আমি যখন লিখি, আমার অস্তিত্ব আছে, তেমনি অস্তিত্ব আছে আমার সম্প্রদায়েরও: রোহিঙ্গা কবি
রোহিঙ্গা কবি মাইয়ু আলি'র বয়স ৩১ বছর। ২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসার পর এখনো নিজের লেখালেখি বাঁচিয়ে রেখেছেন তিনি।
'জান্নাত ও জাহান্নাম, এ দুই দুনিয়াকে কেন্দ্র করে ঘোরে পৃথিবী। আমি একটাকে ছেড়ে এসেছি আরেকটার সন্ধানে।' ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কানাডা'র অন্টারিওতে নিজের ফ্ল্যাটের দরজা দিয়ে স্ত্রী-কন্যাকে নিয়ে প্রবেশ করার সময় এ লাইনগুলো লিখেছিলেন মাইয়ু আলি। এর আগে কক্সবাজারে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবিরে চার বছর কাটিয়েছিলেন তিনি।
সাত লাখ রোহিঙ্গার সঙ্গে দেশ ছেড়েছিলেন মাইয়ু আলিও। পাঁচ বছর পর গত ৬ সেপ্টেম্বর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্য নিয়ে পড়ালেখা শুরু করেছেন তিনি। কিশোর বয়স থেকেই তিনি রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের মুখপাত্র হতে চেয়েছিলেন, ইচ্ছে ছিল লেখক হওয়ারও। ইতোমধ্যে তার কয়েক ডজন কবিতা, এবং অতিসম্প্রতি ফরাসি ভাষায় তার অটোবায়োগ্রাফি 'লিফাসমঁ'ও প্রকাশিত হয়েছে। বইটি তিনি লিখেছেন সাংবাদিক এমিলি লোপেজের সঙ্গে।
'বৈষম্য, লড়াই, সহিংসতা... আমি সব দেখেছি, অভিজ্ঞতা হয়েছে সবগুলোর। এখন আমার কর্তব্য হলো এগুলো নিয়ে বিশ্বকে জানানো,' কানাডা থেকে ফ্রান্স২৪ নামক একটি ফরাসি গণমাধ্যমের সঙ্গে এক আলাপচারিতায় বলেন আলি।
'মিয়ানমারের সরকারের দৃষ্টিতে আমার কোনো অস্তিত্ব নেই'
আরাকানের মংড়ুতে ১৯৯১ সালে জন্ম আলি'র। বাবা ছিলেন জেলে, ছয় সন্তানের মধ্যে আলিই সবার ছোট। 'ছোটবেলা আনন্দেই' কেটেছে আলি'র। নিজের বৌদ্ধ ও হিন্দু বন্ধুদের সঙ্গে খেলে, নদীতে ঝাঁপাঝাপি করে সময় কাটত তার।
'কিন্তু সে আনন্দ ফিকে হয়ে ভয়ে রূপ নিল,' আলি বলেন। ১৯৮২ সালের মায়ানমারের নাগরিক আইনের কারণে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রোহিঙ্গারা রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়ল। 'বয়স তখন ১০, একদিন আমার গ্রামের সব রোহিঙ্গাদের বাড়িতে হামলা চালাল সেনাবাহিনী। আমাদের বাড়িও বাদ পড়ল না,' স্মরণ করেন আলি। 'তাদের কাছে একটা বন্দুক ছিল, দেখতে ভীষণদর্শন। যখন আমি জানতে পারলাম তারা আমার বৌদ্ধ ও হিন্দু বন্ধুদের বাড়িতে যায়নি, তখনই বুঝলাম আমরা বিভাজনের শিকার।'
'আমার ভাইকে মেরে জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিল সে নাকি বাড়ির ট্যাক্স দেয়নি। আমার দাদা'র জমিও কেড়ে নেয় সরকার। আমার আশেপাশের মানুষদের কাজে করতে অকারণে বাঁধা দেওয়া হয়,' বলেন আলি।
জাতিগত কারণে ২০১০ সালে আলিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি পড়া থেকে নিষিদ্ধ করা হয়। হাইস্কুলে থাকতে শেকসপিয়ার ও রবীন্দ্রনাথের প্রতি আগ্রহ জন্মেছিল তার। তারও আগে থেকে গোপনে লেখালেখি করতেন আলি।
'প্রথমে প্রকৃতি, বন্ধুত্ব, পরিবার ইত্যাদি নিয়ে লিখতাম। পরে ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম, লেখা দিয়ে বিদ্রোহও প্রকাশ করা যায়। আমি রোহিঙ্গা, বার্মিজ সরকারের কাছে আমার কোনো অস্তিত্ব নেই। আমি এমন একজন মানুষ যার কোনো মানবাধিকার, নাগরিকত্ব নেই। কিন্তু যখন আমি লিখি, তার মাঝেই আমি বাঁচি, বাঁচে আমার সম্প্রদায়ও,' বলেন আলি।
২০১২ সালে আরাকানে যখন রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচারের মাত্রা বেড়ে গিয়েছিল, তখন মাইয়ু আলি ইংরেজি ও বার্মিজ ভাষায় লিখতেন। কয়েক মাস পরে ইংরেজিভাষী বার্মিজ একটি ম্যাগাজিনে তার একটি কবিতা প্রকাশিত হয়। 'মনে হলো আমার পুনর্জন্ম হয়েছে। হঠাৎ করে আমি মানুষের কাছে পরিচিতি লাভ করলাম,' বলেন আলি।
ঘটনাটিকে 'টার্নিং পয়েন্ট' হিসেবে অভিহিত করেছেন তিনি। 'রোহিঙ্গাদের সবসময় বৈষম্য করা হতো, কিন্তু এরপর কর্তৃপক্ষ তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চাইল।' আলি'র এখনো সহিংস দাঙ্গা, ভয়ানক আগুন, প্রথম ধ্বংস হওয়া গ্রাম, বাংলাদেশে পালিয়ে আসা প্রথম মানুষদের কথা স্পষ্ট মনে আছে। কিন্তু আলি ঠিক করেন, তিনি থেকে যাবেন স্বদেশে। কাজ করবেন স্থানীয়দের জন্য।
আলি'র যত লেখা
কিন্তু সবকিছু বদলে যায় ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট। তখন পৈতৃক বাড়ির বাইরে মংড়ুতে বাস করছিলেন আলি। সেদিন মায়ের ফোনে তার ঘুম ভাঙে। কান্নাজড়ানো কণ্ঠে তার মা তাকে জানান, সেনাবাহিনী গ্রামে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে, সব ধ্বংস হয়ে গেছে। পরবর্তী দিনগুলোতে আলি যা প্রত্যক্ষ করেছেন, তাকে 'জাতিগত নিধন' হিসেবে বর্ণনা করেছেন তিনি।
বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার জন্য তিন দিন ধরে হাঁটতে হয়েছিল আলিদেরকে। যে নদীতে একসময় খেলেছিলেন, সেটাতে ভেসে যাওয়া লাশের পাশাপাশি সাঁতার কাটতে হয়েছিল তাকে। বর্তমানে রোহিঙ্গারা ২৫ আগস্টকে সহিংসতার দিন হিসেবে মনে রাখে।
কক্সবাজারে শরণার্থীজীবনেও লেখা চালিয়ে গিয়েছিলেন আলী। বিভিন্ন মানবিক সংস্থা ও সাংবাদিকদের গাইড হিসেবে কাজ করার সুবাদে অনেক রোহিঙ্গার অভিজ্ঞতার কথা সরাসরি শোনার অভিজ্ঞতা হয় তার। নিজের নোটবুকে সবকিছু লিখে রাখেন। তার আশা কোনো একদিন এ লেখাগুলো ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে সাহায্য করবে।
তার এসব কাজের কারণে ক্যাম্পের ভেতরে থাকা সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা তাকে হত্যার হুমকিও দিয়েছিল। 'কয়েকমাস লুকিয়ে ছিলাম,' বলেন তিনি। তবে এসব হুমকির কারণেই বাংলাদেশ ছেড়ে কানাডা যাওয়াটাও সহজ হয়ে গিয়েছিল তার জন্য।
রোহিঙ্গা সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা
আলি'র মা-বাবা ও ভাইবোন এখনো কক্সবাজারের শিবিরেই আছেন। তাদের কাছ থেকে তিনি জানছেন, শরণার্থী শিবিরের অবস্থা দিনে দিনে আরও খারাপ হচ্ছে। আলি এখনো অন্যদের সহায়তা করতে চান।
রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচারকে 'গণহত্যা' হিসেবে স্বীকৃতি দিতে যেমন লবিং করছেন, তেমনিভাবে ক্যাম্পের শরণার্থী শিশুদের লেখাপড়ার সুযোগা করে দিতেও কাজ করছেন আলি। স্থানীয় সংস্থাগুলোর সহায়তায় দুটো স্কুল তৈরি করেছেন আলি। সেখানে বার্মিজ কারিকুলামে শিশুদের পাঠদান করা হয়।
'রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার নিয়ে কথা উঠলে আমরা কেবল শারীরিক নিগ্রহ ও সহিংসতার কথা ভাবি। কিন্তু আমাদের সংস্কৃতি ও ভাষাও আক্রমণের শিকার,' বলেন আলি। 'শরণার্থী হওয়ার কারণে আমরা আমাদের সাংস্কৃতিক মূল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছি। আমাদেরকে এর বিরুদ্ধে লড়তে হবে। কেবল সংস্কৃতি বাঁচলেই আমাদের জাতিগত পরিচয় টিকে থাকবে।
অবসরটা লেখালেখিতেই কাটান আলি। বিভিন্ন দেশে নিজের লেখা প্রকাশিত হবে, এটা তার চাওয়া। একইসঙ্গে নিজের সম্প্রদায়ের জন্যও কাজ করে যাবেন মাইয়ু আলি।