ইতিহাসের ধুলিমাখা পুরাকীর্তি ও সংগ্রাহকদের ঝলমলে দুনিয়া
পিতল দিয়ে তৈরি একটা মোমবাতি স্ট্যান্ড। স্ট্যান্ডে ছয়টা মোমবাতি রাখার জন্য আলাদা আলাদা জায়গা। এমন একটা জিনিসের ওপর চোখ পড়ামাত্রই সেটি নির্ঘাত আপনার নজর কাড়বে। মোমবাতি রাখার জায়গাগুলো মশালের মতো উঁচু করে রেখেছে রেনেসাঁ যুগের এক নারী। মূর্তিটির চুল তার কপালে এসে পড়েছে, লেস হেম আর ফিতার সূক্ষ্ম কারুকাজ করা গাউনটিও উড়ছে, মনে হচ্ছে তিনি কোনো ঝোড়ো বাতাস বয়ে যাওয়া পাহাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন, মশালবাহক হয়ে পথ দেখাচ্ছেন বাকি পথচারীদেরকে।
মোমদানিটিকে দেখার জন্য আমি একটু বেশি সময় নিলাম, কারণ এর আশেপাশের জিনিসগুলোর তুলনায় এটা বেশ আলাদা। নেপালি কুকরি, হিংস্র ড্রাগন আঁকা চীনা সিরামিকের পাত্র, ধাতব আয়না, হুক্কা স্ট্যান্ড, রাজস্থানী বেতের চেয়ার, পুরনো কাপ, ক্রিস্টালের ঝাড়বাতি, ভারতীয় কাচের লণ্ঠন এবং বিভিন্ন প্রাণি আর উদ্ভিদ আঁকা ভারি কাঠের শো-কেসের মধ্যে এই জিনিসটি বেমানানই বটে।
গুলশান ডিসিসি মার্কেটের প্রথম তলায় 'হোসেন হ্যান্ডিক্র্যাফটস' দোকানটির ভেতরে এই প্রাচীন যুগের অভিবাসীদের মধ্যে মশালবাহী নারীর ওপর জমে থাকা পুরু কালো আস্তরণ দেখে তাকে ক্লান্ত আর বিষণ্ণ মনে হচ্ছিল।
দোকানদারদের একজন রবিউল জানান, "মোমদানিটি ফ্রান্স থেকে এসেছে। আমাদের আশেপাশের এলাকায়, বিশেষ করে গুলশানে বেশ কিছু সংগ্রাহক আছেন, যারা আমাদের কাছে এ ধরনের শিল্পসামগ্রী নিয়ে আসেন। অনেক বিদেশি এবং সচ্ছল পরিবার এখানে বাস করেন। যখন তারা এখান থেকে চলে যাযন, তারা এমন জিনিস বিক্রি করে দেন, যেগুলো তারা আর নিয়ে যেতে চান না। তাছাড়া তারা প্রায়ই নিজেদের বাড়িগুলো নতুন জিনিস দিয়ে সাজাতে চান।"
ফরাসি মশালবাহী নারী এভাবেই দোকানটিতে পৌঁছেছেন।
রবিউল ওপরের শেলফে রাখা জোড়া সিরামিকের পাত্রের দিকে ইশারা করলেন। গুলশানে ১০ বছর ধরে বসবাসকারী এক চীনা ব্যক্তির কাছ থেকে তারা এটি পেয়েছেন। রবিউল বলেন, "এখানে ১০ বছর কাজ করার পর তিনি যখন চীনে চলে যাচ্ছিলেন, তখন তিনি এই ভারি পাত্রগুলো আমাদের কাছে বিক্রি করে দিয়ে চলে যান।"
ঐ মার্কেটেরই আরেক দোকানের মালিক শাহীন ভিনটেজ ফার্নিচার বিক্রি করেন। তার দোকানের একটি বিশেষ জিনিস আমার নজর কাড়লো, একটি কালো রঙের মেহগনি কাঠের দরজার প্যানেল, যার মধ্যে পাঁচ-পাপড়িযুক্ত ফুল, ডালপালা, পেঁচানো হেমিং আর ময়ূর নকশা করে আঁকা।
শাহীন জানান, "এই আইটেমটা কোনো অ্যান্টিক না। আমরা একটা অ্যান্টিক বস্তু থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে সেটারই একটি নকল তৈরি করেছি। আমি এটা ৫০ হাজার টাকা থেকে ৬০ হাজার টাকায় বিক্রি করব। তবে এটি যদি সত্যিকারের অ্যান্টিক হতো, তবে এর দাম হতো এক লাখ টাকার বেশি।"
শাহীন আমাকে তার দোকানে রাখা একটা একেবারে নতুন চকচকে গ্রামোফোন দেখিয়ে জানালেন যে, নকশাটি পুরানো হলেও এটা আসলে চীনে তৈরি।
এই দোকানগুলো কেবল খাঁটি অ্যান্টিক জিনিসই বিক্রি করে না, বরং এগুলোকে কিউরিও স্টোর বলা যায়। বিভিন্ন যুগের বিভিন্ন দেশের সুন্দর সুন্দর বস্তুগুলো এখানে রাখা হয়। শাহীন বলেন, "আমরা আগে দেখি যে, বস্তুটি মানসম্পন্ন, ভালো উপাদান দিয়ে তৈরি, দামি এবং দেখতে পুরানো বা শৈল্পিক কিনা। যদি খাঁটি অ্যান্টিক পিস হয় তবে সেটা বোনাস।"
হাইকমিশন, দূতাবাস এবং আন্তর্জাতিক এনজিও অফিসের বিদেশিরা মুলত গুলশানের এসব দোকানের প্রধান গ্রাহক। তবে সাম্প্রতিক সময়ে, বিশেষ করে ২০১৬ সালে হলি আর্টিজান হামলার পর থেকে বিদেশিদের কাছে বিক্রি অনেকটাই কমে গেছে। বর্তমান ক্রেতাদের বেশিরভাগই বাংলাদেশি ব্যক্তি, যারা নিজেদের ঘর সাজানোর জন্য শৈল্পিক জিনিস কিনতে দোকানে আসেন।
গুলশানের এসব দোকান ছাড়াও শাহবাগের সাকুরা ভবনের নিচতলায় অ্যান্টিক জিনিসপত্র পাওয়া যায়। তাছাড়া এখন অনলাইন পেজ এবং গ্রুপগুলোতেও অ্যান্টিক জিনিসপত্র বেচা-কেনা করা হয়, যদিও অনলাইনে বিক্রি করা পণ্যগুলো সবসময় আসল হয় কিনা তা নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়।
তবে দেশের অ্যান্টিক সংগ্রাহকরা তাদের সংগ্রহে এমন জিনিস রাখতে চান, যার সাথে কোনো ইতিহাস বা জড়িত, এবং যে বস্তুগুলোর যথাযথ ডকুমেন্টেশন রয়েছে।
থিসিয়াস প্যারাডক্সের জাহাজ
১৯৯৪ সাল। এনজিও-তে কাজ করা জিকেএম লুৎফর রহিম লাল্টু ফিল্ডওয়ার্কের জন্য সাতক্ষীরা যান। তার কাজ শেষ করার পর সন্ধ্যাবেলায় এক চায়ের দোকানে চা পান করতে থাকেন।
"হঠাৎ আমি খেয়াল করলাম আমার চারপাশে অনেক ধরনের বাতি জ্বলছে। যেহেতু ওই এলাকায় বিদ্যুৎ ছিল না, তাই স্থানীয়রা রাতে 'কুপি' (অয়েল ল্যাম্প) ব্যবহার করত। আমার যা সবচেয়ে ভালো লেগেছিল, তা হলো কুপিগুলোর নকশা: কারও কাছে ডিম্বাকৃতির পাত্র, কারও হাতে ছিল ফুলের নকশার হাতল, আর কিছু ছিল একেবারেই সাদামাটা। আমার মনে একটা ভাবনার উদয় হলো: এমন এক দিন আসবে যখন আর এই কুপিগুলো ব্যবহার করা হবে না," লাল্টু তার পুরনো দিনের স্মৃতিচারণ করলেন।
সেবার সাতক্ষীরা থেকে লাল্টু বেশ কয়েকটি স্থানীয় কুপি সংগ্রহ করে নিয়ে আসেন। তিনি জানান, "কিছু কিছু কুপি দুই প্রজন্ম ধরে পরিবারগুলোর মাধ্যমে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল।"
বর্তমানে তার সংগ্রহে রয়েছে শতাব্দী প্রাচীন গ্রামোফোন, হুক্কা, ভিনটেজ ক্যামেরা, ল্যাম্পসহ নানা জিনিস।
"এনজিও কর্মী হওয়ার কারণে আমি কখনোই ধনী ছিলাম না। কিন্তু কোনো না কোনোভাবে আমি এগুলো কেনার জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে পেরেছি। এগুলো আসলে অর্থের সাথে জড়িত নয়, এগুলো আবেগের বিষয়।"
এরপর রয়েছেন শাদিকুল বাশার। ২০০৫ সালে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় বগুড়ার এক স্থানীয় মুদি দোকানে তিনি প্রথম এক ব্রিটিশ যুগের মুদ্রা দেখতে পেয়েছিলেন। চকলেট কিনতে গেলে তিনি দেখতে পান দোকানের মালিক তার সমস্ত ধাতব পয়সা একটা কাঁচের পাত্রে রেখেছেন। সেই স্তূপের মধ্যেই এক ব্রিটিশ মুদ্রা দেখতে পান তিনি।
দোকানের মালিক মুদ্রাটি একটি স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে তার বাবার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন। বাশার জানান, "সেদিন আমার মাথায় একটা চিন্তা ঢুকে যায়। বর্তমানের সেই স্তূপে অতীতের এক টুকরো লুকিয়ে ছিল। আর এরকমইভাবেই আশেপাশে ইতিহাসের শত শত নিদর্শন লুকিয়ে আছে।"
সেদিন থেকেই বাশার পুরনো জিনিস সংগ্রহ করতে শুরু করেন: ম্যাচের বাক্স, কয়েন, কাগজের নোট এবং ধীরে ধীরে পুরনো যুগের কাটলারি, কালি রাখার পাত্র, সুরমা রাখার পাত্র সহ নানা জিনিস।
তিনি আমাকে একটি পকেট সুরমাদানি দেখালেন। আঁশযুক্ত মাছের আকারের পিতলের তৈরি এই পাত্রটি আপনার হাতের তালুর মধ্যেই নিখুঁতভাবে বসে যাবে। বাশার এই জিনিসটিও সংগ্রহ করেছিলেন এমন এক ব্যক্তির কাছ থেকে, যিনি সুরমাদানিটি পৈত্রিকসূত্রে পেয়েছিলেন। তার কাছে একটি ময়ূরাকারের প্রদীপও রয়েছে।
তবে বাশার তার সংগ্রহের সবচেয়ে আকর্ষণীয় জিনিসগুলোর একটা আমাকে দেখালেন, আর তা হলো ৫৯০ এবং ৬২৫ সালের শশাঙ্কের আমলের এক জোড়া স্বর্ণমুদ্রা। শশাঙ্ক ছিলেন গৌড় সাম্রাজ্য নামে বঙ্গীয় অঞ্চলকে একীভূত করা রাষ্ট্রের প্রথম স্বাধীন রাজা।
সোনার মুদ্রাগুলোর একপাশে হিন্দু দেবতা শিবকে তার বাহক ষাঁড় নন্দীর ওপর বিশ্রাম করতে দেখা যায়, এর নিচেই ব্রাহ্মী লিপিতে লেখা রয়েছে 'জয়া'। মুদ্রার অন্যপাশে দেখা যায় দেবী লক্ষ্মী একটি পদ্মের উপর পা দিয়ে বসে আছেন এবং ছোট হাতিরা তাদের শুঁড় দিয়ে দেবীর ওপর জল ছিটিয়ে দিচ্ছে।
প্রথমে আমি সত্যিই বিশ্বাস করতে পারিনি যে এগুলো শশাঙ্কের আমলের আসল স্বর্ণমুদ্রা হতে পারে। কিন্তু পরে আমি এনসাইক্লোপিডিয়ার সাথে ক্রস-চেক করে নিশ্চিত হই, এটা আসল মুদ্রাই বটে!
বাশার জানান, "আমি এই দুইটি কয়েন একজন ব্যক্তির কাছ থেকে দশ হাজার টাকায় কিনেছিলাম। তার পূর্বপুরুষরা মাটি খুঁড়ে এগুলো খুঁজে পেয়েছেন এবং যুগ যুগ ধরে এই দুটো মুদ্রাকে আগলে রেখেছেন।"
আমি যখন অ্যান্টিক সংগ্রহকারীদের সাথে কথা বলি, আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে তারা গল্প এবং ইতিহাসের সন্ধান করছেন, আর তাদের এই আগ্রহ কিউরিও শপগুলোর চেয়েও বেশি। অ্যান্টিক সংগ্রাহকদের মতে, তাদের কাছে এই প্রাচীন জিনিসপত্র সংগ্রহ করা প্রায় দেশপ্রেমের মতো কাজ। বাশার যেমন বলেছেন, "আমরা চাই না আমাদের ঐতিহ্যগুলো বিদেশে পাচার হোক। আমরা এগুলো সংগ্রহ করি, যাতে আমাদের অতীতের সুন্দর নিদর্শনগুলো বাংলাদেশের ভূখণ্ডেই থেকে যায়।"
এই বক্তব্য আমাকে থিসিয়াসের জাহাজের বিখ্যাত প্যারাডক্সের কথা মনে করিয়ে দিল। গ্রিক উপকথা অনুযায়ী, গ্রিক রাজপুত্র থিসিয়াস ক্রিটে একটি সফল অভিযানের পর অ্যাথেন্সে ফিরে আসেন এবং অ্যাথেনিয়ানরা সাহসের প্রতীক হিসাবে থিসিয়াসকে বহন করা জাহাজটিকে সংরক্ষণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু দিন অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে জাহাজের কিছু অংশ পচতে শুরু করে। সেগুলো প্রতিস্থাপনের জন্য অ্যাথেনিয়ানরা জাহাজের প্রতিটি তক্তাকে নতুন কাঠের টুকরো দিয়ে প্রতিস্থাপন করে ফেলে।
এখন প্যারাডক্সটি হলো এই যে, এমন এক সময় আসবে যখন সমস্ত তক্তা প্রতিস্থাপিত হবে, আসল জাহাজের কোনো তক্তাই অবশিষ্ট থাকবে না। তাহলে এটা কি থিসিয়াসের আসল জাহাজ, নাকি সম্পূর্ণ নতুন এক জাহাজ?
দার্শনিক জন লকের তত্ত্ব অনুযায়ী, আমাদের স্মৃতিই আমাদের অতীতের সাথে বর্তমানকে যুক্ত করে। এই জিনিসটিই কোনো বস্তুকে বিশেষ করে তোলে। তাই একটি স্যুভেনির দোকান থেকে পুরানো কিন্তু সুন্দর বস্তুর চেয়ে সংগ্রাহকরা এমন বস্তু বাছাই করেন, যার পেছনে একটা গল্প রয়েছে।
তবে অ্যান্টিক সংগ্রহের প্রক্রিয়াটি বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি, বরং বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। যেহেতু দেশে কোনো সরকারি নিলামঘর নেই, তাই সংগ্রাহকরা নিজেদের মধ্যে একটি অনানুষ্ঠানিক নেটওয়ার্ক তৈরি করেছেন যার মাধ্যমে তারা তাদের মূল্যবান অ্যান্টিকগুলো অদলবদল, বিনিময় এবং বিক্রি করে থাকেন।
দেশে অ্যান্টিক সংগ্রাহকদের প্রকৃত সংখ্যা কিংবা অ্যান্টিক সংখ্যা নিয়েও কখনো কোনো জরিপ করা হয়নি।
তবে বাংলাদেশ নিউমিজম্যাটিক কালেক্টরস সোসাইটি (বিএনসিএস)-এর ২৫০ জন আজীবন সদস্য রয়েছেন এবং সোসাইটির সভাপতি অমলেন্দ্র সাহার মতে, সারা দেশে প্রায় ৭,০০০ মুদ্রা সংগ্রাহক রয়েছেন। ফিলাটেলিস্টদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। বাংলাদেশ ন্যাশনাল ফিলাটেলিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, শুধু ঢাকাতেই তিন শতাধিক ফিলাটেলিস্ট [স্ট্যাম্প সংগ্রাহক] রয়েছেন।
কিন্তু অ্যান্টিক সংগ্রাহকদের জন্য এমন কোনো ক্লাব বা সমিতি নেই।
বাশার জানান, প্রাচীন অ্যান্টিক জিনিস সংগ্রহ করাও ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। "আমি বিএনসিএস এর একজন সদস্য, তাই সুলতানি ও মুঘল আমলের দুর্লভ এবং দামি স্বর্ণমুদ্রা রাখা আমার জন্য নিরাপদ। কিন্তু আমার কাছে কালো পাথরের ভাস্কর্য থাকলে কোন নিরাপত্তা নেই, কারণ যে কেউ আমার বাড়িতে ঢুকে অভিযোগ করতে পারে আমি এটা পাচার করছি।"
এই কারণেই সংগ্রাহকরা প্রায়ই নিজেরা প্রদর্শনীর আয়োজন করেন এবং কখনও কখনও স্থানীয় সংগ্রাহকদের সাথে একত্রিত হয়ে কাজ করেন। লাল্টু ব্যাখ্যা করেন, "এই প্রদর্শনীগুলোর লক্ষ্য হলো সরকারকে দেখানো যে, আমরা কিছু লুকাচ্ছি না। অথবা আমার কাছে কোন অবৈধ জিনিস নেই।"
অ্যান্টিক সংগ্রাহকদের বেশিরভাগই শক্ত ধাতব অ্যান্টিক জিনিস সংগ্রহ করতে পছন্দ করেন, কারণ এগুলো ধীরে ধীরে ক্ষয় হয়। বাংলাদেশের জাতীয় জাদুঘরের এথনোগ্রাফি অ্যান্ড ডেকোরেটিভ আর্ট বিভাগের কিপার আসমা ফেরদৌসী বলেন, আমাদের দেশের আবহাওয়ায় কাগজ, ফ্যাব্রিক বা টেক্সটাইলের মতো ভঙ্গুর বস্তু রিস্টোরেশনের জন্য মোটেও উপযুক্ত নয়।
তিনি বলেন, "জাতীয় জাদুঘরে যেসব মসলিন বা অন্যান্য কাপড় রাখা হয়েছে, সেগুলোকে স্পর্শ করলে সেগুলো ধুলোয় মিশে যাবে। তাই আপনি এমন কোনো অ্যান্টিক সংগ্রাহক পাবেন না, যারা অ্যান্টিক কাপড় সংগ্রহ করেন।"
অ্যান্টিক বনাম ভিনটেজ বনাম রেট্রো
১৯৬৮ সালের অ্যান্টিকিটি আইন অনুসারে, প্রাচীন বা অ্যান্টিক বলতে এমন প্রত্নবস্তুকে বোঝায়, যা কমপক্ষে ১০০ বছর আগের সময়ের সাথে জড়িত।
এখানে অ্যান্টিক বলতে বোঝানো হয়েছে মানুষের কার্যক্রমের সাথে জড়িত স্থাবর কিংবা অস্থাবর, শিল্প, স্থাপত্য, কারুশিল্প, প্রথা, সাহিত্য, নৈতিকতা, রাজনীতি, ধর্ম, যুদ্ধ, বিজ্ঞান, বা সভ্যতা বা সংস্কৃতির সাথে সম্পর্কিত প্রাচীন বস্তু অথবা ঐতিহাসিক, নৃতাত্ত্বিক, সামরিক বা বৈজ্ঞানিক আগ্রহের স্থান।
তাই ২০২৩ সালের ক্ষেত্রে ১৯২৩ সালের আগে তৈরি বা ব্যবহার করা প্রত্নবস্তুকে অ্যান্টিক জিনিস হিসেবে বিবেচনা করা হবে।
অন্যদিকে ভিনটেজ বলতে বোঝায় এমন বস্তুকে, যা কমপক্ষে ৩০ থেকে ৪০ বছরের চেয়ে বেশি পুরনো। অর্থাৎ, বর্তমান সময়ে ১৯৭০-১৯৮০ সালের পূর্ববর্তী জিনিসকে ভিনটেজ বস্তু হিসেবে ধরা হবে।
অন্যদিকে রেট্রো হলো এমন বস্তু, যা এক থেকে দুই দশকের চেয়ে বেশি পুরনো নয়।
অনলাইন বিডিংয়ের মাধ্যমে আসল অ্যান্টিক সন্ধান
পারিবারিক উত্তরাধিকার হিসেবে পাওয়া সম্পদ ঘাঁটা এবং একজনের সাথে আরেকজনের মধ্যে অ্যান্টিক জিনিসপত্র বিক্রি বা বিনিময় ছাড়াও সংগ্রাহকরা আন্তর্জাতিক নিলাম এবং আন্তর্জাতিক বিনিময়ে (বিশেষ করে মুদ্রা এবং স্ট্যাম্পের ক্ষেত্রে) অংশগ্রহণ করে থাকেন। বাংলাদেশে বন্ধকী, জমি বা সম্পদ, মুদ্রা এবং স্ট্যাম্পের নিলাম প্ল্যাটফর্ম রয়েছে, কিন্তু অ্যান্টিক বস্তুর ক্ষেত্রে নেই। তাই সংগ্রাহকরা অনলাইন নিলামেই বিড করেন, যার বেশিরভাগই ভারতীয় অকশন হাউজের মাধ্যমে আয়োজন করা হয়।
বাশার জানান, "আমাদের মতো বাংলাদেশি সংগ্রাহকরা উপমহাদেশের ইতিহাসের সাথে জড়িত, এমন জিনিস সংগ্রহ করতে আগ্রহী। এ কারণেই আমরা সংগ্রহের জন্য ভারতীয় নিলামগুলোতেই অংশগ্রহণ করি।"
ভিরাসাত অকশন দেশের অ্যান্টিক সংগ্রহকারীদের মধ্যে একটি জনপ্রিয় অকশন হাউজ। তবে, এদের কাছে টাকা পাঠানো এবং অ্যান্টিক সংগ্রহ করা আরেক চ্যালেঞ্জ।
"বাংলাদেশে পেপাল নেই, তাই আমরা সরাসরি বাংলাদেশ থেকে বিড করতে পারি না। তাই আমাদেরকে বিদেশে থাকা বন্ধুদের মাধ্যমে বিড করতে হয়। তারা যখন বাংলাদেশে আসে, তখন আমরা তাদের কাছ থেকে অ্যান্টিক বস্তুটি সংগ্রহ করি এবং টাকা ফেরত দিই," বলে জানান আরেক অ্যান্টিক সংগ্রাহক আজাদ রহমান।
কার্বন ডেটিং ছাড়াই জাল চিহ্নিতকরণ
প্রাচীন জিনিস শনাক্তকরণের জন্য ডকুমেন্টেশন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ কারণেই বেশিরভাগ সংগ্রাহক মুদ্রা, নোট, স্ট্যাম্প বা এমন কিছু সংগ্রহ করতে পছন্দ করেন, যেগুলোতে একরকম অক্ষর বা লিপি রয়েছে। অক্ষর বা লিপির মাধ্যমে বস্তুটি কোন যুগের তা প্রমাণ করা সহজ হয়।
এ ব্যাপারে আমরা কথা বলেছি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. মোজাম্মেল হকের সঙ্গে।
তিনি জানান, "১৯৫০-এর দশক পর্যন্ত ডিজাইন এবং প্যাটার্নের বিবর্তন বেশ স্থিতিশীল ছিল৷ একটি চমৎকার ডিজাইন তৈরি হতে সময় প্রয়োজন হয় এবং প্রতিটি দশক বা যুগের একটি নির্দিষ্ট ধরনের স্টাইল ছিল৷ তাই আমরা যখন কোনো জায়গা খুঁড়ে কোনো প্রত্নবস্তু খুঁজে পাই, আমরা এর প্যাটার্ন এবং ডিজাইন শণাক্ত করে এটি কোন যুগের তা সহজে অনুমান করতে পারি।"
কিন্তু খোঁড়ার পর পাওয়া প্রত্নবস্তুর বয়স নির্ধারণের জন্য কার্বন ডেটিং প্রয়োজন।
"যখন আমরা কোনও জায়গা খনন করি এবং ধাতব মুদ্রা বা বাতির মতো কোনো প্রাচীন জিনিস খুঁজে পাই, তখন এর সাথে থাকা কয়লা বা মাটিযুক্ত কোনো উপাদান খুঁজে বের করতে হয়৷ কারণ ধাতুকে কার্বন ডেটিং করা যায় না। তাই আমাদের কয়লা, গাছ বা প্রাণীর অবশেষ প্রয়োজন৷ অথবা কাঠ বা চামড়া থেকে তৈরি মানুষের ব্যবহার করা প্রত্নবস্তুর মাধ্যমেও কার্বন ডেটিং করা যায়, কারণ এই জিনিসগুলোর বয়স সাধারণত ৫০ হাজার বছরের কম হয়ে থাকে।"
কিন্তু বাংলাদেশে কার্বন ডেটিং ল্যাব নেই। তাই এই নমুনাগুলোকে ভারতে পাঠাতে হয়। অন্যথায়, প্রত্নবস্তুটির ডিজাইন আর প্যাটার্ন দেখে এর যুগ নির্ধারণ করতে হয়।
ড. হক জানান, "উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পাল আমলের কালো পাথর দিয়ে তৈরি ভাস্কর্যগুলোর কথা। এগুলোতে নির্দিষ্ট কিছু মোটিফ রয়েছে, যেগুলো বিশেষ ধাতব যন্ত্র ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছিল। একজন প্রত্নতত্ত্ববিদ হিসাবে, আমি এর প্রতিলিপি তৈরি করতে পারবো, তবে আপনি যদি এর নকল করার চেষ্টা করেন তবে আপনি ধরা পড়বেন।"