ফেসবুক থেকে বাংলার তামিল হিরো বনে যাওয়া নিশান কুরাইশীর উত্থান
'তামিল সিনেমার অ্যাকশন শর্ট ভিডিও বানানোর পর থেকে তামিলদের মতো লুক নিতে দাড়ি, গোঁফ রাখা শুরু করি। তামিল নায়কদের বেশিরভাগের বড় চুল, ঘন দাড়ি আর গোঁফ থাকে। এই রকম লুকে একটা রাগী রাগী, মানে মাথা গরম ভাব আসে। মারামারির দৃশ্যের সাথে তখন এটা মানানসই লাগে। আমি আগে শান্তশিষ্ট আর চুপচাপ ধরনের মানুষ ছিলাম। আগের স্বভাবেও কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। এখন মনমতো কিছু না হলেই অল্পতে মাথা গরম হয়ে যায়। তাই বলে আমার রাগ উঠলে অ্যাকশন ভিডিওগুলোর মতো অন্যদের ধরে পিটাই না।
আশেপাশের লোকজনের থেকে তখন দূরত্ব মেনে চলি। হয়তো আমার কাজের ছাপ আমার ব্যক্তিত্বের ওপর পড়ছে। ইদানীং তাই কিছু হলেই এমন রাগ উঠে যায়। আমরা যা করি তা আমাদের ওপর কিছুটা হলেও প্রভাব ফেলে, হতে পারে এই জন্যেই আমার এমন পরিবর্তন এসেছে'—অভিনয়ে ধারণকৃত চরিত্রকে ফুটিয়ে তোলার জন্যে বাহ্যিক চেহারার পরিবর্তনের সাথে কীভাবে দীর্ঘদিনের অভ্যাস পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে, এই ব্যাপারে বলছিলেন অ্যাকশন ভিডিও নির্মাতা নিশান কুরাইশী।
কারও ইচ্ছে থাকে বড় হয়ে পাইলট, ডাক্তার হবে—কারও আবার স্বপ্ন সমাজের গতানুগতিক পেশাগুলোয় নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার। এসব কিছুর ধার না ধেরে মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার বাসিন্দা নিশান কুরাইশীর শখ জাগে নিজেকে হিরো হিসেবে গড়ে তোলার। বাণিজ্যিক সিনেমায় ডাক না পেলেও বহুদিনের লালিত স্বপ্ন ও শখের কাজ থেমে থাকেনি এই তরুণের।
তাই তো সমাজের অন্যদের কথায় কান না দিয়ে নিজেই ভিডিও করে তাতে অভিনয় করা শুরু করেন। পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা করতে অর্থ, প্রযুক্তিগত সুবিধা ও প্রচুর লোকবল প্রয়োজন। এগুলোর কোনোটিই তার ছিল না। সিনেমা অনুরাগী নিশান তাই বহুল-আলোচিত দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমাগুলোর মারামারির দৃশ্য শর্ট ভিডিও আকারে রিক্রিয়েট করা আরম্ভ করেন।
করোনার সময় নিশান কুরাইশীর অভিনীত ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক ভাইরাল হলে 'বাংলার তামিল হিরো' নামে পরিচিতি পেতে শুরু করেন তিনি। নিশান কুরাইশীর বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা তাকে এই নামেই ডাকে। তামিল সিনেমার অ্যাকশন ভিডিও রিক্রিয়েট করা এই তরুণের চেহারা ও সাজসজ্জার জন্যেই তাকে এই নাম দিয়েছেন পরিচিত-অপরিচিতরা।
বাউন্ডুলে থেকে বাজিমাত
ছোটবেলায় প্রায়ই স্কুল ফাঁকি দিয়ে বন্ধুদের সাথে ঘুরতে চলে যেতেন নিশান। আড্ডায় মেতে থাকতে গিয়ে পড়াশোনায় ঠিকঠাক মন ছিল না তার। তাই মাধ্যমিক পরীক্ষার পর নিজ থেকেই পড়াশোনা বন্ধ করে দিলেন। জীবনে কিছু করতে হলে পড়াশোনা করেই হতে হবে—এই ধারণায় বিশ্বাসী নন অনেকেই। তাদের দলের একজন নিশান। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগত যোগ্যতা কম থাকলেও খুঁজে নিয়েছেন নিজের আগ্রহের জায়গা। আগ্রহ ও তীব্র ইচ্ছার মিশলে নিজের মধ্যে থাকা সুপ্ত প্রতিভা দেখিয়ে চলেছেন এই ভিডিও নির্মাতা।
কিন্তু এসব রাতারাতি হয়ে যায়নি। এর জন্যে তাকে কঠিন সব পথ আর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। পড়াশোনা বাদ দিয়ে দেওয়ার পর পরিবারের সিদ্ধান্তে তাকে চট্টগ্রাম পাঠিয়ে দেওয়া হয় কাজের জন্যে। সেখানে ৩ বছর তিনি হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যারের কাজ শেখেন। তারপর নিজ এলাকায় ফিরে পুরোনো মোবাইল সারানোর একটি দোকান দিয়ে বসেন। তার সেই পেশাগত কাজের অভিজ্ঞতা শখ পূরণের ক্ষেত্রে আশীবার্দ হয়ে দাঁড়ায়। কারণ ভিডিও শুট করার পর এডিট করতে যা কিছু জানা প্রয়োজন, সে সবকিছুই তিনি চট্টগ্রামে কাজ করতে গিয়ে শিখেছিলেন। কিন্তু বিপত্তি বাধে অন্য জায়গায়!
এডিটের যাবতীয় কাজ নিশান কুরাইশীর নখদর্পণে থাকলেও ক্যামেরায় ভিডিও ধারণে তিনি পারদর্শী ছিলেন না। তাই অভিনয়ে নিজ পারদর্শিতা দেখাতে পারলেও ক্যামেরা পরিচালনার জন্য তাকে পরিচিত বন্ধুদের মধ্য থেকে একজনকে খুঁজে বের করতে হয়েছিল। প্রথমদিকে মোবাইল দিয়েই ভিডিও ও এডিটের যাবতীয় কাজ করা হতো। তারপর শখের কাজকে পেশাগত জায়গায় নিয়ে যেতে কেনা হয় ক্যামেরা ও কম্পিউটার। শুধু তা-ই নয়, মারামারির দৃশ্যে ব্যবহারের জন্যে নিজের পকেটের টাকা খরচা করে নকল বন্দুক, লাঠি, হকিস্টিক বানিয়ে নিয়েছেন নিশান।
মাঝেমধ্যে বাড়িতে ব্যবহৃত আসল হাতিয়ার নিয়ে আসেন ভিডিওতে ব্যবহার করার জন্যে। কারণ ক্যামেরার সামনে থেকে শট নেওয়ার সময় নকল হাতিয়ার দেখে দর্শক বুঝে ফেলতে পারে। প্রতিটি ভিডিও শুট করার জন্যে আগে থেকে স্থান নির্ধারণের পাশাপাশি বালি, সিমেন্ট ও আলতা জোগাড় করে রাখতে হয় তাকে। বাণিজ্যিক সিনেমার মতো বাজেট না থাকলেও এই সাধারণ কিছু দিয়েই অসাধারণ অ্যাকশন ভিডিও বানিয়ে চলেছেন নিশান কুরাইশী।
তরুণ ভিডিও নির্মাতা নিশান নিজের খারাপ সময়ের কথা বলতে গিয়ে জানান, 'ভেবেছিলাম মোবাইল দিয়ে কাজ করে ভিডিও রেজুলেশন কম হওয়ার পরেও যখন লোকের এতো প্রশংসা পাচ্ছি, তাহলে ক্যামেরা কিনলে আরও ভালো করে কাজটা করতে পারব। বন্ধুর আশ্বাসে পরিচিতদের কাছ থেকে ৪ লাখ টাকা ধার নিয়ে ক্যামেরা ও পিসি কিনি। কিছুদিন পর ক্যামেরা পরিচালনার দায়িত্বে থাকা বন্ধু নিজের ব্যক্তিগত জীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়লে আমার সবকিছু ভেস্তে যায়।
কী করব কিছু বুঝতে পারছিলাম না, কারণ আমার ধার করা টাকা ফেরত দিতে হবে। আর যে জন্যে এসব কিনেছিলাম, সেখানেও কাজের কাজ কিছু হয়নি। তারপর নতুন উদ্যমে পরিচিত এক ছোট ভাইকে ক্যামেরা পরিচালনার কাজ শেখানো হয়। কিন্তু ছেলেটির বাবা আমাদের সাথে ভিডিও করতে দিতে রাজি হয়নি। কূলকিনারা না পেয়ে কেনা দামের চেয়ে অনেক কম টাকায় ক্যামেরা বিক্রি করতে বাধ্য হই। আমার দোকানের ব্যবসা থেকে এক বছর ধরে একটু একটু করে ধারের টাকা পরিশোধ করতে হয়েছিল।'
স্কুল ফাঁকি দেওয়া নিশানের এখন দেশজুড়ে ভক্ত রয়েছে। পুষ্পা, আরআরআর, ডিজে, কেজিএফের মতো সম্প্রতি হিট হওয়া দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমার মারামারির দৃশ্যগুলোর ভিডিও বানান নিশান ও তার দলের কয়েকজন মিলে। দৃশ্যের সাথে জুড়ে দেওয়া হয় সিনেমার হুবহু সংলাপ, ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ও দুমদাম মারামারির সাউন্ড। শুধু তা-ই নয় সিনেমার সাথে মিল রয়েছে এমন স্থান খুঁজে বের করে, সেখানে গিয়ে ভিডিও শুট করেন তারা।
প্রতিষ্ঠিত নায়ক না হয়েও নিশান কুরাইশীর শর্ট অ্যাকশন ভিডিওগুলো নেটিজেনদের কাছে বহুল প্রশংসা পেয়েছে। তার ভিডিওর প্রশংসা করতে গিয়ে অনেকেই বাংলা সিনেমার অ্যাকশন কতটা দুর্বল তা অভিব্যক্ত করেছেন কমেন্টে। ভিডিওগুলোর কমেন্টে লোকজন এই তরুণদের প্রতিভার বাহবা দেওয়ার পাশাপাশি তাকে বাণিজ্যিক সিনেমায় কেন কাজ করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না সে প্রশ্নও তোলেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় পিছিয়ে পড়া নিশান যথাযথ সুযোগ পেলে ভিডিও নির্মাতা হিসেবে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রাখবেন বলে ভক্ত ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের শুভাকাঙ্ক্ষীদের বিশ্বাস। তাই অনেকেই ভিডিওগুলোর কমেন্টে বাংলাদেশের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ও প্রযোজকদের মেনশন দিয়ে থাকেন।
প্রবল ইচ্ছা প্রতিবন্ধকতাকে হার মানায়
ভিডিও দেখে লোকের বাহবা মিললেও দু-বছরে এখান থেকে নিশান কুরাইশীর আয় শূন্য। একেকটি ভিডিও তে লক্ষ লক্ষ ভিউ হলেও এই টাকা তিনি বা তার দলের কেউ পাননি। প্রযুক্তির নানা বিষয়ে দক্ষ নন বলে ভিডিও বানানোর দুই বছর পেরিয়ে গেলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এখনো নিজের কোনো পেজ ও ইউটিউব চ্যানেল তেমনভাবে দাঁড় করাতে পারেননি নিশান। ক্যামেরা বিক্রির পর পরবর্তীতে আর সামর্থ্য হয়নি কেনার। তাই নিজের শখের কাজ পুনরায় শুরু করতে আরিয়ান মুন্না নামের একজনের সাথে চুক্তিবদ্ধ হন। চুক্তি অনুযায়ী নিশান ভিডিওর যাবতীয় দায়িত্বে থাকবেন এবং ভিডিও ধারণে ব্যবহার করা হবে আরিয়ান মুন্নার ক্যামেরা। কিছু কিছু ভিডিওতে আরিয়ান নিজেও অভিনয় করবেন নিশানের সাথে। আর সেই ভিডিওগুলো আপলোড করা হবে আরিয়ান মুন্নার নিজস্ব পেজ থেকে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিশানের অভিনীত ভিডিও ভাইরাল হলে প্রতিষ্ঠিত পরিচালকদের কেউ কেউ তার সাথে যোগাযোগ করেন। নাটকে অ্যাকশন ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করে প্রথমবারের মতো নিশান কুরাইশী নিজের শখের কাজ থেকে অর্থ উপার্জন করেন।
ভিডিও এত বেশি ভাইরাল হওয়ার পরেও কেন টাকা পাচ্ছেন না এই বিষয়ে নিজ থেকেই জানালেন তরুণ এই নির্মাতা। 'বন্ধুরা মিলে প্রথম করা অ্যাকশন ভিডিওটি আমার ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডি থেকে আপলোড করার পর ৩০ লাখের মতো ভিউ হয়েছিল। সেখান থেকে উৎসাহ পেয়ে ইউটিউবে চ্যানেল খুলি। তখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমাদের কোনো পেজ ছিল না। এসব বিষয়ে আমার পূর্ব ধারণা না থাকায় চ্যানেলে সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা খুব কম ছিল। ১০ হাজার সাবস্ক্রাইবার হওয়ার পর চ্যানেলটি হ্যাক হয়ে যায়। হ্যাক করা চ্যানেল কীভাবে ফিরে পাওয়া যায়, তা-ও জানা ছিল না। তাই পুনরায় আরেকটি চ্যানেল খুলি। বর্তমানে "নিশান কুরাইশী" নামের ফেসবুক পেজে ২৫ হাজার ফলোয়ার রয়েছে, আর 'সাইবারব্লেড' নামের ইউটিউব চ্যানেলে ৯ হাজারের ওপর সাবস্ক্রাইবার।
'অন্য পেজে ফলোয়ার বেশি থাকায় তারা আমাদের ভিডিও আপলোড করে আয় করছে ঠিকই, কিন্তু প্রচার ছাড়া আমাদের আর কোনো লাভ হচ্ছে না। তাই আমার পরিকল্পনা আছে এমন কোনো বন্ধুকে অনলাইনের এসব দায়িত্ব দেওয়া যার এসব ব্যাপারে ভালো জ্ঞান আছে। আমাদের চ্যানেলের সাবস্ক্রাইবার সংখ্যা বাড়লে তখন হয়তো এখান থেকে আমাদের অর্থ আসবে। যা দিয়ে পুনরায় ভিডিও করার জন্য ক্যামেরা কেনা সম্ভব হবে। তখন আর অন্যদের সাথে কোলাবোরেট করে কাজ করতে হবে না।'
পূর্বে শুট করা ভিডিও একটি একটি করে এডিট করে আপলোড করে যাচ্ছেন নিশান। ভবিষ্যতে আরও ভালো কিছু করার স্বপ্ন দেখেন তরুণ এই অ্যাকশন ভিডিও নির্মাতা। তিনি আশাবাদী তার কাজের জন্য বাণিজ্যিক সিনেমা থেকে ডাক পাবেন একদিন। তবে নিজের মতো স্বাধীনভাবে কাজ করতে চান তিনি। এক্ষেত্রে নিজের চিন্তা ও প্রতিভার সর্বোচ্চটা দিয়ে নতুন কিছু করার মাধ্যমে বাংলা সিনেমাকে অনন্যভাবে তুলে ধরতে চান নিশান।