হিট পাম্প: বিশ্বের বৃহত্তম চকলেট বার ফ্যাক্টরির গোপন রহস্য
চকলেট কোম্পানির বিজ্ঞাপন আর প্রচারণায় দেখেছেন কাল্পনিক বামন মানব ওমা- লুম্পাদের। চকলেট উৎপাদনই নাকি তাদের ধ্যানজ্ঞান। সেতো গেল কল্পনার জগৎ, বাস্তবে কিন্তু বিশ্বের সবচেয়ে বড় চকলেট বার কারখানার আসল নায়ক- হিট পাম্প নামক যন্ত্র।
নেদারল্যান্ডসের ভেগেল - এ বিখ্যাত চকোলেট বার উৎপাদক মার্স ইনকর্পোরেশনের কারখানায় গেলেই দেখবেন স্বচক্ষে। এই যন্ত্র কারখানার রেফ্রিজারেটরগুলো থেকে নিঃসৃত তাপ সংগ্রহ করে, সেই তাপ দিয়েই পানি গরম করা হয়। এরপর উষ্ণ পানিকে বিভিন্ন পাইপের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে চকলেট উৎপাদনে ব্যবহার করা হয়। চকলেট সিরাপ উষ্ণ রাখতে, বা চকলেটকে তরল রাখতেও ব্যবহার হচ্ছে এই উষ্ণতা। নাহলে এই শক্তির পুরোটাই অপচয় হতো। আর তখন এসব কাজের জন্য আলাদাভাবে জ্বালানি পোড়াতে হতো।
চকলেট কারখানার পাশাপাশি অন্যান্য কাজেও বহু বছর ধরে সেটাই হয়ে এসছে। হিট পাম্পের বদলে জীবাশ্ম-জ্বালানি চালিত ফার্নেস দিয়েই শীতকালে ঘর উষ্ণ রাখা হয়েছে। এক্ষেত্রে বর্তমানে ধীরে ধীরে হিট পাম্পের ব্যবহার বাড়ছে। বিশেষত এদিক দিয়ে এগিয়ে রয়েছে পরিবেশ-সচেতন ইউরোপীয় দেশগুলো।
বিশ্বব্যাপী পরিবেশবাদী সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে জীবাশ্ম জ্বালানি বর্জনের চাপ বাড়ছে। জাতিসংঘের মতো বৈশ্বিক সংস্থা-সহ উন্নত দেশগুলোর সরকারও দিচ্ছে তাতে গুরুত্ব। এই বাস্তবতায়, বিশ্বের বিভিন্ন কারখানা খাদ্যপণ্য, কাগজ উৎপাদনসহ অন্যান্য শিল্প পর্যায়ের কর্মকাণ্ডে এই প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু করেছে।
তাছাড়া, ইউক্রেন যুদ্ধ ইউরোপের জ্বালানি নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলে। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়া ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ ব্যাপকভাবে কমায়। আর তাতে নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হয় এই মহাদেশের সরকারগুলো। কারণ, ইউরোপের অনেক দেশই কারখানা কার্যক্রমের জন্য জ্বালানি আমদানির ওপর নির্ভর করে।
এই বাস্তবতায়, জ্বালানি সাশ্রয়ে, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় – নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলেছে হিট পাম্প প্রযুক্তি। অস্ট্রেলিয়ান ইনস্টিটিউট অভ টেকনোলজির জ্যেষ্ঠ গবেষণা প্রকৌশলী ভেরোনিকা উইলকে বলেন, 'হিট পাম্পের মাধ্যমে যে বড় অর্জন করা সম্ভব – সেবিষয়টি এখন উপলদ্ধি করছে শিল্পগুলো। আজ থেকে পাঁচ-সাত বছর আগের তুলনায় এটি বর্তমানে বড় ব্যবধানই গড়ে দিচ্ছে।'
কারখানায় হিট পাম্পের ব্যবহার
লো-কার্বন এনার্জির চাহিদা বাড়ায় বৈশ্বিকভাবে ইন্ডাস্ট্রিয়াল বা শিল্প-পর্যায়ের হিট পাম্পের বাজার আগামী এক দশকে দ্বিগুণ হবে। এক্ষেত্রে আরো অবদান রাখবে বিশেষত ইউরোপীয় দেশগুলোসহ অন্যান্য দেশের গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমানোর প্রচেষ্টা। তাছাড়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ান গ্যাসের নির্ভরশীলতা পুরোপুরি কাটিয়েও উঠতে চায়। সেক্ষেত্রে এ ধরনের জ্বালানি-সাশ্রয়ী প্রযুক্তি অপরিহার্য হবে। এসব তথ্য জানিয়েছে, বাণিজ্যিক তথ্য পরিবেশক – গ্লোবাল মার্কেট ইনসাইটস।
এবিষয়ে হিট পাম্প গবেষক- ভেরোনিকা উইলকে বলেন, 'জ্বালানি সরবরাহের নিরাপত্তার দিকটি নিশ্চিত না থাকায় – দিনে দিনে হিট পাম্পের প্রতি শিল্প প্রতিষ্ঠানের আগ্রহ আরও বাড়ছে।'
এদিকে বাসাবাড়িতে যেসব হিট পাম্প স্থাপন করা হচ্ছে, তারা মাটির নিচ থেকে বা বাতাস থেকে তাপ শোষণ করে – শীতকালে ঘর উষ্ণ, আরামদায়ক রাখছে।
শিল্প-পর্যায়ের হিট পাম্প এগুলোর চেয়ে আকারে আরো বড় হয়। বেশিরভাগ সময়েই তারা শিল্প কার্যক্রম থেকে উৎপাদিত তাপ শোষণ করে পুনরায় সেটা কাজে লাগায়। খাদ্য প্রস্তুতকারক শিল্পে বিপুল তাপের ব্যবহার আছে। আছে খাদ্য উপকরণকে কখনো সেদ্ধ কখনোবা ঠাণ্ডা করার প্রয়োজন। ঠাণ্ডা করার কাজে বিশাল বিশাল সব রেফ্রিজেরেটর যখন চালু থাকে, তখন তারা বিপুল তাপও উৎপন্ন করে। সেই তাপকে কাজে লাগিয়েই মার্স পাইপের ভেতর তরল রাখছে চকলেটের মিশ্রণ। এতে নেদারল্যান্ডসের মার্স কারখানার জ্বালানি বিল ৬ শতাংশ কমেছে বলে জানান কোম্পানির একজন মুখপাত্র রোয়েল গোভার্স।
তিনি আরো বলেন, বর্তমানে এ কারখানায় দুটি হিট পাম্প রয়েছে – এরমধ্যে প্রথমটি ২০১৫ সালে এবং দ্বিতীয়টি ২০২১ সালে স্থাপন করা হয়।
খাদ্য শিল্পের পাশাপাশি কাগজ ও রাসায়নিক শিল্পের জন্যও উপযোগী বলে প্রমাণিত হচ্ছে যন্ত্রটি। আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থা (আইইএ)-র মতে, এই তিনটি খাতের মোট বৈশ্বিক হিটিং চাহিদার ৩০ শতাংশই মেটানো সম্ভব হিট পাম্পের মাধ্যমে।