ক্রিসমাস ট্রি কি আগে ছিল! আধুনিক সময়ের আবিষ্কার, আমেরিকান ব্যবসায়ীরা একে জনপ্রিয় করেছে
বড়দিন উৎসবের কথা শুনলেই চোখে ভেসে ওঠে ক্রিসমাস ট্রি-এর কথা। আপেল, ঘুঘু, মাছ, ফুল, ফল, মোমবাতি, পাখি, স্বর্গদূত ইত্যাদি হরেক রকম ও রঙের নানা উপকরণে সাজানো হয় এই সবুজ গাছ । সান্তা ক্লজের লালা-সাদা টুপি বাদেও এই গাছ ছাড়া যেন বড়দিন উৎসব অপূর্ণ থেকে যায়। তাই ভাবতেই পারেন, এই গাছ বুঝি খ্রিস্টধর্মের 'অবিচ্ছেদ্য রীতি' হিসেবে প্রাচীন কাল থেকেই প্রচলিত।
বড়দিন উপলক্ষে এই গাছের ঐতিহ্যের শুরুটা কোথায় - এ নিয়ে প্রচলিত আছে বিভিন্ন গল্প। কিন্তু সত্যিটা হলো, ক্রিসমাস ট্রি একটি আধুনিক উদ্ভাবন। এটি মূলত এক ধর্মনিরপেক্ষ প্রতীক। কারণ ধর্মগ্রন্থ বাইবেলে এর কোনো ভিত্তি নেই।
জ্ঞান বৃক্ষ (দ্য ট্রি অব নলেজ) থেকে শুরু করে জীবন বৃক্ষ (দ্য ট্রি অব লাইফ) - বাইবেলে অনেক গাছের কথা উল্লেখ আছে। তবে এতে 'ক্রিসমাস ট্রি'-এর কোনো উল্লেখ নেই।
কেবল বাইবেল নয়, প্রাচীন ও পৌত্তলিক উৎসও একই কথা বলে। অনেকে হয়তো ক্রিসমাস ট্রি এবং পৌত্তলিক দেব-দেবী ও উৎসবের মধ্যে সম্পর্ক খুঁজতে পারেন। এই যেমন, মিশরীয় দেবতা রা-এর (যিনি ছিলেন সকল রোমান দেবতাদের প্রধান) মঙ্গল কামনায় দেবদারু গাছ সাজানো হতো।
এছাড়াও রয়েছে রোমান উৎসব স্যাটার্নালিয়া। রোমান কৃষি দেবতা স্যাটার্নকে ঘিরে এই উৎসবে মন্দিরগুলো চিরসবুজ গাছ দিয়ে সাজানো হতো। তবে এসব উৎসবের সাথে ক্রিসমাস ট্রি-এর আদতে কোনো সম্পর্ক নেই।
আরেক লোক বিশ্বাস অনুসারে, গাছটির ঐতিহ্য জড়িয়ে আছে জার্মানির গেইসমার শহরের সাধক বনিফেস-এর সাথে। একটি প্রাচীন ওক গাছের মূলে এক দেবদারু জাতীয় ফার গাছ বেড়ে উঠতে দেখেছিলেন সেইন্ট বনিফেস। তিনি এটিকে যিশুখ্রিষ্টের প্রতি বিশ্বাসের চিহ্ন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। তবে এমন ঘটনার কোনো প্রমাণ নেই, এটি একটি কিংবদন্তী মাত্র ।
প্রাচীন কিংবা আধুনিক, এরকম বহু ধর্মের প্রাব সবকটিতেই ধর্মানুষ্ঠানের অংশ হিসেবে গাছের ব্যবহার রয়েছে, কিন্তু ক্রিসমাস ট্রি অর্থাৎ বড়দিন গাছের কথা অনুপস্থিত।
প্রোটেস্ট্যান্ট ঐতিহ্যমতে, মার্টিন লুথারকে প্রথম ক্রিসমাস ট্রি সাজানোর কৃতিত্ব দেওয়া হয়। তবে এ তথ্য গবেষকরা সমর্থন করেন না।
সত্যি হলো, ক্রিসমাস ট্রি একটি অপেক্ষাকৃত নতুন ঐতিহ্য। ১৭ শতকে এটি একটি ছোট এবং স্থানীয় ঐতিহ্য হিসাবে স্ট্রাসবার্গের আলসেশিয়ান রাজধানীতে এর সূচনা হয়।
জার্মান ঐতিহ্য
স্ট্রাসবার্গের জার্মান নাগরিকরা বড়দিনে 'জাজমেন্ট ট্রেডিশন'-এর অংশ হিসেবে একটি গাছ রাখতেন। এদিন বাবা-মারা তাদের শিশু সন্তানদের কৃতকর্মের বিচার করতেন। ফলাফলে খুশি হলে তাদের জন্য গাছটির নিচে বনবন রেখে দেওয়া হতো, আর সন্তুষ্ট না হলে রাখা হতো না।
১৭৭০-এর দশকে জার্মানির অন্যান্য অঞ্চলেও এই রীতি ছড়িয়ে পড়ে। জার্মান রোম্যান্টিক ঔপন্যাসিক গ্যোটে তার সরোস অব ইয়াং ওয়ার্থার উপন্যাসে ক্রিসমাস ট্রি-এর কথা বলেন। এত সংখ্যক পাঠক কিংবা এত বড় পরিসরে বড়দিন গাছকে তুলে ধরা- এটিই ছিল প্রথম। কিন্তু ১৮৩০-এর দশকের আগ পর্যন্ত সময়েও এই গাছের রীতি ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়নি। ততদিনে আমেরিকায় ক্রিসমাস ট্রি জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেছে।
বড়দিন গাছের ঐতিহ্য ব্রিটেনে আসে ১৮৩০-এর দশকে। রানী ভিক্টোরিয়া এবং প্রিন্স আলবার্ট ব্রিটেনে এ ঐতিহ্য জনপ্রিয় করে তোলেন। ১৯৪০ সালে উইন্ডসর ক্যাসলে বড়দিন উপলক্ষে একটি গাছ সাজান প্রিন্স আলবার্ট। পরবর্তীতে পত্রিকায় ছাপা হলে 'অমর' হয়ে যায় এ দৃশ্য।
১৮৪৮ সালে সাপ্তাহিক সংবাদ ম্যাগাজিন দ্য ইলাস্ট্রেটেড লন্ডন নিউজ-এ একটি ছবি প্রকাশিত হয়, যেখানে একটি কাঁচের তৈরি উপকরণে সজ্জিত ও মোমবাতি প্রজ্জ্বলিত গাছের পাশে রয়েছেন রানী ভিক্টোরিয়া, প্রিন্স আলবার্ট এবং তাদের সন্তানরা। অনেকটা এ ছবিই ব্রিটেনে ক্রিসমাস ট্রি'কে জনপ্রিয় করে তোলে।
বড়দিন মৌসুমের বিশৃঙ্খলাকে এড়াতে
১৮১২ সালের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য পেনসিলভানিয়ায় প্রচলিত হয় প্রথম ক্রিসমাস ট্রি, যেটির নিচে লুকানো থাকত উপহারসামগ্রী। মূলত বড়দিন মৌসুমের বিশৃঙ্খলাকে এড়িয়ে যাওয়ার প্রয়াস হিসেবেই আমেরিকান সংস্কৃতিতে ক্রিসমাস ট্রি'কে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। ঘটনাপ্রবাহ ছিল এরকম -
ঊনিশ শতকের মধ্যভাগের আগে বড়দিনকে একটি কার্নিভাল হিসেবে পালন করা হতো, যেখানে আমোদ-প্রমোদকারীরা (সাধারণত দরিদ্র এবং শ্রমিক শ্রেণী) শহরের চারপাশে কুচকাওয়াজ করতেন। অভিজাতদের দরজায় কড়া নেড়ে তারা ভোজ কিংবা পানীয় চাইতেন। এই অনুশীলনের সাথে একসময় জুড়ে যায় অতিরিক্ত মদ্যপান, প্রমত্ততা, ভাংচুর, অশ্লীলতা ইত্যাদি।
বড়দিন মৌসুমের এই বিশৃঙ্খলাকে প্রশমিত করতে উৎসবকে বাড়ির গণ্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা হতো। শিশুদের বাইরে যেতে অনুমতি দিতেন না বাবা-মায়েরা। তবে নিরাপত্তা বিবেচনায় শিশুদের আনন্দ যেন মাটি না হয়ে যায়, 'বহিরাঙ্গনকেই আনা হতো বাড়ির অভ্যন্তরে!'
বাইরে থেকেই গাছ কেটে নিয়ে আসা হতো এবং শিশুবান্ধব পরিবেশের এই উৎসবে গাছটির চারপাশে জড়ো হতেন মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যরা।
ব্যবসায়ী ও উৎপাদকদের বিপনন
বড়দিন মৌসুমে সৃষ্ট উন্মত্ততা ও বিশৃঙ্খলা কমানোর উদ্দেশ্যে বহিরাঙ্গন থেকে কেটে আনা গাছের রীতিকে ব্যবহার করে আমেরিকান ব্যবসায়ী এবং উৎপাদনকারীরা ক্রিসমাস ট্রিকে জনপ্রিয় করে তুলতে শুরু করেন।
তারা একসময় বুঝতে পারলেন, বরফের এই মৌসুমে বাইরে না গিয়েও বাড়ির মধ্যে থেকেই অনেক আনন্দ উৎসবের প্রচলন করা যেতে পারে, যেগুলোতে পণ্য বিক্রি করে তারা লাভবান হতে পারেন। এভাবেই শুরু হলো গাছের নিচে উপহারসামগ্রী রাখার প্রচলন।
আর এভাবেই মদ্যপান, ভোজন এবং যৌনতা - বড়দিনের অমিতাচারের অতীত পরিণত হলো মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উপহার বিনিময়ের উৎসবে।
র্যাপিংপেপারে মোড়ানো বড়দিন উপহার ১৯৪০-এর দশকে আমেরিকার এক উদ্ভাবন, যেটি আলোড়ন তুলেছিল গোটা বিশ্বে! এক্ষেত্রে বই প্রকাশকদের বিপণন কৌশল বেশ কাজে দিয়েছিল। তারা ছোটগল্প এবং কবিতার বই প্রকাশ করত, যেগুলোতে লেখা থাকত কীভাবে উপহার দিয়ে শিশু সন্তানদের বাড়ির ভেতর রেখেই খুশি রাখা যায়। এই যেমন, ১৮৪৫ সালে প্রকাশিত ক্রিস ক্রিঙ্গল-এর বই ক্রিসমাস ট্রি।
তবে খুব চাতুর্যতার সাথেই, বই প্রকাশকরা উপহার দেওয়া-নেওয়ার এই নতুন রীতিকে একটি পুরোনো 'লোক ঐতিহ্য' হিসেবে উপস্থাপন করেন। বাবা-মায়েদের কাছে এই রীতিকে এমনভাবে তুলে ধরা হয়, যেন উপহারের এই রীতি বাইবেলে উল্লেখিত সোনা, লোবান এবং গন্ধরসওয়ালা ম্যাগির মতোই প্রাচীন।
সুতরাং যিশুখ্রিষ্টের জন্মদিনকে ঘিরে পালিত উৎসবে গাছ এবং উপহারসামগ্রীর প্রচলন কোনো জার্মান অভিবাসী থেকে আসেনি। এসেছে ব্যবসায়ী, উৎপাদক এবং বই প্রকাশকদের হাত ধরে।
ক্রিসমাস ট্রি- এমন নাম থাকা সত্ত্বেও, আধুনিক বড়দিন গাছের 'কল্পিত খ্রিস্টান অতীতের' সাথে সংযোগ নেই বললেই চলে। রঙবেরঙের নানা উপকরণে সাজানো ক্রিসমাস ট্রি-এর এই জনপ্রিয়তার সাথে জুড়ে আছে এক ভোগবাদী অর্থনীতির শক্তি।