তার পেশা পূর্বপুরুষদের খুঁজে বের করা!
"প্রতিবার যখন কোনো নিখোঁজ পরিবারকে খুঁজে পাই, তখনই আমি ভীষণ আবেগপ্রবণ ও উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়ি। আমার মনে হয় এটা আমার একটা অর্জন", বলছিলেন ৭৬ বছর বয়সী শামসু দীন। ত্রিনিদাদ ও টোবাগোর বাসিন্দা শামসু দীন বিগত ২৫ বছর ধরে ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের পরিবারগুলোকে ভারতে তাদের হারিয়ে যাওয়া আত্মীয়স্বজনকে খুঁজে পেতে সাহায্য করে আসছেন। সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে তিনি জানান, এখন পর্যন্ত এমন ৩০০ মানুষকে সাহায্য করেছেন তিনি।
একসময়ের ব্রিটিশ উপনিবেশ ত্রিনিদাদ ও টোবাগোতে এদের পূর্বসূরিরা এসেছিলেন চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক হিসেবে। ১৮০০ শতক এবং ১৯০০ শতকের শুরুর দিকে তারা এ অঞ্চলে এসেছিলেন। কিন্তু কালের পরিক্রমায় দেশে ফেলে আসা পরিবার-পরিজনের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
একসময় পেশায় ভূগোলের শিক্ষক শামসু দীন এখন একজন বংশতত্ত্ববিদ। ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে আসা ভারতীয় চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের উত্তরসূরিদেরকে তিনি সাহায্য করছেন তাদের হারানো পরিবার ও প্রিয়জনদের খুঁজে পেতে।
ভারতে ব্রিটিশ শাসনের সময় দাস প্রথা বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। কিন্তু তথাকথিত শ্রম ঘাটতির দোহাই দিয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যজুড়ে এসব চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদেরকে 'সস্তা শ্রম' হিসেবে ব্যবহার করা হতো। ১৮৩৮ থেকে ১৯১৭ সালের মধ্যে বহু ভারতীয় ক্যারিবিয়ান, দক্ষিণ আফ্রিকা, মরিশাস ও ফিজির মতো ব্রিটিশ উপনিবেশগুলোতে আখের খামারে কাজের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমিয়েছেন।
যদিও বেশিরভাগ শ্রমিকই স্বেচ্ছায় গিয়েছেন; খুব সম্ভবত তারা নিরক্ষর হওয়ায় চুক্তিপত্র স্বাক্ষর করে বিদেশে যাওয়ার পর তাদেরকে কি পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে সে সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত ছিলেন না। আর বাকিদেরকে জোরপূর্বক বিদেশে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
এমনকি কোনো কোনো ইতিহাসবিদ 'চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক' নিয়োগের প্রক্রিয়াকে 'নব্য দাস ব্যবসা' বলে অভিহিত করেছেন।
শামসু দীন যখন জানতে পারেন যে তার দাদা মুনরাদিন একজন চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক হিসেবে ক্যারিবিয়ানে এসেছিলেন, তখন তিনি এই প্রক্রিয়া এবং এটির ফলে পরিবারগুলোর উপর কী প্রভাব পড়েছে- তা নিয়ে কৌতূহলী হয়ে ওঠেন।
শামসু দীন যখন স্কুলে পড়েন, তখন তিনি জানতে পারেন যে তারা যেই বাড়িতে বাস করছেন সেই জমি তার দাদা মুনরাদিনের কেনা। "আমার পরিবারের কেউই আমার দাদার ব্যাপারে কোনোকিছু বলতে পারতো না", বলেন শামসু দীন।
১৯৭২ সালে শামসু দীন ত্রিনিদাদের রেড হাউজে যান (যেটিকে পরবর্তীতে আইন বিষয়ক মন্ত্রণালয় বানানো হয়) এবং শত শত নথিপত্রের স্তূপের মধ্যে সেই রহস্য মানব- নিজের দাদার সম্পর্কে তথ্য খুঁজতে থাকেন।
চার ঘণ্টা খোঁজাখুঁজির পর তিনি পোকায় কাটা একটা বইয়ের শেষ পাতায় তার দাদার নাম খুঁজে পান এবং জানতে পারেন, মুনরাদিন ১৮৫৮ সালের ৫ জানুয়ারি কলকাতা ত্যাগ করেন এবং একই বছরের ১০ এপ্রিল ত্রিনিদাদে পৌঁছান।
শামসু দীন বলেন, "আমরা সবাই জানতাম যে তিনি শিক্ষিত ছিলেন এবং ইংরেজিতে কথা বলতে পারতেন। মুরানদিন আখের খামারে কাজ করতেন। পরবর্তীতে তিনি অনুবাদক হিসেবে কাজ করা শুরু করেন। চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর মুরানদিন শিক্ষকতা পেশায় যোগ দেন এবং অবশেষে দুটি দোকান চালু করেন। তার দুই স্ত্রী ও পাঁচ সন্তান ছিল। যে বাড়িতে তিনি থাকতেন সেটা উত্তরাধিকার সূত্রে তার সন্তানরা পেয়েছিল, কিন্তু পরে সেই বাড়িটা আগুনে পুড়ে যায়।"
শামসু দীন নিজের চেষ্টায় তার মায়ের বংশধরদেরও খুঁজে বের করেন। ভারত থেকে ত্রিনিদাদে আসা তাদের পরিবারের সর্বশেষ পূর্বপুরুষ ছিলেন ভোনজি। তিনি ভোনজির আত্মীয়দের সাথেও যোগাযোগ করেন।
১৮৭২ সালে মাত্র ৭ বছর বয়সে মা-বাবা ও তিন ভাইবোনের সাথে ত্রিনিদাদে আসেন ভোনজি। শামসু দীন বলেন, "আমার কাছে ভোনজির একটা মাত্র ছবি ছিল। ১৯৪৯ সালে যখন তিনি মারা যান, তখন আমার বয়স তিন বছর। তিনি নিজের নাতি-পুতি এবং তাদের ঘরের সন্তানদেরও দেখে গিয়েছেন।"
শামসু দীন হয়তো ভূগোলের শিক্ষক হয়েই জীবনটা পার করতেন, কিন্তু নিখোঁজ আত্মীয়স্বজনের সন্ধান দেওয়ার কাজে তার সফলতা ত্রিনিদাদে ভারতীয় হাইকমিশনের নজর কাড়ে। তারা তাকে ১০টি হিন্দু ও ১০টি মুসলিম পরিবারের আত্মীয়স্বজনদের সন্ধান দিতে বৃত্তি দেন।
এরপরে শামসু দীন এই কাজটিকেই নিজের ক্যারিয়ার হিসেবে বেছে নেন এবং বংশতত্ত্ববিদ হিসেবে কাজ শুরু করেন। ত্রিনিদাদ ও ভারত, দুই দেশেরই গবেষক দলের সহায়তা নিয়ে এই কাজগুলো করেন এবং এর জন্য পারিশ্রমিক পেয়ে থাকেন তিনি।
শামসু দীন যে পরিবারগুলোকে মিলিয়ে দিয়েছেন তাদের স্বজনদের সঙ্গে, তাদের মধ্যে ত্রিনিদাদ ও টোবাগোর দুই প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বাসদেও পান্ডে এবং কমলা পেরসাদ বিশ্বেস্বরের পরিবারও রয়েছে।
ত্রিনিদাদের বাসিন্দা ডেভিড লাখানকেও তার প্র-পিতামহ সম্পর্কে তথ্য খুঁজে বের করতে সাহায্য করেছেন শামসু দীন। ডেভিডের প্র-পিতামহ ১৮৮৮ সালে ভারত থেকে ত্রিনিদাদে আসেন।
"উনি আমাকে শুধু একটা নাম দিয়েছেন তথ্য হিসেবে- 'লাখান'। কিন্তু তিনি কেন এত দূরের পত পাড়ি দিলেন সে সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলাম আমি", বলেন ডেভিড লাখান।
জাতীয় আর্কাইভ থেকে শামসু দীন ইমিগ্রেশনের কাগজপত্র খুঁজে বের করেন, যেখানে লাখানের প্র-প্রপিতামহের বাবা, ভাই, জাত এবং গ্রামের নাম লেখা ছিল। এরপর তিনি লাখানের আত্মীয়দের খুঁজতে নিজস্ব কন্টাক্ট ব্যবহার করেন এবং শেষ পর্যন্ত ২০২০ সালে তাদের পরিবারের পুনর্মিলন হয়।
ডেভিডের স্ত্রী গীতা বলেন, "আমরা ভাবতেই পারিনি যে পুরো গ্রামবাসী এসে আমাদের অভিবাদন জানাবে, ফুলের মালা দেবে।"
এরপর থেকে এই পরিবারটি তাদের ভারতীয় আত্মীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রেখেছে এবং অনুবাদ টুলসের মাধ্যমে ভাষার বাধা মোকাবিলা করেছে। ডেভিডের স্ত্রী বলেন, বংশ পরম্পরায় যেসব সাংস্কৃতিক বিষয় তাদের পরিবারের মধ্যে প্রোথিত হয়েছে, সেগুলোর কারণেই তাদের সঙ্গে সাদৃশ্য খুঁজে পান তিনি।
এখন তারা তাদের ৭ বছর বয়সী নাতিকে তাদের ভারত ভ্রমণের গল্প বলছেন এই আশায় যে, সেও পারিবারিক ঐতিহ্যের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠবে।
শামসু দীন জানান, তার ক্যারিয়ারের শুরুর দিকের চাইতে বর্তমানে মানুষের সন্ধান পাওয়া কিছুটা সহজ, কারণ এখন ডিজিটাল ম্যাপ রয়েছে এবং ঐতিহাসিক অনেক দলিলপত্রই সহজলভ্য। কিন্তু তবুও চ্যালেঞ্জ রয়েই যায়। তিনি জানান, প্রতিটি কেসেই তিনি শতকরা ৮০ ভাগ সফলতা পেয়েছেন।
"আমি প্রত্যেকের বংশপরিচয় খুঁজে বের করতে পারিনি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমাকে শুরুতেই ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছে", বলেন তিনি।
আবার কিছু কিছু চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক ত্রিনিদাদে আসার পথে মারাও গেছেন। যারা এখানে এসে পৌঁছেছিলেন, তারাও বেশিরভাগ সময়ই শোচনীয় জীবনযাপন করেছেন এবং কোনো অফিসিয়াল নথিপত্রে তাদের সম্পর্কে তথ্য দেওয়া হয়নি।
কিন্তু চুক্তি শেষ হওয়ার পরেও অনেক শ্রমিকই স্বেচ্ছায় ত্রিনিদাদে রয়ে গেছেন এবং স্বাধীন জীবনযাপন করেছেন, বলেন শামসু দীন।
তিনি আরও জানান, অবসরে গেলেও তিনি এই কাজটা ছেড়ে দিতে চান না। বরং অবসর নেওয়ার পরেও তিনি ১৯৯৬ সালে ছয় মাসের জন্য ভারতে গিয়েছিলেন এবং আরও ১৪টি পরিবারের সন্ধান বের করেছেন।
শামসু দীন জানান, এই কাজটা তাকে 'সুখ ও সুস্বাস্থ্য' এনে দেয়।
"প্রতিটি কেসই একটা ধাঁধার মতো। দুটি ঘটনা কখনো একই রকম হয় না। সমস্ত মানবজাতির মতোই, আমরাও কিন্তু অভিবাসী। কিন্তু আমাদের অস্তিত্বের গভীরে বাঁধা রয়েছে ভারতীয় ঐতিহ্যের বিনি সুতো", এই বলে নিজের কথার ইতি টানেন শামসু দীন।