ড্যান কেক: এক নবাগত ব্র্যান্ড যেভাবে বাজারে প্রতিষ্ঠিত হলো
ড্যান কেক প্রথম বাংলাদেশে আসে ২০১৫ সালে। ওই সময় খুব বেশি মানুষ ভাবতে পারেনি যে কোম্পানিটি এত দূর আসতে পারবে।
সুইস রোল, মাফিন, লেয়ার কেক—এসব তো ঘরের পাশের বেকারিতেই পাওয়া যায়। সাধারণ মানুষ বা দোকানদার কেন এসব খাবারের প্রতি আগ্রহী হবে?
কিন্তু দেখা গেল, সাধারণ মানুষ ও দোকানদার উভয়েরই ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে। রাস্তার পাশের চায়ের দোকান, মুদি দোকান থেকে শুরু করে হাই-এন্ড সুপারমার্কেট—সর্বত্র নিজেদের উপস্থিতি জানান দিতে লাগল ড্যান কেকের পণ্যগুলো। অন্তত শহর এলাকায় তা-ই দেখা গেল।
ড্যান ফুডস লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজিম উদ্দিন আহমেদের মতে, বাংলাদেশে সহজে ভালো মানের রেডি-টু-ইট ফুড পণ্য পাওয়াটা বরাবরই খুব ঝামেলার বিষয় ছিল। আর এটাই তাকে বাংলাদেশে ড্যান ফুডস প্রতিষ্ঠিত করতে উৎসাহিত করে।
তিনি বলেন, 'ড্যান কেকের মতো একটি ইউরোপীয় ব্র্যান্ড, যা আন্তর্জাতিক মানের খাদ্যপণ্য তৈরিতে দক্ষ এবং স্বাস্থ্যবিধি ও গুণমানের ব্যাপারে আপসহীন, বাংলাদেশের রেডি-টু-ইট ফুড মার্কেটের সমস্যাগুলো অনেকাংশে সমাধান করতে পারবে।
'আমি বিশ্বাস করি, ড্যান কেকের সাফল্য বাংলাদেশের ভোক্তাদের জন্য অন্যান্য উচ্চমানের খাবার নিয়ে আসতে আরও অনেককে অনুপ্রাণিত করবে।'
ড্যান ফুডস লিমিটেড ডেনিশ কোম্পানি ড্যান কেক এ/এস ও বাংলাদেশি কোম্পানি পান্ডুঘর লিমিটেডের সমান সমান অংশীদারত্বের যৌথ উদ্যোগ। ড্যান কেক এ/এস স্ক্যান্ডিনেভিয়ান বাজারে সুইস রোল ও কেকের বাজারের শীর্ষস্থানীয় কোম্পানি। এ প্রতিষ্ঠানের আরও একাধিক ব্র্যান্ডের মালিকানা রয়েছে। আর পান্ডুঘর গ্রুপের যাত্রা শুরু রিয়েল এস্টেট কোম্পানি আরবান ডিজাইন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের (ইউডিডিএল) সঙ্গে। বর্তমানে পান্ডুঘর পোলার আইসক্রিমের মতো ব্র্যান্ডের যঙ্গে যুক্ত আছে।
ড্যান কেক এ/এস-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্লাউস এসকিল্ডসেন বলেন, কোম্পানিটি এশিয়ার ক্রমবর্ধমান বাজারে প্রবেশের সুযোগ খুঁজছিল। দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন, ক্রমবর্ধমান ভোক্তাব্যয় সক্ষমতা ও বিশাল বাজারের কারণে এশিয়ায় তারা বাংলাদেশকে বেছে নিয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ কৌশলগতভাবে সুবিধাজনক ভৌগোলিক অবস্থানে রয়েছে। এখান থেকে মালদ্বীপ, নেপাল ও ভারতের মতো অন্যান্য প্রধান এশীয় দেশগুলোতে পণ্য পৌঁছানো সহজ।
বাংলাদেশে ব্র্যান্ড গড়ে তোলা
ড্যান কেক যখন প্রথম আসে, তখন দেশে তৈরি একই ধরনের আরও অনেক পণ্য ছিল বাজারে। ড্যান কেক এই চ্যালেঞ্জগুলো কীভাবে কাটিয়ে উঠল?
এ প্রশ্নের উত্তরে ড্যান ফুডস লিমিটেডের হেড অভ সেলস শহীদ বিন সারোয়ার বললেন, 'চ্যালেঞ্জ অবশ্যই ছিল, কিন্তু আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে আমরা অনন্য এবং দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আমরা যখন বিক্রি শুরু করি, দোকানগুলো স্বাভাবিকভাবেই আমাদের পণ্য নিতে চাইত না। আমাদের পণ্যের মেয়াদ শেষ হয়ে যেত, আমরা সেগুলো ফিরিয়ে নিতাম। তবু আমরা কখনও মানের সাথে আপস করিনি। এখন দোকান মালিকরা বলেন, "ও, ড্যান কেকের পণ্য? এগুলো আমাদের লাগবে!"'
সারোয়ারের মতে, দেশের অন্যতম বৃহৎ সুপার শপ চেইন যখন ড্যান কেকের পণ্যের জন্য নিজেই তাদের কাছে এসেছিল, সেটাই এখন পর্যন্ত ড্যান কেকের সবচেয়ে বড় অর্জন।
আয় বা প্রবৃদ্ধি-সংক্রান্ত কোনো সংখ্যা বা পরিসংখ্যান জানাতে করতে অনিচ্ছা প্রকাশ করে তিনি বলেন, 'এখন বলতে পারি, আমরা যখন শুরু করেছিলাম, তখন থেকে আমাদের ১০০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ধরুন, আমরা যদি শুরুতে ১০০ টাকার ব্যবসা করতাম তবে এখন ২০০ টাকার ব্যবসা করছি। প্রতি বছরই আমরা বড় হচ্ছি।'
বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে বিক্রয় কর্মীসহ প্রায় সাড়ে চারশ শ্রমিক কাজ করছেন।
সারোয়ার জানান, তারা তাদের পণ্যের ব্যাপারে অভিযোগ পেয়েছেন খুবই কম। যে কয়বার অভিযোগ পেয়েছেন, প্রতিবার ওই ব্যাচের পুরো পণ্য খুঁজে বের করে বাজার থেকে তুলে নিয়েছেন। আর ড্যান কেক মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্যও পুরোপুরি নিজ দায়িত্ব দোকান থেকে ফিরিয়ে নেয়।
ড্যান কেক একটি অনন্য বিপণন কৌশল অবলম্বন করে। যেমন, জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও তারা টেলিভিশন বা বিলবোর্ডে বিজ্ঞাপন দেয় না।
সারোয়ার বলেন, কোভিড-১৯-এর কারণে তারা কিছু সময় বিজ্ঞাপন দেননি। আর বর্তমানে তাদের মনোযোগ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা ডিজিটাল মিডিয়ায় প্রচারণা বাড়ানোর দিকেই বেশি। 'টেলিভিশনের জন্য অনেক বড় বাজেট লাগে। এই মাধ্যমটি আমাদের জন্য লাভজনক বা সাশ্রয়ী নয়। তবে আমরা সবসময় নানা ইভেন্ট, প্রতিযোগিতা ইত্যাদির মাধ্যমে সক্রিয় থাকব।'
তিনি জানান, ড্যান কেকের নাম দেশের মানুষের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠে ২০১৬-১৭ সালের দিকে একটি ক্রিকেট টুর্নামেন্ট স্পনসর করার পর। ওই টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জিতেছিল। ২০২০ সালে তারা স্পেলিং বি প্রতিযোগিতার পঞ্চম মৌসুমে স্পন্সর ছিল।
নানা পণ্যের সমাহার
ড্যান কেক প্রথমে ক্রেতাদের জন্য রেডি-টু-ইট প্যাকেজিংয়ে পাঁচ থেকে সাতটি প্রিমিয়াম পণ্য নিয়ে এসেছিল। এর মধ্যে সুইস রোল বিশেষ জনপ্রিয়তা পেয়ে যায়।
সারা দেশে কার্যক্রম ছড়িয়ে পড়ার পর এবং ব্র্যান্ডটি জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করলে অন্যান্য পণ্য—যেমন পাউন্ড কেক, ব্রাউনিজ, কুকিজ ইত্যাদি—চালু হয়।
এখন চকলেট ও ভ্যানিলা ফ্লেভারে সিঙ্গেল স্লাইস কেক সম্ভবত তাদের সবচেয়ে জনপ্রিয় পণ্য। নিয়মিত চকলেট কেক মাঝেমধ্যে শুকনো স্বাদের হয়। কিন্তু ড্যান কেকের চকলেট কেক সে তুলনায় আরও নরম, এ কেকে ডার্ক চকলেটের ফ্লেভার পাওয়া যায় আরও বেশি।
ড্যান কেকের পণ্যগুলোর প্যাকেজিং করা হয় সাধারণত সাদার পটভূমিতে সবুজ, বাদামি, গাঢ় নীল ও হলুদ রঙের প্যাকেটে। ভোক্তারাও তাদের পণ্যের স্মার্ট প্যাকেজিং পছন্দ করেন। অন্যান্য কেক ফ্লেভারের মধ্যে রয়েছে লেবু, কমলা, স্ট্রবেরি, মাখন, তিরামিসু, ক্যাপাচিনো ইত্যাদি।
২০২২ সালের অক্টোবরে ড্যান কেক সকালের নাস্তায় খাওয়ার জন্য নতুন আইটেম নিয়ে আসে বাজারে। এসবের মধ্যে রয়েছে ক্রোয়াসঁ, মিল্ক ব্রেড, টর্টিলা ব্রেড ইত্যাদি। এসব আইটেম অল্পদিনের মধ্যেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
সারোয়ার বলেন, 'আমরা পরীক্ষামূলকভাবে লাচ্ছা সেমাইয়ের মতো এথনিক পণ্যও আনার চেষ্টা করেছি। কিন্তু দেখলাম, আমাদের কঠোর স্বাস্থ্যবিধি নিয়ন্ত্রণের কারণে দাম কিছুটা বেশি হয়ে গেছে। মিডিয়া প্রতিবেদনে আমরা নিয়মিতই দেখি, এই পণ্যটি সাধারণত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে হাতে তৈরি করা হয়। কিন্তু আমরা মেশিন ব্যবহার করেছি।'
বর্তমানে ৩৭টি পণ্যের আওতায় তাদের ৬৭টি চলমান এসকেইউ (স্টক-কিপিং ইউনিট বা স্টক রক্ষণ ইউনিটের সংক্ষিপ্তসার) রয়েছে, যা সারা দেশে বিপণন করা হয়; পাশাপাশি ভারত ও নেপালের মতো দেশেও রপ্তানি করা হয়।
কোম্পানিটি শিগগিরই 'হোলগ্রেইন' (সম্পূর্ণ শস্যজাতীয় খাবার, একটি শস্যবীজে যতটুকু পুষ্টিকর উপাদান থাকে তার সবটুকুই মেলে হোলগ্রেইন থেকে) ও লো-শুগার আইটেম বাজারে আনার পরিকল্পনা করছে।
'বাংলাদেশের মানুষ স্বাস্থ্য নিয়ে দিন দিন আগের চেয়ে সচেতন হচ্ছে। আমরা লক্ষ করেছি, এর সঙ্গে সঙ্গে হোলগ্রেইন বা ব্রাউন ব্রেডের চাহিদা বাড়ছে,' সারোয়ার বলেন।
ড্যান কেক পণ্যের বর্তমান মূল্য ১০ টাকা থেকে ১৫০ টাকার মধ্যে। বাজারে অল-টাইম, ওয়ান্ডার, কিষোয়ানের মতো অন্যান্য ব্র্যান্ড আছে যারা একই মূল্যসীমার মধ্যে একই পণ্য বিক্রি করে; তবে ভোক্তারা সম্ভবত ড্যান কেকই বেশি পছন্দ করে।
ঢাকার প্রায় প্রতিটি দোকানেই ড্যান কেকের পণ্য পাওয়া গেলেও রাজধানীর বাইরের বাজারে ড্যান কেক খুব বেশি ঢুকতে পারেনি। গ্রামীণ ভোক্তারা মূল্যের ব্যাপারে সংবেদনশীল হন এবং জেলা শহরে স্থানীয় পণ্যের তুলনায় ড্যান কেক এখনও বেশ কিছুটা দামি।
ড্যান কেকের বাজার হিস্যা সম্পর্কে জানতে চাইলে কোম্পানিটি বলে, বাংলাদেশের বেকারি শিল্পে কেক সেগমেন্টের বাজার হিস্যা নিয়ে এখনও কোনো চূড়ান্ত গবেষণা হয়নি। কাজেই তাদের সঠিক বাজার হিস্যা সম্পর্কে মন্তব্য করা তাদের পক্ষে বেশ কঠিন।
ব্র্যান্ডের টার্গেট গ্রাহক সম্পর্কে সারোয়ার বলেন, ড্যান কেক ব্র্যান্ডটি মূলত পরিবারের জন্য। 'আমাদের পণ্যগুলো সব বয়সের মানুষ পছন্দ করে এবং খেয়ে থাকে। যারা পণ্যের গুণমান, খাদ্য নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে সচেতন, তারাই মূলত আমাদের টার্গেট ভোক্তা,' বলেন তিনি।
'আমরা ইউরোপ ও বাংলাদেশ উভয়ের স্বাস্থ্য নির্দেশিকা মেনে চলি।'
ড্যান ফুড লিমিটেডের প্ল্যান্ট অপারেশনের প্রধান মোহাম্মদ তৌফিক হাবিব সাভারে তাদের কারখানা ঘুরিয়ে দেখালেন আমাদের। কোনো দূষণ যাতে না হয়, তা নিশ্চিত করার জন্য কারখানায় প্রবেশের আগে হাত ও পা জীবাণুমুক্ত করা এবং সেফটি গিয়ার বদলানোর মতো একাধিক পদক্ষেপের ভেতর দিয়ে যেতে হয়।
কারখানার ভেতরে সবকিছু সম্পূর্ণ অটোমেটেড। সিল করা প্লাস্টিকের প্যাকেটে পণ্যগুলো বের হওয়ার পর শ্রমিকরা সেগুলো কাগজের কার্টনে রাখেন।
বিশাল ওভেন ও কুলিং র্যাক দেখা গেল কারখানার ভেতরে। মেশিনগুলো ছাঁচ থেকে শত শত ছোট মাফিন বের করে সুন্দরভাবে সাজিয়ে রাখছে কুলিং ট্রেতে। ত্রুটিপূর্ণ পণ্য সঙ্গে সঙ্গে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। কারখানায় একটি লক্ষণীয় বিষয় হলো নারী শ্রমিকের সংখ্যা। বর্তমানে কারখানাটিতে ২৫ জন নারী শ্রমিক আছেন।
কিছু উপাদান ডেনমার্ক থেকে আনা হলেও বেশিরভাগই স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করা হয়। তবে এগুলোকেও একটি নির্দিষ্ট মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হতে হয়। যেমন, ডিমগুলো একই আকারের ও তাজা হতে হয়। তা না হলে যে মেশিন ডিম ভাঙে, সেটি কাজ করে না।
তৌফিক হাবিব জানালেন, প্রতি বছর ডেনমার্কের একটি দল কারখানা পরিদর্শনে আসে। তাছাড়া কারখানার উৎপাদন ইত্যাদির মাসিক প্রতিবেদন ডেনমার্কে পাঠানো হয়। তিনি বলেন, 'ড্যানিশ টিম আমাদের গাইড করে এবং আমরা আমাদের কারখানায় ইউরোপীয় ও বাংলাদেশি উভয় স্বাস্থ্য নির্দেশিকা ও মান বজায় রাখি।'
তৌফিক বলেন, প্রথম দিন থেকেই উৎপাদন ব্যবস্থা একইরকম রাখা হয়েছে, কোনো রদবদল আসেনি। উৎপাদন ও মান ধরে রাখা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে বাংলাদেশ থেকে একটি দলকে এক মাসের জন্য ডেনমার্কে পাঠানো হয়েছিল।