'ব্যবসার পরিস্থিতি' ভাইরাল হয়ে যেভাবে বদলে দিল হাসানের জীবন-জীবিকা!
দোকান বন্ধ করতে করতে রাত কিছু বেশিই হয়ে যেত আলী হাসানের। বাড়ি গিয়েই দাদীকে জিজ্ঞেস করত প্রথম, "খাইছ কিছু? কী খাইলা?" দাদী উত্তর দিত, "ভাত-ডাইল আর তর বাপের গাইল।"
একই প্রশ্ন, উত্তরও একই কিন্তু আলী হাসান হাসি চাপতে পারত না একদিনও। ছোটবেলা থেকেই দাদীকে দেখে আসছে ছড়ায় ছড়ায় কথা বলতে। এই অভ্যাস কিছুটা হাসানেরও আছে। যেমন কেউ ব্যবসার পরিস্থিতি জানতে চাইলে উত্তর দেয়, "দিশা মিশা পাই না, ভিসা মিসা দরকার, যামু গিয়া তাড়াতাড়ি কুয়েত নাইলে কাতার।"
র্যাপ বা হিপহপ গানের নেশা তার বহু পুরনো। ২০১০ সাল থেকে 'খাস বাংলা' নামে ইউটিউব চ্যানেলও করেছেন। দলে তারা ১১ জন। নারায়ণগঞ্জের আদি বাসিন্দা হাসানরা। হার্ডওয়্যারের পারিবারিক ব্যবসা তাদের। তবে তা ভালো যাচ্ছিল না কয়েক বছর ধরেই। প্রধান কারণ পুঁজি কম।
হাসান বলছিলেন, "৫-১০ লাখ টাকায় এখন আর ব্যবসা করা যায় না। তার মধ্যে এলাকা ডেভেলপ হয়ে গেছে। করোনা এসে ধাক্কাও দিলো বড়।"
নয় মাস আগে দোকানটা বিক্রিই করে দিতে হলো। তারপর দোকান বিক্রির টাকায় বিদেশে যাবেন বলে কাগজপত্র ঠিকঠাক করতে লাগলেন। একজন দালালকে পাসপোর্ট ও কিছু টাকা দিলেন আর সেসঙ্গে বাঁধতে থাকলেন গান, পরে যার শিরোনাম হয় 'ব্যবসায় পরিস্থিতি', আরো পরে যা ভাইরাল হয়ে দেশে বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে। প্রায় দেড় বছর লেগেছে গানটি বাঁধতে। বাকি-বক্কা থেকে শুরু করে ক্রেতার আচার-বিচার সবই বাস্তবিকভাবে ধরা পড়ল এ গানে। মোদ্দাকথায়, গানটি বেইজড অন ট্রু স্টোরিজ বা জীবন থেকে নেওয়া গল্প অবলম্বনে। এমনিতে গান বাঁধতে হাসানের সময় বেশি লাগে না যেহেতু ছড়ায় ছড়ায় কথা বলার ব্যাপারটি তার মধ্যে আগে থেকেই আছে। বিশেষ করে গ্যাংস্টার ধাচের র্যাপ সহজেই বাঁধতে পারেন তিনি। হাসানের ভাষায় এগুলা 'হুদাহুদি' র্যাপ, মানে কোনো ম্যাসেজ নেই তবে মজা আছে। তাহলে ব্যবসার পরিস্থিতি লিখতে এতো সময় লাগলো কেন?
কন্নি দিয়া বন্নি
হাসান বলছিলেন, "এটা কনভারসেশনাল র্যাপ। এমন গানে সংলাপ থাকে, অনেকগুলো চরিত্রও থাকে। দোকান যখন করতাম তখনকার বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন ঘটনা মনে করতে হয়েছে গানটি লিখতে গিয়ে। বাকির বিষয়টি বেশি এসেছে কারণ সকালে দোকান খোলার পর থেকেই এ যন্ত্রণা শুরু হতো, আর একবার বাকি নেওয়ার পর কাস্টমারের দেখা পাওয়া যেত না সপ্তাহ পার হয়ে গেলেও। এতে মন কষাকষি হতো, ঝগড়া-ফ্যাসাদও কম হতো না। ক্রেতাদের সঙ্গে যেমন কথা হতো সেগুলোও গানে যেন ঠিক ঠিক ধরা পড়ে তা খেয়াল রাখছিলাম। তাই সময় বেশি লেগেছে।"
ব্যবসার পরিস্থিতি গানটিতে প্রচুর আঞ্চলিক শব্দ আর সেগুলোর স্থানিক ব্যবহার রীতি আছে যেমন 'কলাদা, রুটি নামা গলাদা' বা 'কন্নি দিয়া বন্নি করুম' ইত্যাদি। তবে শ্রোতার বুঝতে অসুবিধা হয় না বেশি কারণ আমরা প্রত্যেকেই ক্রেতা হয়েছি বহুবার আর বিক্রেতাও হয়েছি দু একবার তো বটেই।
এই গানে রূপকের ব্যবহারও আছে যেমন 'মুরগী খুঁজি তিতি তিতি'। আ তিতি তিতি বলে সন্ধ্যায় মুরগী খোঁজার চল এখনো গ্রামে বর্তমান। মুরগীগুলো আশপাশের বাড়ি বা ঝোপঝাড়ে গিয়ে বসে আছে, অথচ সন্ধ্যা হতে চলল, তাই মুরগীর মালিক একটা বড় সময় ধরে আ তিতি তিতি বলে এদিক ওদিক ঘুরতে থাকে। হাসানও বাবা দাদার স্মৃতি মুরগী খোঁজার মতোই খুজে চলেন কারণ সেসব দিনে ব্যবসা ছিল, সংসার চলে যেত। সেই স্মৃতি ধরে রাখতে তার মন চায় কিন্তু টাকুর-টুকুর মানে টুকটাক সদাই বিক্রি করে কীভাবে ব্যবসা বা সংসার চলে?
হাসান আলী তার গানে ভুঁইফোড় কিছু নির্মাতা কোম্পানীর কথাও বলেছেন। এক জায়গায় যেমন আছে- 'কিছু কিছু প্রোডাক্ট আছে, মায়ে বানায় পুতে বেঁচে, দোকানদার পড়ে প্যাচে'। কথাটার মানে দাঁড়ালো- কিছু জিনিসের টেকসই হওয়ার ব্যাপারটা পুরোই নিয়তি নির্ধারিত। কখন কাটবে আর কখন ফাটবে কিছুই নিশ্চয়তা নেই। ক্রেতার আচার-বিচার নিয়েও বলতে ছাড়েননি হাসান- 'ফুটুনি করতে আহে, ভালো মন্দ চিনে না, আইয়া খালি আতাই বাজান, দাম হুইনা আর কিনে না'।
গানের আরেকটি জায়গায় আছে, 'আরেকদিন আরেক হালায় কিন্না নিছে রশি, রশি কিন্না যেই কাম করছে, রশি বেইচ্চা দোষী'। হাসানকে এ কথার মর্মার্থ জিজ্ঞেস করলাম। তিনি হাসতে হাসতে উত্তর করলেন, "হার্ডওয়্যারের দোকান, রশিও বিক্রি করি। একজন যে সেই রশি কিনে নিয়ে গলায় ফাঁস লাগাতে যাবে তা আমি কেমনে জানুম? ভাগ্য ভালো লোকটা প্রাণে মরে নাই। নাইলে তো মনের ভিতরে দাগ লাইগা যাইত।"
গান লেখার পর…
গান লেখার পর হাসানের সমস্যা দাঁড়ালো কাকে কোন পার্ট (চরিত্রাভিনয়) দেবে? হাসান বলছিলেন, "দলের ১১ জনের সবাই এখন নাই তয় ৭ জন আছি আমরা নিয়মিত। আমি ছাড়া অন্যরা হলেন, সাদি ভাই, মানাম, আমিন আলী, উদয়, রাকিব হাসান, মারুফ আকন, সিয়াম ও রিজান। এহন আমি যদি মানামরে বলি তুমি আঠা ক্রেতার ভূমিকায় আসো কিন্তু সে হয়তো মনে মনে বড় ভাইয়ের ভূমিকাটাই বেশি পছন্দ কইরা রাখছে তহন ঝামেলা হবে না? আমি তাই বললাম কে কোন পার্ট করবা নিজেরাই ঠিক কইরা নাও। এইভাবে একটা বড় ঝামেলা মিটছে। তবে শুটিংয়ের জন্য অপেক্ষা করতে হইছে বড় সময়। চেনা একজনের দোকান ঠিক কইরা ক্যামেরা নিয়ে সবাই হাজির হইছি ১১টায়, এহন তাঁ বেচাকেনা আছে, তারপর সব হিসাব নিকাশ সাইরা দুপুর ৩টায় যখন খাইতে বাসায় যান তহন আমরা শুটিং শুরু করতে পারছিলাম।"
করোনার ধাক্কায় হাসানের প্রভূত ক্ষতি হয়েছে আবার সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে হাসান ব্যবসার পরিস্থিতির মতো গানও লিখেছে। তার এই প্রয়াসকে চলচ্চিত্রকার মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ভূয়সী প্রশংসা করে বলেছেন, 'এইটা একটা আসল সোনা। শিল্পের কাজ তার সময়কে ধরা। এই গানে এর কারিগররা সময়ের বুকে বইসা সারিন্দা বাজাচ্ছে রীতিমতো!'
ক্রিকেটার শাহরিয়ার নাফিসও গানটি শুনে মুগ্ধ হয়েছেন। নিজের অফিসিয়াল পেইজে একটি পোস্ট দিয়ে লিখেছেন, 'সাধারণত আমি গান শুনি না। কিন্তু আলী হাসানের ব্যবসার পরিস্থিতি গান শুনতে নিজেকে আটকাতে পারিনি। অবিশ্বাস্য! গানের কথা এমনই হওয়া উচিত। পরিস্কার, সত্য, সহজ এবং বাস্তবসম্মত।'
আলী হাসানকে সাধুবাদ জানিয়ে আরো লিখেছেন শাহরিয়ার নাফিস, 'আমার নানাবাড়ি নারায়ণগঞ্জ বলে কিছু শব্দ আমার কাছে খুব মজার লেগেছে। সহজ সরল স্থানীয় ভাষা। আলী হাসান, তোমার জন্য গর্বিত এবং আনন্দিত'।
এ বছরের মে মাসে গানটি রেকর্ড করেন আলী হাসান। ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ার পর নামী রেকর্ড লেবেল জি-সিরিজ ১১ আগস্ট প্রকাশ করে তার গান। আলী হাসান বলছিলেন, "শুরুর দিকে একদিনে ১ মিলিয়ন ভিউও হইছে। আজকে (২৭ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত ২৪ মিলিয়ন ভিউ হইছে গানটার।"
আলী হাসান জানিয়েছেন, মার্কিন র্যাপার জে-জির মতো তার স্টাইল কিন্তু তিনি পছন্দ করেন অস্ট্রেলিয়ার র্যাপার কেজিকে।
আলী হাসানকে এখন এলাকার লোক সম্মান করে। সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে ডেকে নিয়ে মঞ্চে বসায়। কিছুদিন আগে অভিনেত্রী বিদ্যা সিনহা মিম এক অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন নারায়ণগঞ্জে। তাতে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন হাসানও। এমনকি চিরকুট ব্যান্ডের প্রধান গায়িকা শারমিন সুলতানা সুমি তার কনসার্টে যোগ দেওয়ার অনুরোধ করেছিলেন হাসানকে। এ নিয়ে হাসান বলেন, সুমি আপু আমাকে দাওয়াত দিয়েছেন, এটা তো আমার জন্য বিরাট ব্যাপার। নিজের কাছেই প্রশ্ন করছি, আমি কি এতটা সম্মানের যোগ্য? মিম যে অনুষ্ঠানে এসেছিলেন সেখানে এক সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন, আপনাকে কি আগামীতে নাটক-সিনেমায়ও দেখতে পাবো? আমি উত্তর দিয়েছিলাম, সিচুয়েশন দিবে নোটিফিকেশন। মানে পরিস্থিতিই বলে দিবে কোন পথে যামু। সামনেরটা সামনেই জানে।"
টিবিএস: তাহলে ব্যবসার পরিস্থিতি দিয়ে কি পেলেন?
হাসান: অনেক টাকা পাই নাই। তবে যে টাকা খরচ হইছে তা উঠে আসছে। ফেইস ভ্যালু তৈরি হইছে। নতুন গানের ইনভেস্টর রেডি আছে। এটা তো কম পাওয়া না। আসলে ভয়টা হলো- সোশ্যাল মিডিয়া একটা ধুপধাপ জায়গা। মানে এই আপনি তারকা, এই আবার হাওয়া। তাই উত্তরটা এইভাবে দেই - মোডে খাড়াইছি ভোডে, এহনই কী বুঝুম কেডা ওডে কেডা ফোডে!
এখন যা করছেন
সাদা কথায় আলী হাসান এখন 'সোনার বাংলা' বুনছেন। গানটিতে দুইটি ভিন্ন ভিন্ন প্রসঙ্গ আনছেন তিনি। প্রথম অংশে বলছেন সমস্যাগুলো- যেমন 'রাইতে মশা দিনে মাছি, এইডি মাইরা বাইচা আছি'। পরের অংশে বলছেন নদীমাতৃক-সুজলা-সুফলা সোনার দেশের কথা। বলছিলেন, "দেশটাকে আমরা সবাই ভালোবাসি, কিন্তু ব্যবসায় মাইর খাইয়া, চাকরি-বাকরি না পাইয়া বিদেশ চলে যাই। তয় যেখানেই যাই দেশের মায়া কি ভুলতে পারি? এখন সবাই মিলে যদি দেশটাকে সোনার বাংলাদেশ বানাই তাইলে সুখে শান্তিতে একসঙ্গে বসবাস করতে পারি।"
এই গানটিও জি-সিরিজ থেকেই প্রকাশিত হবে। আলী হাসান বললেন, "আসলে পরিচিতি পাওয়ার আগ পর্যন্ত সংগ্রাম করা লাগে। এরপর একবার পরিচিতি পেয়ে গেলে শিল্পীর আর ঘোরা লাগে না, শিল্পীর পিছেই ঘোরে সবাই। ঘটনাটা শোনেন, ব্যবসার পরিস্থিতির তখনও ভিডিও রেডি করতে পারি নাই, অডিও নিয়ে একটা বিখ্যাত রেকর্ডিং লেবেলের কাছে গেছিলাম, তারা এমন ভাব করল যে এটা কোনো গানই হয় নাই। পরে নিজে কিছু টাকা খাটাইয়া আর শুচি ভাইয়ের সহযোগিতায় ভিডিওটা বানাইতে পারছিলাম। জি-সিরিজের কাছে ভিডিওটা নিয়ে গেলে তারা আমারে যথেষ্ট খাতির করছে। তাই আমি মনে করি জি-সিরিজ আমার গোড়া। আরো লেবেলের সঙ্গে কাজ করব হয়তো তবে জি-সিরিজের সঙ্গে সম্পর্কটা রাখব। কারণ তারাই আজকের আলী হাসানরে চিনাইছে।"
আলী হাসান ব্যবসার পরিস্থিতির সাফল্যের জন্য জি-সিরিজের প্রকল্প সমন্বয়কারী ঈশা খান এবং মিক্সার শুচি শামসের প্রতি কৃতজ্ঞ। উল্লেখ্য ব্যবসার পরিস্থিতির সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে ক্রেতার পরিস্থিতি (ইউটিউব চ্যানেল থার্ড ক্লাস কোম্পানীতে প্রকাশিত) এবং প্রেমের পরিস্থিতি (শাকিল আলভিন এন্টারটেনমেন্টের) নামেও র্যাপ গান বাজারে এসেছে আর সেগুলোও হাজার হাজার ভিউ পেয়েছে।
ব্যক্তি আলী হাসান ও তার সঙ্গীরা
বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান আলী হাসান। পড়াশোনা করেছেন অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত। বয়স এখন ২৯। বাবা মায়ের পছন্দে বিয়ে করেছেন ২০১৮ সালে। এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক তিনি।
নিজে ওয়েল্ডিংয়ের কাজ জানেন। দুলাভাইয়ের ওয়ার্কশপে মাঝে মধ্যে সময় দেন। তাতে কিছু হাত খরচ জোটে। আর ইদানিং শো করার দাওয়াত পাচ্ছেন। আগামী বৃহস্পতিবার শো করবেন শরীয়তপুর, শেষটা করেছেন কক্সবাজারে।
তার সঙ্গী র্যাপারদের মধ্যে মানাম একজন ড্রাইভার, উদয় বাবার ব্যবসার হেলপার আবার ভিডিও এডিটিংয়ের কাজও জানে, রকিবও বাবার ব্যবসার হেলপার, মারুফ আছে বিদেশ যাওয়ার চেষ্টায়, সিয়াম সেলসম্যানের কাজ করে। শো থেকে যে টাকা পাওয়া যায় সবাই ভাগ করে নেন আলী হাসানরা। আলী হাসান বললেন, "আমরা গানের মানুষ, গান গেয়েই খুশি থাকি। কোনো মতে চলে ফিরে যেতে পারলেই হলো।"