তার কাছে আছে রাজা প্রতাপাদিত্যের হুক্কা, শাহ আব্দুল করিমের দোতারা, হরপ্পার পুতুল…
বসার ঘরটা ১৬ ফুটের বেশি হবে, কিন্তু সেখানে বসার কোনো সুযোগ নেই। কারণ পুরোনো সব সংগ্রহ দিয়ে ঘরখানা ঠাসা। রফিকুল ইসলাম দুলাল মেহমানদের বসতে দেন ডাইনিং টেবিলেই। ওয়ারীর ওয়্যার রোডের বাড়িটায় দুলাল আছেন ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে। তার জন্ম অবশ্য বনগ্রাম লেইনে। পড়েছেন টিপু সুলতান রোডের গ্রাজুয়েটস উচ্চ বিদ্যালয়ে। সুরম্য ভজহরি লজ ছিল স্কুলটির ঠিকানা। গেল শতকের শুরুর দিকে ভজহরি সাহা দ্বিতল এ ভবন নির্মাণ করিয়েছিলেন। দুলালের হেরিটেজ ভবনের প্রতি ভালোবাসা তৈরিতে এরও ভূমিকা আছে।
সত্তর সালে মেট্রিক পরীক্ষা দিয়েছেন দুলাল। স্কুলে থাকতে স্কাউট করতেন, সেই সুবাদে রানী এলিজাবেথকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন, চীনা বিপ্লবী লি শাও চি'র সঙ্গে হ্যান্ডশেক করেছিলেন। দুলালের পিতা এমএ হাকিম ছিলেন পাকিস্তান প্রত্নতত্ত্ব দপ্তরের প্রকৌশলী। বাবাকে কোনো কোনো মাসের ১৫ দিনই পাকিস্তানে থাকতে হতো। সেখানে তিনি হরপ্পা মহেঞ্জোদারোর সংস্কারকাজে অংশ নিতেন। বাবা অফিস করতেন লালবাগ কেল্লায়। দুলাল ছোটবেলায় বাবার অফিসে অনেক প্রত্নবস্তু স্তুপকারে জমা থাকতে দেখেছেন।
দুলাল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে সম্পর্কিত হন স্কুলে থাকতেই। সলঙ্গা বিদ্রোহের নেতা এবং পঞ্চাশের দশকে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রিয় সভাপতি মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ থাকতেন দুলালদের বাড়ির কাছেই। সে বাড়িতে তিনি বঙ্গবন্ধুকেও দেখেছেন। এছাড়া সাহচর্য পেয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রাজ্জাকের। দুলাল মুক্তিযুদ্ধেও সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। দেশ স্বাধীন হলে তিনি শখের সাংবাদিক হন। তখন কলকাতায় গিয়ে একবার সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গেও দেখা করে আসেন।
জগন্নাথ কলেজ থেকে তিনি গ্রাজুয়েট হন ১৯৭৫ সালে। সেবছরই বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলে তিনি রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন জার্মানিতে। পরে ১৯৭৬ এ তিনি জার্মানি চলে যান। সেখানে গিয়ে ফটোগ্রাফিতে ডিপ্লোমা করেন। দেশ ঘুরে দেখার বিশেষ করে প্রাচীন নগরী দেখার আগ্রহে তিনি জার্মানি, স্পেন, ইতালি বা ফ্রান্সের অনেক শহর ঘুরে বেড়ান। এগারো বছর পর ১৯৮৭ সালে দেশে ফিরে এসে তিনি ইউরোপে তোলা ছবিগুলো দিয়ে একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেন আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে। কিছুদিন বিজ্ঞাপনী সংস্থা বিটপির হয়ে কিউট, ওরস্যালাইন, সিঙ্গার ইত্যাদি পণ্যের পেপার বিজ্ঞাপনের জন্য ফটো তোলার কাজ করতে থাকেন। অবশ্য অল্পকাল পরেই তিনি বিটিভিতে ক্যামেরাম্যান (ক্লাস-ওয়ান অফিসার) হিসাবে স্থায়ী নিয়োগ পান।
বিটিভিতে দুলাল আউটডোর কাজই করেছেন বেশি। বিশেষ করে 'দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া' এবং 'জেলা পরিচিতি' নামের অনুষ্ঠানগুলোর ছবি তোলার জন্য তিনি সারাদেশ ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ পেয়েছেন। কোনো কোনো জেলায় গিয়েছেন একাধিকবার। এই কারণেই সারাদেশ থেকে পুরনো জিনিস বা অ্যান্টিক সংগ্রহ করার সুযোগ মিলে যায় তার।
যশোরে যাওয়ার পর তিনই রাজা প্রতাপাদিত্যের বংশধরের সঙ্গে পরিচিত হন। সেই বংশধরের কাছ থেকে ১৯৮৯ সালে রাজার একটি চিঠিদানি তিনি সংগ্রহ করেন। টিভি সিরিয়াল বা সিনেমায় আমরা এমন চিঠিদানি দেখার সুযোগ পেয়েছি অনেকবার। এটি সাধারণত তামা বা দস্তায় নির্মিত ধাতব নল যার ভিতরটা ফাঁকা থাকে আর সেই ফাঁকা অংশে কাপড়ে বা কাগজে লেখা মোড়ানো চিঠি থাকে। এতে করে রাজপত্র বা ফরমান দূর দূর অঞ্চলে পৌঁছানো হতো। উল্লেখ্য প্রতাপাদিত্য (১৫৬১-১৬১১) ছিলেন যশোরের স্বাধীন নৃপতি। দুলালের সংগ্রহে রাজা প্রতাপাদিত্যের যে চিটিদানিটা আছে তার গায়ে পুরনো আমলের অনেকগুলো বাংলা হরফ লেখা আছে যার মধ্যে ব আর ম আমি ঠিক ঠিক চিনতে পারলাম। রাজার ব্যবহৃত লম্বা নলের হুকাও আছে দুলালের কাছে।
বাবা দিয়ে গেছেন
আগেই বলা হয়েছে দুলালের বাবা এমএ হাকিম ছিলেন পাকিস্তান সরকারের প্রত্নতত্ত্ব দপ্তরের একজন প্রকৌশলী। কুমিল্লার দাউদকান্দিতে দুলালের দাদাবাড়ি। ত্রিপুরার রানী অমৃতা সুন্দরীর কাছ থেকে সুন্দলপুর কিনে নিয়ে দাদা ওসমান গনি সরকার হয়ে ছিলেন জমিদার। দাদার সূত্রে দুলাল ১৯৪০ সালের একটি ন্যাপকিন হোল্ডার পেয়েছেন যার চারধার নকশা করা যেটি ব্যবহার করতেন অমৃতা সুন্দরী।
বাবা এমএ হাকিম অবসর নিয়েছিলেন ১৯৬৭ সালে। হরপ্পা-মহেঞ্জোদারো ছাড়াও পাহাড়পুর, মহাস্থানগড়ের প্রত্নস্থানসমূহের সংস্কার কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বাবার কাছ থেকে দুলাল হরপ্পা খননে প্রাপ্ত মাটির তৈরি পুতুল ঘোড়া এবং মৃৎপাত্র পেয়েছিলেন যেগুলোর বয়স চার বা সাড়ে চার হাজার বছর। প্রত্নস্থান থেকে প্রাপ্ত ফুলেল নকশার মাটির ফলক এবং ক্ষুদ্রাকৃতির দেবতা মূর্তিও আছে তার সংগ্রহে।
বসার ঘরের নাতিদীর্ঘ সেন্টার টেবিলের ওপর বেতনির্মিত ট্রেতে সেগুলো রাখা। দুলাল নিজে সংগ্রহ শুরু করেন দেশে ফেরার পর মানে আশির দশকের শেষ দিকে। শুরুর কালের একটি দারুণ সংগ্রহ সিকিউরিটি নম্বর প্লেট। ভাওয়াল জয়দেবপুরের রাজা রাজেন্দ্রনারায়ণ রায় চৌধুরীর প্রহরীদের এ প্লেট দেওয়া হতো। সম্ভবত প্রহরীরা সেটি পোশাকের সঙ্গে আটকে রাখত। দুলালের সংগ্রহে থাকা প্লেটটির নম্বর ১১০, সময়কাল ১৮৮৬ সাল। ঘরের উত্তর পূর্ব কোণে আছে একটি দশাসই গ্রামোফোন।
সংগীত শিল্পী উৎপলা সেন (বিশ শতকের একজন প্রধান গায়িকা, সতীনাথ ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দ্বৈত কণ্ঠেও অনেক গান করেছেন) এটি দিয়ে গান শুনতেন। দুলাল জানাচ্ছেন, ১৯৩৫-১৯৪০ সালে যখন উৎপলা আর্মানিটোলায় বাস করতেন তখন তিনি গ্রামোফোনটি ব্যবহার করতেন, ওস্তাদ গুল মোহাম্মদ ছিলেন তার শিক্ষক। তবে উৎপলা সেনেরও আগে ভাওয়াল রাজা রাজেন্দ্রনারায়ণ, পরে রাজার পুত্রবধূ বিভাবতী গ্রামোফোনটি ব্যবহার করেছেন। স্বামী মারা যাওয়ার পর বিভাবতী ভাই সত্যেন ব্যানার্জির সঙ্গে ঢাকায় আসেন, তখন কোনো এক সময়ে হয় এটি উপহার হিসাবে পেয়েছিলেন উৎপলা অথবা কিনেও নিতে পারেন। দুলাল '৮৭ সালে খরিদাসূত্রে এটি নিজের সংগ্রহে আনেন এবং এখনো যন্ত্রটি সচল আছে।
মালনীছড়ার তীর-ধনুক
একটা যন্ত্র দেখে ছোটবেলা ফিরে যেতেই হলো। আগে নির্বাচনে জিতলে পরে বা বিয়ের আসর জমাতে ব্যান্ড পার্টি ভাড়া করা হতো। সে দলের কয়েকজনকে দেখতাম গাল দুটি টমেটোর মতো ফুলিয়ে একটি প্যাঁচানো যন্ত্র বাজাচ্ছে যার সম্মুখভাগ খোলা আর ফুঁ দেওয়ার নলটি সরু। ভাবতাম, নিশ্চয়ই দম লাগে খুব। সে যন্ত্রটির নাম যে ট্রাম্পেট জেনেছিলাম আরো অনেক পরে। সেটি দুলাল ভাইয়ের সংগ্রহে দেখে দারুণ আমোদ বোধ করলাম। তারপর দেখলাম একটা বাঁশি। তারপর ঢোল ও ডুগডুগি।
তবে সংগ্রহের মহার্ঘ্য যন্ত্রটি দেখালেন আরো পরে। সেটি বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের ব্যবহৃত একটি দোতরা। কেবল খোলটিই টিকে আছে এখন, তারগুলোর একটিও নেই। তবুও হাত বুলিয়ে আবেগের সাগরে ভাসলাম কিছুক্ষণ, মনে তখন বাজছিল, আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম আমরা, আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম। বিটিভির 'দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া' অনুষ্ঠানের শুটিং করতে গিয়েছিলেন যখন সুনামগঞ্জে তখন এটি সংগ্রহ করেছিলেন। সিলেটের মালনীছড়া চা বাগান থেকে আরো কিছু মজার জিনিস তিনি সংগ্রহ করে এনেছিলেন।
সেগুলো হলো বাগান শ্রমিকদের তীর-ধনুক এবং হাত কুড়াল। তীরের ধাতব ফলা এখনো চকচক করছে তবে দীর্ঘদিন টেবিলের তলায় পড়ে আছে বলে মাকড়সা জাল বুনেছে। এ যন্ত্রগুলো দিয়ে বাগান শ্রমিকরা বড়জোড় খরগোশ বা পাখি শিকার করতে পারত। এরপর গোটা পাঁচেক ছোরা (ছোট তরবারি) দেখলাম। এগুলোর খাপ আর হাতল আকর্ষণীয়। একটির খাপ চামড়ায় মোড়ানো, একটির হাতল কাঠের, একটির আবার খাপ এবং হাতল দুটিই ধাতুব। তবে সবগুলোই নকশাবহুল।
আরেকটি সংগ্রহ দেখে পাইরেটস অব দ্য ক্যারিবিয়ান ছবির কথা মনে পড়ল। ওই ছবিতে দস্যুনেতা বারবোসাকে যেমন এক নলা দূরবীন ( খাপে খাপে থাকে, এক চোখ দিয়ে দেখতে হয়) ব্যবহার করতে দেখি তেমন একটি দূরবীন আছে দুলাল ভাইয়ের কাছে। এরপর দেখলাম কিছু ঝর্ণাকলম বা ফাউন্টেন পেন। কবিগুরু শেষবারের মতো ১৯২৬ সালে ঢাকায় আসেন। বলধা গার্ডেনের ক্যামেলিয়া হাউস দেখে সেবার তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন। বলধার জমিদার নরেন্দ্রনারায়ণ রায় চৌধুরী ও তার পরিবারকে কবি আশীর্বানীও লিখে দিয়েছিলেন। যে কলমটি দিয়ে লেখা হয়েছিল সে আশীর্বানী সেটি দুলাল ভাইয়ের সংগ্রহে থাকা কলমগুলোর একটি। এরপর কিছু ঘড়ি দেখলাম। এর মধ্যে একটি দেয়ালঘড়ি যার পুরো খোলসটি কাঠের, যার একটি পেন্ডুলাম আছে, যার ১২ সংখ্যাটির নিচেই লেখা আছে মেইড ইন অকুপায়েড জাপান, মনে করিয়ে দিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা, ১৯৪৫ থেকে ১৯৫১, ওই ছয় বছর জাপান যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমাদের দখলে ছিল। সে আমলে তৈরি হয়েছে ঘড়িটা। একটা পকেট ঘড়িও আছে দুলাল ভাইয়ের সংগ্রহে।
কিছু সামুদ্রিক প্রাণীর ফসিল সংগ্রহে আছে দুলাল ভাইয়ের- যেমন শামুক, ঝিনুক ও প্রবাল। আরো আছে জাহাজের সার্চলাইট, যেটি কেরোসিন তেল দিয়ে চলত। কলকাতার গিরিশ ব্যাংকের একটি টিনের পয়সা জমানোর কৌটাও আছে। দুলাল ভাই জানালেন, ব্যাংক থেকে উপহার হিসাবে গ্রাহকদের এই কৌটা দেওয়া হতো। এরপর কয়েকটি মোমবাতিদানি দেখলাম। এগুলোর কোনোটি খাড়া ও সরু। কোনোটির পেট মোটা। একটিকে দেখিয়ে বললেন, এটি ঢাকার আহসান মঞ্জিলে ছিল। নবাব সলিমুল্লাহর এক বোনের বিয়ে হয়েছিল পরীবাগের পীরসাহেবের নাতির সঙ্গে। সেসূত্রে বাতিদানিটি উপহার পেয়েছিলেন পীরসাহেবের পরিবার। সে পরিবারের এক উত্তরসূরীর কাছ থেকে এটি সংগ্রহ করেছেন দুলাল ভাই। চামড়ায় মোড়া জুয়েলারি বাক্সও দেখালেন কয়েকটি। এগুলো সংগ্রহ করেছেন কুমিল্লার নবাব পরিবারের কাছ থেকে।
কাঁচের তৈরি এবং অন্যান্য
কাঁচের তৈরি কিছু তৈজসপত্রও আছে দুলাল ভাইয়ের সংগ্রহে। এগুলোর কোনোটি ফ্লাওয়ার ভাস, কোনোটি পানপাত্র, কোনোটিবা শুকনো ফল রাখার বয়াম। একটি আতরদানি, দুটি ফলপাত্রও আছে তালিকায়। এগুলোর কয়েকটি আবার রঙিন। পুরনো মডেলের কিছু স্টিল ক্যামেরাও সংগ্রহে রেখেছেন দুলাল। একটি যেমন ফোল্ডিং ক্যামেরা। তারপর দেখলাম তিনটি মুদ্রা যেগুলো রাজা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের আমলের। বয়স ২৩০০ বছর। আগের দিনে ব্যাপক ব্যবহার ছিল এমন কিছু জিনিসও সংগ্রহে রেখেছেন দুলাল ভাই যেমন সুপারি কাটার লোহার জাতি, কুপি, লোহার সিল মোহর, কম্পাস ইত্যাদি।
চিন্তায় পড়ে গেছেন
দুই ছেলে রফিকুল ইসলাম দুলালের। ২৭ বছর ছিলেন বিটিভিতে। ভাইবোনদের সকলেই প্রবাসী। মা এক বোনের সঙ্গে লন্ডনে থাকেন। দুলাল ভাইও আগামী ছয় মাসের মধ্যে সপরিবারে পাড়ি জমাবেন আমেরিকায়। কাগজপত্র সবই গুছিয়ে এনেছেন। কিন্তু চিন্তায় পড়েছেন অ্যান্টিকগুলো নিয়ে। এগুলো কার কাছে রেখে যাবেন! নাকি বিক্রি করে দেওয়াই ভালো? এগুলো ঠিক লোকের কাছে রেখে না গেলে অযত্নেই শেষ হয়ে যাবে। বললেন, 'প্রায় কোটি টাকার সম্পদ। সবগুলোর সঙ্গে ইতিহাস জড়ানো না থাকলেও অ্যান্টিক ভ্যালু যথেষ্টই আছে। সময়ের বিচারে সবগুলোই আকর্ষণীয়। সত্যি বুঝতে পারছি না কার কাছে রেখে গেলে এগুলো যত্নে থাকবে।'