জাদুকাটা নদীর পাড়ে বড়দিন
মেঘালয়ের খাসি হিলের এধার ওধার থেকে অনেকগুলো ছড়ার মিলনে জন্ম হয়েছে একটি তেজী স্রোতধারা। বাংলাদেশে নেমে এসে সেটি তৈরি করেছে অপরূপা এক নদী। নামটাও আকর্ষণীয়, জাদুকাটা। সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার বারেকের টিলার গা বেয়েই নেমেছে নদীটা। তারপর বয়ে গেছে প্রশস্ত এক বালু চরের মাঝখান দিয়ে। ওই বারেকের টিলা ৩০০ ফুট উচু আর টিলার মাথায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে গুচ্ছ গুচ্ছ বসতি। বসতিগুলো গারো সম্প্রদায়ের, এদের কেউ কেউ অভিবাসিত হয়ে এসেছে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট বা নেত্রকোণার কলমাকান্দা থেকে, কেউ বা বিরিশিরি থেকে। বসতির বেশিরভাগ ঘর টিনের, কোনো কোনোটি পাকা দালানঘর। জাদুকাটা প্রকৃতির দানে ভরপুর। নুড়ি পাথরের বিশাল সম্ভার নদীর বুকে, মাছও ধরা পড়ে অনেক। এখানকার গারো সম্প্রদায়ের প্রায় সকলেই খ্রিস্টান। বারেকের টিলার মাঝখানে আছে একটি গীর্জা। একটি বড় ক্রুশ গীর্জার মাথায়। গীর্জা ঘরে প্রতি রবিবারের সকাল ও বিকালের উপসনায় টিলাবাসী জড়ো হন । টিলার ওপর থেকে ওপারের খাসি হিলের বৈদ্যুতিক আলো ভেসে আসে, মাঝে মধ্যেই শুনতে পাওয়া যায় ঢোলের তাক ডুমা ডুম ডুম।
শীতকালে সন্ধ্যা লাগার পর পরই বারেকের টিলা নিঝুম হয়। আরেকটু রাত ঘনালে কোনো কোনো রাত জাগা পাখির শিস ছাড়া আর বেশি কোনো শব্দ শোনা যায় না। ব্যতিক্রম ঘটে ডিসেম্বর মাসটায়। মাসের প্রায় শুরু থেকেই গারো শিশুরা হাঁটু অবধি সাদা ফ্রক আর লম্বা মোজা পরে টিলার এবাড়ি ওবাড়ি ক্যারল গেয়ে বেড়ায়। যার একটি বাংলায় এমন:
এলো রে এলো রে বড়দিন
মানুষের রুপ ধরে
একটি তারা উদয় হলো
একটি বছর পরে
স্বর্গ ছেড়ে এলো
বড়দিন বড়দিন…
গৃহস্থরা ক্যারল গাইয়েদের টাকা-পয়সা বা চাল-ডাল দিয়ে পুরস্কৃত করে। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে দূরবাসীরা বাড়ি ফিরতে থাকে। এদের কেউ কাজের খোঁজে কেউবা পড়াশোনার তাগিদে বাড়ির বাইরে থাকে সারা বছর। অনেকেই বাবার বাড়ি নাইওর আসে জামাই নিয়ে। বারেকের টিলা এতো জমজমাট আর কখনো থাকে না যেমন থাকে ডিসেম্বরে। একই ঘটনা ঘটে ওপারের খাসি আর গারো পাহাড়েও। সেখান থেকে গান ভেসে আসে কোনো কোনো মাঝ রাতেও। গাড়ির চলাচল বাড়ে। বাড়ি বাড়ি কাগজে বানানো তারা (স্টার) জ্বলতে দেখা যায়।
চব্বিশ ডিসেম্বরের রাতে তো বারেকের টিলা ঘুমায় না। প্রতিটি বসতির নির্দিষ্ট একটি বাড়িকে ক্রিসমাস হাউজ নির্ধারণ করা হয় আগে থেকেই। সে বাড়ি লাল-নীল বাতি দিয়ে সাজানো হয়, মাইকে গান বাজে। বসতির বাড়ি বাড়ি থেকে চাল, ডাল, মুরগী বা সবজি এনে জড়ো করা হয়। রাতভর রান্না চলে। বাড়ির মাঝখানের উঠানে গোল হয়ে জোয়ান-বুড়ো গানের তালে তালে নাচে। বৃত্তের মাঝখানে বাদ্যকরেরা থাকে। এই গানগুলো ধর্মীয় ভাবসম্পন্ন হয়ে থাকে অথবা লোকগাথাভিত্তিকও হয়। রাতের কোনো এক সময় সকলে মিলে একসঙ্গে খেতে বসে।
পরদিন মানে ২০২০ সালের ২৫ ডিসেম্বর সকালটি ছিল কুয়াশাঘেরা। সূর্য কুয়াশার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করতে পারল না বেলা নয়টা বেজে গেলেও। শেষে যখন উঁকি দিল তখনো পূর্ণ আলো ঢালতে পারল না। আমরা টিলা থেকে নেমে রাজাইয়ের দিকে চলতে লাগলাম। দুপাশে বিস্তীর্ণ শস্যক্ষেত্র, পূবে পাহড়ের পাদদেশ পর্যন্ত আর পশ্চিমে নদীর পার। মাঝখানে পাকা পথ। মোটরসাইকেল এখানকার প্রধান বাহন। হেলেদুলে আমরা পথ চলেছি, আমাদের কোনো তাড়া নেই। এন্ড্রুদার বাড়িতে আজ বড়দিনের সভা শুরু হতে দেরী হবে তা বোঝা হয়ে গেছে। সূর্য পুরো পেখম মেলতে আরো ঘণ্টাখানেক সময় তো নেবেই, আর তার মধ্যে আমাদের পৌছানো হয়ে যাবে।
ধান কেটে নেওয়ার পর ফসলী মাঠ উদলা হয়ে আছে। চোখ মেলে দিলে পাহাড়ে হারিয়ে যায় মন। উদাস করে ফেলে। পাহাড়গুলো সবই ভারতের মেঘালয় রাজ্যের। আজ সেখানে বড়দিনের পরব। এন্ড্রুদার বাড়িতেও আজ বড় সমাবেশ। তাদের পরিবারের সদস্যসংখ্যা কম নয়। গারোদের মতো খাসিয়ারাও মাতৃতান্ত্রিক। এন্ড্রুদার বাবা উইক্লিব সিম ছিলেন প্রকৌশলী, কাজ করতেন টেকেরঘাটের চুনাপাথর খনিতে। টেকেরঘাটে চুনাপাথর খনি প্রকল্প চালু হয় ১৯৬৬ সালে। উইক্লিব ছিলেন এখানকার চিফ ইঞ্জিনিয়ার। স্যুট-টাই পরে, ঘোড়ায় চড়ে বাড়ি থেকে খনিতে যেতেন। রাজার মতো ছিল তার চলাফেরা। তার বাড়িকে লোকেরা বলত রাজার বাড়ি আর গ্রামটির নাম হয়ে যায় রাজাই। খাসি হিলের নংস্ট্রইনে ছিল তাঁদের আদি বাস। সেখানে এন্ড্রুদার বাবা ছিলেন গোত্রপতি। দেশ ভাগের সময় নংস্ট্রইনের স্বাধীনতাও চেয়ে বসেছিলেন উইক্লিব। ফলে শাসকের রোষানলে পড়েছিলেন । শেষে তখনকার পাকিস্তানে রাজনৈতিক আশ্রয় নেন। উইক্লিবের শিকারের নেশাও ছিল। ছুটির দিনে বুনো শুয়োর ধাওয়া করতেন। এক হালি বন্দুক ছিল তার, যার দুটি এখনো রাজার বাড়ির বসার ঘরে টাঙানো আছে। উইক্লিবের স্মরণে বাড়ির আঙিনায় একটি স্মৃতিসৌধ গড়েছেন তাঁর পরিবারের সদস্যরা।
হাঁটতে হাঁটতে আমরা রাজার বাড়িতে চলে এসেছি। আমার সঙ্গী শামস শামীম ও বাপ্পা মৈত্র। রাজার বাড়ির সীমানা শেষ হতেই পাহাড় শুরু হয়ে যায়। বাড়ির সীমানা ছোটও নয় মোটে। বাইরে বেশ খানিকটা খোলা জায়গা, তারপর একটি পুকুর আর পুকুরের ধারে অতিথিশালা। ভিতরবাড়িতে তিনটি আলাদা আলাদা ভিটি। ভিতরবাড়ির উঠানেই শামিয়ানা টাঙানো হয়েছে। দূর থেকে দেখতে পেয়ে এন্ড্রুদার এক বোন জামাই আমাদের বরণ করতে এগিয়ে এলেন। মাতৃতান্ত্রিক পরিবার হওয়ায় এন্ড্রুদার বোন, ভাগ্নে-ভাগ্নি, বোনজামাই সব এই বাড়িতেই থাকে। শামিয়ানার একেবারে উত্তরদিকে লম্বা টেবিল পাতা হয়েছে, টেবিলের ওপাশের চেয়ারগুলোতে পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠদের বসার জায়গা রাখা হয়েছে আর এপাশে পরিবারের ছোট সদস্যরা এবং নিমন্ত্রিতরা বসেছেন। একধারে ছোট্ট একটু সঙ্গীত মঞ্চ করা হয়েছে। সেখানে এন্ড্রুদার চার ভাগ্নি কোরাস গাইছে এবং তার ছেলে ডনবক গিটার বাজাচ্ছে।
প্রথমে আশীর্বাদ মন্ত্র পাঠ করলেন এন্ড্রুদার মা। তারপর বড় বোন বড়দিনের শুভেচ্ছা জানালেন খাসি ভাষায়, তারপর বোনজামাই বললেন বাংলায়। এন্ড্রুদা বড়দিনে সমবেত হওয়ার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে অনুষ্ঠান শেষ করলেন। এবার সবাইকে বড়দিনের ভোজে অংশ নেওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হলো। ভোজে বিন্নি ভাত ও মাংসের সুরুয়া পরিবেশন করা হলো।
সভা ভাঙলে পরে আমরা অতিথিশালায় বিশ্রাম নিতে গেলাম। একটা লম্বা টানা ঘরে ৭-৮টি চৌকি পাতা। পর্যাপ্ত পরিমাণে লেপতোষক আছে। জায়গাটি বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে হলেও বাড়ির লোকদের গোপনীয়তা নষ্ট করে না। আমরাও নিশ্চিন্ত মনে চোখ বুঝলাম। এন্ড্রুদা বিকাল নাগাদ চা খেতে ডেকে তুললেন। চা খেয়ে শেষ না করতেই সন্ধ্যা নামল। বাড়িটায় বড়দিনের আলো জ্বলল। বেথেলহেমে যেদিন জন্মেছিলেন যীশু সেদিন থেকেই পৃথিবীকে আলোকিত করে চলেছেন, এই বিশ্বাস স্থিতি পেয়েছে বিশ্বের অনেক জায়গায় মতো এই জাদুকাটা নদীর পারেও।