ক্যান্সার রোগীদের জন্য পরচুলা তৈরিতে চুলদান করতে চান?
সময়টা ২০০৯ সাল। তখন সবে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়েন সীমান্ত মিত্র। চোখের সামনে ক্যান্সারে শেষ হয়ে যেতে দেখেন একজন কাছের মানুষকে। কেমোথেরাপির ফলে সেই আত্মীয়ের চুল পড়ে যায়। তখন কেমনইবা বয়স সীমান্তের! ক্ষুদে মনে প্রভাব পড়ে এই ঘটনাটির। তখন থেকেই মনের মধ্যে লালন হতে থাকে ক্যান্সার রোগীদের জন্য এমন কিছু করার কথা, যাতে তাদের মুখে হাসি ফোটানো যায়।
সীমান্তের স্বপ্ন সফল হয় ২০২০ সালে এসে। করোনা মহামারির সময় সীমান্ত ছিলেন খুলনার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। মহামারিকালে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে খানিক অবসর পেয়ে সীমান্ত সুযোগ পান তার ইচ্ছাকে বাস্তবে রূপ দিতে কাজ শুরু করার। ক্যান্সার রোগীদের মানসিকভাবে সাহস দেওয়ার জন্য তিনি বেছে নেন চুলদান করার উদ্যোগ। তৈরি করেন 'বাংলাদেশ হেয়ার ডোনেশন-ফর ক্যান্সার পেশেন্টস' নামক সংগঠন। যার মূল প্রতিপাদ্য 'লেটস বিল্ড বাংলাদেশ টুগেদার' অর্থাৎ 'চলো একসাথে গড়ি বাংলাদেশ'।
সীমান্তের কাছে এক্ষেত্রে অবশ্য অনুঘটক ছিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। মহামারির সময় ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ক্যান্সার রোগীদের চুল দান করার বিষয় নিয়ে বিভিন্ন ভিডিও নজরে আসে তার। সেসময় ভারতে অনেকেই চুল কেটে তা দিয়ে পরচুলা তৈরি করে ক্যান্সার রোগীদের কাছে পৌঁছে দিতো। এ ঘটনা দাগ কাটে সীমান্তের মনে। হন্যে হয়ে বাংলাদেশের কোনো প্রতিষ্ঠান এমন কোনো কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত কি না তা খুঁজতে শুরু করে। কিছুটা ব্যর্থই হতে হয় তাকে। কারণ সাম্প্রতিক সময়ে এ ধরনের কোনো কার্যক্রম তার নজরে পড়েনি। এরপর সীমান্ত ঠিক করেন, সামাজিক সচেতনতামূলক কার্যক্রম হিসেবে ক্যান্সার রোগীদের কাছে পরচুলা পৌঁছে দেওয়ার কার্যক্রম নিজেই শুরু করবেন।
যেভাবে শুরু
প্রথমে একা হাতেই সীমান্ত শুরু করেন সবকিছু। ফেসবুকে পেজ এবং গ্রুপ খোলার মাধ্যমে সূচনা করেন কাজের। প্রথমদিকে বন্ধুবান্ধবদের অবহিত করেন এ বিষয়ে। আবেদনে সাড়া দিয়ে এগিয়ে আসে সীমান্তের তিন বন্ধু।
সীমান্ত বলেন, 'আমরা যারা স্টুডেন্ট, তাদের স্টুডেন্ট থাকাকালীন অর্থনৈতিক অবস্থা তেমন একটা ভালো থাকে না। চাইলেই অর্থনৈতিকভাবে আরেকজনকে সাহায্য করা সবসময় সম্ভব হয় না। আমি তখন ভাবলাম, এমন একটা প্ল্যাটফর্ম যদি বানানো যায়, যেখানে অর্থ আদানপ্রদান ছাড়াই আরেকজন মানুষকে গুরুত্বপূর্ণ কাজে সাহায্য করা যেতে পারে। তাই ক্যান্সার রোগীদের জন্য শুরু করেছি এই উদ্যোগ।'
ক্যান্সার রোগীদের পরচুলা তৈরির জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল দাতা পাওয়া। প্রথমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন গ্রুপে সীমান্ত খোঁজা শুরু করেন কারা স্বেচ্ছায় ক্যান্সার রোগীদের জন্য চুলদানে আগ্রহী। ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে সংগঠনের প্রথম চুল দাতা হিসেবে এ খাতায় নাম লেখান যশোরের অধিবাসী দিশা। পরবর্তীসময়ে তিনি সংগঠনের সঙ্গেও যুক্ত করেন নিজেকে।
একে তো নতুন সংগঠন, তার ওপর চুল সংবেদনশীল বস্তু — বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই কাজটি সাধারণ মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করতে বেশ খানিকটা সময় লেগেছে সীমান্ত মিত্রের। তাই প্রথম দিকে চুলদাতাও চাহিদামাফিক পেতেন না। ২০২২ সালের মধ্যবর্তী সময় থেকে ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে সীমান্তের সংগঠন। মানুষের কাছে আস্থাও জন্মায় এবং দাতার সংখ্যাও বাড়তে থাকে।
তবে শুধু দাতা বা চুল পেলেই তো হবে না, তা প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য একটি প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন যারা পরচুলা তৈরি করবে। এবার এগিয়ে আসে উত্তরার ভেটেক্স হেয়ার নামক একটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী মিলন মাহমুদ দায়িত্ব নেন পরচুলা তৈরির, যা চলছে এখন পর্যন্ত।
চুলদানে খুশি দাতারাও
এখন পর্যন্ত ৬০ থেকে ৭০ জনের মতো চুল দান করেছেন বাংলাদেশ হেয়ার ডোনেশন-ফর ক্যান্সার পেশেন্টস-এ। সারা বাংলাদেশ থেকে সাড়া পেয়েছেন তারা। এদের মধ্যে শিক্ষার্থী, চাকরীজীবী, উদ্যোক্তাও রয়েছেন। এমনই একজন দাতা ব্রিটিশ কাউন্সিল বাংলাদেশে কর্মরত সৌরদীপ দাশগুপ্ত। পরচুলা তৈরির জন্য চুলদানের নিয়মিত অভিজ্ঞতা তার অতীতেই ছিল। প্রায় আড়াই বছর ধরে চুল লম্বা করার পর তিনি চুল দান করেছেন সীমান্তদের সংগঠনে।
সৌরদীপ বলেন, 'আমার এক বন্ধু ক্যান্সার গবেষণা নিয়ে কাজ করে। তার কাছ থেকেই প্রথম এই প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে জানতে পারি। এখানে আমার চুলদান করার অভিজ্ঞতা খুব ভালো। আমি নিজে ক্যান্সার সারভাইভারদের দেখেছি। আমার পরিবারের সবচেয়ে কাছের মানুষ এখন ক্যান্সারের সঙ্গে লড়ছে। এসময় শুধু যে শারীরিক সমস্যা হয় তা তো না — মানসিক প্রভাবও অনেক বেশি পড়ে।'
সৌরদীপ দাশগুপ্তের মতো আরেকজন দাতা ঋতিষা মৈত্র। মা ঋতুপর্ণা অধিকারীর উৎসাহে ভিকারুননিসা নূন স্কুলের সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া ঋতিষা চুলদান করে এখানে। ঋতিষা বলে, 'ছোটবেলা থেকেই আমার চুল লম্বা ছিল। তেমন একটা কাটতাম না। কিন্তু মা যখন আমাকে বলে, আমার চুল আমি ক্যান্সার রোগীদের ডোনেট করতে পারব; তখন আমার শুনে অনেক ভালো লাগে। এটা নিয়ে কিছুটা ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করি। এমন একটা উদ্যোগ গ্রহণ করে ক্যান্সার রোগীদের মনে আনন্দ জাগাতে পেরেছি, এজন্য অনেক ভালো লাগছে।'
ঋতিষার মা ঋতুপর্ণা বলেন, 'একবার বলার পরেই আমার মেয়ে এ উদ্যোগে শামিল হয়েছে। ওর জন্য আরেকজন মানুষের উপকার হচ্ছে, এটাই বা কম কীসের!'
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইম্যান অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী রামিস ফারিহাও নিজেকে যুক্ত করেছেন চুলদানের উদ্যোগের সাথে। রামিস বলেন, 'ফেসবুকের মাধ্যমে আমি তাদের সন্ধান পাই। আমি আসলে জানতাম না আর্থিকভাবে ডোনেশন ছাড়াও অন্য কিছু ডোনেট করা যায়। লম্বা চুল আমার অনেক পছন্দের ছিল। চুল কাটার সময় একটু ভয় লাগছিল কারণ এত চুল আমি আগে কখনো কাটিনি। কিন্তু কাটার পর অনেক ভালো লেগেছে। অন্তত আমি কাউকে সাহায্য করতে পারছি।'
আড়াই বছর ধরে লম্বা করার পর নেত্রকোণার স্বেচ্ছাসেবী লেরি রিছিলও দান করেছেন নিজের পুরো চুল। তিনি বলেন, 'আমি বিভিন্ন মানুষের কাছে অনেক ধরনের কথা শুনেছি। কিন্তু আমার লক্ষ্য ছিল যেভাবেই হোক আমি চুল দান করব।'
এক শর্তে চুলদান
বাংলাদেশ হেয়ার ডোনেশন-ফর ক্যান্সার পেশেন্টস-এ চুল প্রদানের একটি শর্ত রয়েছে। সীমান্ত বলেন, 'ন্যূনতম ১৪ থেকে ১৫ ইঞ্চি চুল হতে হবে। চুল সংগ্রহের পর পাঠানো হয় ফ্যাক্টরিতে। প্রক্রিয়াজাত করার পরে ১২ থেকে ১৩ ইঞ্চি চুল থাকে। ক্যান্সার পেশেন্টদের ঘাড় পর্যন্ত পরচুলা তৈরির জন্য ১২ ইঞ্চি চুল প্রয়োজন হয়। এখানে ছেলে অথবা মেয়ে যে কেউ চাইলেই চুল দান করতে পারবেন।'
এমনকি চুল রং করা থাকলেও চুল দানের সুযোগ রয়েছে। কোঁকড়া এবং ঝরঝরে সব ধরনের চুল গ্রহণ করা হয় — কেবল চুলের দৈর্ঘ্য ১৪ থেকে ১৫ ইঞ্চি হতে হবে।
দাতা চাইলে একজন ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীকে মনোনীত করতে পারেন। পরচুলা পাঠানো ক্যান্সার রোগীদের বেশিরভাগ সময় দাতারাই মনোনীত করেন। রোগীর তালিকা কর্তৃপক্ষের হাতে আসার পর শুরু হয় যাচাই-বাছাই। তারপর পৌঁছে দেওয়া হয় পরচুলা। একেকটি পরচুলা বানাতে তিন থেকে চার জনের চুল প্রয়োজন হয়। তৈরি করতে সময় লাগে ১৫ দিনের মতো। এখন পর্যন্ত আট জন ক্যান্সার রোগীর কাছে পরচুলা পৌঁছে দিয়েছে বাংলাদেশ হেয়ার ডোনেশন-ফর ক্যান্সার পেশেন্টস।
সফলতার পাশাপাশি বেড়েছে প্রতারক!
প্রথম দিকে পরিবার থেকে লুকিয়ে নিজে নিজেই কাজ করেছেন সীমান্ত মিত্র। পরিবারের সদস্যরা এই মহতী উদ্যোগ সম্পর্কে অবগত হওয়ার পর সমর্থন করলেও পাড়া-প্রতিবেশীর কটুক্তি এড়াতে পারেননি সীমান্ত।
ভালো-খারাপ দুই ধরনের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন সীমান্ত। প্রশংসার পাশাপাশি অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখিও হতে হয়েছে তাকে। দেশের বাইরে থেকে একাধিকবার আহ্বান এসেছে চুল বিক্রির জন্য। কিন্তু সীমান্ত চুল বিক্রির ক্ষেত্রে নারাজ। তিনি বলেন, 'চুল বিক্রির কাজ এ সংগঠনে করা হয় না। আমরা যেহেতু ডোনেশন পাচ্ছি, তাই চুল সংগ্রহ করে ফ্যাক্টরিতে পাঠাই। তারপর সেখান থেকে প্রক্রিয়াজাত হয়ে এলে ক্যান্সারের রোগীদের ডোনেট করি।'
সংগঠনটির সফলতা বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রতারকের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানান সীমান্ত। অনেক প্রতারক চুল পাওয়ার উদ্দেশ্যে সংগঠনের নাম ভাঙিয়ে চুলের জন্য দাতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সংগঠনের অফিসিয়াল নাম্বার ব্যতীত অন্য নাম্বার থেকে ফোন করে কেউ স্বেচ্ছাসেবী পরিচয় দিয়ে চুল চাইলে সাড়া না দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে সীমান্ত।
দিতে চান প্রাতিষ্ঠানিক রূপ
বর্তমানে বাংলাদেশ হেয়ার ডোনেশন-ফর ক্যান্সার পেশেন্টস একটি অনলাইনভিত্তিক সংগঠন। তবে একে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে সীমান্তের।
সীমান্তসহ আরও চারজন সংগঠনটি পরিচালনায় যুক্ত আছেন। তাদের নেতৃত্বে সারাদেশে ৩০ থেকে ৪০ জন স্বেচ্ছাসেবী কাজ করেন।
চুল দান করার জন্য সংগঠনটির ফেসবুক পেজে যোগাযোগ করলেই চলবে। তাছাড়া চাইলে ফেসবুক পেজে দেওয়া ফোন নাম্বারে যোগাযোগ করলে দ্রুত সাড়া পাওয়া যাবে। এছাড়া বর্তমানে বাংলাদেশ হেয়ার ডোনেশন-ফর ক্যান্সার পেশেন্টস-এর সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছে রাজধানীর ধানমণ্ডির 'বারবারেট' নামক একটি হেয়ার স্যালন। কেউ চাইলে তাদের মারফতও চুল দান করতে পারবে।
সীমান্ত বলেন, বাংলাদেশে ক্যান্সার বিষয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা কম। তাই দেশজুড়ে ক্যান্সার রোগীরা প্রথম থেকেই যাতে ডিজিটাল উপায়ে ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন এবং চিকিৎসার আওতায় থাকতে পারেন তার জন্য কাজ করার পরিকল্পনা করছেন তিনি।