পরিচয়, কাগজপত্র, ‘ওপারের বাড়ি’: দেশভাগে বাস্তুহারা এক বাবার গল্প
১৯৪৭ ও ১৯৬০ সালের কোনো এক সময় বাবা বাস্তুহারা হন। বাংলাদেশের বরিশালে ছিল আমাদের আদি বাড়ি। গত বছর বাবা মারা যাওয়ার পর তার ড্রয়ারে সেসব দুঃসহ সময়ের সাক্ষী দেওয়া অনেক কাগজপত্র খুঁজে পাই।
বাবকে এ লেখায় শ্রী বিশ্বাস হিসেবেই রাখছি। ১৯৩৬ সালে বরিশালে ব্রিটিশ প্রজা হিসেবে জন্ম হয় তার। কিন্তু '৪৭ সালে মুহূর্তের জন্য যেন সব উল্টেপাল্টে গেল। যে দেশে জন্ম হয়েছিল, এতদিন বেঁচে ছিলেন, সে দেশেই তাকে আবার নতুন করে নিজের অস্তিত্ব প্রমাণের লড়াইয়ে নামতে হলো।
পাকিস্তান ভেঙে দু'টুকরো হয়ে গেছে — মাঝখানে ১,৫০০ কিলোমিটারের দূরত্ব। আমরা হিন্দু হলেও বাবা সাতচল্লিশে দেশ ছেড়ে যাননি। কেন যে তখন ওই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তা কখনোই পরিষ্কার জানতে পারিনি তার কাছ থেকে। বাবাকে যখন জিজ্ঞেস করতাম, বলতেন, 'বাংলাদেশেই তো ভিটামাটি, একটু জমিজিরাতও ছিল — বুঝিস তো, আমরা বাঙালি।'
১৯৫০ সালে ১৪ বছর বয়সে ঢাকা থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করেন বাবা। তখন পূর্ব আর পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ছিল নানা বিষয়ে। স্কুল পাস করেই বাবা চলে যান পশ্চিমবঙ্গে তথা কলকাতায়।
এরপর ১৯৬১ সালে বাবা যখন ২৫ বছর বয়সী, তখন ভারতের নাগরিক হিসেবে নিবন্ধিত হন তিনি। পূর্ব পাকিস্তানের ওই স্কুল সার্টিফিকেটের পর এ প্রথম বাবা আরেকটি নতুন 'অফিসিয়াল কাগজ' পেলেন।
ওই নিবন্ধনের কাগজটাতে বাবার তরুণ বয়সের একটা ছবি আঁটা আছে। সেটাই ওই বয়সে তার একমাত্র ছবি। তখনকার দিনে ছবি তোলায় অনেক খরচ ছিল। আর বাবার পক্ষে তো আরও কঠিন ছিল, তিনি তখন পুরোদস্তুর নতুন এক শহরে খড়কুটো আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকার চেষ্টায় রত।
যেদিন ভারতের নাগরিক হিসেবে আমার বাবা শ্রী বিশ্বাস প্রথম কাগজটা হাতে পেলেন, সেদিনই তাকে আরেকটি অফিসে যেতে হয়েছিল অন্য আরেক কাগজের জন্য। ওই কাগজে বাবা যে দলিত সম্প্রদায়ের মানুষ, তা ঘোষণা করা ছিল।
ড্রয়ারের কাগজগুলোতে যতবারই তাকাই, মনে হয় যেন বাবাকে দেখতে পাই। আমি দেখি, বাবা কলকাতায় আসছেন, বিশাল মেট্রোপলিটন শহরে হন্যে হয়ে কাজ খুঁজছে অভিবাসীরা, পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা লাখ-লাখ উদ্বাস্তুর ভিড়।
পরিবারের বড় ছেলে হওয়ায় বাবাকেই আর সবার দায়িত্ব নিতে হয়েছিল। ভারত সব সময় বাবার দেশ ছিল, কিন্তু নতুন ভারত আবার তার জন্য বিদেশ হয়ে উঠল।
বাবার এ নতুন পরিচয় প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম আমি কাগজগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখতে পাই। দেখি, বারাসাতের এক অফিসে বাবা গেছেন নিজেকে ভারতের নাগরিক হিসেবে নিবন্ধন করতে। সেখানে লাইনে দাঁড়ানো আরও কতশত মানুষ, সবারই একই লক্ষ্য।
ইমিগ্রেশন অফিসের কাজকারবার — যারা কখনো এ ধরনের কোনো অফিসে একবারের তরে হলেও গিয়েছেন — তারা ঠিক আঁচ করতে পারবেন কতটা চাপ আর পরিশ্রমের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় একজন মানুষকে। খরচাও হয় অনেক; কাগজপত্রের নোটারি করা, ছবি তোলা, নকল করা, ক্ষেত্রেবিশেষে উৎকোচ দেওয়া।
বারাসাতের অফিসের কাজ সেরে বাবাকে যেতে হয় আলিপুরে — দলিত হিসেবে নিজেকে প্রমাণের কাগজ তুলতে। ৪৫ কিলোমিটার দূরের আলিপুরে যেতে কমপক্ষে দুটো বাস পাল্টাতে হয় তাকে। সময় আর পয়সার আরও শ্রাদ্ধ।
নতুন অফিসে আবারও পুরোনো কাজ। কাগজপত্রের নকল বানানো, লাইনে দাঁড়ানো, নিজের বিস্তারিত তথ্য দেওয়া, আর আশা করা তার কাগজপত্র দেখার অফিসার যেন সদয় হয়ে সাইনটা করে দেন।
এখানেই শেষ নয়। আরও অনেকে কাগজ আর প্রমাণের জন্য বাবাকে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ছুটতে হয়েছিল। ১৯৬২ ও ১৯৬৩ সালে ভারত সরকার থেকে নিজের নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য বাবাকে আরও দুটো কাগজ সংগ্রহ করতে হয়েছিল।
ওই সময় বাবা কলেজে পড়ারও চেষ্টা করেছিলেন। স্কুলের পাট চোকানোর এগারো বছর পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন তিনি।
স্কুলে বাবার সুনাম ছিল ভালো ছাত্র হিসেবে। কিন্তু কলেজের পড়ালেখাটা জমল না, কোনোরকমে পরীক্ষাগুলো উতরেছিলেন। বাবাকে যখন জিজ্ঞস করতাম, কলেজে এ দশা কেন, তিনি অস্পষ্টভাবে বলতেন, 'ওই সময় কত কিছুই তো হচ্ছিল রে'। এর বাইরে কখনো তার কাছ থেকে কিছু জানতে পারিনি।
এখন যখন বাবার কাগজপত্রগুলোর দিকে তাকাই, তখন বুঝি বাবা কী বলতে চেয়েছিলেন। কাগজপত্রের পেছনে দৌঁড়ানো, একটা চাকরি খোঁজা, নিজের পুরোনো দেশে নতুন করে থিতু হওয়ার চেষ্টা — বাবা আর পড়ালেখার দিকে মন দিতে পারেননি।
শেষমেশ বাবা একটা সরকারি চাকরি পান, ধীরে ধীরে পরিবার নিয়ে থিতু হতে শুরু করেন। কিন্তু কাগজপত্রের পেছনে দৌঁড়ানো তখনো থামেনি। যেমন, ১৯৭৯ সালে বাবাকে ৪৩ বছর বয়সে আরেকটা কাগজ নিতে হয়েছিল যেটাতে বলা ছিল, বাবা একজন বাস্তুহারা মানুষ।
কাগজপত্রের পেছনে শ্রী বিশ্বাসের এ সফল অভিযান পরিচয়, নথিপত্র, নাগরিকত্ব ও রাষ্ট্রনির্মাণের মধ্যকার সম্পর্কগুলোকে আমাদের সামনে তুলে ধরে। কাগজপত্র দিয়ে হয়তো নাগরিক হওয়া যায়, নাগরিকের সুবিধা লাভ করা যায়, কিন্তু পরিচয়ের যে আবেগের দিক, সে বুঝবে কে!
সীমানা ছাড়লে শেষ জীবনে তার ধাক্কাটা বোধহয় বেশি করেই লাগে। চাকরি ছাড়ার পর শেষ বয়সে বাবা কেবল পূর্ব বঙ্গের বাড়ির স্মৃতিচারণ করতেন। কলকাতার ব্যাপারে দিনে দিনে তার আগ্রহ কমে যেতে থাকল।
বরিশাল-কলকাতার দূরত্ব বেশি নয়, স্রেফ ২৫০ মাইল। আজকাল পশ্চিমবঙ্গ আর বাংলাদেশের মধ্যে প্রতিদিনই অনেক বাস যাতায়াত করে। আমি ভাবি, এ অল্প কয়েক দশক সময়ে ওই ২৫০ কিলোমিটার পথ কত কি না দেখেছে! আমি সেসব লাখো মানুষের বাস্তুহারা হওয়ার অভিজ্ঞতার কথা ভাবি, যে গল্প কেবল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের পতন ও নতুন রাষ্ট্রের গঠনের ইতিহাসের মহাবিবরণের স্রেফ পাদটীকায় স্থান পেয়েছে।
ঠাকুমা দুখানা বালা দিয়ে বলেছিলেন খুব যত্ন করে রাখতে — কখনো বেচতে না, অন্য গয়নার জন্য বদল করতে না।
গত বছর আমি প্রথম টের পেলাম, ২৫০ কিলোমিটার পার হয়ে আসার সময় আমার ঠাকুমা কেবল ওই দুইখানা মূল্যবান জিনিসই চালের ভেতর লুকিয়ে সঙ্গে করে এনেছিলেন — 'ওপারের বাড়ি থেকে' এপারের 'নতুন ঘরে'।
স্ক্রল ডটইন থেকে পরিমার্জিতভাবে অনূদিত।
বিদিশা বিশ্বাস যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েস্টার্ন ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক।