আম্মার নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়, হাঁটতে চায়, এখন হাঁটুতে ভর দিয়ে চলাই কষ্ট
ঠিকমতো হাঁটাচলা করতে পারলে আম্মারও আজ কলেজে যেত যেমন তার যমজ ভাই হানজালা যায়। সমস্যা তৈরি হয়েছিল জন্মের সময়ই। মাথায় কোনোভাবে আঘাত পেয়ে থাকবে আম্মার কিন্তু বুঝতে পারেনি ডাক্তারও। অস্বাভাবিকতা যা ছিল তা হলো হানজালা যতটা হাত-পা ছুঁড়েছে, কান্না করেছে, আম্মার ততটা করেনি। আম্মারের মাথা ওপর দিকে স্থির হয়ে ছিল, হাত ছিল জড়োসড়ো হয়ে। সবাই ভেবেছিল ভালোমতো তেল মালিশ করলে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু যখন ছয় মাস গেল, হানজালা বসতে পারল, আম্মার পারল না। নয় মাসের মাথায় হানজালা হাঁটতে শিখে গেল, আম্মারের কোনো উন্নতি নেই।
চিন্তিত হয়ে পড়লেন বাবা আমিনুল ইসলাম ও মা জরিনা মরিয়ম সুমী। রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের চিকিৎসক এবি সিদ্দিকীর শরণাপন্ন হলেন। তিনি আম্মারের হাত-পায়ের এক্সরে করালেন। ভিটামিন, ক্যালসিয়াম ও মস্তিষ্কের সচলতা বৃদ্ধির ওষুধ ভিটামিন, নিউরোলেপের মতো ওষুধ দিলেন। প্রায় দেড় বছর ওষুধগুলো নিয়মিত খাওয়ানোর পর আম্মারের মাথা স্বাভাবিক হলো, হাত ধরে তাকে অল্পস্বল্প হাঁটানোও যেত। তবে হাঁটত সে পায়ের পাতার ওপর ভর করে নয়, আঙুলের ওপর ভর করে। এর মধ্যে দুই ভাইয়েরই দুই বার নিউমোনিয়া ও তীব্র ডায়রিয়া হয়ে গেল। সেরেও উঠল দু'জনে কিন্তু পায়ের জোর বাড়ল না। তখন প্রতিবেশী একজনের পরামর্শে আম্মারকে নিয়ে যাওয়া হলো সাভারের সিআরপিতে। তাকে স্ট্যান্ডিং ফ্রেমে করে দাঁড় করানোর ও বিশেষ রকমের জুতা পরিয়ে হাঁটানোর পরামর্শ দেওয়া হলো। কিন্তু দাঁড় করাতে গেলেই আম্মার চিৎকার জুড়ে দিত। মাটিতে গর্ত খুঁড়ে তাতে আম্মারকে দাঁড় করিয়ে রাখার চেষ্টাও করা হয়েছিল।
যখন কিছুতেই ফল মিলল না নীলফামারীর লেপ্রসি মিশনের কথা জানতে পারলেন আমিনুল। ততদিনে আম্মারের বয়স আট পেরিয়ে গেছে। নীলফামারীর লেপ্রসি মিশনে প্রতি শীতকালে জার্মানি থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দল আসে, তাদের মধ্যে শল্যচিকিৎসকও থাকেন। আম্মারকে নিয়ে ২০১৩ সালের শীতে গেলেন নীলফামারী। ডাক্তার দেখে বললেন, বয়স ১৫ হলে তবে অস্ত্রোপচার করা যাবে, তার আগে করালে ফল উল্টো হয়ে যেতে পারে। দিনে দিনে আম্মারের ওজন বাড়ে কিন্তু পা দুটি আরো সরু ও দুর্বল হয়ে যেতে থাকে।
পরের বছর নাটোর খাদ্যগুদামের এক কর্মকর্তা নজরুল ইসলামের মাধ্যমে নতুন এক জায়গার সন্ধান পেলেন আমিনুল। সেটি মেহেরপুরের আমঝুপিতে। সেখানে 'ইমপ্যাক্ট' নামের এক বেসরকারি সংস্থা আছে যারা 'ডিজঅ্যাবিলিটি' নিয়ে কাজ করে। সেখানেও শীতকালীন স্বাস্থ্য ক্যাম্পে ইংল্যান্ড থেকে শল্য চিকিৎসক আসেন। আমিনুল ও সুমী দম্পতি আম্মারকে নিয়ে গেলেন আমঝুপিতে। ডাক্তার দেখেশুনে আগের কথাই বললেন, ১৫ বছরের আগে কোনো অস্ত্রোপচার করা যাবে না।
আম্মার আবার ফিরল রাজশাহীতে বাবার কর্মস্থলে। আমিনুল একজন বীমা কর্মী। আম্মারের জন্মসাল ২০০৫ এ তিনি ১২০০ থেকে ১৩০০ টাকা রোজগার করতে পারতেন মাসে। থাকতেন রাজশাহী শহরের এক ভাড়া বাড়িতে। শ্বশুরবাড়ি কাছে হওয়াতে কিছু সুবিধা হতো। নানা-নানী, মামা, খালা সময় পেলে আম্মারের সাহায্যে এগিয়ে আসতেন। কিন্তু আম্মারের অবস্থার কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না দেখে সকলেই অস্থির হয়ে উঠছিলেন। এর মধ্যে আমিনুল জানলেন নাটোরের জনতা হাসপাতালে ঢাকা থেকে নিউরোমেডিসিনের এক চিকিৎসক এসকে ঘোষ শুক্রবারে চেম্বার করেন। আম্মারকে নিয়ে যাওয়া হলো ড. ঘোষের কাছে। তিনি এমআরআই করতে দিলেন। রিপোর্ট দেখে ড. ঘোষ বললেন, যা ভেবেছিলাম তা-ই। কি ভেবেছিলেন ড. ঘোষ? উৎসুক আম্মারের বাবা-মা-নানাসহ আর সবাই। ড. ঘোষ ব্যাখ্যা করে বললেন, আম্মারের ব্রেইনের একটা অংশ ড্যামেজ (অকেজো) হয়ে গেছে, ওই অংশটাই পায়ের পুষ্টি ও চলাচলের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়। এখন তাহলে উপায়?
চিকিৎসক জানালেন, দেরি হয়ে গেছে অনেক। জন্মের পরপরই তাকে পর্যাপ্ত পরিমাণে অক্সিজেন দেয়া হলে সেরে যেত আপনা থেকে। এছাড়া ৫ বছর পর্যন্ত সময় ছিল, তার মধ্যে চিকিৎসা দেয়া গেলেও সেরে উঠত আম্মার।
আমিনুলের মাথায় বাজ পড়ল। এতোদিন ছোটাছুটি করছেন, এই কথাটা কেউ বলেনি। পনের বছর পার করার পরামর্শই দিয়েছেন ডাক্তাররা, এমনকি বিদেশি ডাক্তাররাও। আম্মার এখন বারোয় পড়েছে। ডা. ঘোষ অবশ্য আশা জোগালেন এই বলে যে, 'তারা যেন একবার ভারতের বেঙ্গালুরুতে অবস্থিত নিহমান্সে ( ন্যাশনাল ইনস্টিটিউউ অব মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড নিউরো সায়েন্সেস) যায় এবং পরামর্শ নেয়।' আমিনুলকে আরো বললেন, এখন থেকে আম্মারের সকল বেলার সব কাজের ভিডিও করে রাখবেন মানে যখন ব্রাশ করে, গোসল করে, যেভাবে ঘুমায় ইত্যাদি।'
আমিনুল ছেলেকে নিয়ে ঢাকায় এলেন শেষ চেষ্টা হিসাবে। নামী অর্থোপেডিক সার্জন ডা. কৃষ্নপ্রিয় দাসকে দেখানোর সময় নিলেন। গ্রিন ডায়ানস্টিক সেন্টারে তিনি চেম্বার করেন। ডা. দাস ভালোমতো পরীক্ষা করে বললেন, এখন দুটি মাত্র উপায় আছে- পা হাঁটু পর্যন্ত কেটে ফেলে কৃত্রিম পা লাগিয়ে দেওয়া অথবা পায়ে অস্ত্রোপচার করে নার্ভগুলো (উদ্দীপনা পরিবাহী তন্তু) সক্রিয় করা। দুটি প্রক্রিয়াই ব্যয়বহুল বিশেষ করে দ্বিতীয়টি। ডা. দাসেরও অভিমত, নিহমান্সেই এর ভালো চিকিৎসা হওয়া সম্ভব।
আমিনুল এবার টাকা সংগ্রহ অভিযানে নামলেন। জাগরণী নামের এক বেসরকারী সংস্থা এবং ইসলামী ব্যাংক থেকে লোন নিলেন। আম্মারের মামাও কিছু টাকা দিলেন। সবমিলিয়ে ২ লাখ টাকা নিয়ে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের গোড়ায় গিয়ে পৌঁছালেন বেঙ্গালুরুতে। ২০ রুপিতে টিকিট কেটে লাইনে দাঁড়ালেন। ডাক পড়লে ভিতরে গিয়ে একজন থেকে আরেকজন তারপর আরেকজন সবমিলিয়ে তিনজন ডাক্তার দেখলেন আম্মারকে। শেষে সকলে মিলে রায় দিলেন নিউরোলজিস্ট ডা. দিবিয়া রঞ্জিতকে দেখানো দরকার। ডা. দিবিয়াকে দেখাতে আরো ১০ রুপির টিকিট কাটতে হলো। দিবিয়ার সহকারী প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে কেস স্টাডি নিলেন সেসঙ্গে গোসল করা, ঘুমানোর ভিডিও ক্লিপগুলোও দেখলেন। দিবিয়া নতুন এমআরআই (ম্যাগনেটিক রেজনেন্স ইমেজেস) করে আবার তার কাছে আসতে বললেন।
এমআরআইয়ের জন্য নাম লেখাতে গিয়ে আমিনুল দেখলেন তার আগে আরো অনেকের নাম লেখানো হয়ে গেছে। তিনি তারিখ পেলেন এপ্রিলের শেষ দিকে। এতদিন ভারতে থাকতে খরচ যেমন হবে চাকুরিতেও সমস্যা দেখা দিবে। তিনি ডা. দিবিয়ার সঙ্গে দেখা করে সাহায্য চাইলেন। দিবিয়া বললেন, 'আপনার চেয়েও অধিক সমস্যাগ্রস্ত আছেন অনেকে। তাই কাউকে ডিঙিয়ে গেলে তার প্রতি অবিচার করা হবে।'
আমিনুল ব্যাপারটি বুঝতে পেরে দেশে ফিরে এলেন। এপ্রিল মাসে আবার গেলেন। দিবিয়া রিপোর্ট দেখে বললেন, 'হ্যা কৃত্রিম পা লাগানো যেতে পারে অথবা নার্ভগুলো সচল করার জন্য অস্ত্রোপচার করা যেতে পারে। কোনটা করাবেন সিদ্ধান্ত নিয়ে আসুন। ১২ লাখ টাকার বেশি খরচ হবে। তাছাড়া আপনাদের একটা বড় সময় এখানে অবস্থান করতে হবে, তার খরচও যোগ করুন।'
আমিনুল টাকার ভাবনা মাথায় নিয়ে দেশে ফিরলেন। তারপর এলো করোনাকাল। আমিনুলরা শহরের ভাড়া বাড়ি ছেড়ে নাটোরে নিজেদের গ্রামের বাড়ি ফিরে গেলেন। আমিনুলের বেতন এই এতদিনে ২৫০০০ টাকায় দাঁড়িয়েছে। কিস্তিতে লোন শোধ করতে গিয়ে জমে না কিছুই। করোনা চলাকালে রোজগার কোনো কোনো মাসে বেশ কমে যায়। একবার কাছের একজনকে কষ্টের কথা বললেন। তিনি নিজে থেকেই কিছু আর্থিক সহযোগিতার আশ্বাস দিলেন। পরে আমিনুল তাকে ফোন করলে ব্যক্তিটি রেগে গিয়ে বললেন, 'ছেলেকে নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছেন? ধান্দাবাজি ছাড়ুন।' আমিনুল সেদিন আর কান্না ধরে রাখতে পারেননি। আমিনুল বলছিলেন, 'স্বচ্ছলতার মুখ কোনোদিন দেখিনি। কোনোমতে সংসার টানি, কিস্তি শোধ করি। আম্মারের জন্মের সময় আমার বয়স ছিল ২৩, আম্মারের মায়ের ২১। এখন আমার চল্লিশ পার হতে চলেছে। ছেলেটার একটা গতি না করে যেতে পারলে মরেও শান্তি পাব না। আম্মারের মায়ের তো আর কোনো জগত নেই। আম্মারকে নিয়েই তার দিনরাত পার। হানজালা এবং তার ছোট আমির হামজারও জীবন ঘরের ভিতরই বাঁধা।'
আমিনুল বুঝতে পারছেন না ১২-১৫ লাখ টাকা কিভাবে জোগাড় করবেন? ইসলামী ব্যাংকের ঋণ প্রায় ১ লাখ টাকা শোধ করা বাকি। মুদি ও ওষুধের দোকান পাবে প্রায় ৩০ হাজার টাকা। বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনদেরও তেমন সামর্থ্য নেই যে সহযোগিতা করবে। শেষে ভেবেছেন, যদি গণমাধ্যমে আম্মারের কথা প্রচার হয়, সহৃদয় ব্যক্তিরা যদি এগিয়ে আসেন, ছেলেটা হয়তো নিজের পায়ের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়াতে পারবে।
আম্মারের মা মরিয়ম সুমী লেখাপড়া করেছিলেন কিছু। নিজের বাবার বাড়িতে খেয়েপরে ভালোই কেটে যেত। আম্মার জন্মের পর থেকেই বলতে গেলে বন্দি হয়ে পড়েছেন। নিজের শখ-আহ্লাদ বলে কিছু নেই আর। গোটা পরিবার যেন আম্মারের মতো হাঁটুতে ভর দিয়ে হাঁটছে।
হানজালা কলেজে পড়ে কিন্তু বন্ধু-বান্ধবদের কাউকে বাড়িতে আনে না। ফুটবল তার প্রিয় খেলা, মেসি প্রিয় ফুটবলার। সপ্তাহে এক-দুই দিন মাঠে যায়। বাকি দিন কলেজ থেকে ফিরে বাড়িতেই থাকে। তাদের ১০-১২টি দেশি মুরগি আছে, সেগুলোর খাবার জোগান দেয় আর আম্মারের পাশে বসে থাকে।
মরিয়ম সুমী বললেন, 'আমরা আম্মারকে বাইরে নিতে কিছু লজ্জাই পাই। লোকজন নানান প্রশ্ন করে। বলেও বসে, ছেলেটাকে চিকিৎসা করান না, কেমন মা আপনি? এই কথা কোন মা সহ্য করতে পারে! কোনো বাবা-মা কি তার ছেলের চিকিৎসা না করিয়ে বসে থাকতে পারে? আমাদের সব কিছু তো আম্মারকে ঘিরে। কম খাই, কম পরি, চাই যেন আম্মার সেরে ওঠে। ওর বাবা যখন যেখানে একটু আশার আলো দেখে সেখানেই ছুটে যায়।'
আম্মার নিজেও এখন বাইরে যেতে চায় না। হাঁটুতে ভর দিয়ে হাঁটতে কষ্ট হয়, মানুষজনও নানান কথা বলে। আগে বাবা মোটর সাইকেল বা অটোতে উঠিয়ে চুল কাটাতে নিয়ে যেত বা বাজারে নিয়ে গিয়ে দই-মিষ্টি খাওয়াত। এখন বাড়িতেই নাপিত ডেকে আনা হয়। পরিবারের সবচেয়ে ছোট সদস্য আমির হামজা। স্কুল থেকে ফেরার পথে সেও আম্মারের জন্য চকলেট না হয় কটকটি নিয়ে আসে। কিছু একটা উপহার পেলেই আম্মার খুশি হয়ে যায়, তা যতই ছোট হোক।
আম্মার কিন্তু পড়াশোনা একদম ছেড়ে দেয়নি। সে স্কুলে যায় না কিন্তু পরীক্ষা দেয়। এখন এই ১৮ বছর বয়সে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র সে। ইংলিশ তার প্রিয় বিষয়। কারণ সে ভালো হয়ে মালয়েশিয়া, জাপান বা চীনে যেতে চায়। সেখানে গিয়ে লোকজনের সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলবে। গরুর মাংস তার পছন্দ যদিও মাসে একবারের বেশি খাওয়ার সুযোগ পায় না।
আম্মারের ওজন ৬৫ কেজি। ছেলেটি হাসতে খুব ভালোবাসে। কিন্তু জীবন তাকে দুঃখের জাল ছিড়তে দেয় না। তাইতো বারান্দায় বসে বিকাল কাটাতে কাটাতে ভাবে, ভালো হলে এক দৌড়ে গাঁয়ের ওমাথায় চলে যাবে। সঙ্গে থাকবে আমির হামজা আর হানজালা। ফেরার পথে আব্বু-আম্মুর জন্য কাঁচাগোল্লা অথবা রসকদম নিয়ে আসবে।