সিঙ্গেল ফাদার: যাকে সব ভারই নিতে হয়!
ছোট্ট ত্বোহার বয়স তখন আড়াই বছর। মায়ের দুধের অভ্যাস ছেড়েছে সবে। হুট করেই একদিন মনোমালিন্যের জেরে আলাদা হয়ে যায় বাবা-মা। ঘুম ভেঙে সে জানতে পারে মা আর থাকছে না তাদের সঙ্গে। কান্নাকাটি করে বাবার কাছে বারবার জানতে চায় মায়ের কথা। বাবা আনোয়ার হোসেন জুয়েল তখন অকুল পাথারে পড়লেন। চার বছরের সংসার ভেঙেছে। ক্যারিয়ারও তখন নড়বড়ে। এর মাঝেই নিঃসঙ্গ কাঁধে এসেছে বাচ্চা মেয়েকে সামলানোর দায়িত্ব। কিন্তু মেয়ের দিকে চেয়ে বুঝেছিলেন মনোবল হারালে চলবে না।
ত্বোহাকে বোঝালেন, 'এখন থেকে আমিই তোমার মা, আমিই তোমার বাবা'। মেয়ের খাওয়া, পড়া, গোসল, ঘুম পাড়ানো—কোনো কিছুতেই যেন ত্রুটি না থাকে তার প্রাণপণ চেষ্টায় সিঙ্গেল ফাদার হিসেবে যাত্রা শুরু হলো জুয়েলের। মেয়ে ত্বোহা এখন ক্লাস ফাইভে পড়ে। বাবার কষ্ট বুঝতে শিখেছে কিছুটা হলেও। মা পাশে না থাকায় আর আফসোস নেই তার। বাবাই সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু ত্বোহার।
মা আর বাবা উভয়ের দায়িত্ব একসঙ্গে পালন করা সিঙ্গেল ফাদারদের বাবা হিসেবে অভিজ্ঞতা অনেকটাই অন্যরকম। সন্তানদের নিয়ে তাদের সেই সাহসী যাত্রার অভিজ্ঞতা জানতে চেয়েছিলাম কয়েকজন সিঙ্গেল ফাদারের কাছে।
বাবা নয় বন্ধু হতে চেয়েছেন
মহিতোষ তালুকদার তাপস আর নীতা মহলানবীশের প্রেমের শুরু হয়েছিল ১৪ বছর বয়সে। বিয়ের ১০ বছর পর জন্ম হয় তাদের ছেলে আগামী মহিরাজের। ২০১৩ সালে আগামীর বয়স যখন চার বছরের কিছুটা বেশি, তখন এনারিজমে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় মা নীতার। এরপর থেকে বাবা মহিতোষের কাছেই বড় হয়েছে আগামী। ছেলেকে নিয়ে আমেরিকার রোড আইল্যান্ডে বসবাস মহিতোষের।
ছেলের বয়স এখন ১৪ বছর। এই বয়সেই যেহেতু প্রেমে পড়েছিলেন মহিতোষ তাই ছেলের কাছেও কদিন পরপর জানতে চান তার পছন্দের কেউ আছে কি না। বাবা-ছেলের মধ্যে কোনো কিছু নিয়ে যেন দূরত্ব আর সংকোচ না থাকে তা নিয়ে সবসময় সচেষ্ট তিনি। তার ভাষ্যে, 'ছেলে আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু। সবকিছু আমার সঙ্গে শেয়ার করে। এখনো রোজ সকালে উঠেই আমাকে চুমু খায় সে। প্রতিবার ফোন রাখার আগেই বলে "বাবা আই লাভ ইউ"।'
তারিক মাহমুদের একমাত্র মেয়ে নদী বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া। পাশাপাশি কাজ করছে দেশের প্রথম সারির একটি দৈনিক পত্রিকায়। আদর্শগত অমিলের কারণে স্ত্রীর সঙ্গে যখন সেপারেশন হলো, মেয়ে তখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে। মায়ের সঙ্গেই থাকত সে। উচ্চশিক্ষার জন্য মা অস্ট্রেলিয়া চলে যাওয়ার পর বাবা তারিক দায়িত্ব নেন তার। নদী ক্যাডেট কলেজ থেকে পাশ করে বেরোনোর পর একসঙ্গে থাকতে শুরু করেন বাবা-মেয়ে।
প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের দায়িত্ব নিতে গিয়ে তার বাবা কিংবা মা হওয়ার চেয়ে বন্ধু হওয়াটাই বেশি দরকারি ভেবেছেন তারিক মাহমুদ। মেয়ে যেন তার সঙ্গে সব কিছু শেয়ার করতে পারে সেই ভরসাটুকু অর্জন করতে চেয়েছেন তিনি। এ বিষয়ে নিজের চেষ্টা সফল বলেই মনে করেন তারিক। বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে যাওয়া, প্রেমিকের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া বা অফিসের কাজের কোনো সমস্যায় সবার আগে বাবার সঙ্গেই আলোচনা করেন নদী। মেয়ের নিরাপত্তা নিয়ে সবসময় চিন্তিত থাকলেও তাকে সর্বোচ্চ স্বাধীনতা দেওয়ার চেষ্টা করেন তারিক।
সিঙ্গেল ফাদার হিসেবে শুরুতেই সন্তানের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার বিষয়ে একমত আনোয়ার হোসেন জুয়েলও। মায়ের অনুপস্থিতিতে সন্তান যেন নিঃসঙ্গ কিংবা অনিরাপদ বোধ না করে, সেজন্যই বন্ধু হিসেবে পাশে থাকাটা জরুরি। ত্বোহার বয়ঃসন্ধিকালীন পরিবর্তন নিয়েও সচেতন জুয়েল। আগে থেকেই মেয়েকে পিরিয়ড বিষয়ে ধারণা দিচ্ছেন, যেন শারীরিক-মানসিক পরিবর্তনের সময়টায় সে ঘাবড়ে না যায়।
সন্তানের ভালোর জন্যই থেকেছেন সিঙ্গেল
ডিভোর্সের পর আত্মীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধব সবাই জুয়েলকে উপদেশ দিয়েছিলেন আরেকবার বিয়ে করতে। নতুন মা এলে ত্বোহার লালনপালনও সহজ হয়ে যাবে বলছিল সবাই। কিন্তু ছোট্ট মেয়ের কথা ভেবেই বিয়ে করেননি তিনি। আবার বিয়ে করলে স্ত্রী-র সঙ্গে যদি বনিবনা না হয় মেয়ের! যদি মেয়েকে সর্বোচ্চ প্রায়োরিটি না দিতে পারেন! এমন সব ভাবনায় বাদ দিয়েছেন বিয়ের চিন্তা। তাছাড়া ছোট্ট ত্বোহাও বাবার বিয়ের কথা উঠলেই বাবাকে হারানোর ভয় পায়। সন্তানকে ভালো রাখতে তাই একাই সব সামলাচ্ছেন জুয়েল।
তারিক মাহমুদও দ্বিতীয় বিয়ে করেননি একই কারণে। নতুন করে সংসার শুরু করলে হয়তো মেয়ের প্রতি ভালোবাসা ভাগ হয়ে যাবে—এমন ভয় পেয়েছিলেন নিজেই। তিনি বলেন, 'বিয়ের কথা তো সবাই বলত, এখনো বলে। বর্তমানে আমার বয়স ৫৪, এই বয়সে আর বিয়ে করে কী হবে! মেয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের বাইরে চলে গেলে হয়তো কিছুটা একা হয়ে যাব। তখন ঢাকা ছেড়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আমার গ্রামের বাড়িতে চলে গিয়ে নিভৃতে বাকি জীবন কাটিয়ে দেব।'
ক্যারিয়ার কম্প্রোমাইজ
সিঙ্গেল ফাদার হিসেবে যাত্রার শুরুতে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন জুয়েল। কিন্তু মেয়ে ত্বোহার দেখাশোনা করতে গিয়ে ছাড়তে হয়েছিল সেই চাকরি। সারাক্ষণ বাবা আশেপাশে না থাকলে কান্নাকাটি করত ত্বোহা। অন্য কারো সঙ্গে স্কুলে যাওয়া-আসা করতেও রাজি ছিল না সে। তাই বাধ্য হয়েই কর্মজীবনের ইস্তফা দিয়েছিলেন জুয়েল। সে সময়টায় বেশ আর্থিক টানপোড়নের মধ্যে কাটাতে হলেও মেয়েকে ভালো রাখতে এর কোনো বিকল্প ছিল না বলে জানান তিনি।
মেয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে ওঠার পর আবার চাকরিতে যোগ দেন জুয়েল। সমবয়সী বন্ধুদের চেয়ে ক্যারিয়ারে এখনো অনেকটাই পিছিয়ে থাকলেও তা নিয়ে আফসোস নেই তার।
কর্মজীবনে তারিক মাহমুদ ছিলেন সাংবাদিক। মেয়ে নদী তার সঙ্গে থাকতে আসার কয়েক বছর পর চাকরি থেকে অবসর নিয়ে নেন তিনি। তার ভাষ্যে, 'জীবনের অনেকটা সময় কাজ করেছি, স্ট্রাগলও করেছি। কিন্তু এখন চাকরির চেয়ে মেয়ের সাথে আরেকটু বেশি সময় কাটাতে পারাটাই আমার বড় চাওয়া। এতদিন যা উপার্জন করেছি, তা দিয়েই বাকি জীবন কেটে যাবে।'
সন্তানের সঙ্গে কাটানো সময়ই জীবনের প্রিয় মুহূর্ত
স্ত্রী নীতার আকস্মিক মৃত্যু মেনে নেওয়া সহজ ছিল না মহিতোষের জন্য। কিন্তু ১০ বছরেও এখন পর্যন্ত সেই শোকে কাঁদতে পারেননি তিনি। ছেলে আগামীর জন্য শক্ত রেখেছেন নিজেকে। ছেলের সঙ্গে কাটানো সব মুহূর্তই মহিতোষের ভীষণ প্রিয়। মার্কিন মুলুকে বাস করেও ছেলেকে দেশীয় সংস্কৃতি অনুযায়ী বড় করেছেন তিনি। এখনো এক বিছানায় ঘুমান দুজনেই। ছেলেকে স্কুলে আনা-নেওয়া করেন নিজেই। ছেলের সঙ্গে বাংলা গান গাওয়া, ঘটা করে ছেলের জন্মদিন পালন করা, দুজনে একইরকম জামা-কাপড় পরা—এসব তার প্রিয় স্মৃতি।
রোজ সকালে মেয়ে ঘুম থেকে ওঠার আগেই তার নাস্তা তৈরি রাখেন তারিক। আবার মেয়ে অফিস থেকে ফেরার আগেই তিনি বাসায় ফেরেন, যেন একসঙ্গে খেতে পারেন। নানান বিষয়ে মেয়ের সঙ্গে মনোমালিন্য হলেও তা স্থায়ী হতে দেন না তিনি। মেয়ের সঙ্গে কাটানো প্রতিটা মুহূর্তই তার কাছে বিশেষ। মেয়ের স্মৃতি নিয়ে 'জীবনের গল্প' নামে বইও লিখেছেন তারিক মাহমুদ।
পাশে পেয়েছিলেন পরিবারকে
সিঙ্গেল ফাদার হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও পরিবারের সাহায্য ছাড়া এই পথ পাড়ি দেওয়া সম্ভব ছিল না বলে জানান মহিতোষ, জুয়েল দুজনেই। স্ত্রী নীতার মৃত্যুর পর পরিবার, বন্ধুবান্ধব সবাই পাশে দাঁড়িয়েছিলেন মহিতোষের। তার মা অঞ্জলী তালুকদার দেশ ছেড়ে ছেলের সঙ্গে স্থায়ী হয়েছেন আমেরিকায়।
মহিতোষ বলেন, 'মা-ই আমার প্রধান শক্তি। মায়ের যখন ২৯ বছর বয়স, তখন আমার বাবা মারা যান। সিঙ্গেল মাদার হিসেবে একা হাতে তিনি ছোট ছোট চার সন্তানকে মানুষ করেছেন। কখনো দুর্বল লাগলেই তার কথা ভাবি আমি। মা যদি পারেন, তাহলে আমি কেন পারব না! এখনো মা আমার সঙ্গে আছেন সবসময়। আগামীকে বড় করতেও তার অবদান অনেক বেশি।'
একা বাবা হিসেবে জুয়েলও কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেছেন তার পরিবারের। ভাই-ভাবীর সঙ্গে এক বাসাতেই থাকেন তিনি ও তার মেয়ে ত্বোহা। মেয়ের স্কুলে কোনো দরকারে মায়ের ডাক পড়লে জুয়েলের ভাবীই সামলান সব। মেয়ের অসুস্থতায়ও দেখাশোনা করেন ভাবী। রান্নাবান্নাসহ ঘরের অন্যান্য কাজেও পরিবারের সদস্যরাই ছিলেন তার ভরসার জায়গা।
সন্তানের কাছে কেমন বাবা
আনতারা রাইসা নদীর কাছে জানতে চেয়েছিলাম তার বাবা তারিক মাহমুদ সম্পর্কে। নদী বলেন, 'বাবার সঙ্গে আমার সত্যিই বন্ধুর মতো সম্পর্ক। নতুন কোনো বাংলা সিনেমা মুক্তি পেলেই বাবাকে নিয়ে দেখতে যাই হলে। তার সঙ্গে বাইরে খেতে যাওয়াও আমার প্রিয় কাজ। মানুষ হিসেবে সবদিক দিয়ে হয়তো পারফেক্ট নন তিনি, কিন্তু আমার জন্য সবসময় সবচেয়ে ভালোটা করার চেষ্টা করেন। আমাকে নিয়ে তার দুশ্চিন্তার শেষ নেই।'
তাসনিম জুয়েল ত্বোহার কাছেও তার বাবা সবচেয়ে কাছের মানুষ। সবকিছুতেই তার বাবাকে চাই। বাবার সঙ্গে ঘুরতে যাওয়া সবচেয়ে প্রিয় কাজ তার।
দেশে সিঙ্গেল মাদারের চেয়ে সিঙ্গেল ফাদারের সংখ্যা কেন কম
সিঙ্গেল ফাদারদের অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখতে গিয়ে সিঙ্গেল ফাদার খুঁজে পাওয়াই বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল আমাদের। আশপাশে প্রায়ই একা বাচ্চার লালনপালন করা মায়েদের দেখা মেলে। সিঙ্গেল মাদারদের নানান সমস্যা নিয়ে আলোচনাও হয় অনেক। কিন্তু সিঙ্গেল ফাদারের ধারণাটি দেশে এখনো সীমিত।
এ বিষয়ে কথা হয় আইসিডিডিআর,বি-র মেটারনাল অ্যান্ড চাইল্ড নিউট্রিশন বিভাগের বিজ্ঞানী ডা. ফাহমিদা তোফায়েলের সঙ্গে। তিনি বলেন, 'বাচ্চার প্রাইমারি কেয়ার গিভার হিসেবে আমাদের দেশে মায়ের বিকল্প কাউকে ভাবা হয় না। মা-বাবা আলাদা হয়ে গেলে বাচ্চা বেশিরভাগ সময়ই তাই মায়ের সঙ্গেই থাকে। বাবা যদি নিজে থেকে আগ্রহী না হন, তাহলে কখনোই তাকে সন্তানের দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া হয় না। তবে এখন কালচার বদলাচ্ছে। বাবারাও সন্তানের দায়িত্ব নিতে এগিয়ে আসছেন।'
বাচ্চার আবেগ, অনুভূতি ও মানসিক সুস্থতার খেয়াল রাখা সিঙ্গেল ফাদারদের জন্য সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং বলে মনে করেন ডা. ফাহমিদা। তবে বাবারা নিজে থেকে দায়িত্ব নিয়ে সিঙ্গেল প্যারেন্টিং উপভোগ করলে অনেকটাই সহজ হয়ে ওঠে এই পরিস্থিতি।