মার্কেসের আত্মজীবনী: গল্পগুলো বলার জন্যই বেঁচে থাকা
বই পড়ি আমি গোগ্রাসে, স্কুল জীবনে পাঠ্য বইয়ের নিচে লুকিয়ে শিক্ষকের চিরুনি দৃষ্টি এড়িয়ে, পারলে ক্লাসের মাঝেই শেষ সংগৃহীত আসল মজাদার বইখানা শেষ করার অভ্যাস করতে করতে এখনো এটি সিন্দবাদের বুড়ো দৈত্যের মত কাঁধে চেপে বসেছে। তবে তাতে নেহাত অখুশি নই আমি! সারাবিশ্বে কত বই, এক ক্ষুদ্র জীবনে প্রায় সবই অপঠিত, অজ্ঞাত থেকে যাবে, তার মাঝে দ্রুত যতগুলো পড়ে ফেলা যায়, ততই হয়ত অপূর্ণতা খানিকটা কমে।
কোনো বই খুব বেশি ভাল লেগে গেলে পড়তে পড়তেই ঘোর লাগা অবস্থা হয়, বিভোর হয়ে ঘুম বাদ দিয়ে, ভোরের অ্যালার্মের তীব্র যন্ত্রণা ভুলে বইটির পাতা উল্টোতেই থাকি আপন মনে। এক পর্যায়ে খেয়াল করি শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে গিয়ে প্রায় জ্বর বাঁধিয়ে ফেলেছি! কিন্তু বইখানার শেষ হবার তৃপ্ত এবং রিক্ত অবসন্ন মনে বসে থাকার খানিক পরেই সব স্বাভাবিক হয়ে আসে; ফিরে আসি চারপাশের চেনা জগতে অন্য ভুবন থেকে।
বোঝা যায় বইটির ঘটনা প্রবাহের সাথে মিশে যেয়ে শেষ করবার উৎকণ্ঠায় আবার অমৃতভাণ্ড খালি হয়ে যাবার আশঙ্কায় এমনটি হয়।
সবসময় না, কিছু কিছু বইয়ের ক্ষেত্রে এমন হয়েছিল। কোনোটার শেষের পর্যায়ে এসে, কোনোটার মাঝে থেকে, কোনোটার আবার শুরু কয়েক লাইন পরেই। শেষ যে বইটির শুরুর প্যারাটি থেকেই আমার জ্বর লাগা ঘোরাক্রান্ত অবস্থা হয়েছিল, তা আমাদের গ্রহের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের আত্নজীবনীর প্রথম খণ্ড Vivir para contarla( LIVING TO TELL THE TALE) (গল্পগুলো বলার জন্যই বেঁচে থাকা)।
নিতান্তই আটপৌরে শুরুয়াদ বইটির, মার্কেসের মা তাকে খুঁজতে এসেছেন উচ্ছল আড্ডার মাঝে, তাকে নিয়েই তিনি তার সর্বশেষ সম্বল বাপের ভিটেটি বিক্রি করতে যেতে চান।
শুরু হয়ে যায় ছত্রে ছত্রে মার্কেসীয় শব্দখেলার মুন্সিয়ানা, নিজের মায়ের এবং তার পারিবারিক ইতিহাসের যে বর্ণনা তিনি অল্প কয়েক লাইনে দিয়েছেন, তা একান্তই তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য, মার্কেসীয় ঘরানার নির্লিপ্ত বর্ণনা কিন্তু গনগনে আবেগে মোড়া, এর মাঝেই চেনা যায় ব্যক্তি লেখকের অভিব্যক্তি।
তখন গাবো মার্কেসের ছন্নছাড়া জীবন তুঙ্গে, মফস্বল এক শহরের অখ্যাত খবরের কাগজে নামমাত্র বেতনে কাজ করে চলেছেন। খাবার ঠিক নেই, রাতে শোয়ার কোনো নির্দিষ্ট ব্যবস্থা নেই, যখন যেখানে যাকে মিলে যায়, তার সাথেই ব্যবস্থা হয়ে যায় কোনমতে; সেইসাথে দিনে ৬০টি সিগারেট ধ্বংস চলছে সমানে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরোনো হয় নি; শুরু যে করবেন, এমন নিশ্চয়তাও দেওয়া যাচ্ছে না!
এমতাবস্থায় মা তাকে নিয়ে জন্মশহর অ্যারাকাতাকার দিকে যেতে যেতে প্রশ্ন করেন- 'তোমার বাবাকে আমি তোমার শিক্ষাজীবন নিয়ে কি বলব?'
মার্কেস- 'তাকে বল সারা জীবনে আমি একটি জিনিসই হতে চাই, তা হলো একজন লেখক এবং সেটি আমি হয়েই ছাড়ব।'
মা- 'তোমার বাবা তো তাতে নিষেধ করছেন না, তার আশা তুমি ডিগ্রিটাও শেষ করবে।'
মার্কেস- 'আমি বুঝি না, তুমি যখন খুব ভালো করে জান আমি হাল ছাড়ব না, তাহলে একই প্রশ্ন করে কি ফায়দা!'
মা- 'তুমি কি করে জানো আমি জানি?'
মার্কেস- 'কারণ, আমি তোমার মতোই হয়েছি!'
এই যাত্রাতেই এক কলা কোম্পানির দরজায় মাকেন্দো নামটি লেখা থাকতে দেখেন গাবো, যে নামটিকে তিনি অমর করে রেখেছেন 'ওয়ান হানড্রেড ইয়ারস অফ সলিচিউড' বইয়ের গ্রাম হিসেবে এবং একাধিক ছোট গল্পে। কিন্তু নামটির অর্থ তার জানা হয়নি আজও।
এভাবেই নিজ জীবনের গল্প বলতে থাকেন আমাদের গ্রহের সেরা লেখক, কোনো সময় তার উদ্দীপ্ত তারুণ্যের, কোনো সময়ের ৪ বছর বয়সে নানার সাথে প্রথম মহাসাগর দর্শনের স্মৃতির। পাঠকের সামনে নির্দিষ্ট কোনো গতিধারা ছাড়াই অপূর্ব ছন্দময় সব ঘটনা একের সাথে অন্যে মিলে তৈরি হয় মুগ্ধতার ইন্দ্রজাল। ছেঁড়া মেঘের ঘটনার ভেলারা ভেসে বেড়ায় গ্যাব্রিয়েল মার্কেস নামের চিরতরুণ গ্রহটির আকাশে।
পরম মমতায় নিজের শৈশব স্মৃতি হাতড়ে তিনি বর্ণনা দিয়ে যান তাদের বাড়ির, বসার ঘরের, প্রতিবেশীর, নিজের দেখা প্রথম মৃত মানুষের, পাঠশালার বইয়ের। দুকূল উপচিয়ে পড়া ঘটনার জোয়ারে মুগ্ধ আবেশে ভেসে যেতে যেতে পাঠক নিজেকে আবিস্কার করে মার্কেসের ৫ম উপন্যাস 'লাভ ইন দ্য টাইম অফ কলেরা'র প্রকাশকালের কথা, যা রচিত হয়েছিল পরিবারের কিছু সদস্যদের সত্য ঘটনা নিয়ে।
সাংবাদিকরা মার্কেসের বাবাকে প্রশ্ন করেছিল, জীবনে তার কোনো সময় উপন্যাস লেখার ইচ্ছে হয়েছিল কিনা? বিরাস বদনে তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, একটিই লেখার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু গাবোর এক প্রশ্নে বুঝে গিয়েছিলাম সেও একই ঘটনা নিয়ে লিখছে, তারপর আর চেষ্টা করি নি।
এরপরই আসে ১৯২৭ সালের ৬মার্চ, রোববার, সকাল নয়টায় মর্ত্যে তার আগমনের এবং অস্তিত্ব প্রকাশের জন্য সুতীব্র গল্প।
শুরু হয় তার বিশাল পরিবারের চাচা-চাচী, খালা-খালু এমন সবার বর্ণময় জীবনের কাহিনী। সেই সাথে অবধারিত ভাবেই স্কুল জীবন, সেখানকার শিক্ষক ও গ্রন্থাগারের করা। মার্কেসের ছোট বেলায় প্রিয় বই ছিল অবশ্যম্ভাবীভাবেই হাজার এক রাত্রির গল্প, এরপরই ডন কুইক্সোট, কাউন্ট অফ মন্টিক্রিস্ট্রো, ট্রেজার আইল্যান্ড।
আসে তার বিখ্যাত ছন্দময় নামের পেছনের ইতিহাসটিও, কি করে ব্যাপ্টিজমের সময় রাখা নাম গ্যাব্রিয়েল হোসে দে লা কনকর্ডিয়া; বাবার পারিবারিক নাম গার্সিয়া এবং মার পারিবারিক নাম মার্কেস নিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে সুপরিচিত নামগুলোর একটি হল তার মজার গাঁথা।
সমান্তরালে চলতে থাকে পারিবারিক এবং শিক্ষা জীবন। ১১ ভাই-বোনের পরিবারে বিনা মেঘে বজ্রপাত হয়ে আসে বাবার ঔরসে অন্য মহিলার গর্ভে জন্ম নেওয়া আরেক সন্তানের ঘটনা। কিন্তু মমতাময়ী মা ঠিক আশ্রয় দেন সেই ছেলেকেও তার আকাশের চেয়ে বিস্তৃত আশ্রয়ডানার নিচে।
খবরের কাগজে নিজের লেখা গল্প ছাপা হবার প্রথম স্মৃতি উদ্বেলিত হয়ে বর্ণনা করেছেন মার্কেস, এর মাত্র ৪২ দিন পরেই তার ২য় গল্পটি ছাপাখানার মুখ দেখে। এরপর চলতেই থাকে তার কলম।
অদ্ভুত এক বই হাতে আসে তরুণ লেখকের, যার প্রথম বাক্যেই একটি মানুষ ঘুম ভেঙ্গে নিজেকে পরিবর্তিত পতঙ্গ হিসেবে দেখতে পান! কাফকার মেটামরফসিসের প্রতি আকাশচুম্বী সাহিত্যিক মুগ্ধতা দেখিয়েছেন তিনি, একই কাতারে আছে জেমস জয়েসের ইউলিসিস।
মায়াবাস্তবতায় ঘিরে নিজের জীবনকে এমনভাবেই আমাদের উদ্দেশ্যে বলে গেলেন তিনি, মায়া, মমতা, আনন্দ, দুঃখ, বেদনার কথা। নিজের প্রথম বই ছাপা হবার অনুভূতির কথা, হুলিয়া মাথায় নিয়ে স্বদেশ ছেড়ে ইউরোপ গমনের ঘটনা, অবশেষে মনের মানুষকে জীবন নদীর বাঁকে খুঁজে পাবার শান্তি।
কিন্তু ঘটনা শেষ হয় না এখানেই, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস আমাদের অঙ্গীকার করেছেন এর পরবর্তী পর্বের, সারা বিশ্বের সমস্ত সাহিত্য পিপাসু যার অপেক্ষায় আছে এক দশক ধরে!
(গাবো মার্কেসের সাথে একবারই আর্নেস্ট হেমিংওয়ের সামনাসামনি দেখা হয়েছিল, রাস্তার অপর পারে প্রিয় লেখককে দেখে উল্লাসে চিৎকার করে উঠেছিলেন তরুণ মার্কেস- Hola Maestro!
মার্কেসের প্রাক্তন বসবাসের শহর বার্সেলোনা, একসময়ের কর্মক্ষেত্র হাভানা, বর্তমান অবস্থানের নগরী মেক্সিকো সিটি, তার জন্মভূমি কলোম্বিয়ার বোগোতায় অবস্থানকালীন সময় মনে মনে অসংখ্যবার চিন্তা করেছি, যদি দেখা হয়ে যেতে প্রিয় লেখকটির সাথে, আমিও চিৎকার করে সোল্লাসে বলতাম- জয় গুরু।
পেঙ্গুইনের প্রকাশিত বইটির ইংরেজি অনুবাদ করেছেন এডিথ গ্রোসমান।
গতকাল ছিল (৬ মার্চ) এই মহান লেখকের জন্মদিন, এই দিনে নিজের জীবন নিয়ে লেখা গ্রন্থ শুরুর আগেই যে বাক্যটি তিনি লিখেছেন তাই দিয়েই শেষ করলাম- "Life is not what one lived, but what One remembers and how One remembers it in order to recount it")