জাতীয় লটারির গোলকধাঁধার দুনিয়ায়: কোটি টাকার লেনদেন, বিজয়ী ও দীর্ঘসূত্রিতার সাতকাহন
২০১৫ সালের একদিন নাটোরের বাসিন্দা ও সরকারি কর্মচারী আব্দুল কুদ্দুস কাজ শেষে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে দেখেন তার ছেলে সাদাত আলী রিফাত বেশ উত্তেজিত। জাতীয় লটারিতে ১০ লাখ টাকা জেতার সুসংবাদ দিতে সেদিন তার আগেও বাবাকে ফোন করেছিল সে। স্কুলে যাওয়ার সময় নাটোরের গোপালপুর বাজারে একটি পত্রিকায় সাদাত লটারিজয়ী টিকেটের নম্বরটি দেখেছিল।
সংবাদপত্রের কাটিংয়ের সাথে এরপর পিতাপুত্র দুজনে মিলে তাদের টিকেটের নম্বর বেশ কয়েকবার মেলালেন। অনলাইনেও খোঁজ নেন।
স্মৃতিচারণ করে আব্দুল কুদ্দুস বলেন, 'চেক করার জন্য আমার ফোন ব্যবহার করেছিল ছেলে। খুব নার্ভাস লাগছিল যে, সত্যিই এটা সঠিক নম্বর কিনা। তাই আমরা বার বার চেক করি'। সে রাতে নিরাপদে রাখতে টিকিটটি আলমারিতে তুলে রেখেছিলেন তিনি।
পরের দিন আব্দুল কুদ্দুস ও তার ভাগ্নে লটারি টিকিটটি নিয়ে ঢাকায় বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির অফিসে আসেন পুরষ্কার দাবী করতে।
গত তিন দশক ধরে যেসব সংস্থা লটারির টিকেট বিক্রির মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহ করছে, তারমধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটি। রাষ্ট্র-অনুমোদিত জাতীয় লটারির শুরুটা ১৯৯০ এর দশকের শুরুর দিকে হলেও, ওই দশকের শেষদিকে এবং ২০০০ এর দশকের শুরুর দিকে তা পূর্ণমাত্রা লাভ করে।
তবে লটারি এজেন্ট ও অংশীজনরা বলেছেন, গত ১০-১৫ বছরে পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি হয়েছে। শেষ আঘাতটা হানে করোনা মহামারি, ফলে লটারি কার্যক্রম একদম বন্ধ হয়ে গেছে।
প্রাণান্তকর এক গোলকধাঁধাঁ
ঢাকায় বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির অফিসে আসার পর আব্দুল কুদ্দুসকে প্রথমে বলা হয়, পুরস্কারের অর্থদাবী করতে তিনি অনেক দেরিতে এসেছেন। কিন্তু, আসল ঘটনা ছিল অন্য। আব্দুল কর্মকর্তাদের কথার প্রতিবাদ করলে তাকে জানানো হয়, নাটোরের জেলা প্রশাসকের (ডিসি) স্বাক্ষর লাগবে।
এ ছিল তারপরের অসম লড়াইয়ের শুরুমাত্র, কিন্তু হাল ছাড়েননি তিনি।
নাটোরের ডিসি অফিসে আসার পর তাকে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন ও মন্তব্যের সম্মুখীন হতে হয়, যেমন কর্মকর্তারা বলেন, 'এটা সঠিক নয়, ডিসি অফিস কেন সই দেবে?'। সেখান থেকে নাটোরের ইউএনও-র কার্যালয়ে যান আব্দুল। সেখানে এই প্রথম কিছুটা আশার আলো দেখেন। ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তাকে সত্যয়নপত্রসহ যোগাযোগ করার জন্য ফোন নম্বরও দেন।
সত্যয়নপত্র নিয়ে আবারো ডিসি অফিস আসেন আব্দুল। সেখানকার কর্মকর্তারা এবিষয়ে ইউএনও অফিসে খোঁজখবর নিয়ে নিশ্চিত হবার পর অবশেষে বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটি যে 'সইটি' চেয়েছিল তা দিয়ে দেন।
অবশ্য এটাও যথেষ্ট ছিল না। তখন কাজটা এগিয়ে নিতে পরিচিতজনদের মাধ্যমে একজন সাংসদের দ্বারস্থ হন। ওই সাংসদ ক্যান্সার সোসাইটির অফিসে ফোন করেছিলেন বলেও জানান তিনি।
সাংসদের ফোন পেয়েও সচেষ্ট হয়নি ক্যান্সার সোসাইটি, সেজন্য আরো চেষ্টাচরিত্রের দরকার ছিল।
স্মৃতি হাতড়ে আব্দুল কুদ্দুস বলেন, 'সেসময় ঢাকায় পুলিশের একজন পদস্থ কর্মকর্তার গাড়িচালক ছিলেন আমারই এক আত্মীয়। তার মাধ্যমে ওই কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করি। তখন তিনি বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির সামনে অবস্থিত পুলিশ বক্সকে বিষয়টি জানান। বিষয়টিতে যখন পুলিশ জড়িয়ে পড়লো, কেবল তখনই সোসাইটির অফিস আমাকে লটারির পুরস্কার দিতে রাজি হয়।'
আব্দুল বলেন, 'এসব কিছু করা হয়েছে আমাকে ঠেকাতে', যাতে আমি 'টিকেট জমা দেওয়ার তারিখ মিস করি'। কারণ লটারি টিকেটের নির্দিষ্ট সময় থাকে – বিজয়ী নম্বরগুলো ঘোষণার পর লটারি জয়ীদের নির্ধারিত অফিসে এসে ৯০ দিনের মধ্যে পুরস্কার দাবি করতে হয়।
এত ঝক্কি-ঝামেলা পোহানোর পর ক্যান্সার সোসাইটির অফিস আব্দুলকে অর্থ প্রদানে রাজি হলেও – সে টাকা দেয় আরো ১৫-২০ দিন পর।
তিনি বলেন, লটারি এজেন্টরা আমাকে পাঁচ লাখ টাকা দিতে বলেন। কিন্তু, আমি তাদের বলেছিলাম, বড়জোর ১ থেকে ২ লাখ টাকার ব্যবস্থা করতে পারব। কিন্তু, শেষপর্যন্ত ঘুষ না দিয়েই লটারি জয়ের টাকা পান তিনি।
এজন্য তিন থেকে চার মাস আব্দুলকে ভোগান্তি পোহাতে হয়। প্রতিটি পর্যায়ে ছিল ছোটখাট আরো অনেক মারপ্যাঁচ, লটারিতে জয়ী প্রায় সকলকেই যার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়।
শেষপর্যন্ত ৮ লাখ টাকা পান আব্দুল। তিনি বলেন, 'আমাকে জানানো হয় বাকী ২ লাখ টাকা কর হিসেবে কর্তন করা হয়েছে।'
আব্দুলের বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির কাছে প্রশ্ন রাখা হলে, সোসাইটির অ্যাকাউন্টস ও প্রশাসন ব্যবস্থাপক হেনা খানম বলেন, 'আমরা তাকে কোনোভাবে হয়রানি বা বিব্রত করিনি। বিজয়ী যে এলাকার বাসিন্দা আমরা সেখানকার একটি সনদ (সত্যয়নপত্র) চেয়েছি। কারণ, যাকে টাকা দেওয়া হবে তিনিই যে আসল বিজয়ী, সেটা আমাদের নিশ্চিত হওয়া দরকার ছিল'।
বাজে ব্যবস্থাপনায় চালিত একটি ভঙ্গুর ব্যবস্থা
জাতীয় লটারি ব্যবস্থার অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়াকে আরেকটু তলিয়ে দেখে; এবং কেন ও কীভাবে এক সময়ের সফল এই রাষ্ট্র অনুমোদিত তহবিল সংগ্রহের প্রক্রিয়া মুখ থুবড়ে পড়েছে তা খতিয়ে দেখে জানা গেছে – এটি বাজে ব্যবস্থাপনায় চালিত একটি ভঙ্গুর ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে।
গত এক দশকে ক্রমান্বয়ে কমেছে টিকেট বিক্রি, ফলে অধিকাংশ সংস্থাই জাতীয় লটারিকে তহবিল সংগ্রহের কার্যকরী উপায় বলে আর মনে করে না। লটারি প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার অভাবেও মানুষ এর ওপর আস্থা হারিয়েছে ফেলেছে, যেমনটা দুর্ভোগের মধ্যে পড়ে উপলদ্ধি করেন আব্দুল কুদ্দুস।
সর্বশেষ ২০১৯ সালে জাতীয় লটারি অনুষ্ঠান করেছিল অধ্যাপক (ডা.) ওবায়দুল্লাহ-ফেরদৌসী ফাউন্ডেশন ক্যান্সার হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট।
লটারির মাধ্যমে তার প্রতিষ্ঠান কত টাকা সংগ্রহ করেছিল - তা জানতে চাওয়া হয় ইনস্টিটিউটের প্রধান নির্বাহী ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোল্লা ওবায়দুল্লাহ বাকীর কাছে। বিষয়টি তার স্মরণে নেই জানিয়ে লটারি এজেন্টের সাথে যোগাযোগের পরামর্শ দেন টিবিএস প্রতিবেদকদের।
নিবির কর্পোরেশনের স্বত্বাধিকারী এবং দীর্ঘকালের অভিজ্ঞ লটারি এজেন্ট হাজি আলম কবির বলেন, 'আমাদের দায়িত্ব হলো টিকেট বিক্রি করা। এর মাধ্যমে কোনো সংস্থা কত টাকা সংগ্রহ করছে তা আমাদের জানা নেই।'
কোনো সংস্থার পক্ষে কোম্পানি বা কনসোর্টিয়ামের মাধ্যমে কমিশন ভিত্তিতে লটারি ব্যবস্থাপনা, টিকেট বিতরণ ও বিক্রি করে থাকেন লটারি এজেন্টরা।
কবির জানান, ২০১৯ সালের সর্বশেষ লটারির ড্র অনুষ্ঠিত হয়েছিল ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে। কিন্তু, প্রথম পুরস্কার জয়ী কখনই আসেননি।
এসব রেকর্ড কার কাছে থাকে? লটারির উদ্যোগ নেওয়া সংস্থা, নাকি লটারি এজেন্টদের কাছে?
এর উত্তর যেন কোনো পক্ষই জানে না। এরই ধারাবাহিক ছন্দ চলতে থাকে তারপর। অতীতে অনুষ্ঠিত জাতীয় লটারিগুলোর বিষয়ে প্রশ্ন রাখলে – এমনকী কারা এগুলোর বিজয়ী ছিলেন – জানতে চাইলে উভয়পক্ষই একে-অপরের কাছে উত্তর সন্ধান করতে বলেন।
লটারিতে টিকেটের নম্বর ঘোষণার পর বিজয়ীদের আয়োজক সংস্থায় গিয়ে পুরস্কার দাবি করতে হয়। কিন্তু, অনুসন্ধানে জানা যায়- আরেকটি হতবাক করে দেওয়ার মতো বিষয়; এসব বিজয়ীদের নাম প্রকাশিত না করার ঘটনা।
কবির বলেন, বিজয়ীদের নাম জনস্মমুখে প্রকাশ করা অপরিহার্য; এটি যেমন স্বচ্ছতা আনে, তেমনি জাতীয় লটারির ওপর মানুষের আস্থা বাড়ায়।
কবিরের ভাষ্য অনুযায়ী, তহবিল সংগ্রাহক সংস্থাগুলো অনেক সময় বিজয়ীদের নামের বিজ্ঞাপন দিয়ে আর বাড়তি খরচ করতে চায় না। তাছাড়া, আত্মীয়স্বজন ও পরিচিতরা টাকা চেয়ে বসবে এমন আশঙ্কায় কিছু ক্ষেত্রে বিজয়ীরাও তাদের নাম না প্রকাশের অনুরোধ করেন।
জাতীয় লটারি করতে চাইলে আয়োজক সংস্থাকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের অনুমতি নিতে হয়। অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের (আইআরডি) জ্যেষ্ঠ সচিব আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেন, গত তিন বছর ধরে জাতীয় লটারি পরিচালনার অনুমতি দেওয়া বন্ধ রয়েছে।
কেন তা জানতে চাইলে- তিনি তার অধস্তন কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলতে বলেন। আইআরডির সিনিয়র সহকারী সচিব তারেক মোহাম্মদ জাকারিয়া বলেন, গত এক বছরে কোনো সংগঠন তহবিল সংগ্রহের আবেদন করেনি।
বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির সভাপতি ডা. গোলাম মহীউদ্দিন ফারুক জানান, খুব শিগগিরই লটারির মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহ করা হবে কিনা– সেবিষয়ে তারা সিদ্ধান্ত নেবেন।
'বৈঠকে যদি আমরা লটারির মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নেই, তাহলে নিজেরাই করব। কোনো দরপত্র জারি বা এজেন্ট নিয়োগ করা হবে না। আমি আগের একটি লটারির প্রক্রিয়ায় জড়িত ছিলাম। তখন উপলদ্ধি করেছি, এজেন্টরা টিকেট বিক্রির ক্ষেত্রে অনিয়ম করতে পারে।'
লটারির টিকেট ক্রেতাদের মধ্যে অনাস্থা থাকার বিষয়টি উল্লেখ করে বলেছেন, তাই এখন থেকে আমরা প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পুরষ্কার জয়ীদের ছবিসহ নাম প্রকাশ করব।
সে যাই হোক, বাস্তবতা হচ্ছে বিগত অনেক বছর ধরে- বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির মতোন বিভিন্ন সংস্থার আর্থিকভাবে টিকে থাকার গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ ছিল জাতীয় লটারি।
ডা. ফারুক জানান, 'লটারির টাকায় আমরা ঢাকার টেকনিক্যাল মোড় এলাকায় ৭০ শয্যার ক্যান্সার হাসপাতালের ভিত্তি নির্মাণ করি। ওই সময়ে এটা (লটারি) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে'।
বর্তমানে ক্যান্সার সোসাইটির আর্থিক অবস্থা আগের চেয়ে অনেক ভালো বলেও জানান তিনি। হয়তো এ ঘটনাই লটারি পরিচালনায় তাদের আগ্রহ কমে যাওয়ার প্রধান কারণ।
জাতীয় লটারি যেভাবে পরিচালিত হয়
লটারিতে জড়িত বিভিন্ন পক্ষ ও এর ব্যবস্থা সম্পর্কে একটু ভেঙে বলা যাক এবার। এখানে মূল পক্ষ তিনটি – সরকার, আয়োজক সংস্থা এবং লটারির এজেন্ট। সে তুলনায়, লটারির বিজয়ীরা- অর্থাৎ, আদৌ যদি তেমন কেউ থাকেন এবং সময়মতো পুরস্কার দাবি করতে হাজির হন – তারা হচ্ছেন অগৌণ পক্ষ।
লটারির নিয়ন্ত্রক পক্ষ হিসেবে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ, অনুমোদন দেওয়ার আগে সংস্থাগুলোর আবেদন তদন্ত ও যাচাই-বাছাই করে।
হাজি আলম কবির বলেন, লটারি আয়োজনে ইচ্ছুক সংস্থাকে বাংলাদেশের বিদ্যমান আইনে থাকা বেশকিছু শর্ত পূরণ করতে হয়। আর তা করতে পারলেই কোনো সংস্থা সরকারি অনুমোদনের যোগ্য বলে বিবেচিত হয়। এসব পূর্বশর্তের মধ্যে আছে, প্রতিষ্ঠানের কর রেকর্ড স্বচ্ছ থাকা, নিজস্ব কেন্দ্র থাকা ইত্যাদি।
তিনি বলেন, 'যোগ্যতা যাচাইয়ের অনেক ধাপ আছে। নাহলে কোনো ক্লাবের মতো যে কেউ এসে আবেদন করতে পারতো। আর এই অনুমোদন পেতে সর্বোচ্চ দেড় বছর সময় লাগতে পারে'।
যেসব সংস্থাকে জাতীয় লটারির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে বেশিরভাগই বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্রীড়া সংস্থা। যেমন বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটি, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন, সন্ধানী চক্ষু হাসপাতাল, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য এজড অ্যান্ড ইনস্টিটিউট ফর জেরিয়াট্রিক মেডিসিন, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইতি, বাংলাদেশ স্কাউটস, বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন, অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য প্রিভেনশন অব ড্রাগ এবিউজ, সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষা কর্মসূচি ইউসেপ বাংলাদেশ, ঢাকা আহসানিয়া মিশন এবং অধ্যাপক (ডা.) ওবায়দুল্লাহ-ফেরদৌসী ফাউন্ডেশন ক্যান্সার হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট।
এরপর আসে লটারি এজেন্টদের কথা – যারা কনসোর্টিয়াম বা কোম্পানির মাধ্যমে – জনগণের কাছে কমিশনের বিনিময়ে লটারির টিকেট বিক্রির দায়িত্ব নেয়।
প্রতিটি ক্ষেত্রেই আয়োজক সংস্থা ও লটারি এজেন্টের মধ্যে একটি লক্ষ্য পূরণের শর্ত থাকে।
কবির জানান, 'যেমন ধরুন, ২০ লাখ টিকেট বিক্রি করলে ২০ শতাংশ কমিশন পাওয়া যাবে'। এবিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট বা পূর্ব-নির্ধারিত হার নেই। উভয়পক্ষের মধ্যে চুক্তি অনুসারে, টিকেট বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ও কমিশন হার নির্ধারণ করা হয়।
আরেকটি পদ্ধতি হচ্ছে, উভয়পক্ষের মধ্যে ৫০:৫০ বা অন্য কোনো অনুপাতে টিকিট বিক্রির লভ্যাংশ ভাগাভাগি করে নেওয়া।
অনেক সময় আয়োজক সংস্থা একাধিক এজেন্ট নিয়োগ দেয়। কবির জানান, 'একবার আমি ছিলাম চার এজেন্ট মিলে গঠিত একটি কনসোর্টিয়ামের বিপরীতে। তারা অনেক কম দরে, ধরেন ৭ টাকায় টিকেট বিক্রি করে। ফলে আমার চেয়ে দ্রুত টার্গেট অর্জন করে। তাদের দেখাদেখি আমিও টিকেটের দাম কমাই। কিন্তু আমার আগেই টার্গেট পূরণ করায় – তারা সংগঠনের থেকে কমিশন পেয়ে যায়। এভাবে আমার বিপুল লোকসান হয়'।
এপর্যন্ত সর্বোচ্চ কত মুনাফা করেছেন জানতে চাইলে বলেন, 'একবার সর্বোচ্চ ৪০ লাখ টিকেট বিক্রি করে ২০-২৫ লাখ টাকা মুনাফা করেছিলাম'।
কবিরের মতে, বর্তমানে বাজারে শীর্ষস্থানীয় দুজন লটারি এজেন্ট আছেন। এরমধ্যে একজন তিনি নিজে, অপরজন হলেন খান এন্টারপ্রাইজের মালিক রফিকুল ইসলাম খান।
১৯৯৪ সালে লটারি এজেন্ট হন রফিকুল ইসলাম খান। এপর্যন্ত ১২-১৪টি জাতীয় লটারি ব্যবস্থাপনায় অংশ নেওয়া এই এজেন্ট বলেন, 'দেশে জাতীয় লটারি ব্যবস্থাপনার জন্য পাঁচটি বা ছয়টি কোম্পানি (লটারি এজেন্ট) রয়েছে। এই ব্যবসায় জড়িত আছে ১০ হাজারের বেশি ব্যক্তি'।
১৯৯১ সাল, জাতীয় লটারির যাত্রা শুরুর বছর
বাংলাদেশ জাতীয় লটারির যাত্রা শুরু কীভাবে?
কবির জানান, 'জাতীয় লটারির আগে ২ টাকার কুপন ছিল। দেশের বিভিন্ন জনপ্রিয় সিনেমা হলে এগুলো বিক্রি করা হতো।
জেলা কমিশনার ও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনুমতি নিয়ে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি ও অন্ধ কল্যাণ সমিতি এভাবে তহবিল সংগ্রহ করতো। কবির বলেন, 'আমিও এসব কুপন কিনেছি'।
এই কুপন বিক্রির ধারাবাহিকতাতেই বাংলাদেশ সরকার জাতীয় লটারির জন্য বিধান তৈরি করে। তবে ১৯৯১ সালের আগে কেউ তার সুযোগ নেয়নি।
তৎকালীন যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী সাদেক হোসেন খোকার নেতৃত্বে অর্থ মন্ত্রণালয় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের জন্য যৌথভাবে লটারির আয়োজন করে। কবির জানান, সে সময় ক্রীড়া পরিষদকে প্রাণবন্ত করতে তহবিলের একান্ত দরকার ছিল। আর এভাবেই জাতীয় লটারির যাত্রা শুরু হয়।
প্রাথমিক ধারণাটি ছিল খুবই সহজ-সরল; বিভিন্ন কল্যাণ সংস্থার তহবিল সংগ্রহে – লটারির আয়োজন ও ব্যবস্থাপনা করে উন্নতি করা যাতে সবাই এর সুফল পায়।
ওই সময় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ১০টি লটারি আয়োজনের অনুমোদন পায়।
'তখন বেশিরভাগ মানুষই লটারি সম্পর্কে বেশি জানতো না। কিন্তু, তৃতীয় বা চতুর্থ জাতীয় লটারি (অনুমোদিত ১০টির মধ্যে) যখন পরিচালিত হয়, ততোদিনে এর জনপ্রিয়তাও অনেক বেড়ে যায়, যা আমাদের কল্পনাতীত ছিল। এভাবে কোটি কোটি টাকা সংগ্রহ করে ক্রীড়া পরিষদ'- বলছিলেন কবির।
১৯৯০ এর দশকের মাঝামাঝি সর্দার এজেন্সির ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত থাকার সময়েই এ ব্যবসায় জড়িয়ে পড়া কবিরের মতে, তখন স্বচ্ছতাও ছিল। এর কয়েক বছর বছর পর কবির ও খান এন্টারপ্রাইজে ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত জাহিদুল ইসলাম চাকরি ছেড়ে নিবির কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠা করেন।
এবিষয়ে তার বক্তব্য, 'আমরা লক্ষ করি, আমাদের নিয়োগদাতা কোম্পানি দুটি কোটি কোটি টাকা আয় করছে, কিন্তু তার কোনো প্রতিফলন নেই আমাদের বেতন-ভাতায়। তাই চাকরি ছেড়ে নিজেরাই এ ব্যবসায় নামার সিদ্ধান্ত নেই'।
স্মৃতিচারণ করে কবির জানান, ষষ্ঠ জাতীয় লটারি সম্পন্ন হওয়ার পর কিছুদিনের বিরতি ছিল। 'তহবিলে কারচুপি বা অব্যবস্থাপনার কারণেই এমনটা হয়; ততোদিনে কিছু অসাধু ব্যক্তি লটারি ব্যবস্থায় অনুপ্রবেশ করেছিল'।
তবে ওই বিরতির পরও প্রাণবন্ত ছিল লটারি কার্যক্রম, এমনকী তার প্রসারও হচ্ছিল।
২০০৭-২০০৯ সাল পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের (আইআরডি) সচিবের দায়িত্বে থাকা ড. মো. আব্দুল মজিদ বলেন, কল্যাণ সংস্থা, হাসপাতাল ও ক্রীড়া সংগঠনের জন্য লটারির মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহ একটি ভালো উদ্যোগ। কিন্তু, অতিবাহিত সময়ের সাথে সাথে স্বচ্ছতার অভাব এবং এই প্রক্রিয়ায় জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নানান অনিয়মের অভিযোগ বাড়তে থাকে। 'আয়োজক সংস্থাগুলো যথাযথ অডিট রিপোর্ট দেওয়া বন্ধ করে দেয়। ফলে তারা কত টিকেট বিক্রি করেছে তা আইআরডি জানতে পারেনি'।
তিনি আরো বলেন, কিছু ক্ষেত্রে এমনও হয়েছে, কোনো সংগঠন যে পরিমাণ টিকেট বিক্রির অনুমোদন নিয়েছে, তার চেয়েও বেশি টিকেট বিক্রি করেছে। বাড়তি এসব টিকেট লটারির অন্তর্ভুক্ত ছিল না।
কিছু হাসপাতালের কর্তৃপক্ষও জানান, লটারি বিক্রির ক্ষেত্রে তারাও অনিয়ম পেয়েছেন। স্বচ্ছতার অভাবে যা দিনে দিনে চরম রূপ নিয়েছে।
বেশিরভাগ জাতীয় লটারি ব্যবস্থাপনায় জড়িত থাকার দাবি করা হাজি আলম কবির এর তীব্র প্রতিবাদ করেন। বরং তার মতে, সরকারের অনুমোদন নিয়ে জাতীয় লটারিকে পুনর্জীবিত করাটা অতি-জরুরি। এই খাত থেকে অনেক সম্ভাবনা কাজে লাগানোর সুযোগ রয়েছে বলে মনে করেন তিনি।