ফুড কার্ভিং: ফল কিংবা সবজিতে নকশা কাটা যাদের পেশা!
'মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়'- আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদের এই উক্তিটি মনে প্রশ্ন জাগায়, কত বড় হলে আসলে স্বপ্নকে ছোঁয়া যায়। তথাকথিত সমাজের চোখ এড়িয়ে কি স্বপ্নকে জয় করা যায়? সমাজের ছুঁড়ে দেওয়া প্রশ্ন যখন ফারদিনের দিকে ছুটে এসেছিলো তখন তিনি সবে দশম শ্রেণীর ছাত্র। রঙ-তুলি নিয়ে খেলতে খেলতে কখন যে ছুরি চামচ দিয়ে ফল-সবজিতে নকশা করার দিকে মন ঝুঁকে গিয়েছে তা নিজেও বুঝতে পারেননি।
ফল কিংবা সবজিতে ছুরি-চামচ দিয়ে নকশা কাটার বিষয়টি 'ফুড কার্ভিং' হিসেবে পরিচিত। বোনের বিয়েতে ফারদিন প্রথম বুঝতে পেরেছিলেন, ফুড কার্ভিং অর্থাৎ ছুরি দিয়ে সবজিতে নকশা কাটার কাজ তিনিও করতে পারেন। কিন্তু 'ছেলে হয়েও ছুরি-চামচ নিয়ে কারিকুরি দেখাবে'- এমন তাচ্ছিল্যের মুখোমুখি হতে হয়েছিলো তাকে। কটু কথা কিংবা আড় চোখে তাকানো কোনোটিই পিছু ছাড়েনি। কিন্তু ফারদিন ঘুরে দাঁড়িয়েছেন বার বার। তাই এখন নিজের পরিচয় দেওয়ার কথা বললেই বলেন, 'আমি ফুড কার্ভিং আর্টিস্ট ফারদিন খান বলছি।'
শুধু ফারদিনই নয়, আমাদের দেশে ফুড কার্ভিং আর্টিস্ট হিসেবে সুনাম কুড়িয়েছেন আরো অনেক শিল্পী। সারাবছর অল্প বিস্তর কাজ থাকলেও বিয়ের মৌসুম অর্থাৎ নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত তাদের চাহিদাও বেড়ে যায় বহুগুণ।
গত দেড় দশকে ফুড কার্ভিং আমাদের দেশে বেশ জনপ্রিয়তা পেলেও বিশ্বজুড়ে বহু শতাব্দী আগে থেকেই এর প্রচলন রয়েছে। থাইল্যান্ড, জাপান, চীনভেদে ফুড কার্ভিং এর উৎপত্তির ভিন্ন ভিন্ন ইতিহাসও রয়েছে। অনেকে মনে করেন চীনে তাং রাজবংশের সময়কালে জন্ম হয়েছিল ফুড কার্ভিং এর। আবার থাইল্যান্ডের প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী, সুখোথাই রাজ্যে লোই ক্র্যাথং উৎসবে প্রচলন ঘটে ফুড কার্ভিং এর। লোই ক্র্যাথং থাইল্যান্ডে আলোর উৎসব হিসেবে পরিচিত। এই উৎসবে ঝুড়ি ফুল দিয়ে সাজিয়ে ভাসিয়ে দেওয়া হয় নদীতে। ১৪ শতকে এই উৎসবেই থাই রাজা ফ্রা রুয়াং এর এক ভৃত্য ন্যাং নোপ্পামার্টের হাত ধরে উৎপত্তি ঘটে ফুড কার্ভিং এর।
গায়ে হলুদের টেবিল থেকে শুরু করে জন্মদিনের অনুষ্ঠান- আজকাল কর্পোরেট অনুষ্ঠানের টেবিলেও শোভা পায় 'ফুড কার্ভিং' খ্যাত শিল্পকর্মটি। চোখের পলকে শিল্পীরা কুমড়ো থেকে ঝুড়ি, ময়ূর, মাছ, হাঁস কিংবা গাজর-টমেটো দিয়ে ফুল-পাতা তৈরি করে ফেলতে পারেন। দেখতে সহজ হলেও এই শিল্পকর্মের পেছনের শিল্পীদের করতে হয় ভীষণ পরিশ্রম। সৌন্দর্যে মণ্ডিত এ শিল্পের পেছনে থাকা কারিগরদের কাছে তাই জানতে চেয়েছিলাম তাদের অভিজ্ঞতা।
আগ্রহই তাদের এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা
বাংলাদেশের ফুড কার্ভিং জগতে অনন্য নাম হিসেবে আবিদা সুলতানার কথা উঠে আসে সবার আগে। ফল কিংবা সবজি দিয়ে কারিশমা দেখানো আবিদা সুলতানার ফুড কার্ভিং এর প্রতি আকর্ষণ জন্মায় ছোটবেলাতেই; যার প্রতিফলন ঘটে তার বিয়ের সময়। নিজের বিয়েতে ফুড কার্ভিং করে যখন চারপাশ থেকে প্রশংসা পান, তখনই সিদ্ধান্ত নেন পছন্দের কাজ নিয়েই তিনি এগিয়ে যাবেন। যেই ভাবা সেই কাজ। ২০১০ সালে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ফাউন্ডেশন (এসএমই) থেকে কোর্স করার মাধ্যমে শিখে নেন ফুড কার্ভিং-এর খুঁটিনাটি।
পাকাপাকিভাবে চাকরি ছেড়ে ফুড কার্ভিংয়ের জগতে ভিড়বেন- এমন সিদ্ধান্তে ঝুঁকি নিতে হয়েছিলো আবিদাকে। সৃজনশীলতা ও হাতের কাজের উপর ভরসা করেই জড়িয়ে পড়েছিলেন এই শিল্পের সাথে। পরবর্তী সময়ে ফেসবুকে পেজ খুলে শুরু করেন প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এগিয়ে যাওয়ার কাজ। শুরু করেন 'আবিদা'স ডিজাইন'- এর যাত্রা। পাশাপাশি চলতে থাকে 'ব্রাইডাল ক্রিয়েশন্স'- এর কাজ। এতে অবশ্য অসফল হননি। একা হাতে ব্যবসা শুরু করা আবিদা এখন অনেক মানুষের অনুপ্রেরণা।
যশোরের জলিল রহমানের গল্প কিছুটা ভিন্নরকম। বাড়িতে থাকা গবাদি পশুর জন্য আনা সবজি দিয়ে শুরু হয়েছিল তার যাত্রা। সময়টা ২০১১ সাল। গৃহে পালিত গরুর জন্য আনা সবজির গায়ে আগ্রহের বশেই কাটতেন নকশা। নকশা কাটা শেষে সে সবজিগুলো খেতে দিতেন গরুকে। ফুড কার্ভিংয়ে ছেলের এমন আগ্রহ বাবারও চোখ এড়ায়নি। ছেলে যাতে আরো ভালোভাবে কাজ করতে পারে তাই বাজার থেকে একটি ছুরি এনে দিয়েছিলেন। নতুন ছুরিই জলিলের মধ্যে তৈরি করে আকাশচুম্বী বাসনা। মনের মধ্যে জন্মাতে থাকে ফুড কার্ভিং শিল্পের মাধ্যমে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার বিপুল ইচ্ছা।
জলিলের হাতে সেসময় কোনো অ্যানড্রয়েড ফোন ছিল না। স্থানীয় বিভিন্ন সংগঠনের সাথে যুক্ত থাকায় সেখানকার কম্পিউটারের ইউটিউবে ফুড কার্ভিংয়ের ভিডিও দেখা শুরু করেন। বাড়ি ফিরে বাবার কিনে দেওয়া ছুরির মাধ্যমে চালিয়ে যেতেন নিয়মিত চর্চা। এভাবেই কেটেছে প্রায় ৮ বছর। ২০১৯ সালে বাবার মৃত্যুর পর জলিল যশোর থেকে চলে আসেন ঢাকায়। ঢাকায় এসে শুরু করেন প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ফুড কার্ভিংয়ের কাজ। তারই হাত ধরে শুরু হয় 'ঢাকা ফ্রুটস কার্ভিং' এর পথচলা।
শখই তাদের শক্তি
আগ্রহের পাশাপাশি অনেকে শখ থেকে কিংবা আত্মবিশ্বাসী হয়েও ফুড কার্ভিং পেশায় যুক্ত হয়েছেন। তাদেরই একজন ফারজানা ফিহা সোনিয়া। নিতান্তই শখের বশে ২০১৩ সালে ফুড কার্ভিং এর সাথে যুক্ত হন সোনিয়া। জাতীয় মহিলা সমিতি থেকে তিন মাসের কোর্স করে শুরু করে ঠিক করলেন ফুড কার্ভিং নিয়েই নিজের কর্মসংস্থানের উপায় বের করবেন। শুরুর দিকে যদিও কিছুটা অনিয়মিতই ছিলেন। তবে দিন যত আগাতে থাকে সোনিয়ার কাজের প্রতিও মনোযোগ বাড়তে থাকে। অতঃপর পেশাগতভাবে ফেসবুকে পেজ খুলে শুরু করলেন 'ফুড কার্ভিং বাই সোনিয়ার' যাত্রা। শুরুতে ফল বা সবজির কার্ভিং করলেও পরবর্তী সময়ে পিঠার উপরে নকশা তৈরির কাজেও নিজেকে যুক্ত করেন তিনি। নকশার মাধ্যমে টেবিলকে সুন্দরভাবে সাজানোই সোনিয়ার লক্ষ্য।
ফারদিন খানের গল্পটা অবশ্য সমাজের প্রতিকূলতা পেরিয়ে সামনে এগোনোর গল্প। ২০১৭ সালে ফারদিন খান ঠিক করেছিলেন পেশাগতভাবে ফুড কার্ভিংকে বেছে নেবেন। প্রথমদিকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শেখার সুযোগ ফারদিনের হয়নি। তাই শিক্ষক হিসেবে তখন কাজ করে গুগল। গুগলে দেশি-বিদেশি শিল্পীদের কাজ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তিনি শেখেন কার্ভিংয়ের খুঁটিনাটি।
কয়েলের স্ট্যান্ডের ধারালো অংশ দিয়েই প্রথমদিকে ফল কিংবা সবজি কাটার কাজ চালাতেন। বাজার থেকে বাসায় আনা সবজি দিয়েই চালিয়ে যেতেন চর্চা। কিন্তু ফুড কার্ভিংকে ব্যবসা হিসেবে নেবেন- তা জানার পর পরিবার একটু আপত্তিই জানিয়েছিল। তবে বোনদের সাহচর্যে সে সমস্যা কাটাতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। বর্তমানে স্নাতক তৃতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত ফারদিন খান 'বিয়ের সাজঘর/ ফ্রুট কার্ভিং ঘর' নিয়ে ঢাকা এবং শরীয়তপুর দুই জায়গাতেই সমানতালে কাজ করে যাচ্ছেন। প্রায় ১২০০'র বেশি ডিজাইন এখন তার ভাণ্ডারে আছে।
প্রয়োজন হয় বিশেষ কিছু ছুরি-চামচের
সাধারণ ছুরি চামচের থেকে আলাদা কিছু সামগ্রী দিয়েই করা হয় ফুড কার্ভিং এর কাজ। এখন বিশেষায়িত ছুরি-চামচ-ডাইস দিয়ে কাজ করলেও এই শিল্পীদের শুরুটা হয়েছিলো সাধারণ ছুরি দিয়েই। কেউ কেউ আবার টিন কেটে শান দিয়ে ছুরি বানিয়েছেন, আবার কেউ মশার কয়েলের স্ট্যান্ড দিয়ে কাজ করেছেন।
তবে বর্তমানে ফুড কার্ভিং শিল্পীদের সংগ্রহে আছে অনেকরকমের ছুরি চামচ। অনেকে সেগুলো বিদেশ থেকে নিয়ে এসেছেন আবার অনেকে দেশের ভিতর থেকেই সংগ্রহ করেছেন। বিভিন্ন অনলাইন পেজের পাশাপাশি ঢাকার নিউমার্কেটেই পাওয়া যায় ফুড কার্ভিং এর আনুষঙ্গিক সামগ্রী।
আবিদা বলেন, 'আমি যখন কার্ভিং এর কাজ প্রথম শুরু করি, তখন মানুষের মধ্যে অতটা চাহিদা তৈরি হয়নি। ধীরে ধীরে চাহিদা সৃষ্টি হয়। প্রথমদিকে একটি মাত্র ছুরি দিয়েই কাজ করতাম। বিভিন্ন টুলস সম্পর্কে যখন গুগল ইউটিউব থেকে জানলাম, তখন নিউমার্কেটে সেগুলো দেখি।'
ফল কিংবা সবজি সংরক্ষণ
সাধারণত যেদিনের অনুষ্ঠানের জন্য ফুড কার্ভিং করতে হয়, সেদিন বা তার আগেরদিন কার্ভিং এর কাজ করতে হয়। বেশিদিন আগে কার্ভিং করলে তা নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সাধারণত ফলের ক্ষেত্রে তরমুজ, আনারস, মাল্টা, আঙ্গুর, আপেল ব্যবহার করা হয়। সবজির মধ্যে মিষ্টি কুমড়া, গাজর, পেঁপে, মূলা, লাউ, বাঁধাকপি, ফুলকপি, শসা, বেগুন ব্যবহার করা হয়।
কার্ভিং এর জন্য ফল-সবজি সংরক্ষণে শিল্পীরা দেন বিশেষ গুরুত্ব৷ সাধারণত কিছু ফল বা সবজি বাতাসের সংস্পর্শে এলে কালো হয়ে যায়। তাই কাটার পর সেলোফেন পেপার দিয়ে মুড়িয়ে রেখে তারা সংরক্ষণের চেষ্টা করেন। আবিদা সুলতানা বলেন, 'অক্সিডাইজড হওয়ার কারণে আপেলকে সাধারণত এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। আপেল ব্যবহার করতে হলে অনুষ্ঠানের জায়গায় গিয়ে সেট করি।'
জলিল খান বলেন, 'আমি সাধারণত একদিন আগে বাজার করি। কিছু ফল বা সবজি আছে সহজে নষ্ট হয় না, যেমন: গাজর। এগুলো আগে কেটে ফ্রিজে রেখে দেই। অনুষ্ঠানের দুই ঘণ্টা আগে আমি ফ্রিজ থেকে বের করে এনে সেট করি। টাটকা দেখানোর জন্য সবসময় ফ্রিজের ঠাণ্ডা পানি দিয়ে ভিজিয়ে রাখি।'
একই নিয়মে ফারদিন খানও সংরক্ষণের কাজ করেন। আপেল যাতে সহজে কালো না হয়, সেই তরিকাও দিয়েছেন তিনি। ফারদিন বলেন, 'আপেলকে লবণ পানি আর লেবুর পানি দিয়ে ভিজিয়ে রাখলে সহজে কালো হয় না। আপেল অনেকক্ষণ ভালো থাকে তাতে।'
প্রতিকূলতা পেরিয়ে সামনে আগানো
শুরু থেকেই পরিবারের সমর্থন ভালোভাবে পাচ্ছেন 'ফুড কার্ভিং বাই সোনিয়া'র স্বত্বাধিকারী সোনিয়া। সোনিয়া বলেন, 'আমার হাজবেন্ডই আমাকে কার্ভিং করার জন্য ইন্সট্রুমেন্ট জোগাড় করে দিয়েছে। এই কাজে অনেক সময় দেওয়া লাগে বলে অন্যান্য কাজ পরিবারের অন্যরাই সামলে নেয়।'
তবে ফারদিনের গল্প কিছুটা ভিন্ন। এই পেশায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য মা এবং বোনেদের সমর্থন থাকলেও বাবার কিছুটা অমত ছিলো। ফারদিন বলেন, 'আমার আত্মীয়-স্বজনরা বলতো যে ছেলে মানুষ কীসব ফল সবজি কেটে নষ্ট করছে। ছেলেরা পড়াশোনা শেষে চাকরি করবে। আমার বাবা ব্যবসায়ী। বাবা তার ব্যবসা নিয়ে আমাকে বলেছিলো। আমি তখন বলেছিলাম যে আমি আমার নিজের ব্যবসা নিয়ে আগাতে চাই। সেই থেকেই শুরু। এখন আমার বাবা, মা আমাকে অনেক সমর্থন করে।'
ফারদিনের যখন কাজের অনেক চাপ থাকে, তখন তার মা-ও সাহায্য করে। এখন রাত জেগে কাজ করলে বাবা কফি বানিয়ে দেন।
সাধারণত গায়ে হলুদের টেবিল, জন্মদিনের টেবিল, কর্পোরেট ডিনার প্রোগ্রামের টেবিল সাজানোর কাজ করেন আবিদা সুলতানা। যশোরে রাষ্ট্রপতির প্যারেড অনুষ্ঠানেও টেবিল সাজানোর সুযোগ পেয়েছেন তিনি। গায়ে হলুদের টেবিলের সাজানোর ক্ষেত্রেই সোনিয়া ও জলিলের অর্ডার বেশি আসে। ফারদিন বিয়ের অনুষ্ঠানের পাশাপাশি সেনাবাহিনীর অনুষ্ঠান, ফুড ফেস্টিভ্যালেও টেবিল সাজিয়েছেন।
প্যাকেজের মাধ্যমে ফুড কার্ভিং বিক্রি
ফুড কার্ভিং শিল্পীদের কাছে প্রতিমাসে আয়ের বিষয়টিও ভিন্ন রকম হয়। বিয়ের সিজনের উপরই আয় বেশিরভাগ সময়ে নির্ভর করে। আবিদা বলেন, 'বছরের চার মাসে আমাদের আয় বেশি হয়। অফ সিজনে আয় ওঠানামা করে।' অন্তত ২ থেকে ৩ দিন পূর্বে শিল্পীদের কাজের বিষয়ে অবগত করতে হয়। নিয়মিত কাজ করলে প্রতি মাসে ১৫ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় হয় সোনিয়ার। জলিলের প্রতি মাসে ৪ থেকে ৫টির মতো অর্ডার আসে। নিয়মিত কাজ করলে কোনো কোনো মাসে ৪০ হাজার টাকাও জলিলের আয় হয়।
ফুড কার্ভিং এর সামগ্রী মূলত প্যাকেজ আকারে বিক্রি করেন শিল্পীরা। চার হাজার টাকা থেকে বিশ হাজার টাকার প্যাকেজ বিক্রি হয় 'ঢাকা ফ্রুটস কার্ভিং'-এ। 'ফুড কার্ভিং বাই সোনিয়া'তে ১ হাজার থেকে ৩ হাজার টাকার কার্ভিং পাওয়া যায়। আবিদার সুলতানার 'আবিদা'স ডিজাইন'-এ ৩ হাজার, ৫ হাজার, ১০ হাজার টাকার প্যাকেজ রয়েছে। ক্ষেত্র বিশেষে ৫০ হাজার টাকার প্যাকেজও এখানে পাওয়া যায়। এখানে গ্রাহকের পছন্দমতো প্যাকেজ বাছাইয়ের সুযোগ রয়েছে।
ফারদিন খানের 'বিয়ের সাজঘর/ফ্রুট কার্ভিং ঘর'-এ ৬৫০০ টাকা থেকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকার কার্ভিং পাওয়া যায়। ১ লাখ ২০ হাজার টাকার প্যাকেজের কার্ভিং এ ৪০টি কাস্টমাইজড কার্ভিং থাকে। কার্ভিং এর প্রতিটি প্যাকেজে ফারদিন চেষ্টা করেন গ্রাহকদের অতিরিক্ত একটি কার্ভিং উপহার দেওয়ার। ফারদিন খানের পাওয়া অর্ডারের ক্ষেত্রে মাল্টার পুতুল, মিষ্টি কুমড়ার ভেজিটেবল কেক, মূলার ময়ূর, মিষ্টি-কুমড়ার মাছের চাহিদা অনেক বেশি থাকে।
ফুড কার্ভিং কিছুটা সংবেদনশীল হওয়ায় শিল্পীরা নিজেরাই চেষ্টা করেন ডেলিভারি করে দেওয়ার। অধিকাংশ সময় অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত হয়ে কাজ করেন তারা। আবার গ্রাহক নিজে এসেও নিয়ে যেতে পারেন। অল্পকিছু ডেলিভারি প্রতিষ্ঠান আছে যেগুলো গ্রাহকের কাছে অর্ডার পৌঁছে দেয়। কার্ভিং এর ওজন এবং স্থানের দূরত্বভেদেই ডেলিভারি চার্জ নির্ধারিত হয়।
শিখে কাজ করার প্রতি আহ্বান
খুব বড় পরিমাণের মূলধন দিয়ে সাধারণত এই ব্যবসায় শুরু করতে হয় না। যেহেতু এটি দক্ষতার উপর নির্ভরশীল কাজ, তাই প্রচুর সময় ও ধৈর্য্যের প্রয়োজন হয়। একেকটি আকর্ষণীয় কার্ভিং তৈরি করতে কয়েক ঘণ্টা পর্যন্তও সময় লেগে যায়।
গুরুমুখী বিদ্যায় ভীষণ বিশ্বাসী আবিদা সুলতানা। কাজ না শিখে এই অঙ্গনে আসা উচিত নয় বলে বিশ্বাস করেন তিনি। আবিদা বলেন, 'এখন অনেককেই কাজ করতে দেখি, কিন্তু দেখা যায় ফিনিশিং অতটা ভালো হয় না। কিছু নতুন নতুন লোক কাজ করছে কিন্তু তাদের কাজ এখনো বেশি ভালো হয় না। এর কারণে মার্কেট নষ্ট হচ্ছে। ভালো আর্টিস্ট বের হয়ে আসুক সেটা আমরা চাই।'
বর্তমানে সময়ে মানুষ কোনোভাবে শিখেই আয়ের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে, এটি নিয়ে আবিদার তীব্র আক্ষেপ রয়েছে। নতুন শিল্পীদের ভালোভাবে কাজ শিখে অর্ডার নিয়ে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
ভালোভাবে শেখার পর কেউ যদি কাজ করতে শুরু করে, তবে সে অন্যকেও ভালোভাবে শেখাতে পারবে বলে বিশ্বাস করেন আবিদা। দিনাজপুরের নারীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে হাতে ধরে কাজ শেখান আবিদা সুলতানা। তিনি বলেন, 'আমি বিভিন্ন ইন্সটিটিউটে ক্লাস নেই। ইম্পেরিয়াল হোটেল ম্যানেজমেন্টে আমি ক্লাস নিয়েছি। প্রফেশনাল কুকিং একাডেমিতে আমি ক্লাস নেই।'
ফুড কার্ভিং শিল্পে প্রয়োজন ভীষণ ধৈর্য। তাই নবীনদের ধৈর্য ধরে কাজ করে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন ফারদিন খান। বর্তমানে ঢাকাসহ ১৮টি জেলায় কাজ করেন তিনি। তার স্বপ্ন বাংলাদেশের ৬৪ জেলাতেই যেন তিনি হাতের কাজ ছড়িয়ে দিতে পারেন। ফুড কার্ভিং শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে গিয়ে প্রতিষ্ঠান তৈরি করা সোনিয়ার স্বপ্ন। একইভাবে, পরিশ্রমে বরাবরই বিশ্বাসী জলিল রহমান। 'তুমি যদি পরিশ্রম করো, তবে অবশ্যই সাফল্য লাভ করতে পারবে'- বাবার দেওয়া এই উপদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে এগিয়ে যাচ্ছেন তিনি।