৭০ বছর পর বন্ধ হয়ে যাচ্ছে লন্ডনের ঐতিহাসিক 'ইন্ডিয়া ক্লাব' রেস্টুরেন্ট
বাইরে থেকে জায়গাটির তেমন কোনো বিশেষত্ব নেই; আপনি যদি গিয়ে এটিকে না খোঁজেন তাহলে হয়তো চোখেই পড়বে না। কিন্তু তবুও গত ৭০ বছরেরও বেশি সময় ধরে লন্ডনে বসবাসরত বহু ভারতীয়র পদার্পণ এখানে; বিদেশ-বিভূঁইয়ে পরিচিত মুখ ও পরিচিত স্বাদের আশায় তারা এই জায়গায় আসেন।
জায়গাটির নাম ইন্ডিয়া ক্লাব। সেন্ট্রাল লন্ডনের ব্যস্ততম এক সড়কের পাশে হোটেল স্ট্র্যান্ড কন্টিনেন্টালের ভেতরে অবস্থিত লাউঞ্জ-কাম-রেস্টুরেন্টটি সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে লন্ডনে বসবাসরত এই দক্ষিণ এশীয় সম্প্রদায়ের জন্য ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান হিসেবে বিবেচিত।
১৯৫০-এর দশকে ভারতীয় অভিবাসী সম্প্রদায়ের জন্য দেখাসাক্ষাৎ ও যোগাযোগের একটি কেন্দ্র হিসেবে ইন্ডিয়া ক্লাব প্রতিষ্ঠা করা হয়। কিন্তু এখন লন্ডনের বুকে দরজা বন্ধ হতে চলেছে ইন্ডিয়া ক্লাবের; যে ভবনে এটি অবস্থিত তার মালিকেরা ভবনটির একাংশ ভেঙে আধুনিক হোটেল নির্মাণ করতে চাইছেন।
ইন্ডিয়া ক্লাবের পৃষ্ঠপোষকদের অনেকেই জানিয়েছেন, রেস্টুরেন্টটি বন্ধ করে দেওয়ার খবরে তারা ব্যথিত এবং তারা মনে করেন, ইন্ডিয়া ক্লাব বন্ধ করে দিলে নগরীর দীর্ঘদিনের একটি ঐতিহ্য বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
আসলে অনেকদিন ধরেই এই রেস্টুরেন্টটি বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। বছর দুয়েক আগে রেস্টুরেন্টের মালিক ইয়ডগার মার্কার ও তার মেয়ে ফিরোজা ''সেভ ইন্ডিয়া ক্লাব' আন্দোলনের মাধ্যমে রেস্টুরেন্টটি টিকিয়ে রাখার পক্ষে হাজারো লোকের স্বাক্ষর আদায়ের পর এটি ভেঙে দেওয়া প্রতিরোধে সক্ষম হন। কিন্তু গত সপ্তাহে তারা গণমাধ্যমকে জানিয়ে দিয়েছেন, আগামী ১৭ সেপ্টেম্বরের পর থেকে বন্ধ হয়ে যাবে ইন্ডিয়া ক্লাবের দরজা।
ইতিহাসের নানা ঘটনার সাক্ষী এই ক্লাবটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার খবরে অনেকেই হতবাক। হোটেল স্ট্র্যান্ড কন্টিনেন্টালের দ্বিতীয় তলায় অবস্থিত ইন্ডিয়া ক্লাব রেস্টুরেন্টের গোড়াপত্তন করেছিলেন 'ইন্ডিয়া লীগ' নামক ভারতের স্বাধীনতাকামী একটি সংগঠনের সদস্যরা। এই সংগঠনটি ১৯০০'র দশকে ভারতের স্বাধীনতার দাবিতে ক্যাম্পেইন করেছিল। বলা হয়ে থাকে, ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ছিলেন ইন্ডিয়া ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের একজন। পরবর্তীতে ১৯৯০'র দশকে মার্কার পরিবার এই সম্পত্তিটি ইজারা হিসেবে কিনে নেয়।
গণমাধ্যমের বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, শুরুর দিকে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীরা ইন্ডিয়া ক্লাবকে তাদের আলোচনা-বৈঠকের স্থান হিসেবে ব্যবহার করতো। কিন্তু পরবর্তীতে এটি এই দক্ষিণ এশীয় সম্প্রদায়ের আড্ডা, খাওয়াদাওয়া ও অনুষ্ঠান আয়োজনের কেন্দ্র হয়ে ওঠে।
১৯৫৩ সালে যুক্তরাজ্যে পাড়ি দেওয়ার পর থেকে নিয়মিত এই ক্লাবে যেতেন ইতিহাসবিদ কুসুম ভারগামা। তিনি বলেন, "১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে এটাই ছিল একমাত্র জায়গা যেখানে ভারতীয়রা স্বদেশী ভাষায় কথা বলার মতো লোকজনের সঙ্গে মিশতে পারতো এবং স্বদেশের খাবারের স্বাদ উপভোগ করতে পারতো।"
"বিদেশের নতুন জীবনে আমাদের একাকীত্ব কিছুটা হলেও দূর করতে সাহায্য করেছে ইন্ডিয়া ক্লাব", যোগ করেন কুসুম। তিনি আরও জানান, ভারতীয়রা প্রায়ই জন্মদিন, বিয়ে বা দিওয়ালির মতো উৎসব উদযাপনের জন্য ইন্ডিয়া ক্লাবে জড়ো হতো।
পূর্ব আফ্রিকায় ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে বড় হওয়া কুসুম ভারগামা পরবর্তীতে উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাজ্যে চলে আসেন। স্বাধীনতা লাভের পরবর্তী কয়েক বছরে ভারত থেকেও বহু মানুষ যুক্তরাজ্যে চলে এসেছিলেন, কিন্তু সেসময় লন্ডনে প্রবাসী ভারতীয়দের জন্য কোনো সাংস্কৃতিক স্থাপনা ছিল না বললেই চলে।
প্রবাসী ভারতীয় সম্প্রদায়ের জন্য সেই শূন্যস্থান পূরণ করেছে ইন্ডিয়া ক্লাব। ভারতীয়দের মধ্যে পরিচিত ও জনপ্রিয় খাবারগুলো এখানে পরিবেশন করা হতো; যেমন- দোসা, সাম্বার, বাটার চিকেন এবং পাকোড়ার মতো তেলেভাজা ভারতীয় স্ট্রিট ফুড; সেইসঙ্গে কফি আর মাসালা চা তো ছিলই।
এমনকি ইন্ডিয়া ক্লাবের অন্দরসজ্জাও করা হয়েছিল স্বাধীনতা-পূর্ব ভারতের কফিশপগুলোর আদলে, যেখানে মানুষ চা-সিগারেট খেতে খেতে সংস্কৃতি ও রাজনীতি নিয়ে আলাপ করতো ঘণ্টার পর ঘন্টা। আজ থেকে ৭০ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হলেও, ক্লাবের ঝাড়বাতি, ফরমিকা টেবিল এবং পেছনে হেলানের অংশটি খাড়া-ধরনের চেয়ারগুলো এখনও অপরিবর্তিত রয়েছে।
এছাড়াও, ক্লাবের সমৃদ্ধ সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের চিহ্ন হিসেবে, যেসব বিখ্যাত ভারতীয় ও ব্রিটিশ ব্যক্তিত্বরা বিগত বছরগুলোতে এই ক্লাব পরিদর্শন করেছেন, তাদের প্রতিকৃতি ক্লাবের দেওয়ালে টানানো রয়েছে। এদের মধ্যে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে প্রথম ভারতীয় এমপি দাদাভাই নওরোজী এবং দার্শনিক বারট্রান্ড রাসেলের নাম উল্লেখযোগ্য।
কালের পরিক্রমায় এই রেস্টুরেন্টটি শুধুমাত্র অভিবাসীদের কাছেই নয়, বরং সাংবাদিক থেকে শুরু করে বিভিন্ন ইন্ডিয়া-ব্রিটিশ গ্রুপ ও এসোসিয়েশনসহ সকল শ্রেণীর মানুষের কাছেই একটি জনপ্রিয় পাব হয়ে ওঠে।
সাংবাদিক ও লেখক শর্বাণী বসু ১৯৮০'র দশকে অন্যান্য সাংবাদিকদের সঙ্গে এই রেস্টুরেন্টে যাওয়ার স্মৃতিচারণ করে বলেন, "সেন্ট্রাল লন্ডনে ইন্ডিয়া ক্লাবই ছিল একমাত্র জায়গা যেখানে সুলভ মূল্যে ভারতীয় খাবার পাওয়া যেত।" তিনি ইন্ডিয়া ক্লাবকে এ শহরের 'লুকানো সম্পদ' বলে অভিহিত করেন এবং জানান, ভারত থেকে আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুবান্ধব এলে তিনি তাদেরকে ইন্ডিয়া ক্লাবে নিয়ে যান।
মোটিভেশনাল স্পিকার স্মিতা থারুর বলেন, তার বাবা চন্দন থারুর ছিলেন ইন্ডিয়া ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের মধ্যে একজন, এবং তিনি এই জায়গা সম্পর্কে অনেক মজার ঘটনা জানতেন। অবিবাহিত থাকাকালীন তার বাবা প্রায়ই এই ক্লাবে যেতেন এবং তার বলা একটা মজার গল্প ছিল এরকম- বারের এক নারী কর্মী যেসব পুরুষকে দেখে মাতাল মনে করতেন, তাদেরকে তিনি পানীয় পরিবেশন করতে চাইতেন না।"
কয়েক বছর পরে যখন তার বাবা তার সঙ্গে দেখা করতে লন্ডনে আসেন, তখন তাকে ক্লাবে নিয়ে যান, এরপর থেকে স্মিতাও ইন্ডিয়া ক্লাবের নিয়মিত দর্শনার্থীদের একজন হয়ে ওঠেন। "বাবার মৃত্যুর পর আমি ইন্ডিয়া ক্লাবে তার সম্মানে একটা ইভেন্ট আয়োজন করেছিলাম। আমার স্বামীর ৫০তম জন্মদিনও এখানে উদযাপন করেছিলাম। আমাদের হৃদয়ে ইন্ডিয়ান ক্লাবের জন্য একটা বিশেষ জায়গা আছে, তাই এটা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে দেখে খারাপ লাগছে। এখন শুধু এর স্মৃতিগুলোই রয়ে যাবে।"