এক রোমানিয়ানের শেকড়ের খোঁজে ট্রান্সিলভানিয়া থেকে গোপালগঞ্জ
নভেম্বরের এক শীতের বিকেল। রোমানিয়ার ট্রান্সিলভানিয়ায় নিজের বাড়িতে কম্পিউটারের সামনে বসে আছেন সুদর্শন চেহারার গ্রেগর। বয়স ৫০-এর কোঠা ছুঁইছুঁই। জাবোলা এস্টেটে তার বাড়িটি ঢাউস এক অট্টালিকা, নাম মাইকস ক্যাসল। এই এস্টেটে এরকম আরও কিছু প্রাসাদোপম বাড়ি রয়েছে। গত ৬০০ বছরে বিভিন্ন সময়ে তৈরি করা হয়েছে এগুলো।
এস্টেট থেকে গাড়িতে এক ঘণ্টার রাস্তা বিখ্যাত ব্রান ক্যাসল — ভ্লাদ দ্য ইমপেলার ওরফে 'কাউন্ট ড্রাকুলা' এখানে কিছুদিনের জন্য অবস্থান করেছিলেন। প্রতি বছর লাখ দশেকের মতো ভ্রমণপিপাসু ব্রান ক্যাসল দেখতে আসেন। তাদের কেউ কেউ জাবোলা এস্টেটেও ঢু মেরে যান। এস্টেটটাকে এখন গেস্ট হাউজে পরিণত করা হয়েছে। বিয়ে, কনসার্ট ইত্যাদির জন্য এখানে কক্ষ ভাড়া দেওয়া হয়। এখানকার আরকেটি দর্শনীয় বস্তু হলো রাজা চার্লসের একটি এস্টেট।
'১৭০০ শতকের কোনো এক সময়ে আমার পূর্বপুরুষেরা ব্রান ক্যাসল দখলে নিয়েছিলেন। তো ওই জায়গার সঙ্গেও আমার কিছুটা সংযোগ আছে বলা যায়,' জুম কলে হাসতে হাসতে বললেন মৃদুভাষী গ্রেগর।
বাংলাদেশি সাংবাদিকের সঙ্গে হুট করে এভাবে আলাপ হয়ে যাওয়ায় গ্রেগর এদেশের অর্থনীতি ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলতে বেশ উন্মুখ হয়ে উঠেছেন। ২০২০ সালে তিনি রোমানিয়ার অন্যতম বড় একটি টেক্সটাইল কারখানার সংখ্যাগরিষ্ঠ শেয়ারের মালিক হন। এরপর থেকে বাংলাদেশের স্বনামখ্যাত পোশাক খাত থেকে তার কারখানার জন্য নিদেনপক্ষে কিছু কাঁচামাল আমদানি করা যায় কি না তার সম্ভাব্যতা যাচাই করছেন। বছরের শুরুতে বাংলাদেশে একটি রপ্তানি মেলায় আসবারও কথা ছিল তার।
কিন্তু সুদূর রোমানিয়া থেকে বাংলাদেশ কেন? কারণ গ্রেগরের পদবি যে রায়চৌধুরী। তার মা ছিলেন হাঙ্গেরিয়ান বংশোদ্ভূত, আর বাবা বাঙালি। বাবার দিক থেকে গ্রেগরের শিকড় গোপালগঞ্জের উলপুরের জমিদার বাড়ি। বলা বাহুল্য, বাড়িটির জীর্ণদশা এখন। ১১ শতকে উলপুরে পরিবারটি বসতি গেড়েছিল, মোগল শাসনের সময় রমরমা জমিদারি ছিল। ওই সময়ই পরিবারটি জায়গির হিসেবে চৌধুরী খেতাব পায়।
অন্যদিকে গ্রেগরের মায়ের বংশও সম্ভ্রান্ত। ট্রান্সিলভানিয়ার এক বনেদি পরিবারে মায়ের জন্ম। সে বংশের ইতিহাস প্রায় মধ্যযুগের সময়ে শুরু, আজও উল্লেখ পাওয়া যায় স্থানীয় ঐতিহাসিক নথিপত্রে।
দুদিক থেকেই বনেদিপনা থাকায় মনে হতে পারে, গ্রেগর বুঝি ছোটবেলায় ভৃত্য-দাসি পরিবেষ্টিত হয়ে প্রাসাদতুল্য দুর্গের রাজসিক পরিবেশে বেড়ে উঠেছিলেন। কিন্তু গ্রেগর ও তার পরিবারের কপালে সে সৌভাগ্য লেখা ছিল না, তার বদলে তারা বিংশ শতাব্দীর মুখে পড়লেন। ছোট ভাইসহ গ্রেগর বিদেশবিভুঁইয়ে অস্ট্রিয়ায় শরণার্থী মা-বাবা'র কাছে বেড়ে উঠেছিলেন।
রায়চৌধুরী পরিবার
শাহপুর পরগনায় উলপুর গ্রামটি প্রতিষ্ঠা করেছিল বসু রায়চৌধুরী পরিবার। এই এস্টেটে ছোট-বড় অনেক অবকাঠামো তৈরি করেছিল পরিবারটি, তার মধ্যে ২০ শতকের শুরুতে ২০০ একর জায়গার ওপর বিশাল এক প্রাসাদ তৈরি করা হয়।
কিন্তু সাতচল্লিশের দেশভাগের সময় পরিবারের প্রায় সবাই রাতারাতি কলকাতা চলে যান। তবে একজন শেকড় ছাড়েননি। আজ এস্টেটের বড় অংশ অর্পিত সম্পত্তি। বিভিন্ন সরকারি কাজে কিছু ভবন এখন ব্যবহার করা হলেও প্রায় বেশিরভাগই ভগ্নদশায় কোনোক্রমে টিকে আছে।
ছোটবেলায় বাপ-ঠাকুরদার বংশ নিয়ে এটুকুই জানতে পেরেছিলেন গ্রেগর। পরিবারের অনেক সদস্য কলকাতায় গিয়ে ভালোই অবস্থান তৈরি করে নিয়েছিলেন। তবে গ্রেগরের সরাসরি পূর্বপুরুষেরা দেশভাগের আগেই দিল্লি চলে গিয়েছিলেন। কলকাতা-দিল্লি দুজায়গাতেই বেশ কয়েকবার ভ্রমণ করেন গ্রেগর।
'বাংলাদেশের কথা কেউ কখনো বলত না। ২০০২ সালে বাবা মারা যাওয়ার পর বাংলাদেশ নিয়ে আমার আগ্রহ বাড়ে। নিজের শেকড় খুঁজে বের করতে চেয়েছিলাম খুব করে,' বলেন গ্রেগর।
লন্ডন স্কুল অভ ইকোনমিক্স-এ রাজনৈতিক অর্থনীতির ওপর পড়ালেখা করে ও লন্ডনে ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকার হিসেবে কয়েক বছর কাজ করার পর মায়ের দিককার বংশের টানে ততদিনে গ্রেগর রোমানিয়ায় গিয়ে বসবাস শুরু করেছিলেন। ওই সময়ই বাংলাদেশে থেকে যাওয়া পরিবারটির সঙ্গে নতুন করে যোগাযোগ শুরু করার ব্যাপারে ভাবছিলেন তিনি।
"যখনই এ আলোচনা উঠত, অনেক আত্মীয়স্বজন একেবারে না না করে উঠতেন — 'আমরা সব ছেড়ে এসেছি, এগুলো অতীত, ছেড়ে দাও না' — তারা বলতেন," স্মৃতিচারণ করেন গ্রেগর।
রায়চৌধুরী পরিবারের এক সদস্য ১৯২০-এর দশকে পরিবারের ইতিহাস নিয়ে একটি বই লিখেছিলেন। বইটা গ্রেগরের হাতে আসে। কিন্তু বাংলা তো তার কখনো শেখা হয়নি। 'একজনকে বললাম বইটা অনুবাদ করতে। প্রতি সপ্তাহে কয়েক পৃষ্ঠা হাতে আসত, সেগুলো পড়তাম। এভাবে অনেকটুকু পড়া হলো। শেষতক আমি এ এলাকার ইতিহাস নিয়ে আরও বেশি আগ্রহী হয়ে উঠি,' গ্রেগর বলেন।
রায়চোধুরী পরিবারের বিভিন্ন তথ্য নিয়ে একটি ওয়েবসাইটও তৈরি করেন গ্রেগর। পরিবারটির বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা অনেক সদস্যই এ ওয়েবসাইটের মাধ্যমে একে অপরের সঙ্গে যুক্ত হন। অবশ্য এসব যোগাযোগ এখন অন্য মাধ্যমেও হচ্ছে।
বাংলাদেশে ভ্রমণের কথা গ্রেগর প্রথম যখন আত্মীয়স্বজনকে জানালেন, তারা বেশ আবেগপ্রবণ হয়ে উঠেছিলেন। কেউ কেউ তো বলেও বসলেন, 'যেও না।'
'আমি যাওয়ার ব্যাপারে নাছোড়বান্দা হয়ে গিয়েছিলাম। শেষতক তাদের মন গলল, গোপালগঞ্জে বাস করা এক তুতো ভাই পোপা'র ব্যাপারে জানাল আমাকে।'
সুধন্য রায়চৌধুরী দেশের ভিটেটুকু আঁকড়ে থেকে গিয়েছিলেন। তার চার পুত্রের একজন পোপা ওরফে মৃণাল রায়চৌধুরীর সঙ্গে অবশেষে যোগাযোগ হলো গ্রেগরের। দিল্লিতে থাকা পরিবারের আরেক সদস্য জয়ন্ত রায়চৌধুরী দুজনের মধ্যে যোগাযোগ করিয়ে দেন।
'জয়ন্ত আমাকে বলল 'অস্ট্রিয়া থেকে একজন আসছে', আমার সঙ্গে দেখা করতে চায়,' মৃণাল বলেন। গোপালগঞ্জে এখন তিনি ফার্মেসি ব্যবসায় যুক্ত। পুরোনো জমিদার বাড়ির জায়গার ওপর নতুন একটি বাড়ি করেছেন তিনি।
জয়ন্তের সহায়তায় দিল্লি থেকে ভিসার ব্যবস্থা করে অবশেষে ২০০৮ সালের একদিন কলকাতা থেকে এক ব্যক্তিগত গাড়িতে চড়ে বাংলাদেশ–ভারত সীমান্তের পথে রওনা দিলেন গ্রেগর। সীমান্তের অন্য পারে তাকে অভ্যর্থনা জানাতে অপেক্ষায় ছিলেন মৃণাল।
'সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার পরপরই বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে আমি সঙ্গে সঙ্গে অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম,' এখনো সে স্মৃতি টাটকা গ্রেগরের মনে। ওই যাত্রায় দু'রাত মৃণালের বাড়িতে কাটিয়েছিলেন তিনি, ঘুরে দেখেছিলেন পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি।
'পুরোনো বাড়িগুলো দেখে ইন্ডিয়ানা জোন্সের একটা সিনেমার কথা মনে পড়ে গেল; গাছগাছালি আর ঝোপঝাড় একদম বাড়ির মাথায় চেপে বসেছে,' হেসে বললেন গ্রেগর। 'নিচের কোঠাগুলোতে অন্যরা বাস করছেন, দোতলা আর তেতলার ঘরগুলো ফাঁকাই পড়ে ছিল।'
'অস্ট্রিয়া থেকে আসা একটা লোক'কে প্রথমবারের মতো দেখলেন গ্রামবাসী; তাদের জন্য সে এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা।
'যেখানেই যেতাম, কয়েকশ লোক আমাদের পিছু নিত। সারাদিন কেবল খেতাম। আর হ্যাঁ, প্রচুর ইলিশ খেয়েছিলাম,' জানান গ্রেগর।
এখন অব্দি চারবার বাংলাদেশে এসেছেন গ্রেগর। কলকাতা আর ঢাকা; দুজায়গা হয়েই গোপালগঞ্জ গিয়েছিলেন তিনি। একবার সঙ্গে করে ছোটভাইকে নিয়ে এসেছিলেন তিনি।
মৃণাল আর গ্রেগর মিলে পরে পরিবারের আরও অনেক সদস্যকে উলপুরের বাড়ির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। সে তালিকায় আছেন তাদের স্বনামখ্যাত কাকা অমিতাভ ঘোষও। আন্তর্জাতিকভাবে প্রখ্যাত এ লেখক এ বছরের জানুয়ারিতে প্রথমবারের মতো মায়ের পূর্বপুরুষের বাড়ি দেখে আসেন।
কোভিড-১৯ মহামারি শুরু হওয়ার আগে শেষবার বাংলাদেশ ভ্রমণ করেছিলেন গ্রেগর। সে সময় সঙ্গে করে দুজন আলোকচিত্রীকে নিয়ে এসেছিলেন তিনি — হাঙ্গেরির বেলা কাসা ও কলকাতার কুশল রায়। ঢাকা থেকেও আরেক চিত্রগ্রাহক প্রতীক সরকারকে নিয়ে আসেন। তাদেরকে দিয়ে পূর্বপুরুষের বাড়ির ছবি তুলিয়ে নিয়েছেন গ্রেগর — ভবিষ্যতে কোনো একদিন ওসব ছবির প্রদর্শনী করার ইচ্ছে আছে তার।
বাংলাদেশে অতীত খুঁড়ে বের করা নিয়ে পরিবারের বিরুদ্ধটান এখন আর নেই বটে, কিন্তু গ্রেগর বুঝতে পারেন শুরুর দিকে সবাই কেন এমন বাধা দিয়েছিলেন।
'তারা যখন দেশ ছেড়েছিলেন, সে সয়মটা নিয়ে অনেক নেতিবাচক কথা ছিল। তাদেরকে রাতারাতি দেশ ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল, ব্যাপারটা খুব একটি ইতিবাচক অভিজ্ঞতা ছিল না। ট্রমা ছিল। আপনি একটা জীবন কাটাচ্ছেন এবং তারপর হুট করে আপনি শরণার্থী হয়ে গেলেন,' গ্রেগর বলেন। গ্রেগর তার মায়ের পরিবারের সদস্যদের মুখ থেকে যেসব ঘটনার কথা শুনেছিলেন, তার বাঙালি আত্মীয়স্বজনেরাও সে ধরনের কাহিনীই বলেছেন। 'পটভূমি স্রেফ ভিন্ন দুটো মহাদেশ,' গ্রেগর বলেন।
২০০০-এর দশকের শুরুতে গ্রেগর যখন প্রথম রোমানিয়ায় আসেন, তখনো সারাবিশ্বে ছড়িয়ে থাকা পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকেও একই বাধার মুখে পড়েছিলেন গ্রেগর: 'পূর্ব ইউরোপে ফিরে যেও না। রোমানিয়ায় আর ফেরার দরকার নেই। ওখানে কিচ্ছু নেই। স্রেফ অসুবিধায় পড়বে।'
মাইকস পরিবার
ইতিহাসের পাকচক্রে পড়ে রায়চৌধুরী পরিবারের সদস্যরা যখন কলকাতা ও অন্যান্য অঞ্চলে গিয়ে উঠেছিলেন, কাছাকাছি সময়ে বিশ্বের আরেক প্রান্তে মাইকস পরিবারও একই ঐতিহাসিক ঘটনাচক্রে আটকে পড়ে।
১৯৪৭ সালে কমিউনিস্ট শাসনের অধীনে চলে যায় রোমানিয়া। ১৯৪৯ সালের এক রাতে দেশটির সব সম্ভ্রান্ত পরিবারকে ঘর থেকে বের করে দেওয়া হয়। যে ক্যাসলে গ্রেগর এখন বসে আছেন, সে ক্যাসলের মেঝেতে পড়ে থাকা ভাঙা কাচের টুকরো মাড়িয়ে তার মা কাউন্টেস কাটালিন মাইকস যখন দুর্গ ছেড়ে বের হন, তখন তিনি ছিলেন ছোট্ট এক বালিকা।
'আমার প্রমাতামহকে লেবার ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পাশের গ্রামে এক ভূস্বামী পরিবারে মা বেড়ে ওঠেন, তাদেরকে কম্যুনিস্টরা তাৎক্ষণিকভাবে বাড়িছাড়া করেনি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদেরকেও ঘর ছাড়তে হয়।'
১৯৬০ সালে কাটালিনা অস্ট্রিয়ায় চলে যান। গ্রাজের নিকটে এক শহরে এক খালার কাছে বড় হন তিনি। গ্রাজেই কয়েক বছর পরে তার আর গ্রেগরের বাবা শুভেন্দু বসু রায়চৌধুরীর দেখা হয়।
রবিঠাকুর ও কাইজারলিং
জার্মান দার্শনিক হারম্যান ভন কাইজারলিং ১৯১১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাক্ষাৎ পান। প্রথম দেখাতেই মুগ্ধ হয়ে পড়েন তিনি।
কাইজারলিং রবি'র বন্ধু ও সহযোগী তো হয়েইছিলেন, সেই সঙ্গে পরের বেশ কয়েক বছর তিনি পশ্চিমে রবীন্দ্রনাথের কাজের প্রচার করেন। ১৯২১ সালে কবির জার্মানি ভ্রমণের সময় ডার্মস্টাড শহরে 'ট্যাগোর উইক'-এর আয়োজন করেছিলেন এ দার্শনিক।
'কাইজারলিংকের ছেলে আমার মায়ের তুতো বোনকে বিয়ে করেছিলেন। তিনি গ্রাজে এক বিশ্ববিদ্যালয়ে একবার বক্তৃতা দিতে এসেছিলেন। মাও যান সেখানে।'
শুভেন্দু বসু রায়চৌধুরী উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে পরিবারের প্রথা ভঙ্গ করেছিলেন। তার বাবা ও দুই ভাই যুক্তরাজ্যে পড়লেও গ্রেগরের বাবা ডার্মস্টাডে এক টেকনিক্যাল কলেজে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বেন বলে সিদ্ধান্ত নেন। এরপর তিনি এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামের আওতায় অস্ট্রিয়ায় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যান। পরে সেখানেই পাকাপাকিভাবে পড়ালেখা শুরু করেন। রবীন্দ্রনাথ ও কাইজারলিংয়ের মধ্যকার নিবিড় সম্পর্কের কথা জানতেন শুভেন্দু, তাই কাইজালিংয়ের ছেলের দেওয়া বক্তৃতা অনুষ্ঠানে তিনিও হাজির হন।
'ওই অনুষ্ঠানে কোনোভাবে তাদের দুজনের দেখা হয়, যোগাযোগ তৈরি হয়। সবই রবি ও কাইজারলিংয়ের কল্যাণে,' গ্রেগর হেসে বলেন। এ কবি-দার্শনিক জুটির একটি ছবি এখনো তাদের ঘরের দেওয়ালে ঝোলানে আছে জানান তিনি।
দুনিয়ার দুই অংশের দুই শরণার্থী এক হলেন। 'কিন্তু সেটাও খুব সহজে হয়নি। দিনশেষে তাদের দুজনেরই সাংস্কৃতিক পটভূমি আলাদা, দুজনেরই দেশ তাদের মাতৃভূমি ছিল না,' বলেন গ্রেগর।
অতীতে ভর করে ভবিষ্যৎ নির্মাণ
১৯৮৯ সালে রোমানিয়ায় কমিউনিস্ট সরকারের পতন ঘটে। ৪২ বছর পর দেশটি আবারও গণতন্ত্রের দেখা পায়। নতুন সরকার নতুন আইন করে সম্পদের বেসরকারিকরণের চেষ্টা শুরু করে আবার।
'আইন তৈরি করা এক কথা, আর সে আইনকে কার্যকর করা পুরোপুরি ভিন্ন বিষয়। আমাদের সম্পত্তির কিছু অংশ ফেরত পাওয়ার জন্য আমাদেরকে কয়েক বছর ধরে মামলা লড়তে হয়েছিল,' বলেন গ্রেগর।
১৯৯৮ সালে গ্রেগরের মা প্রথম মামলা জেতেন। গ্রেগর তখনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। বাবার মৃত্যুর পর তিনি রোমানিয়ায় গিয়ে নিজেদের সম্পত্তির ওপর থাকা একটি বাড়ি সংস্কার করার চিন্তা করেন, যাতে কখনো পরিবারের সদস্যরা সেখানে গেলে থাকতে পারেন।
'কীভাবে যেন আমি এখানেই ২০ বছরের বেশি থেকে গেলাম, এখনো দিন কাটিয়ে দিচ্ছি,' গ্রেগর বলেন। গত কয়েক বছরে তিনি ট্রান্সিলভানিয়ার পর্যটন খাতের অংশ হয়ে উঠেছেন। জাবোলা এস্টেটে এখন ৬০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন। দর্শনার্থীদেরকে এখানে ২০টি কক্ষ ভাড়া দেওয়া হয়, সামনে সেটা ৩০ হওয়ার কথা রয়েছে।
২০২১ সালে গ্রেগর সেকুইয়ানা টেক্সটাইল কারখানার সংখ্যাগরিষ্ঠ শেয়ারের মালিক হন। এ কারখানার কর্মীসংখ্যা ৭০০-এর মতো। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশে ব্যবসায়িক যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে এদেশের সঙ্গে সম্পর্কটা আরেকটু পাকাপোক্ত করতে চাচ্ছেন। 'আমার যেহেতু বাংলাদেশের সঙ্গে পারিবারিক সম্পর্ক আছে, তাই আমার অফিস সবসময় বলে বাংলাদেশে কিছু করতে,' বলেন তিনি।
'বাংলাদেশে যখন গিয়েছিলাম, তখনই ভেবেছিলাম ওখানে কিছু করব। এখনো শুরু করা হয়নি, কিন্তু সময় তো আছেই,' গ্রেগর বলেন। এককালে উলপুরে ট্রান্সিলভানিয়ার মতো করে পর্যটনের উদ্দেশ্যে একটা গেস্ট হাউজ চালু করার চিন্তাও করেছিলেন তিনি। পরে অবশ্য বুঝতে পারেন, 'এখানে পর্যটন অতটা সহজ বিষয় নয়।'
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: সুজন সেন গুপ্ত