প্রথমবারের মতো জনসমক্ষে উন্মুক্ত আর্নেস্ট হেমিংওয়ের লেখা, ছবির আর্কাইভ
গবেষক ও জনসাধারণের জন্য প্রথমবারের মতো উন্মুক্ত করে দেওয়া হলো কালজয়ী মার্কিন কথাসাহিত্যিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ের লেখা, ছবি এবং ব্যক্তিগত জিনিসপত্র। এগুলো বর্তমানে পেন স্টেট ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরিজ-এর আর্কাইভে টোবি অ্যান্ড ব্রুস কালেকশনে রয়েছে। স্মিথসোনিয়ান ম্যাগাজিন অবলম্বনে।
সংগ্রহটির লেখার মধ্যে আছে হেমিংওয়ের মাত্র ১০ বছর বয়সে লেখা ছোটগল্প, চারটি অপ্রকাশিত ছোটগল্প, ম্যানুসক্রিপ্ট আইডিয়া এবং চিঠিপত্র। এছাড়াও রয়েছে শতাধিক আলোকচিত্র, তার কাপড়চোপড় এবং কিছু ব্যক্তিগত জিনিসপত্র।
নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, এ সংগ্রহটি 'গত ৬০ বছরে হেমিংওয়ের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ সুপ্ত ভাণ্ডার।'
পেন স্টেট ইউনিভার্সিটির সাহিত্য স্কলার স্যান্ড্রা স্পেনিয়ার এক বিবৃতিতে বলেন, "হেমিংওয়ে 'প্যাক র্যাট' বলেও পরিচিত ছিলেন। স্পেনে ষাড়ের লড়াই দেখতে যাবার টিকেট থেকে শুরু করে বারের বিল- সবকিছুই ফেলে না দিয়ে জমিয়ে রাখতেন তিনি। এমনকি, এক টুকরো কার্ডবোর্ডে লেখা গল্পের শিরোনামের একটি তালিকা, যেটি কিনা প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল- তিনি সেটিও রেখে দিয়েছিলেন।"
ফ্লোরিডার কী ওয়েস্টে অবস্থিত স্লপি জো'স নামে একটি বার ছিল তার প্রিয় বারগুলোর একটি। এই বারেই তিনি ১৯৩৯ সালে তার জমানো জিনিসপত্র রেখে যান এবং ১৯৬১ সালে তার আত্মহত্যার আগ পর্যন্ত সেগুলো এখানেই ছিল।
হেমিংওয়ের আত্মহত্যার পর তার চতুর্থ স্ত্রী মেরি একদিন স্লপি জো'স বার থেকে একটি ফোনকল পান। '৩০ এর দশকে আর্নেস্ট কিছু জিনিস এখানে রেখে গিয়েছিলেন। জিনিসগুলো এসে নিয়ে যেতে পারবেন?'- ফোনের ওপাশ থেকে কথাগুলো শুনতে পান মেরি।
১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারিতে মেরি তার প্রয়াত স্বামীর জিনিসগুলো আনতে যান। পরে হেমিংওয়ের রেখে যাওয়া একগাদা কাগজ নিখুঁতভাবে দেখতে তার বন্ধুদম্পতি টোবি ব্রুস ও বেটি ব্রুসের সাহায্য নেন তিনি।
কিছু জিনিস মেরি তার নিজের কাছে রেখে দিয়ে বাকিগুলো টোবিকে দিয়ে দেন। টোবি ছিলেন হেমিংওয়ের দীর্ঘদিনের বন্ধু এবং সহকারী। ব্রুস দম্পতি সেগুলো একসময় তাদের সন্তান বেঞ্জামিন ব্রুসকে দেন। পরবর্তীতে বেঞ্জামিন স্থানীয় ইতিহাসবিদ ব্রুস্টার চ্যাম্বারলিন এবং স্যান্ড্রা স্পেনিয়ারের সঙ্গে মিলে হেমিংওয়ের সংগ্রহের জিনিসগুলোর তালিকা করা শুরু করেন।
নিউইয়র্ক টাইমস এই সংগ্রহ নিয়ে প্রথমবার লেখে ২০১৭ সালে। ব্রুস্টার এবং স্যান্ড্রা সেসময় ব্রুসদের পারিবারিক আর্কাইভে আবিষ্কার করেছিলেন হেমিংওয়ের শৈশবে লেখা ছোটগল্প।
বেঞ্জামিন চেয়েছিলেন জিনিসগুলো যেন একটি স্থায়ী ঠিকানা পায়। তখনো সেগুলো জনসাধারণের কাছে প্রদর্শিত হয়নি।
এরপর ২০২০ সালে বেঞ্জামিনের মারা গেলে তার উত্তরাধিকারীরা স্যান্ড্রার সঙ্গে মিলে সংগ্রহটি পেন স্টেটে আনেন।
স্যান্ড্রা নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, "বেঞ্জামিন এবং ব্রুস্টারের প্রতি আমার অগাধ স্নেহ আর সম্মানবোধের পাশাপাশি, একজন গবেষক হিসেবেও এটি করার পেছনে আমার একটি দায়িত্ববোধ কাজ করেছিল।"
স্যান্ড্রা বর্তমানে হেমিংওয়ে লেটার্স প্রজেক্ট-এর সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
আর্কাইভের জিনিসগুলোর মধ্যে আছে হেমিংওয়ের লেখা তিন পৃষ্ঠার একটি ডকুমেন্ট। এটি তিনি আত্মহত্যার প্রায় ৩৫ বছর আগে ২৬ বছর বয়সে লিখেছিলেন।
প্রবন্ধটিতে লেখক মৃত্যুর সবচেয়ে ভালো উপায় নিয়ে তার চিন্তাভাবনাগুলো লিখেছিলেন। তিনি লেখেন, 'যদি ঘুমন্ত অবস্থায় মৃত্যুর কোনো উপায় ব্যবস্থা করা না যায়, তাহলে মারা যাবার সবচেয়ে আদর্শ উপায় হলো কোনো ওশান লাইনার (মহাসাগরে যাত্রীবাহী জাহাজ) থেকে লাফ দেওয়া'।
স্যান্ড্রা দ্য লন্ডন টাইমসকে জানান, "আমার জানামতে হেমিংওয়ে এখানেই প্রথমবারের মতো তার এই দিকটি নিয়ে লেখেন।"
একই প্রবন্ধে আরেক পর্যায়ে তিনি লেখেন, 'অনেক বছর ধরে আমি মৃত্যুকে ভয় করতাম। সে ভয় কেটে যাওয়ায় এখন খুব স্বাচ্ছন্দ্যবোধ হয়। অবশ্য ভয়টা হয়তো আবারও ফেরত আসতে পারে'।
হেমিংওয়ে তার সমসাময়িক প্রতিদ্বন্দ্বী মার্কিন ঔপন্যাসিক এফ স্কট ফিটজেরাল্ড'কে নিয়ে একটি ছোট গল্প লিখেছিলেন। ফিটজেরাল্ডকে তিনি 'কিড ফিটজ' নামে একজন তরুণ বক্সারের চরিত্রে দেখান, যার 'স্ট্র্যাংগুলেটেড হার্নিয়া রোগ আছে, একটি নাক নেই এবং চোখ দুটো কালো।'
এখন যেহেতু সংগ্রটি গবেষকদের জন্য উন্মুক্ত, তাই আশা করা যায় আগামী সময়ে হেমিংওয়ের জীবন নিয়ে আরও অনেক কিছু জানা যাবে। গবেষকরা সংগ্রহের প্রত্যেকটি জিনিস খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন।
স্যান্ড্রা নিউইয়র্ক টাইমসকে জানান, "জিনিসগুলোকে যেভাবে ঘেটে দেখা হচ্ছে, এটি অনেকটা 'ইস্টারের সময় ডিম খোঁজার' মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে।"
পেন স্টেট ইউনিভার্সিটির আরেক সাহিত্যিক এবং হেমিংওয়ে লেটার্স প্রজেক্ট-এর সহযোগী সম্পাদক ভার্না কেইল বলেন, "সংগ্রহটি বিশেষ করে পেন স্টেটের শিক্ষার্থীদের জন্য শেখার একটি মূল্যবান সুযোগ করে দেবে। এটি খুব ভালো হয়েছে যে, জিনিসগুলো কোনো ব্যক্তির কাছে না গিয়ে অক্ষত অবস্থায় একটি গবেষণাভিত্তিক গ্রন্থাগারে এসে পৌঁছে।"
কেল আরও বলেন, "সাবেক গ্রন্থাগারিক বেটি ব্রুস জেনে খুশি হতেন, তার এবং টোবির বাঁচিয়ে রাখা লেখাগুলো এখানে আর্কাইভ করা হয়েছে।"