মহররমের ১০ দিন: হোসেনী দালান, বড় কাটরা, বিবি কা রওজা থেকে মোহাম্মাদপুর…
বাড়ি বাড়ি উড়ছে কালো পতাকা আর লাল-সবুজ নিশান। রাস্তার মোড়ে মোড়ে টাঙানো মজলিশের কালো ব্যানার। ইমামবাড়া আর শিয়া মসজিদে কালো জামা-কাপড় পরা মানুষের ভিড়। মহরমের চাঁদ ওঠামাত্রই শিয়া সম্প্রদ্রায়ের মুসলিমরা শোকের চিহ্ন ধারণ করেন তাদের জীবনযাত্রায়। অন্যান্য সময় চাঁদ ওঠা মানেই মুসলিমদের জন্য খুশির ইঙ্গিত। হয় ঈদ, নয়তো রোজা বা শবে বরাতের মতো বিশেষ কোনো দিনের আগমন। কিন্তু মহররমের চাঁদ কোনো খুশির বার্তা নিয়ে আসেনা। বরং চাঁদ উঠলেই নেমে আসে শোকের ছায়া।
"বাঙালির জন্য ২১শে ফেব্রুয়ারী যেমন শোক দিবস, আহলে বাইত (নবীর বংশধর) ভক্তদের কাছে আশুরাও তেমন। মহররমের এক তারিখ থেকে শুরু করে পরবর্তী সোয়া দুই মাস কারবালার শহীদদের স্মরণে শোক পালন করি আমরা। আশুরা পর্যন্ত প্রথম দশদিন হয় মূল আয়োজন। এসময়টায় আমাদের খাবার-দাবার, চলা-ফেরা, পোশাক-আশাক সবেতেই থাকে শোকের আমেজ। বিষয়টা যতটা না ধর্মীয় তার চেয়ে বেশি সাংস্কৃতিক রীতি হিসেবে পালন করি আমরা," বলছিলেন পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ছোট্টান হাউজের বড় ছেলে সৈয়দ আহমদ আলী। আবুল হাসনাত রোডের জানমিয়া গলির এই বাড়িতে আছে প্রায় তিনশো বছরের পুরানো ইমামবাড়া।
পুরো মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ মহররম মাস। হিজরি ৬১ সালের ১০ মহররম কারবালার প্রান্তরে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর দৌহিত্র হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) অন্যায় ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে চক্রান্তকারী ইয়াজিদ বাহিনীর হাতে মর্মান্তিকভাবে শাহাদত বরণ করেন। সঙ্গে ছিল তার পরিবার, অনুসারীসহ আরো ৭১ জন সদস্য। মহররমের প্রথম ১০ দিন ঘিরে চলে তাই শোকপালন।
মহররম মাসের চাঁদ দেখা যাওয়ার পর গত ২০ জুলাই থেকেই শুরু হয়েছে ঢাকার শিয়া সম্প্রদায়ের শোক পালনের প্রথা। আজ তাজিয়া মিছিলের মধ্য দিয়ে শেষ হবে এই আয়োজন। গত নয় দিনে মজলিস, মিছিলসহ নানান ধরনের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শোক পালন করেছেন আহলে বাইত ভক্তরা। উর্দু বা ফারসি ভাষায় এসব রীতিনীতির আছে একেক ধরনের নাম। পুরান ঢাকার হোসেনী দালান, বড় কাটরা, ছোট্টান হাউজ, বিবি কা রওজা, মোহাম্মাদপুরের শিয়া মসজিদ এলাকা ঘুরে মহরমের নানা অনুষ্ঠান প্রত্যক্ষ করি আমরা।
নয় দিন পর্যন্ত টানা মজলিশ
মহররমের মূল আয়োজনের মধ্যে অন্যতম নয়দিন ব্যাপী মজলিশ। ইমামবাড়াগুলোতে মহররমের এক তারিখ থেকে নয় তারিখ পর্যন্ত টানা চলে এই মজলিশ। মূলত কারবালার শহীদদের স্মরণসভা হিসেবে আয়োজিত হয় এটি। একেক দিন একেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ও ব্যক্তিকে নিয়ে বয়ান করা হয় মজলিশে। বক্তা হিসেবে থাকেন শিয়া সম্প্রদায়ের গণমান্য আলেমরা।
কোনো কোনো ইমামবাড়ায় নারী-পুরুষদের জন্য আলাদা আলাদা সময়ে আয়োজিত হয় মজলিশ। আবার কোনো কোনো জায়গায় নারী-পুরুষদের জন্য পৃথক বসার ব্যবস্থা করে একই সময়ে মজলিশ হয়। বয়ানের পাশাপাশি মার্সিয়া (শোক গাঁথা), নওহা-সোয়্যাজ (মূলত শোকের কবিতা, মার্সিয়ার একটি অংশ) গাওয়া আর মাতম আর শিন্নি (শিরনি) বিতরণও হয় এসময়।
একসময় পুরোনো ঢাকার প্রতিটি মহল্লায় মার্সিয়া দল গঠন করা হতো। তারা হিন্দুস্তানি আর উর্দু ভাষায় মার্সিয়া রচনা করত এবং পালাক্রমে হোসেনী দালানে গিয়ে দলবদ্ধভাবে গাইতো।
উর্দু আর বাংলা দুই ভাষাতেই বয়ান হয় মজলিশে। ঢাকার বাইরে বিভিন্ন এলাকায় মজলিশের সময় কারবালার ঘটনার পুঁথি পাঠ করা হয়।
জীবনযাত্রায় শোকের চিহ্ন ধারণ
মহররমের চাঁদ দেখা যাওয়ার পর থেকে পরবর্তী সোয়া দুই মাস আনন্দ-উৎসব থেকে বিরত থাকেন শিয়া সম্প্রদায়ের মানুষেরা। মহররমের প্রথম দশদিন ভালো কোনো খাবারও খান না তারা। বাড়িতে যতটা সম্ভব সাধারণ খাবার রান্না হয়। এসময়ে চুলে তেল দেওয়া, নখ, দাড়ি কাটা থেকেও বিরত থাকেন অনেকে। কালো কাপড় পরিধান করা হয় শোকের চিহ্ন হিসেবে।
"আমাদের রাসূল (সা.)-এর বংশধরদের কী সাংঘাতিক ক্ষুধা-তৃষ্ণার কষ্ট পেয়ে শাহাদাত বরণ করতে হয়েছে! তার স্মরণে আমরাও তাই ভালো খাবার পরিত্যাগ করি এই সময়টায়। মাছ আমাদের এ অঞ্চলের সবচেয়ে সুস্বাদু আর রাজকীয় খাবার, তাই এই দশদিন আমরা মাছ খাইনা," বলছিলেন ছোট্টান হাউজের সৈয়দ আহমদ আলীর মা সৈয়দা উম্মে সালমা জায়েদী।
মোহাম্মাদপুর শিয়া মসজিদের ট্রাস্টি ফিরোজ হোসেন জানান, মহররমের প্রথম দশদিনে জীবনযাত্রার সব কাজেই শোকের আমেজ ধারণ করার চেষ্টা করেন শিয়া সম্প্রদায়ের সবাই।
কারবালার শহীদদের পিপাসার স্মরণে বিতরণ করা হয় শরবত
কারবালার প্রান্তরে হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) ও তার অনুসারীদের পানি সরবরাহের রাস্তা বন্ধ করে নির্যাতন করা হয়েছিল। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পিপাসায় কষ্ট পেয়েছিলেন তারা। সেই কষ্টের কথা স্মরণ করে মহররমের প্রথম দশদিন ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার মাঝে শরবত বা পানীয় বিতরণ করে আপ্যায়ন করেন শিয়া মতাদর্শীরা।
ছোট্টান হাউজে পৌঁছাতেই দেখা গেল জাফরান, তোকমা আর চিনির শরবত দেওয়া হচ্ছে মজলিশে আসা সকলকেই। শিয়া মসজিদে বোতলে করে বিতরণ করা হচ্ছিল পানি আর চা। বিহারী ক্যাম্পের সামনের রাস্তাতেও এলাকাবাসীদের মাঝে বিতরণ করা হচ্ছিল শরবত।
'কায়েস কা লাড্ডু'
বিবি কা রওজায় ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়েছিল ছোট ছোট মাটির বাটিতে সারি সারি সাজানো মিষ্টি নিয়ে বসে আছেন স্বেচ্ছাসেবকেরা। যারা চাচ্ছেন তাদেরকে মিষ্টি বিলাচ্ছেন। অগাধ বিশ্বাস আর ভক্তির সঙ্গে সে মিষ্টি হাত পেতে নিচ্ছেন ভক্তরা। জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম এগুলো 'কায়েস কা লাড্ডু'। মহররমের নয় তারিখ পর্যন্ত ইমামবাড়ায় মনোবাসনা পূরণ হওয়ার মানত করে খাওয়া হয় এই লাড্ডু। মানত পূরণ হলে পরের মহররমে আবার ১৪টি মিষ্টি শিন্নি হিসেবে দান করে যেতে হয় ইমামবাড়ায়।
ছোটবেলা থেকেই মায়ের সঙ্গে মহররমে এখানে আসতেন নওরোজ। এবার নিজের মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন তিনি। সুন্নী সম্প্রদায়ের হলেও মহররমে মানত করে কায়েস কা লাড্ডু খান তারা। জানালেন, শুধু মুসলিমরাই নন, অন্যান্য ধর্মাবলম্বী ব্যক্তিরাও মানত করে নিতে আসেন এই কায়েস কা লাড্ডু।
হোসেনী দালানেও চোখে পড়লো একই দৃশ্য। দালানের বাইরের দোকানগুলো থেকে লাড্ডু কিনে নিয়ে যাচ্ছেন ভক্তরা। লালবাগ থেকে হিন্দু ধর্মাবলম্বী রিনা দাস এসেছিলেন বোনকে সঙ্গে নিয়ে। তার ভাষ্যে, "সব ধর্মের মানুষই পালন করে মহররম। আমাদের বাসাতেও এই কয়দিন ভালো খাবার দাবার খাওয়া হয় না শোক পালনের উদ্দেশ্যে। ইমামবাড়ায় এসেছি কায়েস কা লাড্ডু দিতে।"
'বেহেশতা বা হোসেন কা বদ্দি'
ইমামবাড়াগুলোতে সবাই কালো বা সাধাসিধা পোশাক পরে এলেও, এক বিশেষ শ্রেণি (বিশেষত শিশুরা) এসেছিল ভিন্ন সাজে। গায়ে তাদের লাল-সবুজ জামা আর গলায় জরির ফুল, মাথায় কাপড় বাঁধা।
বিবি কা রওজায় দেখা মেলে এমন একজনের, নাম তার স্বপ্নীল। বয়স কেবল পাঁচ। সাদা গেঞ্জির সঙ্গে লাল কাপড় গায়ে পেঁচিয়ে, গলায় লাল-সবুজ ফিতা আর জরির ফুল ঝুলিয়ে মায়ের সঙ্গে এসেছিল সে। নাজিরাবাজারের বাসিন্দা তারা।
জন্মের পর থেকেই কঠিন রোগ ধরা পড়েছিল স্বপ্নীলের। সেই রোগ মুক্তির আশায় তাকে বেহেশতা বানানোর মানত করেছিলেন তার নানী। এবার মহররমের শুরুর দিন থেকেই তাই স্বপ্নীল বেহেশতার বেশে সেজে আচার পালন করছে।
হোসেনী দালানেও দেখা মেলে আরেক বেহেশতার। লাল জামা গায়ে একই রকম সাজে এসেছিল মাইশা (ছদ্মনাম)। মাইশা তার মা র সঙ্গে এসেছে, মা জানালানে, তাদের ইচ্ছাপুরণ হয়েছে তাই মেয়ে বেহেশতা সেজেছে।
বেহেশতার মতোই আরেকটি দল 'হোসেন কা বদ্দি'। অর্থ হোসেনের ভিক্ষুক। ছোট্টান হাউজে দেখা পেয়েছিলাম এরকম এক ভিক্ষুকের। বয়স ছয়। সবুজ কাপড় পরে হাতে সবুজ পাত্র নিয়ে ঘুরছে। আর আশেপাশের মানুষজন সে পাত্রে টাকা রাখছে।
ভিক্ষুক বা বেহেশতা দুই দলেরই দায়িত্ব প্রায় একই। বাড়ি বাড়ি ঘুরে শিন্নির টাকা জোগাড় করতে হয় তাদের । খালি পায়ে যোগ দিতে হয় মহররমের মিছিলেও৷ সন্তান ছোট হলে তার পরিবর্তে অভিভাবকেরা এসব রীতিনীতি পালন করে থাকেন।
আনিস আহমেদের 'ঢাকাইয়া আসলি' বইতে বেহেশতা আর হোসেনের ভিক্ষুকদের বর্ণনা পাওয়া যায়। বইয়ের তথ্য অনুযায়ী, নিঃসন্তান দম্পতি বা অসুস্থ সন্তানের অভিভাবকেরা মহররমের সময় মানত করেন সুস্থ-সবল সন্তানের জন্য। সেই মানত রক্ষার্থেই শিশুদের বেহেশতা বা হোসেনের ভিক্ষুক বানানো হয়। তারা মহররমের প্রথম ১০ দিন গলায় সবুজ রঙের ফিতা ও লাল-সবুজ কাপড় পরিধান করে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে সবুজ কাপড়ে ঢাকা পাত্রে ভিক্ষা করে বেড়ায়। সংগৃহীত পয়সা ও চাল দিয়ে আশুরার দিন খিচুড়ি রান্না করে বিতরণ করা হয়।
এই রীতি এখনও চালু রয়েছে।
'মেহেদি কা রাসাম বা মেহেদি নাজার'
মহররমের প্রথম নয়দিনের রেওয়াজগুলোর মধ্যে অন্যতম মেহেদি কা রাসাম বা মেহেদি নাজার। ইমাম হাসান (রা.)-এর পুত্র আর ইমাম হোসাইন (রা.) এর কন্যার বিয়ের স্মরণে আয়োজিত হয় এই প্রথা। হোসেনী দালান, বড় কাটরায় মহররমের ছয় তারিখ রাতে আর ছোট্টান হাউজে সাত তারিখ রাতে পালন করা হয়েছে মেহেদি নাজার।
সৈয়দা উম্মে সালমা জায়েদী বলেন, "মেহেদি কা রাসামে আমরা ইমামবাড়ার সামনে একটা দস্তরখানায় ফল-মূল আর নানা ধরনের শিন্নির পাশাপাশি চুড়ি, হলুদ-মেহেদি সাজিয়ে রাখি। খাবারগুলো শিন্নি হিসেবে বিতরণ করা হয় সবার মাঝে। আর হলুদ, মেহেদি মেয়েরা মানত করে নিয়ে যায়।"
হোসেনী দালানে জিয়ারত করতে এসেছিলেন রাবেয়া। তিনি জানালেন, মেহেদি নাজারের পর খাদেমরা তুলে রাখেন এই হলুদ-মেহেদি। মেয়েরা কপালে হলুদ মাখেন আর এক আঙ্গুলে পরেন এই মেহেদি। নিয়ম অনুযায়ী, বিয়ে হওয়ার আগ পর্যন্ত তারা আর হলুদ-মেহেদি ছুঁতে পারে না।
মেলা
একসময়ে মহররম উপলক্ষে মেলা বসতো হোসেনী দালান, বকশীবাজার, ফরাসগঞ্জ, ও আজিমপুরে। এরমধ্যে আজিমপুরের মেলাটাই ছিল সবচেয়ে বড়। বর্তমানে তার চল অনেকটাই কমে এসেছে। এবার ফরাসগঞ্জে বা বকশীবাজারে মেলার আয়োজন চোখে পড়েনি। তবে হোসেনী দালান রোডে দেখা গেল মহররমের মেলার আমেজ।
চানখারপুল থেকে হোসেনি দালান পর্যন্ত পুরো রাস্তার দুই পাশ জুড়ে সারি সারি দোকান বসেছে। শিশুদের খেলনা, থালা-বাসন, মেয়েদের সাজসজ্জার সামগ্রী ইত্যাদি নানারকমের জিনিসের পাশাপাশি লাড্ডু, বাতাসা, মুরালিসহ বিভিন্ন শুকনো মিষ্টির আধিক্য ছিল দোকানগুলোতে।
নাজরানা বা শিন্নি
মহররমের সময় আগে বাড়ি বাড়ি পয়সা সংগ্রহ করে খিচুড়ি রান্না হতো ইমামবাড়ায়। ভর্তা-সবজি দিয়ে সেই খিচুড়ি নাজরানা বা শিন্নি হিসেবে বিতরণ করা হত মানুষের মাঝে। সামর্থ্য অনুযায়ী অনেকেই শিন্নি দিত বিরিয়ানি বা মাংস-রুটি।
বর্তমানে বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাঁদা তোলার প্রচলন কমে এলেও অনেকে ব্যক্তিগত উদ্যোগে শিন্নি দিয়ে থাকেন ইমামবাড়ায়। আবার ফান্ডের টাকা থেকেও আয়োজন করা হয় এই শিন্নির।
ফিরোজ হোসেন জানান, মহররমের এক তারিখ থেকে মসজিদে প্রতিদিন কারও না কারো পক্ষ থেকে শিন্নি দেওয়া হচ্ছে। এই শিন্নি যে যার সামর্থ্য অনুযায়ী দিয়ে থাকে। কেউ খিচুড়ি, কেউ রুটি বা কেউবা চা-বিস্কুটও দিচ্ছেন। শিয়া মসজিদে প্রতিদিন ৭০০ থেকে ১১০০ মানুষের জন্য শিন্নির আয়োজন হয়েছে।
তাজিয়া তৈরি ও মিছিলের প্রস্তুতি
প্রতিবছর মহররমের আয়োজনের মূল আকর্ষণ থাকে তাজিয়া মিছিল। প্রতীকী কবর হিসেবে বানানো তাজিয়া নিয়ে শোকের মাতম করতে করতে মিছিল করেন আহলে বাইত ভক্তরা। অন্যান্য দেশে তাজিয়ার শুধু ইমাম হোসাইনের কবরের প্রতিকৃতি থাকলেও আমাদের দেশে ইমাম হাসানসহ দুইটি কবরের প্রতীক হিসেবে বানানো হয় তাজিয়া।
বাঁশ, কাঠ, কাপড় ইত্যাদি দিয়েই মূলত তাজিয়া বানানো হয়। ইমামবাড়াগুলোতে স্থায়ী তাজিয়া থাকলেও, প্রতিবছর অস্থায়ী তাজিয়া বানানো হয় মিছিলের জন্য। তাজিয়া ঢাকার জন্য থাকে মখমলের নানা রঙের নকশাদার কাপড়।
তাজিয়ার পাশাপাশি অন্যান্য বারের মতোই এবার মিছিলে ইমামের পরিবারে মহিলাদের পালকি স্বরূপ বিবিকা ডোলা (মা ফাতিমার পালকি), গাঞ্জে শাহীদান (শহীদদের গণকবর), ধর্মীয় পতাকা, পাঞ্জা (ইমামের হাতের নকশাধারী পতাকা) বহন করা হবে। দুধে ধোয়ানো দুলদুল ঘোড়া (যে ঘোড়ায় ইমাম হোসাইন যুদ্ধ করেছিলেন), রক্তের মত লাল রঙে রাঙানো খুনি ঘোড়ার (যে ঘোড়ায় ইমামের পবিত্র মস্তক বহন করা হয়েছিল) প্রতীক হিসেবে সাজানো ঘোড়া থাকবে মিছিলে। এমদাদুল হক চৌধুরীর 'ঢাকার ইতিহাস' বই থেকে জানা যায়, নবাবী আমলে হাতীও আনা হতো এই মিছিলে।
বাংলাপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, মোগল আমলে বিশেষত সতেরো শতকের মাঝামাঝি শাহ সুজা বাংলার সুবেদার থাকাকালীন শিয়াদের প্রভাব বৃদ্ধি পায়। সে সময়টাতেই এখানে তাজিয়া মিছিলের প্রচলন হয় বলে ধারণা করা হয়।
'ঢাকার ইতিহাস' বইয়ের তথ্য অনুযায়ী ঢাকায় মহররমের মিছিলের সবচেয়ে পুরানো বর্ণনাটি নবাবী আমলের, ১৮৫০ সালে কলকাতার এক সংবাদপত্রের রিপোর্টে পাওয়া যায়। ঢাকায় এই মহররমের ব্যাপকতা বাড়ে নায়েব নাজিমদের আমলেই।
নবাব শায়েস্তা খাঁর বংশধরদের লোপ পাবার সঙ্গে সঙ্গে মহররমের জৌলুস কমতে শুরু করে। অনেক কিছুতেই ভাটা পড়ে গেছে আজ। ২০১৫ সালে আশুরার মিছিলে বোমা হামলার ঘটনার পর থেকে নিরাপত্তার খাতিরে মিছিলের ব্যপ্তিও কমিয়ে আনা হয়েছে।
নাজির হোসেনের 'কিংবদন্তীর ঢাকা' বইয়ের তথ্য অনুযায়ী, মহররমের এই মিছিল দেখার জন্য একসময় বহু দূর থেকে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে দলে দলে লোক এসে জড়ো হতো ঢাকায়। বাড়ির জানালা, বারান্দা ও ছাদে মানুষের ভিড়ে তিল ধরানোর জায়গা থাকতো না। তাজিয়া আর মার্সিয়ার হৃদয়-বিদারী করুণ সুরে অনেকের চোখেই পানি চলে আসতো। এখন দূর দূরান্ত থেকে মানুষ আসেন কমই। তবে আশেপাশের বাড়ির লোকেরা এখনো বারান্দা, ছাদ কিংবা বাড়ির নিচে নেমে দাঁড়িয়ে মিছিল যাত্রা দেখেন। অনেকেই মানত হিসেবে তাজিয়ার উপর ছুঁড়ে দেন মুরগি বা কবুতর। আশুরার দিন তাজিয়া মিছিল থেকে পথিকদের মাঝে বিলিয়ে দেওয়া হয় শরবত।
মাতম করার পাশাপাশি অতীতে মহররমের শেষ তিনদিন ধরে চলতো ঢোলের শব্দে কারবালার রূপক যুদ্ধের মহড়া৷ এসব মহড়ায় ব্যবহার হতো নানাধরনের লাঠিসোঁটা, তরবারি অস্ত্র। ফলে মিছিলে দা, ছুরি, কাঁচি, বর্শা, বল্লম, তরবারি, লাঠি বহন করতো অনেকেই। এসব অস্ত্রের মহড়া বা অস্ত্র চালানোর পারদর্শিতা ছিল মিছিলের অন্যতম আকর্ষণ। সাধারণ মানুষ মুগ্ধ হয়ে দেখতো তাদের কসরৎ। তাতবির করা বা তরবারি, শিকল দিয়ে নিজের শরীর আঘাত করাও ছিল তাজিয়া মিছিলের অন্যতম অংশ৷ নিরাপত্তার কারণে তা নিষিদ্ধ করা হয়েছে বর্তমানে।
গত কয়েকবছরের মতো এবারও তাজিয়া মিছিলে যেন উচ্চস্বরে ঢাকঢোল বাজানো না হয়, গায়ে চাদর জড়িয়ে কোনো লোক যেন চলাফেরা না করেন এবং নিজের শরীরে আঘাত করে রক্তাক্ত বা জখম করা থেকে যেন সবাই বিরত থাকেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে সেই পরামর্শ দেওয়া হয় আয়োজকদের।
মহররমের পাঁচ তারিখ পর্যন্ত প্রতিদিনই বিভিন্ন সময়ে খণ্ড খণ্ড মিছিল বের হয় ইমামবাড়াগুলো থেকে। 'ঢাকাইয়া আসলি' বই থেকে জানা যায়, মহররমের আট তারিখে বের হতো 'সামরাত কি মিছিল' (সন্ধ্যার মিছিল) আর নয় তারিখে বের হতো 'ভোররাত কি মিছিল' (ভোররাতের মিছিল)। নিরাপত্তার খাতিরে নানান বিধিনিষেধ থাকায় বর্তমানে মিছিলের সময়সূচীতেও এসেছে কিছু পরিবর্তন।
হোসেনী দালান যাবার পথে একটি খণ্ড মিছিলের সঙ্গে হেঁটে এসেছিলাম ইমামবাড়া পর্যন্ত। দুপাশের বাড়ির পরিবারগুলোকে দেখছিলাম নিচে জড়ো হয়ে বুকে হাত দিয়ে মাতম করতে। মহিলাদের অনেকেই মাথায় কাপড় দিয়ে বাড়ির বারান্দায়, ছাদে বা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে মাতম করছিলেন৷
প্রধান তাজিয়া মিছিলটি বের হয় মহররমের ১০ তারিখ অর্থাৎ আশুরার দিন সকালে হোসেনী দালান ইমামবাড়া থেকে। প্রতিবারের মতো এবারও ঢাকার অন্যান্য ইমামবাড়া থেকে বের হওয়া মিছিলগুলো গিয়ে যোগ হবে হোসেনী দালানের প্রধান মিছিলের সাথে। সায়েন্স-ল্যাব মোড়ে সবগুলো মিছিল একত্র হয়ে ধানমন্ডি লেকের দিকে এগিয়ে পরিকল্পনা। এরপর ধানমন্ডি লেকের প্রতীকী কারবালা প্রাঙ্গণে শেষ হবে তাজিয়া মিছিলের। মহররমকে ঘিরে ঢাকা নগরীর বুকে, বিশেষ করে শিয়া অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে দশদিন ধরে যে বিপুল প্রাণসমারোহের সৃষ্টি হয়েছিল তাও শেষ হবে এখানেই।