মাথাব্যথা বা ক্যান্সার: ইউরোপে একসময় সর্বরোগের দাওয়াই ছিল মিশরের মমি, খাওয়া হতো পথ্য হিসেবে
একটু মাথাব্যথা হয়েছে? খানিকটা মমি খাইয়ে দাও। পেটে ব্যথা? মমি খেলেই ঠিক হয়ে যাবে। ক্যান্সার! ওই তো, মমিই আসল দাওয়াই।
১৫ শতকে ইউরোপে মমির কদর এমনই ছিল! প্রাচীন মিশরের সংরক্ষতি এ মৃতদেহগুলোর ঐতিহাসিক মূল্য ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠেছিল চিকিৎসাজনিত প্রয়োজনীয়তা। কিন্তু কী কারণে মমি খেতেও দ্বিধা করেনি মানুষ? কেন তখনকার ইউরোপীয়রা মনে করেছিল মমি খেলে শরীরের অনেক অসুখ ভালো হয়ে যাবে?
ইউরোপে প্রথমে মমির বিভিন্ন অংশকে চূর্ণ করে খাওয়া হতো। এসবের শুরু হয়েছিল সেই ১১ শতকে। ইতিহাসবিদ কার্ল ড্যানেনফেল্ট লিখেছেন, অনুবাদের সময় মমি শব্দটির অর্থ বদলে যাওয়া এবং আরও কিছু ভুল বোঝাবুঝির কারণেই ইউরোপের বাসিন্দারা মিশরের মমিকে খাওয়ার বস্তু হিসেবে ধরে নিয়েছিল।
যেভাবে মমি হলো 'পথ্য'
পারস্যের একটি পাহাড়ের গায়ে পাওয়া যেত মমিয়া নামক এক উপাদান। কালো তরল পাথর থেকে চুইয়ে চুইয়ে পড়ত এ মমিয়া। মানবদেহের বিভিন্ন ব্যাধি সারানোর জন্য এটি প্রসিদ্ধ ছিল। স্থানীয় ভাষায় 'মম' (মোম) থেকে এই মমিয়ার নামকরণ করা হয়েছিল। এটি তৎকালীন আরবের বিভিন্ন দেমে দামি, বহুমূল্য ও কার্যকরী উপদান হিসেবে বেশ খ্যাতি অর্জন করেছিল।
এরপর পশ্চিমা ইউরোপীয়রা আরবের সংস্পর্শে এলো। তারা ইসলামিক বিভিন্ন রচনা তাদের ভাষায় অনুবাদ করতে শুরু করল। আর মমিয়া শব্দটি অনুবাদ করতে গিয়েই বাধল বিপত্তি। ড্যানেনফেল্টের মতে, ১১ ও ১২ শতকে অনেক অনুবাদক মমিয়া বলতে বুঝেছিলেন মিশরীয় বিভিন্ন কবরের সংরক্ষিত মৃতদেহ থেকে সংগ্রহ করা নির্যাস হিসেবে।
'মমিয়া' আর 'মমি' শব্দদুটো শুনতে প্রায়ই একই। অনুবাদে ভুল করার এটা একটা বড় কারণ ছিল। আবার প্রাচীন মিশরে মৃতদেহ সংরক্ষণ করা তথা মমি বানানোর ক্ষেত্রে গলিত পাথরও ব্যবহার করা হতো। তবে বর্তমানে বিজ্ঞানীরা জেনেছেন যে, কেবল অল্প কিছু মমিই এভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছিল। কিন্তু পশ্চিমা ইউরোপীয়রা মমি আর মমিয়াকে একই ভেবেই মমি খাওয়া শুরু করেছিল।
মেডিক্যাল ক্যানিবালিজাম
মমিকে পথ্য হিসেবে ব্যবহারের আরেকটি কারণ হচ্ছে চিকিৎসা নিয়ে দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা একটি ভুল ধারণা। একসময় মানুষ মনে করত, মানবশরীরের এমন সব উপাদান রয়েছে যা দিয়ে অন্য মানবদেহের রোগবালাই সারাই সম্ভব। বেশ কয়েক প্রজন্ম ধরে মেডিক্যাল ক্যানিবালিজাম হিসেবে পরিচিত এ পদ্ধতির চর্চা করেছিল মানুষ।
গ্ল্যাডিয়েটরদের রক্ত মৃগীরোগ সারাতে পারে বা মানবদেহের চর্বি ঘরোয়া পথ্য হিসেবে ব্যবহার করা যায় — এমন সব বিশ্বাস প্রচলিত ছিল মধ্যযুগের পশ্চিম ইউরোপে। ফলে মমিয়া বা মমির কথা যখন তখনকার চিকিৎসকেরা জানতে পারলেন, তারা মনে করলেন মানবশরীর ব্যবহার করে রোগ সারানোর নতুন একটি উৎস পেয়ে গেছেন তারা।
মাথাব্যথা থেকে শুরু করে হার্ট অ্যাটাক — সবকিছুতেই মমিয়া তথা মমি খাওয়ার হিড়িক পড়ে গেল। বলা বাহুল্য, তুমুল চাহিদা তৈরি হলো মিশরের মমির। মানুষজন মিশরের বিভিন্ন কবরে হানা দিয়ে সোনাদানা বা বাসনকোসন চুরির পাশাপাশি মৃতদেহও চুরি করতে শুরু করল। সেসব মৃতদেহ চিকিৎসার জন্য দেদার বিক্রি হতে লাগল।
মমির জোগানের চেয়ে চাহিদা কম — ফলে দেখা গেল 'বাজার' ছেয়ে গেছে নকল মমিতে। লাশচোর ও অসাধু ব্যবসায়ীরা অন্য যেকোনো লাশ, মৃত্যুদণ্ড পাওয়া অপরাধীদের লাশ সংগ্রহ করে সেগুলোকে মমি বানাতে শুরু করল। তাদের হাত থেকে রেহাই পায়নি দাস এবং সাধারণ মানুষও।
তৎকালীন এক পর্যবেক্ষক লিখেছেন, 'রাতের বেলায় ফাঁসিকাঠে ঝুলে থাকা লাশ চুরি করত মুর্দাচোরেরা'। তিনি আরও জানান, সংরক্ষণের জন্য লবণ ও বিভিন্ন মাদক ব্যবহার করত তারা। এরপর চুলায় সেই মৃতদেহ শুকিয়ে নিলেই মমি হিসেবে বিক্রির জন্য প্রস্তুত হয়ে যেত।
১৫ শতকের শুরুতে মিশর থেকে মমি চুরি করে ইউরোপে বিক্রি করা একটি লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছিল। এছাড়া ১৬ শতকের দিকে ইউরোপীয় শিল্পীরা মমি থেকে তৈরি 'মমি ব্রাউন' নামক একধরনের রঞ্জক পদার্থ তাদের ছবি আঁকার কাজে ব্যবহার শুরু করেন। সবমিলিয়ে তখন মমির ব্যবসা দারুণ জমজমাট হয়ে উঠেছিল মিশরে। মিশরের রাস্তায় মমি নিয়ে বিক্রির জন্য বসে থাকতেন অনেকেই।
ভিক্টোরিয়ান যুগে মিশর-ম্যানিয়া
অবশ্য পরের শতকগুলোতে মমির রোগ সারাইয়ের সক্ষমতা নিয়ে মানুষের মধ্যে সন্দেহ তৈরি হয়। তা সত্ত্বেও মমির প্রতি মানুষের আগ্রহ কেবল বেড়েছিল।
ভিক্টোরিয়ান যুগে ইংল্যান্ডে মিশর বিষয়ে মানুষের আগ্রহ ছিল তুঙ্গে। মমি উন্মোচনের বিষয়টি সে সময় ইংল্যান্ডে জনপ্রিয় চিত্তবিনোদন হয়ে উঠেছিল। বিভিন্ন লেকচার হল, হাসপাতাল, এমনিক ১৯ শতকের ব্যক্তিগত উদ্যোগেও অনেক বনেদি ব্রিটিশ নিজ বাড়িতে মমি উন্মোচনের আয়োজন করতেন।
মমির শরীর থেকে ব্যান্ডেজ খোলা আর সে দৃশ্য উপভোগ করা তাদের অবসর সময় কাটানোর অন্যতম আকর্ষণীয় উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এসব মমির বেশিরভাগই তারা মিশরের বিভিন্ন কবর থেকে চুরি করে কিংবা পথচলতি বাজার থেকে কিনে আনতেন।