মনিপুরী গ্রামে থাকা-খাওয়া-ঘোরাঘুরি: চা বাগান, পাহাড় ও লেক সন্নিবিষ্ট যে গ্রাম ম্যাপে নেই
গুগল ম্যাপে আদমপুর পাওয়া গেলেও ভানুবিলের কোনো হদিস মিলল না। সঙ্গে কোনো গাইড নেই। কমলগঞ্জ ভানুগাছ বাজার থেকে আদমপু্রের মনিপুরী গ্রামে যাওয়ার কথা বলে রাজ্জাক ভাইয়ের সিএনজিতে ওঠা। বেলা তখন ১২টা। সামনে ঘণ্টাখানেকের পথ। দূরত্ব কিছুটা বেশি হলেও রাস্তা বেশ ভালো।
জানা গেল সাবেক বিচারপতি এস কে সিনহার বদৌলতে মিলেছে এই রাস্তা। সিনহা সাহেব বিষ্ণুপ্রিয়া সম্প্রদায়ের লোক। আর আমরা যেখানে যাচ্ছি সেটা মেইতেই সম্প্রদায়ের গ্রাম। মেইতেইদের আদিনিবাস কংলৈপাক যেটা কিনা এখন ভারতের মনিপুর রাজ্য। এই আদমপুরে আছে ১৪টি মেইতেই গ্রাম, যার একটি ভানুবিল মাঝেরগাঁও আমাদের আজকের গন্তব্য।
সিলেটের মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলাটি ভারতের সীমান্তবর্তী। পথে যেতে যেতেই ত্রিপুরার পাহাড়গুলো চোখে পড়বে। মাত্র কয়েক মাস আগেই চালু হয়েছে সীমান্ত হাট। মসৃণ রাস্তার দুধারে সারি সারি আকাশমনি আর দুপাশে ধানখেত ও জলাশয়।
আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা প্রকৃতির রূপ যেন আরও বহুগুণে বাড়িয়েছে। রাজ্জাক ভাই আশ্বস্ত করলেন, এরকম মেঘ প্রায়ই গুমোট মুখে হাজির হলেও শেষমেষ আর বৃষ্টি হয় না।
আদমপুর বাজার আসার পরই ভানুবিল মাঝেরগাঁওয়ের পথনির্দেশক কমিউনিটি টুরিজমের বেশকিছু সাইনবোর্ডের দেখা মিলল। এবার আর হারিয়ে যাওয়ার ভয় নেই। নিরঞ্জনদার সঙ্গে আগেই ফোনে কথা হয়েছিল। নিরঞ্জনদা মানে নিরঞ্জন সিংহ রাজু, ভানুরবিল মাঝেরগাঁও কমিউনিটি বেইসড ট্যুরিজমের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক। দুপুরে তাঁর বাড়িতেই খাওয়ার ব্যবস্থা।
বর্তমানে গ্রামে যে তিনটি বাড়িতে হোমস্টের ব্যবস্থা আছে, তার একটি নিরঞ্জনদার বাড়ি। ঢোকার মুখে বাঁশের তোরণের প্রধান ফটক পার করলে হাতের বাম পাশে বাঁশ ও ছনের দুটি ছাউনি। দেখেই মনে হলো বিকেল বেলা চা নিয়ে আড্ডা জমানোর দারুণ এক জায়গা।
ইট বিছানো রাস্তা ধরে এগিয়ে যেতেই নিরঞ্জনদা হাসিমুখে এগিয়ে এলেন। দাদা ভীষণ আন্তরিক একজন মানুষ। তাঁর সঙ্গে ভেতরে ঢুকতে বড় এক হল ঘর সামনে পড়ল। এখানেই অতিথিদের বসার ব্যবস্থা। এই ঘরের এক পাশে মনিপুরী কাপড় বোনার ড্রাম থেকে শুরু করে চরকা-তাঁত সবকিছু রাখা।
ভেতরে অবশ্য আগে থেকেই কয়েকজন উপস্থিত আছেন। বুয়েটের আর্কিটেকচার বিভাগের তিন শিক্ষার্থী এসেছেন মনিপুরী তাঁত নিয়ে সার্ভের কাজে। দলটির সঙ্গে সকালে শ্রীমঙ্গলে পানসীতে নাস্তা করার সময়ও দেখা হয়েছিল। বেশ ধৈর্য নিয়ে তাদের সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলেন নিরঞ্জনদার ছেলে প্লাবন। মজার কাণ্ড হলো প্রসঙ্গক্রমে জানা গেল আমরা সবাই একই ব্যাচের শিক্ষার্থী।
আমার আগ্রহ ছিল মনিপুরী রান্না নিয়ে। তাই তাদের কাজে আর বিরক্ত না করে রান্না চলছে কি না জানতে চাইলাম। প্লাবন জানালেন ভেতরে তার মা রান্না করছেন। বাড়ির কত্রী নিজ হাতে এতগুলো মানুষের জন্য রান্না করছেন শুনে যে একটু অবাক হইনি তা নয়।
রান্না দেখার অনুমতি নিয়ে ভেতরে যেতে যেতে পুরো বাড়িও দেখা হয়ে গেল। নিরঞ্জনদা কমিউনিটি বেইজড টুরিজমের ব্যাখ্যা দিয়ে বললেন, এ ধারার পর্যটনের মূল জায়গাটি আন্তরিকতা। এখানে কমিউনিটির সদস্যদের সঙ্গে একই পরিবারের সদস্য হয়ে থাকা-খাওয়ার মাধ্যমে নিবিড়ভাবে মনিপুরী সংস্কৃতি, খাদ্যাভাস, বুনন ও বিভিন্ন রীতিনীতি সম্পর্কে জানতে পারার সুযোগ পান অতিথিরা।
নিরঞ্জনদার স্ত্রী সু্নীতি দেবী একাহাতেই সব রান্না করছিলেন। সুনীতিদির চোখেমুখে মাতৃস্নেহের প্রবল এক ভাব। আমাকে আপন করে নিতে তাঁর মুহূর্তও লাগল না। চুলায় এক ধরনের লাল পাতা ফুটছিল। জানা গেল এটা হেইনা পাতার চা। দিদি জানালেন এই চা কাঁচামরিচ, লবণ, চিনি দিয়ে খেতেও বেশ মজা।
দুপুরের খাবার সম্পূর্ণ মনিপুরী রীতিতে রাঁধা। এই রান্নায় পেঁয়াজ, রসুন, আদার ব্যবহার নেই। মনিপুরীরা সাধারণত মশলা হিসেবে বিভিন্ন সবুজ পাতা ও গুল্ম ব্যবহার করে থাকে। নিরঞ্জনদা আমাকে তেমনই কিছু পাতা দেখালেন। তনিংঘক, জেনুম পাতা, তুলসী পাতা, শিউলি ফুলের পাতা, লেবু পাতা কত যে নাম। সবজি মশলা নামেও আছে এক ধরনের পাতা। রান্নার ঠিক আগে সতেজ পাতাগুলো সংগ্রহ করা হয়।
দিদি জানালেন, মানুষ বেশি হলে টুরিজম কমিটির নারীরা এসেও রান্নার কাজে সাহায্য করে। পাকোড়ার জন্য পাঁচফোড়ন আর জেনুম পাতার ফোড়ন দিতে দিতে সুনীতিদি বিয়ের পর তার বাংলা শেখা, নিরঞ্জনদার স্বর্ণের দোকানে ডাকাতির ধাক্কা সামলে ওঠার গল্পগুলো শোনালেন।
আমার খুবই জানার আগ্রহ ছিল ঘরে মানুষ আসে দেখে উনার কোনো সমস্যা হয় কি না। দিদি জানালেন সেরকম সমস্যা হয় না। মানুষ বাইরে ঘুরতেই পছন্দ করে। সুনীতিদি যদিও সদা হাস্যোজ্জ্বল, তবু বেশ কিছুক্ষণ ধরেই মন খচখচ করছিল যে এভাবে ঢুকে পড়ে তাকে কোনো অস্বস্তিতে ফেললাম কি না। বলেই ফেললাম, আমি যে এভাবে ঢুকে পড়েছি? দিদি এবার হেসে ফেললেন। বললেন- তুমি তো আমার মেয়ের মতো, এসে খুব ভালো করেছ।
এতসব গল্পের ফাঁকে হেইনা চা আর মোয়া খেয়ে নিলাম। ইরম্বার জন্য বাসপাতি শুঁটকি পোড়ানো দেখতে দেখতেই শুনলাম মেইতেইদের নিরাকার ঈশ্বরের ধর্মাচার আর নানা সংস্কারের কথা। মনিপুরী পরিবারের সংস্কারগুলোর একটি হলো শৌচালয় বাড়ি থেকে আলাদা থাকা। প্রাতকার্য সেরে গোসল করে তবেই ঘরে ঢোকা যায়।
এখনকার অধিকাংশ মনিপুরী পরিবার অবশ্য এসব বিষয়ে বেশ নমনীয়। এখনও দেখা গেল শৌচাগারগুলো ঘরের বাইরে। তবে অতিথিদের সুবিধার জন্যই হলঘরের সঙ্গে গেস্টরুমে এটাচড বাথ জুড়ে দেওয়া হয়েছে।
নিরঞ্জনদার কাছে জানতে চাইলাম এখানে কেমন মানুষ আসে। জানা গেল শুক্র-শনিবার সাধারণত নিয়মিত বুকিং থাকেই। খরচের বিষয়ে তিনি বললেন থাকা-খাওয়াসহ দৈনিক খরচ পড়ে ১,৯৫০ টাকা। নিরঞ্জনদার বাড়িতে থাকার জন্য এখন তিনটি বেডের ব্যবস্থা রয়েছে।
হোমস্টের জন্য অতিথিদের সারাদিন থাকার পরিকল্পনা বেশ সুন্দরভাবে গুছানো রয়েছে। এরমধ্যে রাত্রিযাপন ও মনিপুরী খাবারের ব্যবস্থা ছাড়াও মনিপুরী গ্রামগুলো ঘুরে দেখা, স্থানীয়দের সঙ্গে সাক্ষাৎ, মনিপুরী তাঁত বুননের কৌশল, চা বাগানে চা তোলা দেখার সুযোগও মিলবে। এর বাইরে আগত অতিথিরা মনিপুরী নাচগানও উপভোগ করতে পারেন, তবে এর জন্য বাড়তি কিছু যোগ করতে হবে। তাছাড়া এর জন্য আগে থেকে পোশাক ঠিক করাসহ বিশেষ প্রস্তুতিরও প্রয়োজন পড়ে।
এখানে থাকাকালে চা তোলা দেখতে হলে সকাল সকাল উঠতে হবে। মাঝেরগাঁও থেকে কামারছড়া চা বাগানের দূরত্ব মাত্র মিনিট দশেকের। বিশেষ সব মনিপুরী চা খাওয়ার সুযোগও মিলবে।
দুপুরে খাওয়ার সময় কথা হলো শুভ আর অদিতির (ছদ্মনাম) সঙ্গে। ছুটি কাটাতে এখানে তাদের ঘুরতে আসা। এখানকার দারুণ অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিলেন তারা। খেতে খেতেই বিকেলে নিরঞ্জনদার সঙ্গে পাঙনদের পাড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনাও করে ফেললেন।
দুপুরের খাবারের তালিকায় ছিল আলুর বড়া, ইরম্বা, ডুজমানা পাতার ফ্রাই, কালাই ডাল সেদ্ধ করা আতাওবা হিংজাং পাকোড়া, উতি, টক জলপাই আর রুইমাছ। খাবারের স্বাদ বাঙালি রান্নার থেকে স্পষ্টতই ভিন্ন। রান্নার স্বাদ মুখে লেগে থাকার মতো। অন্তত জীবনে একবার হলেও এই রান্না চেখে দেখা উচিত বলেই আমার অভিমত।
শুভ জানালেন তিনি এর আগেও গেস্ট হিসেবে পাহাড়ি বম সম্প্রদায়ের সঙ্গে থেকেছেন। কিন্তু কমিউনিটি বেইজড পর্যটন হলেও পরিবেশিত খাবারে বম রান্নার চেয়ে বাঙালি রান্নাই ছিল বেশি। এর কারণ ব্যাখ্যা করলেন নিরঞ্জনদা।
বমদের পাহাড়ি রান্নার সঙ্গে বাঙালি রান্নার পার্থক্য খুব বেশি। স্বল্প মশলার সেদ্ধ খাবার বাঙালি পর্যটকরা খেতে চান না। তাই পর্যটকদের উপযোগী খাবারই পরিবেশন করতে হয়।
আমার মনে হলো কমিউনিটি বেইজড টুরিজমের এটাই মূল সমস্যা। পর্যটন উপযোগী ফিউশন আনতে গিয়ে অনেক সময় ঐতিহ্যবাহী রন্ধনশৈলীর বিশুদ্ধতা নষ্ট হয়। মনিপুরী খাবারের ক্ষেত্রেও এমন ঝুঁকি আছে কি না এই প্রসঙ্গে দাদা বললেন, মনিপুরীরা সমতলের অধিবাসী হওয়ায় মনিপুরী রান্নার রীতিনীতি অনেকটাই বাঙালিদের কাছাকাছি। তবে মশলার ব্যবহার পুরোপুরি ভিন্ন হওয়ায় স্বাদ একদমই অন্যরকম।
খাওয়া শেষে তাকে সাজানো মনিপুরী কাপড়গুলো দেখছিলাম। হোমস্টে ছাড়াও নিরঞ্জনদা বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের সঙ্গে কাজ করেন। আদমপুর ইউনিয়ন ২ নং ওয়ার্ডের নারীদের তাঁতী সমিতির পরিচালক তিনি। তার বাড়িতেই আছে তারেং মনিপুরী হ্যান্ডলুম এন্ড ক্রাফট রিসার্চ সেন্টার। এখানে তাঁতীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ছাড়াও মনিপুরী প্রথাগত বুনন ও নকশাগুলোর মধ্যে নতুনত্ব আনা ও হারাতে চলা বিভিন্ন নকশার পুনরুদ্ধারে কাজ করা হয়।
তারেং ছাড়াও ফ্যাশন ডিজাইনে পড়া প্লাবনের আছে নিজস্ব ফ্যাশন হাউজ যেখানে তিনি মনিপুরী ডিজাইনার শাড়ি, ওড়না, শাল ও পাঞ্জাবির নকশা করেন। ফেসবুকে প্ল্যাব অন প্রডাকশন পেইজটিতে ঢু মারলেই মিলবে এসব পণ্য।
মনিপুরী তাঁতের কাজ সম্পর্কেও প্লাবনের মুখেই শোনা। প্রথমে ড্রামে তুলে সুতা টানা হয়। শাড়ি, ওড়না, চাদর, গামছা সবই এই ড্রামে টানা হয়। এরপর এগুলো উঠে তাঁতে। সেখানেই মূল কাপড়টি বুনা হয়ে থাকে। ড্রামে তোলা ৫৭-৫৮ ইঞ্চির শাড়ি বুনন শেষে ৪৫ ইঞ্চিতে নেমে আসে।
ট্যুরিজমের ইতিহাস শুনতে গিয়ে জানলাম ২০১১ সাল থেকেই এখানে কমিউনিটি ভিত্তিক পর্যটন নিয়ে কাজ শুরু হয়। তবে কার্যকরভাবে তা চালু হয় ২০১৪-১৫ সালের দিকে। শুরুতে জাপানিজ ও বিদেশি অতিথিরাই বেশি আসতেন। বাংলাদেশ পর্যটন বোর্ড ও আজিয়ার ফেয়ার ট্রেড পর্যটন সংস্থার উদ্যোগে দুবার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করা হয়। পল্লী কর্মসহায়ক সংস্থাও পর্যটন বান্ধব পরিবেশ নির্মাণে পৃষ্ঠপোষকতা করে।
প্লাবন জানান, করোনার পর থেকে এখানে বাঙালি পর্যটকদের আনাগোনা বাড়ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পর্যটক সপরিবারে আসেন। এর বাইরে শিক্ষার্থীদের সংখ্যাও বেশি। স্রেফ ছুটি কাটানোর চেয়ে এখানে মানুষ মনিপু্রী জীবনের অভিজ্ঞতা আস্বাদন করতে আসেন বলেই মনে করেন প্লাবন।
তবে এই পর্যটন ব্যবস্থা স্থানীয়দের সবাই যে সন্তুষ্ট তা নয়। কমিউনিটি বেইজড টুরিজমের বিষয়টি স্থানীয় নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করলেও তা নিয়ে মনিপুরী সমাজেই আছে বহু দ্বন্দ্ব। এ ধারার পর্যটন ব্যবস্থা সংস্কৃতিগত সংকরায়নের সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলে। কিন্তু বিশ্বায়নের সংস্পর্শে এসে হোমোজেনাইজড হওয়ার ভয়টি শুধু মনিপুরী নয়, বাঙালি বা অন্য জাতিগোষ্ঠীর জন্যও সমানভাবে প্রযোজ্য। কিন্তু জাতিগত বৈচিত্রের মনিপুরীদের জন্য ঝুঁকিটা যে বেশি তা বোঝা কঠিন নয়।
বাংলাদেশের জাতিগত বৈচিত্র্যের মানুষদের সংরক্ষণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিই সম্ভবত ভূমি। ভূমির সঙ্গে মানুষের সংশ্লিষ্টতাই সম্ভবত বহিরাগতদের পুনর্বাসন রোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায়। আদমপুরের মনিপুরী গ্রামগুলোতে এখন শিক্ষার হার অনেক। এখানকার গ্রামগুলো থেকে সরকারি চাকরি, আর্মি ও বিডিআরে যোগদানের প্রবণতা বেশি বলে জানালেন প্লাবন। আর তাই কৃষির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতাও দিন দিন কমছে। অথচ এই ভানুবিলেই সংঘঠিত হয়েছিল ব্রিটিশ ও জমিদার বিরোধী ঐতিহাসিক কৃষক বিদ্রোহ।
ইতিহাস বলে বর্মীদের বারবার আক্রমণের কারণেই মনিপুরীরা এই অঞ্চলে আসে। এখানে তাদের বসবাস সাড়ে ৪০০ বছরের বেশি সময় ধরে। একসময় তারা ভানুবিলের পতিত জমিকে আবাদযোগ্য করে তোলে। কিন্তু খাজনা নিয়ে জমিদার ও নায়েবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এখানকার কৃষকরা। তখন সাল ১৯৩১। সেই কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাস মিলে ভানুরবিলের পুঁথিতেও-
সাহেব বলেন প্রজাগণ বলি তোমাদের কাছে
ভানুবিলের বহু খাজনা বাকি পড়িয়াছে…
হুকুম করিয়া সাহেব দেশওয়ালি ডাকিয়া
পিলখানাতে মনিপুরী সব রাখ বান্দিয়া…
তবে বিদ্রোহের নায়ক সেই মনিপুরীদের মধ্যে বর্তমানে কৃষি কাজ কমলেও এখানে সরকারি উদ্যোগে এখানে বিষ ও সারমুক্ত কৃষির তিন বছরের প্রকল্প চলছে বলে জানান নিরঞ্জনদা।
কৃষিকাজ থেকে কিছুটা সরে আসলেও মনিপুরী তাঁতের ঐতিহ্য আজও অটুট। প্রতিটি মনিপুরী বাড়িতেই তাঁত থাকে বলেও জানান তিনি। মনিপুরী নারীরাই মূলত কাপড় বোনার কাজটি করে থাকে। প্লাবন জানান, অবসর সময়ে তাঁর মাও এখানে বসেই কাপড় বুনেন।
তারেংয়ের মাধ্যমে স্থানীয় মনিপুরী কাপড়গুলো সংগ্রহ করেও বাজারে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। সেই সংগ্রহ শালা দেখতে বসে নিজের জন্যও একখানা মনিপুরী শাড়ি কিনে ফেললাম।
বিদায়বেলায় নিরঞ্জনদা জানালেন আগামী ২৭ ও ২৮ সেপ্টেম্বর পর্যটকদের জন্য প্রথমবারের মতো বড় পরিসরে মনিপুরী মেলার আয়োজন হতে চলেছে। এই মেলায় মনিপুরী সংস্কৃতির নানা দিক দেখার সুযোগও মিলবে। মেলার অগ্রীম আমন্ত্রণও পেয়ে গেলাম। ফেরার পথে বারবার মনে হচ্ছিল এখানে এসে স্রেফ একবেলা ঘুরে চলে আসাটা ভারি অন্যায় হচ্ছে। ফের এলে গ্রামগুলো খুব ভালোমতো ঘুরে অন্তত একটি রাত কাটিয়ে যাব এই প্রতিজ্ঞা করে বাধ্য হয়েই ফিরতে হলো।