ডান্সিং অন দ্য গ্রেভ: তিন দশক আগে যে হত্যাকাণ্ড ভারতজুড়ে আলোড়ন তুলেছিল
দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের সবচেয়ে অভিজাত একটি পরিবার থেকে উঠে এসেছিলেন শাকিরা খলিলি। তিনি ছিলেন তার সময়ের সবচেয়ে 'সুন্দর এবং বিত্তশালী' নারীদের মধ্যে একজন। কিন্তু ১৯৯১ সালে একদিন হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যান তিনি, যেন ভোজবাজির মতোই হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছেন! ভারতের অন্যতম বিত্তশালী এই নারীর চাঞ্চল্যকর মৃত্যু সম্পর্কে নানা তথ্য উঠে এসেছে সংবাদমাধ্যম বিবিসির সাম্প্রতিক একটি প্রতিবেদনে।
নিখোঁজ হওয়ার পরবর্তী তিন বছরে শাকিরার দ্বিতীয় স্বামী মুরালি মনোহর মিশ্র, যিনি স্বামী শ্রদ্ধানন্দ নামেই বেশি পরিচিত- অজস্র মনগড়া কাহিনী বানিয়ে গিয়েছেন স্ত্রীর হদিস সম্পর্কে।
তিন বছর পর ১৯৯৪ সালে বেঙ্গালুরুতে তাদের নিজ বাড়ির উঠান খুঁড়ে শাকিরার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। জানা যায়, প্রথমে মাদক সেবন করানোর পর কাঠের বাক্সে ভরে তাকে মাটিচাপা দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে তদন্তে বেরিয়ে আসে যে তাকে জীবন্তই মাটিচাপা দেওয়া হয়েছিল! শাকিরা খলিলির এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা সেসময় ভারতজুড়ে আলোড়ন তুলেছিল।
২০০৩ সালে ট্রায়াল কোর্ট স্বামী শ্রদ্ধানন্দকে খুনের দায়ে অভিযুক্ত করে এবং মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয়, যা পরে নিশ্চিত করে হাইকোর্ট। আদালত এই সিদ্ধান্তে আসে যে তিনি শাকিরা খলিলিকে তার কোটি কোটি রূপির সম্পদের লোভে বিয়ে করেছিলেন।
তার আপিলের সময় সুপ্রিম কোর্ট এ ঘটনাকে 'একজন মানুষের জঘন্য লোভ এবং শয়তানের মতো ধূর্ততা' বলে আখ্যা দেয়। তবে শ্রদ্ধানন্দের সাজা কমিয়ে 'বিনা মওকুফে' যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। বিবিসি জানিয়েছে, গত সপ্তাহে শীর্ষ আদালত তার প্যারোলের আবেদন গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
৩০ বছর আগে যে চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ড ভারতজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল, সেই ঘটনা অবলম্বনেই এবার তৈরি হচ্ছে নতুন একটি ওয়েব শো। আমাজন প্রাইম ভিডিওতে প্রচারিত হবে 'ডান্সিং অন দ্য গ্রেভ' নামের এই ওয়েব শো। ওয়েব শো'র এরকম নামকরণের কারণ- যে উঠানে স্ত্রীকে মাটিচাপা দিয়েছেন, সেই উঠানেই একাধিক নাচের পার্টি আয়োজন করেছিলেন স্বামী শ্রদ্ধানন্দ।
ওয়েব শো'টির প্রযোজক, ইন্ডিয়া টুডে অরিজিনালস প্রোডাকশন-এর চাঁদনি আলাওয়াত দাবাস জানান, শাকিরার হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে এখনো অনেক 'কি, কেন, কিভাবে' প্রশ্ন রয়েছে যা এখনও বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না।
"৩০ বছর পুরনো ঘটনা হলেও, আমাদের মনে হয় এটা এমন একটা অপরাধ ছিল যা সম্পর্কে মানুষের জানা উচিত, কারণ এই হত্যাকাণ্ডটি আজও রহস্যঘেরা", বলেন চাঁদনি।
যদিও খুনের ঘটনা ও খুনীর ওপর নির্মিত সিরিজে এই সকল প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় না, কিন্তু এটি দর্শকদের দেখার জন্য আকর্ষণীয় একটি সিরিজ এবং ভারতে এটি বেশ সাড়া ফেলেছে। চার পার্টের এই সিরিজের প্রথম দুই এপিসোডে শাকিরা খলিলির জীবনের নানা দিক তুলে ধরা হয়েছে।
মাইসোর, ব্যাঙ্গালোর, জয়পুর ও হারদরাবাদের দেওয়ান হিসেবে দায়িত্ব পালন করা, স্যার মির্জা ইসমাইলের নাতনি শাকিরা খলিলি প্রথম বিয়ে করেছিলেন সুদর্শন কূটনীতিবিদ আকবর খলিলিকে। এই দুজনের সংসারে চার মেয়ের জন্ম হয়।
পরিবারের সদস্যরা শাকিরাকে একজন 'মনোমুগ্ধকারী, লার্জার দ্যান লাইফ চরিত্র' হিসেবে অভিহিত করেছিলেন, যার 'ভিন্টেজ গাড়ির শখ ছিল, যিনি ছিলেন খুবই সামাজিক এবং স্নেহময়ী নারী'।
কিন্তু আশির দশকের মাঝামাঝিতে শ্রদ্ধানন্দের সাথে পরিচয় হয় তার এবং শাকিরার জীবন নতুন দিকে মোড় নেয়।
বিবিসি হিন্দি'র ইমরান কুরেশি সেসময় ব্যাঙ্গালোরে টাইমস অব ইন্ডিয়ার হয়ে কাজ করতেন। ডকুসিরিজেও দেখা যাবে তাকে। তিনি বলেন, "শাকিরার হত্যাকাণ্ডে মানুষ শিউরে উঠেছিল, কারণ তাকে খুবই নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল- এমনকি তাকে জীবিত মাটিচাপা দেওয়া হয়েছিল। এ হত্যাকাণ্ড মানুষের মুখে মুখে ফিরেছিল, কারণ প্রথম স্বামীকে ডিভোর্স দিয়েই তিনি শ্রদ্ধানন্দের মতো একজনকে বিয়ে করেছিলেন।"
সে সময়কার প্রেস ক্লিপিংসে স্বামী শ্রদ্ধানন্দকে খুবই দরিদ্র ঘরের সন্তান এবং স্কুল থেকে ঝরে পড়া একজন হিসেবে অভিহিত করা হয়। একই সঙ্গে তাকে একজন 'ভণ্ড সাধু' ও 'কাজের ছেলে' হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, যিনি 'কিছু সম্পত্তি সংক্রান্ত কিছু বিষয়ে শাকিরাকে সাহায্য করে' তার প্রিয় হয়ে ওঠেন। শাকিরার ছেলে সন্তানের মা হওয়ার ইচ্ছার সুযোগ নেন শ্রদ্ধানন্দ এবং দাবি করেন যে তিনি জাদুকরী শক্তিতে তার সেই ইচ্ছা পূরণ করবেন।
বিভিন্ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৮৬ সালে শ্রদ্ধানন্দকে বিয়ে করার পরপরই দুজনের সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে। তারা দুজনে প্রায়ই ঝগড়া করতেন এবং বেশিরভাগ সময়ই তা হতো টাকাপয়সা নিয়ে। ফলে স্ত্রীকে নৃশংসভাবে খুন করে তার সম্পত্তি হাতিয়ে নিতে চেয়েছিলেন শ্রদ্ধানন্দ।
ভারতের ট্রায়াল কোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টের মোট আটজন বিচারক শ্রদ্ধানন্দকে দোষী সাব্যস্ত করলেও, তার আইনজীবীদের দাবি- তার বিরুদ্ধে 'সারকামসটেনশিয়াল এভিডেন্স' পাওয়া গেছে। আর ওয়েব সিরিজে শ্রদ্ধানন্দ নিজে দাবি করেছেন যে তিনি শাকিরা খলিলিকে খুন করেননি।
কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন যে এই শো এর মাধ্যমে অপরাধীদের একটি প্ল্যাটফর্ম দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু 'ড্যান্সিং অন দ্য গ্রেভ' এর পরিচালক, মুম্বাইভিত্তিক ব্রিটিশ চলচ্চিত্র নির্মাতা প্যাট্রিক গ্রাহাম শ্রদ্ধানন্দকে কথা বলার সুযোগ দেওয়ার সিদ্ধান্তের পক্ষে যুক্তি দিয়েছেন।
বিবিসিকে গ্রাহাম বলেন, "আমি মনে করি আমাদের অপর পক্ষের কথাগুলো শোনারও দরকার আছে, কারণ গত ৩০ বছর ধরে আমরা তার কাছ থেকে কোনো সাড়াশব্দ পাইনি। তিনি শাকিরার চরিত্রটি সম্পর্কে আমাদের মূল্যবান কিছু তথ্য দিয়েছেন।"
গ্রাহাম জানান, তারা কারাগারের ভেতরে গিয়েছিলেন কারণ তারা বুঝতে চেয়েছিলেন কিভাবে শ্রদ্ধানন্দের মতো একজন মানুষ শাকিরার উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারল।
"কিন্তু তিনি আমাদের উপরও প্রভাব বিস্তার করতে চেয়েছিলেন। শুরুতে তো আমরা বিশ্বাস করেই নিচ্ছিলাম যে এই কাহিনীর ভেতরে আরও অনেক স্তর আছে, যদিও তার সাথে পুরো কথোপকথন শেষ করার পর আমাদের আর কোনো সন্দেহ ছিল না যে শ্রদ্ধানন্দই খুনী", বলেন গ্রাহাম।
তিনি বলে চলেন, তাদেরকে এই বৃদ্ধ লোকটির মিথ্যার জালে ফেঁসে যাওয়ার বিষয়ে সতর্ক থাকতে হয়েছে। "কিন্তু যখন আমরা এই কাহিনীর আরও গভীরে গেলাম, আমাদের মনে হলো তার (শ্রদ্ধানন্দ) একটি এজেন্ডা আছে এবং তিনি একটা জাল বুনছেন।"
"তার সাথে আমরা যত বেশি সময় কাটিয়েছি, ততই এটা আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়েছে যে তার অনুভূতিগুলো সত্যি নয় এবং শেষের দিকে আমরা তার সাথে আরও কড়াভাবে আলাপ করার চেষ্টা করেছি", যোগ করেন গ্রাহাম।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত শ্রদ্ধানন্দ এটিকে'ঝগড়ার পর্যায়ে' নিয়ে যান এবং জোর করে দাবি করেন যে তিনি নির্দোষ এবং তার সঙ্গে খারাপ আচরণ করা হয়েছে, বলেন গ্রাহাম।
এই চলচ্চিত্র নির্মাতার ভাষ্যে, 'বেশিরভাগ সত্যিকার ক্রাইম সিরিজে অপরাধীকে 'জ্ঞানী' রূপে দেখানো হয়। কিন্তু আমি আগেই বদ্ধপরিকর ছিলাম যে আমি তা চাই না। অবশ্যই শ্রদ্ধানন্দের কিছু 'যোগ্যতা' ছিল, তার একটি হলো মানুষকে তার কথা বিশ্বাস করানো।"
কিন্তু দিনশেষে ভারতের আদালতকে তিনি তার কথা বিশ্বাস করাতে পারেননি এবং নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারেননি।