১০ টাকায় ইলিশ, ১ টাকায় লবণ! প্রয়োজন যতটুকু ঠিক ততটুকুই কেনা যায় জুয়েলের দোকানে
"গরুর গোশ, ইলিশ মাছ তো আমাদের মতো নিম্ন আয়ের মানুষেরা ছয় মাসেও চোখে দেখার সুযোগ পায় না। এই যে দেশে ইলিশের উৎপাদন বাড়ছে, সিজনে সবাই আনন্দ করে জাতীয় মাছ খাইতেছে, আমরা মাসের পর মাস টাকা জমায়েও ৭-৮শ টাকায় একটা ইলিশ কেনার সাহস করতে পারি না। জুয়েল ভাইয়ের দোকানে ১০ টাকায় ইলিশের পিস পাওয়া যায়, গরুর গোশের প্যাকেটও শুরু হয় ১০ টাকা থেকে। এখন প্রায়ই অল্প করে গরুর গোশ বা ইলিশ কিনে খেতে পারি প্রয়োজন মতো। মেহমান আসলেও খুব একটা বিপদে পড়তে হয় না। মাছ-মাংস বা অন্য যেকোনো বাজার যেকোন পরিমাণে নেওয়ার সুযোগ আছে। এইটা একটা বড় সাপোর্ট," বলছিলেন রাজধানীর দক্ষিণখানের এক গার্মেন্টসে নিরাপত্তা রক্ষীর কাজ করা মো: সাদ্দাম। সবে গার্মেন্টস ছুটি হয়েছে। ফায়দাবাদের পাটোয়ারী স্টোরে বাড়তে শুরু করেছে ক্রেতার ভিড়। মো: শাহাদাত হোসেন জুয়েলের এই দোকানে তেল, চিনি, মাছ, মাংস থেকে শুরু করে চাল-ডালসহ নিত্য প্রয়োজনীয় যেকোনো বাজারই পাওয়া যায় সাধ্যের ভেতর যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকুই।
১ টাকায় চিনি/লবণ বা মুড়ি, ২ টাকায় আদা/হলুদ/মরিচ, ৩ টাকায় চা পাতা, ৫ টাকায় কোল্ড ড্রিংকস বা রান্নার তেলের মতো হাতের নাগালে ভেতর সাজিয়ে রাখা নানা পণ্যের পসরা পাটোয়ারী স্টোরে। দোকান মালিক জুয়েলের ভাষ্যে, "এভাবে প্যাকেট করে সাজিয়ে রেখেছি কাস্টমারদের আশ্বস্ত করার জন্যই। ২০০৭ সাল থেকে মুদির ব্যবসা শুরু করছি আমি। তখন থেকেই সবার চাহিদা মতো যতটুকু দরকার ততটুকুই কেনার সুযোগ আছে আমার দোকানে। কিন্তু অনেকেই সংকোচ করে চাইতে পারত না কোনো কিছু কম করে। কারণ আমাদের দেশে বেশিরভাগ দোকানেই প্রতিদিনের দরকারি জিনিসগুলো একটা নির্দিষ্ট পরিমাণের কমে কেউ বিক্রি করে না। পকেটে অল্প টাকা নিয়ে বেশি পরিমাণে জিনিস কেনা অনেকের জন্যই খুব চাপের বিষয়।
"এমন অনেক মানুষকে দেখছি বাজার করতে গেলে মুদির আইটেম কিনতে কিনতে মাছ কেনার টাকা থাকে না। আবার মাছের বাজারে ঢুকলে মুদির আইটেম কিনতে পারে না। সেক্ষেত্রে তাদের প্রতিদিনই কোনো না কোনো অভাব থেকেই যায়। মানুষ যেন অল্প টাকার মধ্যে তার দিনের প্রয়োজন মেটানোর সুযোগ পায় সেজন্যই নিজের জায়গা থেকে এইটুকু করার চেষ্টা করি আমি। এই প্যাকেটগুলো দেখে কাস্টমাররা যেন সংকোচ ছাড়াই যেকোনো পরিমাণের জিনিস চাইতে পারে সেটাই উদ্দেশ্য আমার।"
রাজধানীর দক্ষিণখানের স্থানীয় জুয়েলের পুরো পরিবার। বাবা আর বড় ভাইয়ের সঙ্গে শুরুতে ব্যবসা করতেন গুলশানে। এইচএইসসি পর্যন্ত পড়াশোনার পর তার ইচ্ছা ছিল অস্ট্রেলিয়ায় স্থায়ী হওয়ার। আইইএলটিএসের প্রস্তুতিও নিয়েছিলেন বেশ কিছুদিন। ব্যক্তিগত নানা কারণে সেই পরিকল্পনা বাদ দিতে হলে নিজের বাসার নিচেই তার নিজস্ব মুদি দোকান শুরু করেন। করোনা অতিমারীর সময়ে ঘরে ঘরে অভাব-দুর্দশা দেখে এভাবে পণ্য বিক্রির উদ্যোগ নেন তিনি।
কয়েক বছর ধরেই পাটোয়ারী স্টোরে এই ব্যবস্থা থাকলেও সপ্তাহখানেক আগে এক ব্লগারের ভিডিওতে জুয়েলের ব্যবসার অভিনবত্ব প্রচার হলে দেশ জুড়ে বেশ প্রশংসিত হতে থাকে তার উদ্যোগ। এখন আশেপাশের অনেক এলাকা থেকেও কৌতূহল নিয়ে দোকানটি দেখতে আসছেন মানুষজন। অনেকেই নিজেদের প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার পাশাপাশি ধন্যবাদও জানিয়ে যাচ্ছেন দোকানিকে। কাজের ব্যস্ততাও বেড়েছে জুয়েলের। ব্যবসাকে মানব সেবার মাধ্যম হিসেবেই দেখেন তিনি। জুয়েলের এই উদ্যোগে গর্বিত বাবা হানিফ পাটোয়ারীও।
নাতিকে কোলে নিয়ে দোকানে ২০ টাকার তেল কিনতে এসেছিলেন বয়স্ক রাশেদা। চেহারায় কৃতজ্ঞতার ছাপ নিয়ে জুয়েলের প্রতি তার ভালবাসার কথা জানান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে। "আজকে সাত-আট বছর ধইরা জুয়েলের দোহান থেইকা সদাই নেই আমি। কোনো কাস্টমাররেই ঘুইরা যাইতে হয় না এইহান থেইকা। হে (জুয়েল) যে সুন্দর কইরা মানুষের চাহিদা মতো দিতাছে সব জিনিস, অন্য কোনো দোহানেই কেউ দেয় না। ১০ ট্যাহার আদা লাগলে কোনো দোহানেই দেয় না, হে পাঁচ ট্যাহারও দেয়। আমি হেরে সবসমই কই যে তুমি মাইনষের লাইজ্ঞা করতাসো আল্লায় তুমারে দিব।" পাটয়ারী স্টোরের প্রতি এমন দোয়া আছে এলাকাবাসী সবারই।
দেশে করোনাভাইরাস মহামারি শুরু হওয়ার কিছুদিন আগের ঘটনা স্মরণ করে জুয়েল বলেন, "একবার মাসের শেষের দিকে এক চাকরিজীবি আসেন আমার দোকানে। তার কাছে খুব অল্প টাকা আছে তখন। লজ্জায় আমার কাছে বলতেও পারতেছে না। খুব ইতস্তত করে বললো, 'ভাই, চিনি সর্বনিম্ন কত টাকার বিক্রি করেন? আর গুড়া দুধের কি ছোট প্যাকেট আছে?' তখন কিন্তু বাজারে ১০-২০ টাকার গুড়া দুধের প্যাকেট ছিল না। জিজ্ঞেস করলাম তার কতটুকু লাগবে। সে বললো বাচ্চাকে খাওয়াবে, অল্প করে দিলেই হবে। তখন তাকে ১০ টাকার চিনি দিলাম আর ২০০ গ্রামের গুঁড়া দুধের প্যাকেট খুলে ৩০ টাকার দুধ মেপে দিলাম। তালমিছরিও লাগত তার। সেটাও আধা কেজির প্যাকেট খুলে ১০ টাকার মেপে দিলাম। ৫০ টাকার মধ্যেই বাচ্চার জন্য প্রায় তিন-চারদিনের খাবার নিয়ে যেতে পারল সে। ওইদিন লোকটা খুবই খুশি হইছিল সবকিছু কিনতে পারায়। বারবার কৃতজ্ঞতা জানাইছিল আমাকে। এরকম কিছু ঘটনা থেকেই আসলে অনুপ্রেরণা পাইছি আমি।"
প্রতিদিন ভোরে উঠে নিজেই মাছ মাংসের বাজার করেন জুয়েল। ইলিশ ছাড়াও, রুই, তেলাপিয়া, পাবদাসহ নানা ধরনের মাছ রাখতে চেষ্টা করেন দোকানে। গরুর মাংসের পাশাপাশি মুরগির মাংস রাখার পরিকল্পনাও করছেন। এভাবে অল্প অল্প করে পণ্য বিক্রি করতে গিয়ে বিক্রি বা লাভের হিসাবে গণ্ডগোল হয় কি না জানতে চাইলে বলেন, "লাভটা আমি গড়ে হিসাব করি। আমার এখানে তো সব ধরনের কাস্টমারই আসে। সবাই তো আর ১ টাকার চিনি বা ৫ টাকার তেল নেয় না। বেশিরভাগই কেজি হিসেবেই কেনেন। এর মধ্যে কয়েকজন যদি অল্প করে কয়েক টাকার জিনিস নেয় তাতে হিসাবে খুব একটা ঝামেলা হয় না। আর লাভ কম-বেশি সবেতেই হয়। কোম্পানি যদি ১ টাকার চকলেট বিক্রি করেও লাভ করতে পারে, তাহলে আমি ১-২ টাকার জিনিস বিক্রি করে লাভ করতে পারব না কেন। আলাদা করে মেপে প্যাকেট করাটা একটু সময়সাপেক্ষ। কিন্তু মানুষের উপকার করার চিন্তা থাকলে আসলে সবই করা যায়। ইচ্ছাটাই আসল।"
জুয়েলের এমন উদ্যোগ দেখে আশেপাশের দোকানিরাও উৎসাহী হচ্ছেন কি না জিজ্ঞেস করলে জানান, এখনো কাউকে এরকম উদ্যোগ নিতে দেখেননি। শুরুতে আশেপাশের ব্যবসায়ীরা তাকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টাও করতেন। সেগুলোকে পাত্তা না দিয়ে নিজের কাজ অব্যাহত রেখেছেন তিনি।
জুয়েলের দোকানের গলির শুরুতেই আরেকটি মুদির দোকান বিসমিল্লাহ জেনারেল স্টোর। সেখানকার ব্যবসায়ী ফারজানা ববির কাছে জানতে চেয়েছিলাম তার দোকানেও এরকম উদ্যোগ নিতে আগ্রহী হয়েছেন কি না। তিনি বলেন, "কাস্টমার এসে চাইলে তাদের দরকার অনুযায়ী যেকোনো মাপের জিনিস দিতে পারি। কিন্তু জুয়েল ভাইয়ের মতো সব জিনিস আলাদা করে প্যাকেট করে বিক্রি করার সময় আমার নাই। সে দিতেছে কারণ তার অনেক সময় আছে।"
শুধু নিজের দোকানেই নয়, একদিন দেশের সব এলাকায় এমন উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে এমনটাই স্বপ্ন দেখেন জুয়েল। তার মতে, কেবল নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্যই এ ব্যবস্থা উপযোগী-তা নয়। সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যার যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকু পণ্য কেনার সুযোগ থাকলে মানুষের অপচয় কমে যাবে অনেক গুণ।