আন্তর্জাতিক নারী দিবস কী? কেন, কীভাবে শুরু এ দিনের?
মূলধারার গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমরা প্রতি বছরই আন্তর্জাতিক নারী দিবসের কথা শুনে থাকি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গুরুত্বের সঙ্গে দিনটি পালন করা হয়।
কিন্তু এই দিনটি আসলে কীসের জন্য? কবে থেকে পালন হচ্ছে? নারী দিবসের মতো কি আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবসও আছে? কীভাবে উদযাপিত হচ্ছে ২০২৪ সালের নারী দিবস?
অনেকের মনে এই প্রশ্নগুলো আসলেও বেশিরভাগ সময়ই একসঙ্গে এতোগুলো উত্তর জানা হয়ে ওঠে না। নারী দিবস উপলক্ষে ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসির এক প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের বিস্তর ইতিহাস। চলুন দিবসটির পিছনের খুঁটিনাটি সব তথ্য জেনে নেওয়া যাক।
যেভাবে শুরু হল
এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে ৮ মার্চকে নারী দিবস হিসেবে পালন করে আসছে সারাবিশ্বের মানুষ।
আন্তর্জাতিক নারী দিবসকে সংক্ষেপে আইডব্লিউডি বলা হয়ে থাকে। শ্রমিক আন্দোলন থেকেই উদ্ভূত হয় নারী দিবসের ধারণা। পরবর্তীতে দিনটি জাতিসংঘের স্বীকৃত পায় এবং প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী উদযাপিত হতে থাকে।
১৯০৮ সালে কর্মঘণ্টা কমিয়ে আনা, বেতন বৃদ্ধি এবং ভোটাধিকারের দাবিতে প্রায় ১৫,০০০ নারী নিউইয়র্ক শহরের রাস্তায় আন্দোলনে নেমেছিল। মূলত এই আন্দোলনের মাঝেই লুকিয়ে ছিল আনুষ্ঠানিকভাবে নারী দিবস পালনের বীজ। এই আন্দোলনের এক বছর পর আমেরিকার সোশ্যালিস্ট পার্টি সর্বপ্রথম জাতীয় নারী দিবস ঘোষণা করে।
জাতীয় পর্যায় থেকে দিনটিকে আন্তর্জাতিক নারী দিবসে পরিণত করার প্রথম উদ্যোগটি নিয়েছিলেন কমিউনিস্ট ও নারী অধিকার কর্মী ক্লারা জেটকিন। ১৯১০ সালে তিনি কোপেনহেগেনে কর্মজীবী নারীদের এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এ ধারণার প্রস্তাব দেন। সেই সম্মেলনে উপস্থিত ১৭ দেশের ১০০ জন নারীর সকলেই তার প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে গ্রহণ করেন।
এরপরের বছর, অর্থাৎ ১৯১১ সালে অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক, জার্মানি এবং সুইজারল্যান্ডে প্রথমবারের মতো পালিত হয়েছিল আন্তর্জাতিক নারী দিবস। ২০১১ সালে পালিত হয় দিনটির শতবর্ষ। প্রতি বছর একটু একটু করে এগিয়ে ২০২৪ সালে আজ আমরা পালন করছি ১১৩তম আন্তর্জাতিক নারী দিবস।
কেন ৮ মার্চ?
আন্তর্জাতিক নারী দিবসের ধারণাটি যখন ক্লারা উত্থাপন করেন, তখন তিনি নির্দিষ্ট কোনো তারিখ উল্লেখ করেননি।
১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের আগ পর্যন্ত দিনটি আনুষ্ঠানিকভাবে নির্দিষ্ট করা যায়নি বলেই উল্লেখ রয়েছে বিবিসির প্রতিবেদনে। একই বছর রুশ নারীরা 'রুটি এবং শান্তি'-এর দাবিতে তৎকালীন জারের (রাশিয়ার সম্রাট) বিরুদ্ধে ধর্মঘট শুরু করেন; এর ৪ দিনের মাথায় গদি ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল জার এবং জারের গদিতে বসা অস্থায়ী সরকার তখন নারীদের আনুষ্ঠানিক ভোটাধিকার দিয়েছিলেন।
সে সময়ে রাশিয়ায় প্রচলিত জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী, নারীদের ধর্মঘট শুরু হয়েছিল ২৩ ফেব্রুয়ারি, রোববার। আর গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে এই দিনটি ছিল ৮ মার্চ; পরবর্তীতে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ৮ মার্চকেই আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
নারী দিবসের প্রতীক কেন বেগুনি?
আন্তর্জাতিক নারী দিবসের ওয়েবসাইট অনুসারে বেগুনি, সবুজ এবং সাদা হল আন্তর্জাতিক নারী দিবসের রঙ।
"বেগুনি রঙ দিয়ে ন্যায়বিচার এবং মর্যাদাকে বোঝানো হয়। সবুজ আশার প্রতীক; আর সাদা বিশুদ্ধতার। যদিও এই ধারণা নিয়ে বিতর্কিত রয়েছে, ১৯০৮ সালে যুক্তরাজ্যের উইমেন'স সোশ্যাল অ্যান্ড পলিটিক্যাল ইউনিয়ন (ডব্লিউএসপিইউ) এই রঙগুলোকেই নির্দিষ্ট করেছিল," ওয়েবসাইট অনুসারে।
নারী দিবসের মতো কি আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবসও আছে?
এ প্রশ্ন অনেকেরই। উত্তর হলো, পুরুষ দিবসও আছে; আর সেটি ১৯ নভেম্বর।
১৯৯০ সালে প্রথম পুরুষ দিবস পালিত হয়; তবে এটি জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃত নয়। প্রতিবছর যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের ৮০টিরও বেশি দেশে দিনটি উদযাপন করা হয়ে থাকে।
কীভাবে পালিত হয় অন্তর্জাতিক নারী দিবস?
রাশিয়াসহ বিশ্বের অনেক দেশেই আন্তর্জাতিক নারী দিবসে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। ৮ মার্চের আগে-পরের ৩/৪ দিন এসব দেশে ফুলের বিক্রি বেড়ে হয় প্রায় দ্বিগুণ।
চীনের অনেক স্টেটে কাউন্সিলের বিবেচনায় ৮ মার্চ নারীদেরকে অর্ধেক দিনের ছুটি দেওয়া হয়।
ইতালিতে দিনটি নারীদের ফুল দেওয়ার মাধ্যমে উদযাপিত হয়। ফুলের শুভেচ্ছা জানানোর এ ঐতিহ্যের উৎপত্তি অস্পষ্ট; তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এটি রোমে শুরু হয়েছিল বলে মনে করা হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মার্চ মাসকে নারীদের ইতিহাসের মাস বলে মনে করা হয়। প্রতিবছর আমেরিকান নারীদের কৃতিত্বের স্বীকৃতি স্বরূপ মার্কিন প্রেসিডেন্ট একটি ঘোষণাপত্র জারি করেন এই দিনে।
২০২৪ সালের নারী দিবসের প্রতিপাদ্য
২০২৪ সালে নারী দিবসে জাতিসংঘের প্রতিপাদ্য হল "নারীদের উপর বিনিয়োগ করুন : দ্রুত উন্নতি আনুন"। এর মাধ্যমে লিঙ্গ সমতা আনতে যে যথেষ্ট অর্থ বিনিয়োগ করা হচ্ছে না সেই বিষয়টাতে মনোযোগ দেয়া হয়েছে।
নারী দিবস কেন প্রয়োজন?
আফগানিস্তান, ইরান, ইউক্রেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো অনেক দেশে নারীরা তাদের নিজ নিজ দেশে যুদ্ধ, সহিংসতা এবং সরকারি নীতি পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে নিজেদের অধিকারের জন্য লড়াই করে গেছেন এবং এখনও করছেন।
আফগানিস্তানে ফের তালেবান সরকার ক্ষমতায় আসার পর সেখানে নারীদের জন্য উচ্চাশিক্ষা ও চাকরি নিষিদ্ধ করা হয়; এমনকি বাড়ির বাইরে যেতে হলেও বৈধ পুরুষ সঙ্গী নিয়ে যাওয়ার নিয়ম জারি করে তালেবান সরকার।
ইরানেও নারী অধিকারের বিষয়টি সম্প্রতি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে ঠিকভাবে হিজাব না পরার অভিযোগে ২২ বছরের তরুণী মাহসা আমিনিকে গ্রেপ্তার করে তেহরানের নৈতিকতা বিষয়ক পুলিশ। এরপর পুলিশি হেফাজতেই তার মৃত্যু হলে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। সেই বিক্ষোভে নারীরা নিজেদের মাথার স্কার্ক বা হিজাব খুলে, আগুনে পুড়িয়ে সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। সেই বিক্ষোভে যোগ দিয়েছিলেন ইরানের পুরুষরাও।
শুধু মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেই নয়, পশ্চিমের অনেক দেশেও অধিকারের জন্য এখনও লড়ছেন নারীরা। জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে বিশ্বজুড়ে যে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা, অপুষ্টি, দারিদ্র্য এবং লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতার সৃষ্টি হয়েছে, তার সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী হলো নারী। এছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রও ও মেক্সিকোতে সম্প্রতি নারীদের গর্ভপাতের অধিকার নিয়েও চলেছে বেশ হট্টগোল।
মূলত, এসব বাধাবিপত্তি পেরিয়ে আগামী দিনগুলোতে নারীর সুন্দর জীবনের নিশ্চয়তার জন্যই আনুষ্ঠানিকভাবে এই নারী দিবসের প্রয়োজন এখনও রয়েছে বলে মনে করেন বিশ্বের নারী ও মানবাধিকার কর্মীরা।