ভ্রমণের স্মৃতিচিহ্ন, কাগুজে বোর্ডিং পাসের দিন কি শেষ হতে চললো?
অনেক বিমানযাত্রীর কাছেই এয়ারলাইন থেকে দেওয়া কাগজের বোর্ডিং পাস কেবলই বিমানের আসন খুঁজে বের করার নির্দেশিকা নয়; বরং তারচেয়ে আরো বেশি কিছু।
কারো কাছে হয়তো তা বিদেশে নতুন জীবন শুরু করার উদ্দেশ্যে চড়া ফ্লাইটের মূল্যবান স্মৃতি, প্রিয়জনের সাথে ভ্রমণের স্মারক কিংবা কারো কাছে হয়তো একটি ভালো বুক মার্ক।
এমিরেটস এয়ারলাইনস এই বছরের শুরুর দিকে ঘোষণা করে যে, আপাতত কিছু গ্রাহকের জন্য তারা কাগুজে বোর্ডিং কার্ড বাদ দিয়ে ডিজিটাল পাস নিয়ে আসবে। অন্য এয়ারলাইনগুলোও একই পথ অনুসরণ করার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
এটি কাগুজে বোর্ডিং পাসের শেষের শুরু কিনা তা এখনো বলা যাচ্ছে না। তবে এমন শঙ্কার মধ্যেই সিএনএন-এর কাছে অনেক পাঠকই লিখেছেন, কেন তারা পুরনো বোর্ডিং পাস সংরক্ষণ করেন। সেগুলোর পেছনের গল্পও তারা জানিয়েছেন।
কয়েক দশক ধরে কাগজের বোর্ডিং পাস কীভাবে পরিবর্তিত হয়েছে এবং কেন এত মানুষ ৫০ বছর ধরে সেগুলো সংরক্ষণ করে যাচ্ছেন, তা তুলে ধরেছে সিএনএন।
১৯৫০ এর দশক: টিকেট জ্যাকেট
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ১৯৬০ এর দশকের শেষভাগ কিংবা ১৯৭০ এর দশকের শুরুর দিকে ফ্লাইটের টিকেট রাখা হতো একটি খামে। যাকে টিকেট জ্যাকেট বা টিকেট ওয়ালেট বলা হতো। ভ্রমণ শিল্প বিশ্লেষক হেনরি এইচ হার্টভেল্ট বলেন, কিছু এয়ারলাইন্সের টিকেট জ্যাকেট বোর্ডিং কার্ডের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ বড় হতো।
বিমান সংস্থার কর্মচারীরা জ্যাকেটের বাইরে যাত্রীর নাম, ফ্লাইট নাম্বার এবং বিমানবন্দরের তিন অক্ষরের কোড নাম্বার লিখতেন। বিমানের ইতিহাসবিদ ডেভিড এইচ. স্ট্রিংগার বলেন, তখন বিমানের আসন সাধারণত পূর্ব নির্ধারিত ছিল না। যাত্রীরা বিমানে প্রবেশ করে যে কোনো একটি আসন বেছে নিতেন। তাই বোর্ডিং কার্ডে কোনো আসন নম্বর দেওয়া থাকতো না।
১৯৬০ এর দশক: আসন নির্ধারণ ও স্টিকি ট্যাব
১৯৬০ এর দশকে এয়ারলাইনগুলোর বহরে বড় বড় বিমান যুক্ত হয়। তখন আসন নির্ধারণ করাও শুরু হয়। স্ট্রিংগার বলেন, প্রত্যেক বিমানের জন্য আলাদা আলাদা চার্ট থাকত এয়ারলাইন্সগুলোর। সেখানে প্রতি সিটের পৃথক স্টিকি ট্যাব থাকত। যখন যাত্রী তার পছন্দের সিট বেছে নিতেন তখন আসন নাম্বারযুক্ত স্টিকি ট্যাব চার্ট থেকে উঠিয়ে টিকেট জ্যাকেটে বসিয়ে দেওয়া হতো।
১৯৬০ এর দশক: পৃথক বোর্ডিং পাস
এই সময় টিকেট জ্যাকেট না দিয়ে শুধু বোর্ডিং পাস দেওয়া জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। স্ট্রিংগার বলেন, এসব বোর্ডিং পাসের সঙ্গে আলাদা ছোট অংশ যুক্ত থাকত। যা বিমানবালারা বিমানে ওঠার সময় সংগ্রহ করে নিতেন।
১৯৭০ এর দশক: কম্পিউটারে প্রিন্ট হওয়া বোর্ডিং পাস
১৯৭০ এর দশকের মাঝামাঝি থেকে টিকেটিং পদ্ধতিতে পরিবর্তন আসে। এসময় কম্পিউটারের মাধ্যমে টিকেট প্রিন্ট করার ব্যবস্থা চালু হয়। হার্টভেল্ট বলেন, এই সুবিধার কারণে এয়ারলাইনগুলো শহরে তাদের বিভিন্ন অফিসে এবং ট্রাভেল এজেন্সিরাও সহজে বোর্ডিং পাস ছাপাতে পারতেন। এসময় বোর্ডিং পাসের ধরনে কিছুটা পরিবর্তন আসে। কারণ সেগুলোকে কম্পিউটারের মাধ্যমে প্রিন্ট করানোর মতো করে ডিজাইন করা হয়েছিল।
সাউথওয়েস্ট-এর প্লাস্টিকের বোর্ডিং পাস
প্রায় ৩০ বছর সাউথওয়েস্ট এয়ারলাইন প্লাস্টিকের তৈরি বোর্ডিং পাস দিত যাত্রীদের। এই বিমান সংস্থা কখনো আসন নাম্বার নির্ধারণ করে দিত না। ফলে বোর্ডিং পাসে আসন নাম্বার প্রিন্ট করার প্রয়োজন ছিল না ।
যাত্রীরা নাম্বার সম্বলিত রঙিন প্লাস্টিকের বোর্ডিং পাস পছন্দ করে নিতেন। এতে করে বহির্গমন গেইটে সাউথওয়েস্টের যাত্রীদের সহজে চিহ্নিত করা যেত এবং তাদের বোর্ডিং দ্রুততর সময়ে হত। যাত্রীরা বিমানে প্রবেশ করার সময় বোর্ডিং পাস নিয়ে নেওয়া হতো।
তবে ২০০১ সালে টুইন টাওয়ারে হামলার ঘটনার পর নেওয়া বাড়তি নিরাপত্তার কারণে সাউথওয়েস্ট এয়ারলাইনকে ধীরে ধীরে তাদের প্লাস্টিকের বোর্ডিং পাস বন্ধ করে দিতে হয়।
১৯৮০ এর দশক: একই কাগজে টিকেট ও বোর্ডিং পাস
১৯৮৩ সালে, পিছনে একটি ম্যাগনেটিক স্ট্রাইপসহ টিকেট চালু করা হয়েছিল। ম্যাগনেটিক স্ট্রাইপের মাধ্যমে টিকেটের তথ্য ইলেকট্রনিকভাবে টিকিটেই সংরক্ষণ করা যেত। একই সাথে তা বোর্ডিং পাসের কাজও করতো।
ম্যাগনেটিক স্ট্রাইপ বোর্ডিং পাসের জন্য বিমানবন্দরে একটি চেক-ইন ডেস্ক বা কিয়স্কের ভিতরে অবস্থিত বিশেষ প্রিন্টার প্রয়োজন হতো। ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশন (আইএটিএ) এর তথ্য অনুযায়ী, এটির জন্য পৃথক কাগজেরও প্রয়োজন হত।
১৯৯০ এর দশক: বারকোডের আগমন
১৯৯০ এর দশকে, কিছু এয়ারলাইন স্ক্যানযোগ্য বারকোড নিয়ে আসে। একমাত্রিক এসব বারকোডে কেবল উলম্ব রেখা থাকতো। ২০০৫ সালে আইএটিএ দ্বি-মাত্রিক বারকোডের জন্য একটি মানদণ্ড ঠিক করে দেয়। যা আরও জটিল প্যাটার্ন ব্যবহার করে আরও তথ্য ধারণ করতে সক্ষম।
১৯৯০ এর দশক: ই-টিকেটিং ও অনলাইন চেক-ইন
প্রথম ই-টিকেট ইস্যু করা হয় ১৯৯৪ সালে। ১৯৯৭ সালেই ই-টিকেটিং এর জন্য মানদণ্ড ঠিক করে দেয় আইএটিএ। ২০০৮ সালে আইএটিএ ঘোষণা দেয় যে, শতভাগ ই-টিকেটিংয়ের যুগে প্রবেশ করেছে এয়ারলাইনগুলো।
১৯৯০ এর দশকের শেষভাগে যাত্রীরা বাসাতেই চেক-ইন করে বোর্ডিং পাস প্রিন্ট করে নিতে পারতেন।
বিশ্লেষক হার্টভেল্ট বলেন, অনেক বছর ধরে বোর্ডিং পাসের আকার ছিল এয়ারলাইনের টিকেটের সমান। কিন্তু ঘরের প্রিন্টারের জন্য উপযুক্ত করতে পরে ফরম্যাট ও ডিজাইনের পরিবর্তন আনা হয়েছে।
একবিংশ শতাব্দী: কাগজবিহীন বোর্ডিং
২০০৭ সালে আন্তর্জাতিক এয়ারলাইনগুলো মোবাইলের মাধ্যমে চেক-ইন করার পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করে। একই বছর অ্যাপল বাজারে তাদের প্রথম স্মার্টফোন নিয়ে আসে। ২০০৮ সালে কাগজবিহীন মোবাইল পাসের বিষয়ে মানদণ্ড ঠিক করা হয়।
জুনিপার রিসার্চের প্রযুক্তি শিল্প বিশ্লেষকরা জানান, ২০২৩ সালে ৪.৬ বিলিয়নের বেশি বোর্ডি কার্ড ইস্যু করা হতে পারে। তারমধ্যে ৫৩ শতাংশ হবে মোবাইলে। ২০২৭ সালে তা ৭৫ শতাংশে গিয়ে দাঁড়াবে বলে তাদের অনুমান।
আগামীতে কি আসছে?
এমিরেটস এয়ারলাইনস এই বছরের শুরুর দিকে ঘোষণা করে যে, আপাতত কিছু গ্রাহকের জন্য তারা কাগুজে বোর্ডিং কার্ড বাদ দিয়ে ডিজিটাল পাস নিয়ে আসবে। তাহলে এটাই কি কাগুজে বোর্ডিং পাসের শেষের শুরু?
ভ্রমণ উপদেষ্টা জন ডেকের কিন্তু এমনটাই মনে করেন। তিনি বলেন, প্রত্যেক এয়ারলাইন কাগুজে টিকেট থেকে বায়োমেট্রিকে দিকে ঝুঁকবে। অর্থাৎ তখন বোর্ডিং পাসের কোনো প্রয়োজনই হবে না।
স্মৃতিচিহ্ন কিংবা বিশেষ ভ্রমণের শরীরী প্রমাণ
যারা স্মৃতি হিসেবে বোর্ডিং পাস সংরক্ষণ করেন, সম্পূর্ণ ডিজিটালাইজেশনের ধারণা তাদের হতাশ করেছে। হার্টভেল্ট বলেন, কিছু সময় একটি ফ্লাইট কেবল পাখাযুক্ত যানে চড়া হিসেবে সীমাবদ্ধ থাকে না। কিছু কিছু যাত্রা বিশেষও হয়ে থাকে। বোর্ডিং পাস এসব যাত্রার স্মৃতি হিসেবে থেকে যায়।
সিএনএন এর অনেক পাঠক বোর্ডিং পাস জমানো এবং তার পেছনের গল্পের কথা তুলে ধরেন।
ব্রায়ান বায়ুম নামের এক পাঠক জানান, ১৯৭১ সালে তিনি প্রথম বিমানে চড়েন। ১,০০০ এর বেশি বার তিনি বিমান ভ্রমণ করেছেন এবং সেগুলোর বোর্ডিং পাস তার কাছে সংরক্ষিত আছে।
তিনি বলেন, ডিসি-৩, ইলেক্ট্রা, ৭০৭ এবং কানকোর্ড এর মতো বিমান এখন ব্যবহৃত হয় না। সেগুলোতে চড়ার প্রমাণ তার কাছে থাকা ছোট্ট বোর্ডিং পাসগুলো। আর এ বিষয়টি তাকে পুলকিত করে।
২৫ বছর আগে ভারতের মুম্বাই থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান রাহুল পুন্নিয়াহ। বিদেশে নতুন জীবন শুরু করার স্মৃতি হিসেবে সেদিনের বোর্ডিং পাস তিনি এখনো সংরক্ষণ করে রেখেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকোর সুজেন ওয়েকার বলেন, টুইন টাওয়ারে হামলার দিনের ফ্লাইটের বোর্ডিং পাস আমি এখনো সংরক্ষণ করে রেখেছি। ইতালির মিলান থেকে সান ফ্রান্সিসেকো যাওয়ার কথা ছিল আমার। বিমানটি নির্দিষ্ট সময়ে ছাড়ে কিন্তু দুর্ঘটনার খবরে যুক্তরাজ্যের ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় তা আবারও ইতালিতে ফিরে আসে।