'অনেক বেশি ভুল করুন!' মাত্র চার শব্দে স্টিভ জবসের সফলতার মন্ত্র
সময়টা ছিল ১৯৮৪ সাল। এর বছরখানেক বাদেই, ১৯৮৫ সালে স্টিভ জবস আমেরিকান বহুজাতিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান 'অ্যাপল' ছেড়ে চলে যান। কিন্তু তার এক দশক পর তিনি ফিরে আসেন; অ্যাপলকে দেউলিয়া হওয়ার দ্বারপ্রান্ত থেকে বাঁচিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে দামী একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড় করানোর মাধ্যমে ব্যবসায়ের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী মোড় আনেন এই মার্কিন উদ্যোক্তা।
অ্যাপলের সিইও হিসেবে থাকাকালীন বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমের সামনে নিজের সফলতা ও কর্মপরিচালনা নিয়ে কথা বলেছেন স্টিভ জবস। তৎকালীন সময়ে সিলিকন ভ্যালির একজন সাংবাদিক মাইকেল মোরিটজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জবস বলেছিলেন, তার সফলতার পেছনে কোনো গোপন মন্ত্র বা বিশেষ প্রতিভা লুকিয়ে নেই, কিংবা পণ্যের নকশা করার ক্ষেত্রে কোনো বিশেষ পন্থাও নেই। বরং নিজের সফলতার পেছনে মাত্র ৪টি শব্দের ভূমিকা রয়েছে বলে জানিয়েছিলেন অ্যাপলের এই সহ-প্রতিষ্ঠাতা!
সেদিন জবস বলেছিলেন, "আপনি যত বেশি ভুল করবেন, আপনার কাজগুলো আরও পরিমার্জিত হবে। সে কারণেই আমি আমার কর্মক্ষেত্রে প্রচুর ভুল করেছি। কারণ ভুল করলে নিজের মধ্যকার নান্দনিকতাবোধ আরও বেশি জেগে ওঠে। কিন্তু সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো আমি সবসময়ই যা অনুভব করি- আপনি যদি কিছু বানাতে চান তাহলে সেটা সবচেয়ে সেরাভাবে বানাতে আপনার বাড়তি শক্তি বা টাকা প্রয়োজন হবে না। যা প্রয়োজন হবে তা হলো- সময়...এর বেশি কিছু নয়। আর হ্যাঁ, কাজটা করার ইচ্ছাও থাকতে হবে, যতক্ষণ না পর্যন্ত সেরা কাজ বের করে আনতে পারছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত অধ্যবসায় বজায় রাখতে হবে।"
স্টিভ জবসের এই কথা থেকে বোঝা যায়, একটি ভালো পণ্য তৈরি বা ব্যবসায়ে সফলতা আনতে চাইলে জবসের পরামর্শ অনুযায়ী, আপনাকে স্রেফ চারটি শব্দ দিয়ে শুরু করতে হবে। আর সেগুলো হলো- 'অনেক বেশি ভুল করুন'।
জবসের এই 'ভুল করার' দর্শনটি আবেগীয় দিক থেকে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেয়, কারণ এটি একজন মানুষের চিন্তাধারায় পরিবর্তন আনতে সাহায্য করে। কাজে ভুল করাকে অনেকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখলেও, এ প্রক্রিয়ায় ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান বা কোনো পণ্যকে উন্নত করার সুযোগ তৈরি হয়।
বিষয়টি আরো ভালোভাবে বোঝার জন্য অ্যাপলের ইতিহাসের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক।
২০০১ সালের দিকে, স্টিভ জবস যখন ইতোমধ্যেই অ্যাপলের খোলনলচে বদলে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন, তখন প্রতিষ্ঠানটি এক উভয় সংকটের মুখে পড়ে। তখন সবেমাত্র আইপড বাজারে এসেছে এবং রাতারাতি আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তাও পেয়ে গেছে। ফলে স্বভাবতই, অ্যাপলের ডিজাইনার ও নির্বাহী কর্মকর্তারা ভীষণ খুশি; কিন্তু তারা এও জানতেন যে তাদেরকে আরও দ্রুতগতিতে বিভিন্ন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে হবে।
কিন্তু কেন? কারণ এর পরবর্তী পদক্ষেপটি হওয়ার কথা ছিল মোবাইল ফোনের ভেতরে এমপি থ্রি প্লেয়ার সংযুক্ত করা। অন্য কোনো বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান এই পদক্ষেপটি নেওয়া ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র, যা আইপডকেই অচল করে তুলতো! কিন্তু এখানে আরও একটি সমস্যা ছিল এবং তা হলো- অ্যাপল তখনো মোবাইল ফোন তৈরি করেনি।
মার্কেট শেয়ার হারিয়ে ফেলার ভয়ে ডিজাইনাররা দ্রুত প্রথম অ্যাপল মোবাইল ফোনের প্রটোটাইপ তৈরির কাজে নেমে পড়েন। ডিজাইনারদের একজন, টনি ফ্যাডেল বিষয়টি ব্যাখা করেন এভাবে- "এটি একটি ফোন মডিউল সংযুক্ত আইপড। আপনি যদি এর মাধ্যমে কোনো নাম্বারে ডায়াল করতে চান, এটা অনেকটা রোটারি ডায়াল ব্যবহারের মতো দাঁড়াবে।"
কিন্তু স্টিভ জবস পুরো প্রজেক্টটি বাদ দিয়ে দেন এবং আবারও ড্রয়িং বোর্ডের দিকে এগিয়ে যান। ১৯৯৩ সালে অ্যাপল প্রথমবারের মতো 'অ্যাপল নিউটন' নামক একটি টাচস্ক্রিন ডিভাইস নির্মাণের যে উদ্যোগ নিয়েছিল (এবং সেসময় তা সুপার ফ্লপ হয়েছিল), সেই পরিকল্পনা আবারও ফিরিয়ে আনেন জবস। কিন্তু এরপরে কেটে গেছে একটি দশক এবং টাচস্ক্রিন গবেষণা খাতও ততদিনে অনেকটা অগ্রসর হয়ে গেছে। জবস পরিকল্পনাগুলোর দিকে এক নজর তাকিয়েই বললেন, "এটাই হয়তো মোবাইল ফোন'। এরপরে বাকিটা ইতিহাস!
এই গল্প থেকে জবসের দর্শনের গুরুত্ব ফুটে ওঠে; অর্থাৎ, অ্যাপলের তৈরি সবকিছু যে প্রথমবারেই সফলতা পেয়েছে এমনটা নয়। বরং সমালোচকরা বলেন, অ্যাপল সত্যিকার অর্থে কিছু উদ্ভাবন করেনি। কারণ ম্যাকই প্রথম কম্পিউটার ছিল না, আইফোন প্রথম স্মার্টফোন ছিল না এবং আইপ্যাডও প্রথম ট্যাবলেট ছিল না।
তবে নির্মাণের পেছনের গল্প যাই হোক, 'সবকিছু সঠিকভাবে তৈরি'র জন্য অ্যাপলের বিশেষ সুনাম রয়েছে। তারা ডিজাইন, পণ্যের কার্যকারিতা ও ব্যবহারকারীদের অভিজ্ঞতাকে পরবর্তী ধাপে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রতিনিয়ত নানা সৃজনশীল উপায় খোঁজে এবং সে অনুযায়ী পণ্য বাজারে আনে।
এবার চিন্তার পালা, স্টিভ জবসের 'চার শব্দের উপদেশ'কে আপনি কিভাবে নিজের ব্যবসায়ে কাজে লাগাবেন?
ধরুন আপনি একটি অনলাইন কোর্স বা অ্যাপ কিংবা কোনো পণ্য তৈরি করতে চান। সেক্ষেত্রে প্রথমেই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠানগুলো কী করছে তা নিয়ে বিশদভাবে জানতে হবে এবং তাদের পণ্যে কী কী দুর্বলতা বা ফাঁকফোকর রয়েছে তা খুঁজে বের করতে হবে। এবার ভাবতে হবে, আপনি কিভাবে নিজের পণ্য দিয়ে সেই শূন্যস্থান পূরণ করবেন? এই প্রশ্নটিকে সামনে রেখেই এগিয়ে যেতে হবে।
আপনি হয়তো নিজের পণ্যটি একেবারে নিখুঁতভাবে তৈরি করে বাজারে ছাড়ার জন্য অপেক্ষা করবেন। কিন্তু তা করা যাবে না। আপনি যতই গবেষণা-পরীক্ষা চালানো বা কাজের পুনরাবৃত্তি করুন না কেন, পণ্যটি কখনোই নিঁখুত হবে না। মনে রাখতে হবে, অ্যাপলের টাচস্ক্রিন নিউটন প্রজেক্ট পুরোপুরি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছিল; প্রথম আইফোনও আইফোন ২, ৩ বা আইফোন ১০ এর ধারেকাছেও ছিল না।
তারচেয়ে বরং যতটা সম্ভব সুন্দরভাবে একটি পণ্য তৈরি করে বাজারে আনতে হবে। এরপরে ব্যবহারকারীদের প্রতিক্রিয়ার ভিত্তিতে পণ্যের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে হবে এবং পণ্যটিকে দিন দিন আরও আধুনিক, আরও কার্যকরী ও ভোক্তাবান্ধব করে তুলতে হবে। বারবার নিজের পণ্য সংশোধন করতে হবে, যতক্ষণ না পর্যন্ত এটি সেরা হয়ে উঠছে ততক্ষণ পর্যন্ত ধৈর্য ধরে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
মনে রাখতে হবে- যে যাত্রা আপনি শুরু করেছেন, 'ভুল করা' সেই পথেরই সঙ্গী। যত বেশি আপনি ভুল করবেন, তত বেশি সংশোধন ও উন্নতির সুযোগ থাকবে। আর স্টিভ জবস যেমনটা বলেছেন...আপনার শুধু দরকার সময় এবং নিজের পণ্য বা প্রতিষ্ঠানকে সেরা অবস্থানে দেখার ইচ্ছা। কারণ আপনি যদি ধৈর্য ধরতে পারেন তাহলে কোনোকিছুই আপনার সেরা হওয়া আটকে রাখতে পারবে না।