়েও ঘৃণা প্রকাশ করা হয়েছে এসব রিভিউতে। বাধ্য হয়ে প্রাইম ভিডিওতে রিভিউ বন্ধ করে রেখেছে অ্যামাজন।
শোনা যাচ্ছে, এখন পর্যন্ত তৈরি করা সবচেয়ে বেশি বাজেটের টেলিভিশন সিরিজ এটি। প্রথম দুই এপিসোডে তা-ই যেন প্রমাণ করলো ভিজ্যুয়াল কাজগুলো। এছাড়া দর্শক সবধরনের চিত্তাকর্ষক ও সিনেম্যাটিক বিষয়গুলো দেখতে পাবেন এটিতে। এ সিরিজে এসবের পাশাপাশি সুপ্রাচীন সব সাহিত্য থেকেও কিংবদন্তি, মিথ ইত্যাদির উপস্থিতি দেখা যাবে।
জার্মান কম্পোজার রিচার্ড বাগনারের অপেরা রিং অভ দ্য নিবেলাম দ্বারা জে. আর. আর. টোলকিন অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন বলে ধারণা করা হয়। জার্মান কম্পোজার বাগনার তার অপেরা লেখার প্রায় শত বছর পরে টোলকিন ১৯৩৭ সালে দ্য হবিট লিখেছিলেন। রিং অভ দ্য নিবেলামের থেকে লর্ড অভ দ্য রিং অনুপ্রাণিত; এ কথা মানতে নারাজ ছিলেন খোদ টোলকিন। প্রকাশকদের কাছে টোলকিন লিখেছিলেন: 'দুটো আংটি দেখতে গোলাকার আর দুটোর মধ্যে মিল কেবল এতটুকুই।' তবে দুটো আংটিরই ক্ষমতা, নেতিবাচক প্রভাব ইত্যাদি বিষয়গুলোতেও মিল ছিল।
সবাই অবশ্য একটা ব্যাপারে নিশ্চিত: বাগনার ও টোলকিন দুজনই একই উৎস থেকে তাদের কাজের উৎসাহ পেয়েছিলেন। এ উৎসের মধ্যে প্রধান ছিল নর্ডিক প্রাচীন বীরত্বপূর্ণ কাহিনীগুলো। যুক্তরাজ্যে ১৯ শতকের পরে ভাইকিংসদের নিদর্শনগুলো পুনরুদ্ধার করতে শুরু করেন প্রত্নতাত্ত্বিকেরা, একইসময়ে তাদের নিয়ে গবেষণাও শুরু হয় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে। নর্স মিথোলজি ও অন্যান্য ইতিহাস বিষয়ে দেশটির মানুষের আগ্রহ ওঠে তুঙ্গে।
নর্ডিকদের নিয়ে ইংরেজরা সে সময় এতই মেতে উঠেছিলেন যে, একটা সময় দাবি করা হয় রানি ভিক্টোরিয়া ছিলেন নর্স দেবতা ওডিনের বংশধর, ও হ্যানোভারিয়ান রাজপরিবারের পুরোটা ছিল ভাইকিং রাজা র্যাগনার লথব্রকের সঙ্গে সম্পর্কিত। টোলকিন জন্মেছিলেন ১৮৯২ সালে। তাই বাল্যকালেই এ নর্ডিকজ্বরের আঁচ লেগেছিল তার ওপরে। ছোটবেলায় টোলকিন অ্যান্ড্রু ল্যাং-এর লেখা রেড ফেইরি বুক পড়ে ড্রাগন-বধক সিগার্ডের গল্পে মজেছিলেন।
'বার্মিংহামের কিং এডওয়ার্ড স্কুলে পড়ার সময়ই টোলকিন নর্স বীরগাথাগুলো মূল ভাষায় (মধ্যযুগীয় আইসল্যান্ডিক) পড়তে শুরু করেন। ১৯১১ সালে এ বিষয়ে একটি লেখাও লিখেছিলেন তিনি,' বলেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টোরাল গবেষক গ্রেস খুরি। অক্সফোর্ডে প্রথমে ধ্রুপদী বিষয়াদি পড়েছিলেন টোলকিন। পরে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে চলে যান। তখনই স্যার গাওয়াইন, গ্রিন নাইট ইত্যাদির মতো আর্থারিয়ান মিথ ও কিংবদন্তির সঙ্গে পরিচয় ঘটে তার।
টোলকিনের প্রথম দিকে সংগ্রহ করা নর্স বীরগাথাগুলোর মধ্যে একটি ছিল ভলসুংগা। তখন কেবল ইংরেজিতে এর একটাই অনুবাদ বের হয়েছিল। এই গাথায় একটি তরোয়াল ও অ্যান্ডভ্যারানট নামক একটি সোনার আংটির বিবরণ রয়েছে। নর্স দেবতা ওডিনেরও ড্রপনির নামক একটি আংটি ছিল। দুটো আংটিই তৈরি করেছিল ডর্ফেরা।
এসব গল্পে আংটিকে প্রায়ই ক্ষমতার মেটাফর হিসেবে ব্যবহার করা হতো। সামন্ততান্ত্রিক জার্মানিতে শাসকেরা তাদের বিশ্বাসভাজনদের পুরষ্কার হিসেবে নিজেদের আংটি দিতেন। সব আংটির উদ্দেশ্য আঙুলে পরা ছিল না। যেমন ইরবিগজা নামক আরেকটি নর্স বীরগাথায় বাহুর জন্য তৈরি করা একটি আংটি দেবতা ও মানুষদের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে দেখানো হয়েছে।
'টোলকিন ও তার সমসাময়িকদের কাছে নর্স বীরগাথাগুলো বিশেষ অর্থবহ ছিল। 'বীরত্ব, রাজপরিবারের বিষাদ, ও মহাপ্রলয়ের ইঙ্গিত; নর্স সাহিত্যের এই চিহ্নগুলো টোলকিন ও তার সমকালের অন্যদের কাজের মধ্যেও দেখা যায়। বিশেষত, তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে সাম্রাজ্য, রাজবংশগুলো ভেঙে পড়ছিল,' বলেন খুরি। তাই টোলকিনদের ওপর এসবের প্রভাব কেবল আংটি প্রতীকে সীমাবদ্ধ থাকেনি। গ্যান্ডালফের মধ্যে ওডিনের ছায়া দেখতে পান অনেকে। গ্যান্ডালফ এবং ডুরিন, থোরিন, ফিলি, কিলি, ওকেনশিল্ড ইত্যাদি ডর্ফের নাম টোলকিন নিয়েছিলেন আরেকটি নর্স মিথোলজিক্যাল কাব্য ভোলুসপা থেকে।
লর্ড অভ দ্য রিংস-এর প্রোটাগনিস্ট চরিত্র ফ্রোডো ব্যাগিনসের নামের উৎপত্তিও ওল্ড নর্সের 'ফ্রোডোর্' (fróðr) এবং ওল্ড ইংলিশের ফ্রোডা (জ্ঞানী) থেকে। বানানের ক্ষেত্রে টোলকিন ব্যবহার করেছেন ওল্ড ফ্রিজিয়ান পদ্ধতি। ড্যানিশ রাজা ফ্রোডি ছিলেন লোভী, তিনি দুটো দানবীকে বন্দি করে রেখেছিলেন যেন তারা তার জন্য সোনা তৈরি করে। ফ্রোডোকেও আমরা দেখি একসময় দ্য ওয়ান রিং-এর জন্য লোভী হয়ে উঠতে।
টোলকিনের জীবনীকার জন গার্থ মনে করেন টোলকিন ছিলেন একজন মাস্টার সিনথেসিস্ট। 'মানুষ মনে করে টোলকিন কেবল নর্ডিক মিথ থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। আদতে তিনি সর্বত্র থেকে নিয়েছেন। মধ্যযুগের রাজা আলেকজান্ডারের, ও মিশরীয় স্থাপত্যের কিংবদন্তির ছোঁয়া আছে মিডল-আর্থের রাজ্য গন্ডরে। নুমেনরের জন্য তিনি সাহায্য নিয়েছিলেন আটলান্টিস মিথের।
প্লেটো'র রিপাবলিক গ্রন্থে দ্য রিং অভ জাইজিস নামক একটি আংটির কথা পাওয়া যায়। টোলকিনের আংটির মতোই এ জাইজিসের আংটি কেউ পরলে তিনি অদৃশ্য হয়ে যেতেন। ১৯২৮-'২৯ সালে যুক্তরাজ্যের ফরেস্ট অভ ডিন-এ একটি রোমান-কেল্টিক প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানে খোঁড়ার কাজে অংশগ্রহণ করেছিলেন টোলকিন। তখন ওই কিংবদন্তিতে আকৃষ্ট হয়েছিলেন তিনি। এছাড়া লাতিন অনেক পাণ্ডুলিপিও পড়েছিলেন টোলকিন।
অন্য সংস্কৃতি থেকে কোনো শৈল্পিক উপাদান ধার করার ক্ষেত্রে সতর্কতার প্রয়োজন। বিশেষত মূল সংস্কৃতির যেন কোনো অবমাননা না হয়, তার খেয়াল রাখতে হয়। আর এ অনুপ্রেরণা গ্রহণ করে যা তৈরি করা হবে, সেটাও সুচারুরূপে নির্মাণ করতে হবে। টোলকিন এই সবগুলো শর্তে পাস করে গেছেন। তিনি এত সুদক্ষভাবেই বিভিন্ন উৎস থেকে উপাদান গ্রহণ করেছেন যে এখন তার সৃষ্টি নিজেই কিংবদন্তিতুল্য হয়ে উঠেছে।
সূত্র: বিবিসি