কোনো প্রতিবন্ধকতা মানেননি, স্বপ্ন জয়ে সঙ্গী ছিলেন মা
জন্মের পরপরই রোগটা ধরা পড়েছিল ইমতিয়াজ কবির ইফতুর। পা দুটো বাঁকা তার। আর দশটা শিশুর মতো স্বাভাবিকভাবে কখনো হাঁটতে পারবে না সে। দুর্বলতার কারণে বারবার ভেঙ্গে পড়তে পারে পায়ের হাড়। সেই রোগের কারণে সাতদিন বয়সেই পায়ে ব্যান্ডেজ লাগাতে হয়েছিল তার।
প্রথম সন্তানের এমন শারীরিক অবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই ভেঙ্গে পড়েছিলেন মা ইয়াসমিন নাহার লুনা আর বাবা ইনামুল কবির। কিন্তু নয়মাস গর্ভধারণ করে সন্তানকে পৃথিবীতে আনার পর এত সহজে হার মানতে রাজি ছিলেন না লুনা।
ছেলে যেন তার বয়সী অন্য সবার চেয়ে আলাদা না হয়ে যায়, অন্যদের চেয়ে কখনো নিজেকে কম না ভাবে, চব্বিশ বছর যাবত সে চেষ্টাই করে যাচ্ছেন মা। কিন্ডারগার্টেন স্কুল থেকে শুরু করে কলেজ পর্যন্ত সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছেলেকে কোলে করে নিয়ে গেছেন চট্টগ্রামের বাসিন্দা লুনা-ইনামুল দম্পতি। মায়ের স্বপ্ন পূরণে ছেলেও নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করেছেন সবসময়।
সম্প্রতি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (সাস্ট)-এর কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগ থেকে গ্র্যাজুয়েশন শেষে মায়ের সেই স্বপ্ন যেন কিছুটা হলেও পূরণ করতে পেরেছেন ইফতু। ইতোমধ্যেই সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজও শুরু করেছেন তিনি। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে এক আলাপচারিতায় উঠে আসে মা-ছেলের এই চব্বিশ বছরের সংগ্রামের গল্প।
স্কুলে ভর্তির অনিশ্চয়তা থেকে বোর্ড পরীক্ষায় তাক লাগানো রেজাল্ট
ইফতুকে সাধারণ স্কুলে ভর্তি করানো হবে, নাকি বাসায় রেখেই প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে পড়ানো হবে, তা নিয়ে বেশ চিন্তাতেই ছিলেন বাবা-মা। ইফতুর ভাষ্যে, "সেই সময়ে শারীরিক প্রতিবন্ধিতার শিকার বাচ্চাদের স্কুলে পড়ালেখা করার নজির তেমন ছিল না। কারো বাসায় এমন বাচ্চা থাকলেই শোনা যেত সে সারাদিন কাঁদে, তাকে সবার থেকে আলাদা করে রাখা হয়। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে আম্মু তা চায়নি কোনোভাবেই।"
মায়ের কাছে লেখাপড়ায় হাতেখড়ি হওয়ার পর একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে ভর্তি করানো হয় তাকে। কোলে করে স্কুলে আনা-নেওয়া করা হত বলে স্কুলের বাচ্চাদের বুলিং এর শিকারও হতে হত ছোট্ট ইফতুকে। যতদূর সম্ভব এসব থেকে তাকে দূরে রাখার চেষ্টা করতেন মা।
চট্টগ্রামের নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছা ছিল ইফতুর। হাজার হাজার পরীক্ষার্থীদের মাঝে উত্তীর্ণ হয়ে তখন ভর্তি হতে হত সেই স্কুলে। ভর্তি পরীক্ষার জন্য বছরখানেক কোচিং করারও রেওয়াজ ছিল। পাঁচ তলা সিঁড়ি বেয়ে কোলে করে ইফতুকে কোচিং করাতে নিয়ে যেতেন তার মা।
"একদিন কোচিং-এ গিয়ে মাকে শুনতে হয়েছিল, শুধু শুধু এত কষ্ট করে আমাকে আনা-নেওয়া করছে সে। এর চেয়ে কোনো প্রতিবন্ধী স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেই পারতো! মা সেদিন বাসায় এসে খুব কান্না করেছিল লুকিয়ে। মায়ের এই কষ্টগুলোই আমাকে সাহস জোগাত ভালো করে পড়ার," বলছিলেন ইফতু।
কলেজিয়েট স্কুলে কৃতিত্বের সঙ্গেই উত্তীর্ণ হয়েছিলেন তিনি। যোগ্যতা নিয়ে এরপর থেকে আর কখনো ইফতুকে কটুক্তি শুনতে হয়নি পরিচিতজনদের কাছ থেকে। বরং ভালো ছাত্রের উদাহরণ হিসেবে সব জায়গায় উচ্চারিত হতো তার নাম। এসএসসি পরীক্ষাতে গোল্ডেন এ প্লাসের পাশাপাশি চট্টগ্রাম বোর্ডে ৪৯তম হওয়ার গৌরবও অর্জন করেছিলেন ইমতিয়াজ কবির ইফতু।
বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্ধুরা ছিলেন সবচেয়ে বড় ভরসা
ছেলের ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার স্বপ্ন থাকলেও মায়ের ইচ্ছা ছিল ডাক্তার হবে সে। এইচএসসিতে আশানুরূপ ফলাফল না হওয়ায় মাসখানেক বেশ হতাশাতে কেটেছিল ইফতুর। বুয়েটে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগও পাননি তিনি। সে সময়ের কথা মনে করে বলেন, "প্রতিবন্ধী হিসেবে বোর্ড পরীক্ষায় রিটেনের ৩০ মিনিট বেশি সময় দেওয়া হত আমাকে। ইন্টারে রিটেন পরীক্ষা পরে হওয়ায় আমার খাতাগুলো আলাদা জমা হয়েছিল। প্রতিবন্ধী কোটায় পরীক্ষা দেওয়া ছাত্রদের খাতা খুব একটা ভালো করে দেখা হয় না। ইন্টারে আমার ক্লাসের সবাই ভালো রেজাল্ট করলেও, আমি পেয়েছিলাম এ গ্রেড, যা পুরোপুরি অপ্রত্যাশিত ছিল। ওই সময়টায় আমার বেঁচে থাকাটাই দুর্বিষহ মনে হচ্ছিল।"
তবু বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন যতদূর সম্ভব। চান্সও পেয়ে যান সাস্ট, রুয়েট এবং কুয়েটে। অবশেষে পছন্দের বিভাগ সিএসই-তে ভর্তি হন সাস্টে। জীবনে প্রথমবার পরিবারের বাইরে দূরে কোথাও থাকতে আসেন ইফতু।
একা একা ছেলে সব সামলে নিতে পারবে তো! ভয় ছিল মায়ের। ইফতু ঠিকই সামলে নিয়েছিলেন সবটা। বিশ্ববিদ্যালয়ে আনা-নেওয়া করার জন্য আলাদা মানুষ আর হুইল চেয়ার থাকলেও এ যাত্রায় তার সবচেয়ে বড় ভরসা ছিল বন্ধুরা। বন্ধুদের জন্যই পরিবার থেকে এত দূরে এসে পড়ালেখাটা চালিয়ে যেতে পেরেছিলেন। কোলে করে ক্লাস-ল্যাবে নিয়ে যাওয়া, সিঁড়িতে ওঠানামা করানো, খেতে বা ঘুরতে যাওয়াসহ সব জায়গাতেই পেয়েছিলেন বন্ধুদের সাহায্য।
মা লুনা বলেন, "আমার ছেলের একটা আলাদা জগত হয়েছে, তার ফ্রেন্ডসার্কেল আছে এটাই আমার জন্য বড় পাওয়া। ছেলেটা যেন সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন না হয়ে যায় সেজন্যই আমার এত বছরের সংগ্রাম। মনে আছে, ছেলের বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার সময় তাকে কোলে করে পাবলিক বাসে চড়তাম। ছেলেকে কোলে দেখলে বাসগুলো আমাকে নিতে চাইতো না। একদিন বাসে উঠে পুরো রাস্তা ছেলেকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। সেই দিনগুলোর কথা মনে হলে আজও কষ্ট পাই। আমাদের ছাড়া এতদূরে সে থাকতে পেরেছে বন্ধুদের সাহায্যেই।"
রোগের পরিচয় এখনো অনিশ্চিত
হাড়ের দুর্বলতার কারণে এ পর্যন্ত দুই পায়ে মোট ১৫ বার ফ্র্যাকচার হয়েছে ইফতুর। তার মেরুদন্ডের হাড়েও রয়েছে সমস্যা। বেশিক্ষণ বসে লিখতে থাকলে অসহ্য ব্যথা শুরু হয় হাতে। এইচএসসি পরীক্ষার আগে একবার পুরো বাম পাশ অবশ হয়ে গিয়েছিল। ঘাড়ও পুরোপুরি সোজা করতে পারেন না তিনি।
চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশ-ভারতের নানান প্রান্তে ছোটাছুটি করেছেন ইফতুর মা-বাবা। কিন্তু এখনো সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় হয়নি কোথাও। ইফতুর ভাষ্যে, "ডাক্তাররা ধারণা করেছিলেন রোগটা অস্টিও জেনেসিস ইম্পারফেক্টা। কিন্তু আমার সমস্যাগুলোর সাথে এটা পুরোপুরি মেলে না। এখনো তাই রোগটা শনাক্ত করা যায়নি।"
মা-ই তার শক্তি
"২০০৮- 'ভাবী! শুধু শুধু কষ্ট করে পাঁচতলা তুলতেছেন,ও কি আর কলেজিয়েটে চান্স পাবে? প্রতিবন্ধী স্কুলগুলাতে খোঁজ নিতে পারেন।"
২০১২- "কী চিন্তা করলেন ভাবী! ছেলেকে কি আর ম্যাট্রিকের পর পড়াশোনা করাবেন?"
২০১৭- এইচএসসি বোর্ড এক্সাম এ এক্সট্রা ৩০মিনিটে দায়িত্বরত শিক্ষিকা, "এই ছেলে এই! তুমি সায়েন্স নিসো কেন? তোমরা আবার ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হবা নাকি? আর কতক্ষণ লিখবা তুমি?"
'Celebration of successfully ruling and dominating against society more than a decade'- ফুটবলার ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর সেলিব্রেশনের পোজে মায়ের সঙ্গে ছবি তুলে এই ক্যাপশনসহ সপ্তাহখানেক আগেই ফেসবুকে পোস্ট করেছিলেন ইমতিয়াজ কবির ইফতু।
এ নিয়ে জিজ্ঞেস করলে জানান, "একজন সাধারণ খেলোয়াড় থেকে পরিশ্রম করে অনন্য হয়ে উঠেছেন রোনালদো। এটা আমার জন্য অনেক অনুপ্রেরণাদায়ক। আমি তো জন্মগতভাবে আশীর্বাদপ্রাপ্ত কেউ না, জীবনে এইটুকু আসতে একমাত্র পরিশ্রমই আমার পুঁজি। শুধু শারীরিকভাবেই নয়, মানসিকভাবেও সাধারণ যে কারোর চেয়ে কয়েকগুণ পরিশ্রম করতে হয়েছে আমাকে এই পর্যন্ত আসতে।"
তার এই পথচলায় মায়ের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি বলে স্বীকার করেন ইফতু। জীবনে যতবার হতাশ হয়েছেন, থেমে যেতে চেয়েছেন বা পারবেন না ভেবেছেন, ততবারই মায়ের কথা ভেবে উদ্দীপনা নিয়ে সামনে এগিয়েছেন তিনি।
ভবিষ্যতে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে গুগল, ফেসবুকের মতো প্রতিষ্ঠানে আন্তর্জাতিক পরিসরে কাজ করতে চান তিনি। ইফতু বলেন, "নিজের শারীরিক প্রতিবন্ধকতার বিষয়টা মেনে নিতে পারলে অনেক কিছুই সহজ হয়ে যায়। এটা তো কোনো ক্রাইম না। তাই লজ্জা পাওয়ার বা নিজেকে ছোট মনে করার কিছু নেই। নিজের যা আছে তা-ই কাজে লাগিয়ে যোগ্য হয়ে উঠতে পারলে আপনার কারো দিকে ফিরে তাকাতে হবে না, অন্যরাই আপনাকে খুঁজে নেবে।"