ইলন মাস্ক কেন সবচেয়ে জঘন্য ধরনের বস
কর্মক্ষেত্রে অনেকসময়ই ভয়াবহ বস বা সুপারভাইজরের হাতে গিয়ে পড়ি আমরা। তাদের অত্যাচারে কর্মজীবন তো বটেই, ব্যক্তিগত জীবনও নরক হয়ে যায় অনেক ক্ষেত্রে।
কর্মীদের সঙ্গে জঘন্য আচরণ করেন, এমন খারাপ বসের কিন্তু কোনো কমতি নেই। এই যেমন ২০০৭ সালেই ব্রিটিশ সুপারমডেল নাওমি ক্যাম্পবেল তার গৃহকর্মীকে একজোড়া জিনস নিয়ে কথা কাটাকাটির দায়ে সেলফোন নিয়ে আঘাত করার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হন। এছাড়া মার্কিন জ্বালানি কোম্পানি এনরনের সাবেক সিইও জেফরি কে স্কিলিংয়ের কথাই ধরা যাক। জালিয়াতির দায়ে স্কিলিংকে যেতে হয় কারাগারে। আর তার এই কাণ্ডের জন্য কর্মহীন হতে হয় কয়েক হাজার মানুষকে।
২০২২ সালেও এরকম খ্যাপাটে বস হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন ধনকুবের ইলন মাস্ক। আর কর্মীরা তাকে আখ্যা দিয়েছেন সবচেয়ে জঘন্য ধরনের বস হিসেবে। কারণ মাস্কের মধ্যে এমন সব বৈশিষ্ট্য রয়েছে যেগুলো মানুষ একজন নিয়োগদাতার মধ্যে দেখতে মোটেও পছন্দ করে না।
মাস্ক কেন জঘন্য বস
কর্মক্ষেত্রে ভয়ের পরিবেশ তৈরি, কর্মীদের ওপর অনৈতিকভাবে মাত্রাতিরিক্ত কাজ চাপিয়ে দেওয়া
অক্টোবরের শেষ দিকে ৪৪ বিলিয়ন ডলার দিয়ে টুইটার কিনে নেন বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান টেসলার সিইও মাস্ক। টুইটার কেনার কদিন পরই খরচ কমাতে অর্ধেক কর্মী ছাঁটাই করে ফেলেন তিনি। কাজটি এত দ্রুত ও আধখেঁচড়াভাবে করা হয়েছিল যে কদিন পরই অনেক কর্মীকে ফের চাকরিতে ফিরে আসতে বলতে বাধ্য হয় টুইটার।
আর যারা চাকরিতে থেকে যায় তাদের বলা হয়, কর্মক্ষেত্রে 'কঠোর পরিশ্রম' করার লিখিত অঙ্গীকার দিতে হবে। তা দিতে না পারলে তারা যেন চাকরি ছেড়ে দেন। এক ইমেইলে মাস্ক কর্মীদের বলেন, 'এর মানে হলো তীব্র নিবেদন নিয়ে দীর্ঘ সময় কাজ করতে হবে।'
এই আল্টিমেটাম পেয়ে শত শত কর্মী চাকরি ছেড়ে দেন। রোবটের মতো মুখ বুজে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিতে রাজি হলেন না কেউই।
এখন খবর পাওয়া গেছে, স্যান ফ্রান্সিসকোভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটি কর্মীদের জন্য বিছানা কিনেছে, যাতে তারা অফিসেই রাত কাটাতে পারেন। শহরটির বিল্ডিং ইন্সপেকশন বিভাগও এই মর্মে অভিযোগ পেয়েছে যে, 'টুইটারের বেশ কয়েকটি কার্যালয়কে কর্মীদের জন্য মোটেল রুমে পরিণত করা হয়েছে, যা বিধিমালার পরিপন্থী।'
তবে মাস্কের এই কাজ যদি ভবনের বিধিমালার পরিপন্থী না-ও হয়, তারপরও এভাবে অফিসে বিছানার ব্যবস্থা করা কর্মীদের ওপর অনৈতিক চাপই বাড়াবে কেবল। এভাবে অফিসে বিছানা রাখার অর্থ হলো—'রোবটের মতো কাজ করে যাও, দরকার হলে অফিসেই ঘুমাবে, বাড়ি যাওয়ার দরকার নেই।'
অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে স্যান ফ্রান্সিসকো নগর কর্তৃপক্ষ তদন্ত করবে বলে আশ্বস্ত করেছিল। এরপর মাস্ক স্যান ফ্রান্সিসকোর মেয়রের উদ্দেশে টুইট করে নগর কর্তৃপক্ষের উদ্যোগকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন।
টুইটে মাস্ক লেখেন: 'এসএফের মেয়র তাহলে শিশুদের ফেন্টানাইল থেকে নিরাপদ না রেখে ক্লান্ত কর্মীদের জন্য বিছানার ব্যবস্থা করা কোম্পানিগুলোকে আক্রমণ করছেন।'
সব মিলিয়ে মাস্ক পরিণত হয়েছেন নির্মম পরিহাসের সমার্থক রূপে।
আর এত সব কাণ্ডের পর বছরের সবচেয়ে জঘন্য বসের তকমাটাও পেয়ে গেছেন ইলন মাস্ক।
'মানসম্মত' খারাপ বস হিসেবে মনোনয়ন পাওয়ার দাবিদার আরও অনেকেই আছেন নিশ্চয়, কিন্তু তাদের কেউই কর্মীদের সঙ্গে জঘন্য আচরণ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করে বেড়ানোর সাহস দেখাননি।
আপনাকে বেতন দেওয়া হয় চাকরিকে সবকিছুর ওপরে অগ্রাধিকার দেওয়ার জন্য—ইলন মাস্ক ব্যবস্থাপনার এই তত্ত্বের একনিষ্ঠ অনুসারী। পরিবার, ব্যক্তিগত জীবন—এমনকি ঘুমের কথাও ভুলে যান।
এমন জঘন্য বস কিন্তু দুর্লভ চরিত্র না। এক গবেষণা অনুসারে ইউরোপের ১৩ শতাংশ ব্যবস্থাপক 'খারাপ বস'-এর শ্রেণিতে পড়েন। এই ব্যবস্থাপকরা তাদের অধীনে কাজ করা কর্মীদের ফিডব্যযাক দেন না, তাদের অসম্মান করেন, তাদের কোনো প্রশংসা ও স্বীকৃতিও দেন না, টিমকে কার্যকরভাবে কাজ করতে বাধা দেন এবং কর্মীদের প্রয়োজনীয় সাহায্য ও সমর্থন দেন না।
মহামারির প্রাদুর্ভাবের পর থেকে 'কোয়ায়েট কুইটিং' আন্দোলন বেশ জমে উঠেছে। বিনা বেতনে ওভারটাইম যারা করেন তাদেরকে অসাধারণ কর্মী হিসেবে বিবেচনা করার একটা অলিখিত নিয়ম ছিল। কিন্তু 'কোয়ায়েট কুইটিং' আন্দোলনকারীরা এই নিয়মকে প্রত্যাখ্যান করেছেন।
দেখা যায়, একজন কর্মীর কর্মদিবস অফিসিয়াল শেষ হয় বিকাল চারটায়, কিন্তু শিফট শেষ হওয়ার পরপরই তিনি কালেভদ্রে অফিস থেকে বের হতে পারেন। সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও তাকে কাজ করতে হয়, এমনকি লম্বা ছুটির সময়ও কাজ করতে হয়।
আর এই নিবেদনের পুরস্কার?
আরও কাজ।
অবশেষে একদিন ওই কর্মী সিদ্ধান্ত নিলেন, আর না। যে কাজের জন্য কোনো বিনিময় তো দূরের কথা, দুটো ভালো কথাও জোটে না, সেই বাড়তি কাজ তিনি করবেন না। এ-ই হলো কোয়ায়েট কুইটিং।
কর্মক্ষেত্রে নিবেদিত কর্মীরা প্রায়ই প্রতিদান পান না।
শেয়ারমূল্য কমছে? কর্মী ছাঁটাই করো।
শেয়ারমূল্য বাড়ছে? শীর্ষ নির্বাহীদের বেতন এক লাগে অনেকটা বাড়িয়ে দাও।
কর্মীদের প্রকাশ্যে অপমান ও তাদের ওপর প্রতিশোধ
কর্মীদের সঙ্গে মাস্কের অভব্য আচরণের ইতিহাস কিন্তু নতুন নয়। টেসলাতেও একবার তাকে এক প্রকৌশলীর সঙ্গে চেঁচিয়ে অসভ্য ভাষায় গালি দিতে দেখা গেছে।
মাস্কের প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা জানিয়েছেন, তিনি প্রকাশ্যে মানুষকে অপমান করতে পছন্দ করেন।
২০২১ সালে প্রকাশিত 'পাওয়ার প্লে' বইয়ে টিম হিগিন্স লিখেছেন, মাস্ক বেশ কয়েকবার শীর্ষ নির্বাহীদের ওপরও সবার সামনে রাগ ঝেড়েছেন। এর ফলে বেশ কয়েকজন নির্বাহী কোম্পানি ছেড়েছেন।
টেসলার কর্মী মার্টিন ট্রিপ সংবাদমাধ্যম 'ইনসাইডার'কে ২০১৮ সালে টেসলার ব্যাটারি কারখানার অতিরিক্ত স্ক্র্যাপ বর্জ্য নিয়ে কিছু তথ্য ফাঁস করে দেন। এরপরই তিনি মাস্কের রোষানলে পড়েন। গোয়েন্দা লাগিয়ে এই হুইসেলব্লোয়ারকে খুঁজে বের করেন মাস্ক। তার সর্বনাশ করার জন্য উঠেপড়ে লাগেন। শেষে হাঙ্গেরিতে পালিয়ে বাঁচেন মার্টিন ট্রিপ।
ঘন ঘন মেজাজ বদল ও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ
টেসলার কর্মীরা বেশ কয়েকটি সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন যে মাস্কের ঘন ঘন মেজাজ বদলায়। বদলে যায় তার প্রতিশ্রুতিও।
সংবাদমাধ্যম ওয়্যারডকে টেসলার একজন সাবেক নির্বাহী বলেছিলেন, 'টেসলার প্রত্যেকে ইলনের সঙ্গে শোষণমূলক সম্পর্কে আছে।'
এ ধরনে অস্থিরচিত্ত বসেরা নিজেদের কথামতো কাজ করেন না। হ্যাঁ, নিজেদের ভুল বুঝে সেটা স্বীকার করে সিদ্ধান্ত বদলানো ভালো ব্যাপার। কিন্তু নতুন তথ্য পেয়ে ঘন ঘন নিজের অবস্থান বদলালে কর্মীদের আস্থা ও বিশ্বাস টুটে যেতে পারে। আর মাস্ক এই কাজটিই নিয়মিত করেন।
নিজের দেওয়া প্রতিশ্রুতি রাখতে না পারার অতীত রেকর্ড অনেক আছে মাস্কের। কর্মীদের সঙ্গেও কথার বরখেলাপ করেছেন তিনি। যেমন ২০২০ সালে তিনি মহামারির সময় কারখানায় যেতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ না করলে টেসলা কর্মীদের বাড়িতে বসে কাজ করার অনুমতি দেন। কিন্তু এরপর সশরীরে অফিস না করার কারণে কর্মীদের চাকরিচ্যুত করার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে।
কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য ও হয়রানির সংস্কৃতি
মাস্কের ব্যবস্থাপনা নিয়ে আরও অনেক সমস্যা আছে। তার প্রতিষ্ঠানে প্রায়ই বৈষম্য ও হয়রানির অভিযোগ আসে। যেমন বর্ণবাদমূলক বৈষম্যের দায়ে করা মামলায় টেসলাকে ১৫ মিলিয়ন ডলার জরিমানা করেছিলেন আদালত।
এছাড়া টেসলার কারখানা কর্মীরা জানিয়েছেন, তাদেরকে অনিরাপদ পরিবেশে কাজ তো করতে হয়ই, সেইসঙ্গে উৎপাদন বাড়ানোর জন্যও তাদের ওপর অনৈতিক চাপ দেওয়া হয়।
২০২১ সালে স্পেসএক্সের পাঁচজন সাবেক কর্মী অভিযোগ আনেন, কোম্পানিটি যৌন হয়রানির সংস্কৃতি লালন করে। মাস্ক একগাদা সেক্সিস্ট কৌতুক টুইট করার মাত্র এক মাস বাদেই এই অভিযোগ আসে।
এছাড়া মাস্কের মতো বসেরা কর্মীদের শুধু হাড়ভাঙা পরিশ্রম করাতেই আগ্রহী, তার বিনিময়ে উপযুক্ত পুরস্কার দিতে আগ্রহী না।
যেসব কর্মী হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে কোম্পানিকে মোটা লাভের মুখ দেখান তাদের কপালে বড়জোর জোটে বছর শেষে একটা হলিডে পার্টি আর সামান্য ভূরিভোজ।
কর্মজীবনে কর্মীদের ভারসাম্য প্রয়োজন। এর অর্থ সীমা বেঁধে দিতে হবে। হ্যাঁ, কোনো প্রজেক্টের কাজ শেষ করতে কখনও কখনও কর্মীদের সারা রাত অফিসে থাকতে হতে পারে। কিন্তু তার মানে এই না যে অফিসেই বিছানার ব্যবস্থা করতে হবে। বিশেষ করে কর্মীরা যথেষ্ট কাজ করছে না বলেই বাড়ি চলে যাচ্ছে—এমন ভাবনা থেকে তো এ কাজ করাই যাবে না। এতে কর্মক্ষেত্রের পুরো পরিবেশ বিষিয়ে ওঠে।
কর্মীদের কাছে পাঠানো মেইলে মাস্ক আরও বলেছেন, 'কেবল দারুণ ব্যতিক্রমী পারফরম্যান্সই পাসিং গ্রেড এনে দেওয়া নিশ্চয়তা দেবে।'
মাস্ক বোঝাতে চাইছেন, একজন কর্মীকে কখনোই গোটের (গ্রেটেস্ট অভ অল টাইম) কম কাজ করলে চলবে না।
কিন্তু কারও পক্ষেই এভাবে দীর্ঘদিন কাজ করা সম্ভব নয়। এতে মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
মার্কিন বিশ্লেষক সংস্থা গ্যালাপের ২০১৯ সালের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, কর্মীদের অতিরিক্ত কাজ করানো সত্যিই ক্ষতিকর। ৭৬ শতাংশ কর্মীকে কখনও না কখনও মাত্রাতিরিক্ত কাজ করতে হয়।
গ্যালাপের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, যাদের দিয়ে মাত্রাতিরিক্ত কাজ করানো হয় তারা নতুন চাকরি খোঁজেন বেশি। এতে প্রতিষ্ঠানই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কর্মীর কাজের মান কমে যায়। কর্মীকে যখন মাত্রাতিরিক্ত কাজ করানো হয়, তখন তার মনোযোগ থাকে প্রতিদিন কীভাবে টিকে থাকা যায় তার ওপর। ভবিষ্যতে কীভাবে কাজের উৎকর্ষ বাড়াবেন, সেদিকে তার মন থাকে না।
মাস্ক যা করছেন, সেটি দীর্ঘ মেয়াদে আদতে ক্ষতি ছাড়া কোনো উপকার করবে না। আর অফিসে বিছানার ব্যবস্থা করাটা বরং কাজের পরিবেশ খারাপ করছে।
- সূত্র: দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট, লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস, দ্য গার্ডিয়ান ও কোয়ার্টজ