টাককে কখনোই রোগ মনে করা হতো না, গণমাধ্যমই আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিয়েছে
মাথায় টাক পড়া একটি সাধারণ ঘটনা, ৫০ শতাংশের বেশি পুরুষের ক্ষেত্রেই এটি হয়ে থাকে। টাক শরীরের ওপর কোনো নেতিবাচক প্রভাবও ফেলে না। তাহলে প্রিন্স হ্যারি তার স্মৃতিকথা 'স্পেয়ার'-এ তার ভাইয়ের মাথায় টাক পড়াকে 'ভীতিকর' কেন বলেছেন?
টাককে আজকাল রীতিমতো রোগ হিসেবে দেখা হয়। এর 'নিরাময়ের' জন্য নানা ওষুধ, চিকিৎসাও বেরিয়েছে। কিন্তু ইতিহাস বলছে, টাক পড়াকে অতীতে সাধারণ বিষয় হিসেবেই দেখা হতো, রোগ হিসেবে নয়। ২০১৯ সালে ঈজিপ্টোলজির অধ্যাপক সমর কামাল ২৬১৩ থেকে ৫২৫ খ্রিষ্টপূর্ব পর্যন্ত প্রাচীন মিশরীয় কবরফলকে ১২২ জন টাকমাথা পুরুষের ছবি আবিষ্কার করেন।
এই পুরুষদের অধিকাংশই বয়স্ক ছিলেন। কৃষক থেকে জেলে, ভাস্কর, অভিজাত—মিশরের সব শ্রেণির পুরুষ রয়েছে সেসব ছবিতে।
এসব শিল্পকর্ম ইঙ্গিত দেয়, প্রাচীন মিশরীয়রা টাকমাথা পুরুষদের আলাদা চোখে দেখত না।
ইউরোপীয় শিল্পকর্মে টাক
ইউরোপীয় শিল্পকর্মেও দেখা যায়, টাক পড়াকে সাধারণ ব্যাপার হিসেবেও নেওয়া হতো অতীতে। ভিনসেন্ট ভ্যান গগের পেইন্টিং 'অন দ্য থ্রেশোল্ড অব ইটারনিটি'তে (১৮৯০) টাকমাথা ডাচ পেনশনভোগী আদ্রিয়েনাস জুইডারল্যান্ডের ছবি আঁকা হয়েছে।
এই ছবিতে মানুষের হতাশা ফুটে উঠেছে। এখানে জুইডারল্যান্ডের টাক বরং শিল্পকর্মটিকে আরও আকর্ষণীয় করেছে।
ভ্যান গগ তার চিঠিতে এই পেইন্টিং সম্পর্কে লিখেছেন: 'তালি মারা বম্বাজিন স্যুট পরা টাকমাথার একজন কর্মজীবী বৃদ্ধ লোক কী চমৎকার এক দৃশ্যেরই না অবতারণা করেছে!'
শুধু জুইডারল্যান্ড নয়, ঐতিহাসিক শিল্পে টাকমাথা পুরুষদের স্বাভাবিকভাবে তুলে ধরার আরও অনেক নজির আছে। যেমন ডাচ স্বর্ণযুগের চিত্রশিল্পী ফ্রান্স ভ্যান মিয়েরিস দ্য ইয়ঙ্গার-এর 'ম্যান উইথ আ ট্যাঙ্কার্ড' (১৭৯৩) নামক ছবিতে দেখা যায়, একজন টাকমাথা পুরুষ একটি পাবে বসে তৃপ্তির সঙ্গে দুপুরের খাবার খাচ্ছে।
ইতিহাসের বিভিন্ন সময় টাকমাথা পুরুষদের আদর্শায়িত করা হয়েছে। যেমন ইতালির রেনেসাঁ যুগের শিল্পী পাওলো ভেওনেসে-র ১৬ শতাব্দীর ছবি 'দি ইটারনাল ফাদার'-এ দেখা যায়, একজন টাকমাথা দেবতা দৈবশক্তি প্রদর্শন করছেন।
ডাচ স্বর্ণযুগের আরেক শিল্পী রেমব্র্যান্ড-এর 'অ্যানাটমি লেসন অভ ড. নিকোলায়েস টাল্প' (১৬৩২) নামক ছবিতে দেখা যায়, টাক পড়ছে এমন কয়েকজন ডাক্তার ব্যবচ্ছেদ শিখছে।
টাক পড়াকে 'ভীতিকর' বলাকে চ্যালেঞ্জ করার মতো এরকম বিস্তর ঐতিহাসিক প্রমাণ রয়েছে।
প্রায় সব ধর্মেই টাকমাথার ধর্মীয় নেতা রয়েছেন। যেমন: বুদ্ধ, খ্রিষ্টান সন্ত জেরোম ও অগাস্টিন—এছাড়া আছেন জাপানি দুই টাকমাথা দেবতা ফুকুরোকুজু ও হোতেই।
রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতারাও বরাবরই টাককে উৎসাহ দিয়েছেন। যেমন খ্রিষ্টান সন্ন্যাসীরা মাথা কামান।
টাক যেভাবে 'ভীতিকর' হলো
২০ শতকে টাকরোধী পণ্যের ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা ও মার্কেটিংয়ের কারণে টাক সম্পর্কে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যায়। এই সময়েই টাক সৌম্য আভিজাত্য থেকে এমন রোগে পরিণত হয় যার 'নিরাময়ের জন্য ওষুধ' প্রয়োজন।
এ ধরনের 'ওষুধের' মধ্যে ব্যয়বহুল ও অকার্যকর 'সাপের তেল' থেকে তৈরি পণ্য থেকে শুরু করে নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ অনুমোদিত কিছুটা কার্যকর পণ্যও আছে (যেমন মিনোক্সিডিল)।
এসব পণ্যের ব্যাপক বিজ্ঞাপনই মানুষের মনে ধারণা তৈরি করে যে টাক ভীতিকর।
২০১৪ সালে সোশিওলিঙ্গুইস্টিকসের অধ্যাপক কেভিন হার্ভে মন্তব্য করেছিলেন, অনলাইনে দেওয়া টাক-প্রতিরোধী বিজ্ঞাপনগুলোতে চুলওয়ালা পুরুষদের আকর্ষণীয়, সফল ও সুখী হিসেবে তুলে ধরা হয়।
আবার একই বিজ্ঞাপনে প্রচার করা হয় যে, টাক একটি রোগ যা পুরুষদের মারাত্মক কষ্ট দেয় এবং সুবিধাবঞ্চিত করে। যেমন, টাক-প্রতিরোধী শ্যাম্পু রেনাক্সিলের বিজ্ঞাপনে দেখানো হয়েছে, চুলে গ্রন্থিকোষগুলো আত্মহত্যা করতে গেলে তাদেরকে বাঁচানোর জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়েছে রেনাক্সিলের বোতলগুলো।
সমসাময়িক গণমাধ্যমে অল্প কয়েকজন অভিনেতা ছাড়া (যেমন জেসন স্ট্যাথাম, ভিন ডিজেল ও ব্রুস উইলিস) সফল টাকমাথা অভিনেতা খুব কমই দেখা যায়। ২০০৬ সালে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, শিশুদের জনপ্রিয় মার্কিন টিভি শোগুলোতে ১ হাজার ৩৫৬টি চরিত্রের মধ্যে টাক চরিত্র ছিল মাত্র ৩ শতাংশ।
লিডস বেকেট ইউনিভার্সিটির সমাজবিজ্ঞানের সিনিয়র লেকচারার গ্লেন জানকোওস্কি একটি গবেষণায় নেতৃত্ব দেন। ওই গবেষণায় ২০১১ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে প্রকাশিত জনপ্রিয় ম্যাগাজিনগুলোতে ছাপা পুরুষদের ৫ হাজার ছবি বিশ্লেষণ করা হয়। দেখা যায়, ওই ৫ হাজার পুরুষের মধ্যে টাকমাথা পুরুষ আছে মাত্র ৮ শতাংশ।
সমসাময়িক সময়ে টাককে উপস্থাপন করার ক্ষেত্রে অনেক নেতিবাচক স্টেরিওটাইপও দেখা যায়। টিভি ট্রোপস নামক ওয়েবসাইটে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, টিভি ও চলচ্চিত্রের টাক চরিত্রগুলো বেশিরভাগ সময় ভিলেন অথবা বয়স্ক হয়ে থাকে।
আরেকটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, ১৯৮০-র দশকে যেসব টিভি অভিনেতা টাক চরিত্রে অভিনয় করেছেন, তাদের ৬০ শতাংশেরও বেশি চরিত্রকে 'কুৎসিত', অযোগ্য অথবা অলস হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
এমনকি একাডেমিক গবেষণায়ও টাকভীতির প্রচারণা করা হয়। গ্লেন জানকোওস্কি ও হ্যানা ফ্রিথের সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৮০ শতাংশ টাক-মনস্তত্ত্ব গবেষণার সঙ্গে ব্যবসা জড়িত। গবেষণাগুলোতে টাক পড়াকে রোগ হিসেবে চিহ্নিত (৭৭ শতাংশ ক্ষেত্রে) করার প্রবণতা থাকে। পাশাপাশি টাকের ওষুধের সীমাবদ্ধতা (৬৮ শতাংশ ক্ষেত্রে) ঠিকমতো আলোচনা না করেই এসব ওষুধের পক্ষে প্রচারণা (৬০ শতাংশ ক্ষেত্রে) করা হয় গবেষণাগুলোতে।
টাকের উপস্থাপনার ধরন গুরুত্বপূর্ণ। আধুনিক যুগে যদিও দেখানো হয় চুল পড়া বড় একটি সমস্যা ও রোগ এবং টিভি, বিজ্ঞাপন ও গবেষণায়ও তাতে সমর্থন দেওয়া হয়, টাক পড়া মানুষের শিল্প-ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় পরিস্থিতি সবসময় এমন ছিল না। টাক পুরুষরাও চুলওয়ালা পুরুষদের মতোই সুস্থ, সফল ও সন্তুষ্ট হতে পারেন বলেই দেখা গেছে।
- সূত্র: স্ক্রল ডটইন