নগরে মিমের উৎসব, মিমের জাদু, আর মিমের জাগরণের গল্প
"যে জন মিমের মর্ম বোঝে না, তার সাথে নেই লেনা-দেনা," গানের তালে তালে মাথা দুলিয়ে মিমের এক মহাযজ্ঞে জড়ো হয়েছিল হাজারও মিমপ্রেমী। গত ১৯ ডিসেম্বর মঙ্গলবার তেজগাঁওয়ের আলোকিতে দেশের প্রথম মিম ফেস্ট আয়োজন করে কৌতুক ও ব্যঙ্গবিদ্রূপভিত্তিক প্রতিষ্ঠান eআরকি।
শত শত প্রিন্ট করা মিমের ভেতর হারিয়ে যাওয়া পরিবেশে মিম উৎসবে দর্শকদের আকর্ষণ ধরে রাখার জন্য আয়োজনটিকে ইন্টারঅ্যাকটিভ করতে চেষ্টার কমতি ছিল না আয়োজকদের পক্ষ থেকে। দর্শনার্থীদের দিন আজকে কেমন যাবে, সেজন্য ছিল মিমভিত্তিক লটারি। ছিল তৎক্ষণাৎ মিম তৈরির সুযোগ, যেখানে লটারি থেকে পাওয়া টেমপ্লেট থেকে দর্শকরা নিজেদের কল্পনা আর লেখা যুক্ত করে বানিয়ে ফেলতে পারবেন মিম। এছাড়াও দর্শনার্থীদের মিমের জ্ঞান পরীক্ষা করার কুইজ এবং মুরাদ টাকলা ভাষা ডিকোড করার প্রতিযোগিতা ছিল মিম উৎসবে।
প্রিয় কোনো মিম চরিত্র হিসেবে সাজার জন্য মিম কসপ্লে এবং জীবন্ত মিম শামসুল আলম ওরফে 'ছোটন কাকু'ও ছিল উৎসবের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। এছাড়াও বিখ্যাত মিমগুলোর উৎপত্তি কীভাবে তার সংক্ষিপ্ত 'কন্টেক্সট'সহ প্রদর্শনের ব্যবস্থা ছিল উৎসবের 'মিম জাদুঘর' অংশে।
সেরা মিম চরিত্রকে ভোট দেওয়ার জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছিল ব্যালট পেপার ও ব্যালট বক্সের। দর্শনার্থীরা ভোট দিতে পারবেন দুইভাবে: দিনের আলোতে এবং রাতের অন্ধকারে। বুথের ঠিক বাইরে সারি করে সাজানো রয়েছে eআরকিতে প্রকাশিত রাজনৈতিক মিমগুলো।
তবে দেশের প্রথম মিম উৎসবের আয়োজনের উদ্দেশ্য কী? এ প্রসঙ্গে eআরকির সম্পাদক সিমু নাসের এবং প্রধান আয়োজক বলেন, "সিনেমা দেখার জন্য সিনেমা হল রয়েছে, নাটক দেখার জন্য রয়েছে থিয়েটার, গান শোনার জন্যও কনসার্ট রয়েছে। সেখানে গিয়ে শিল্পীকে সরাসরি দেখার সুযোগ হয়। কিন্তু মিম দেখার জন্য কী রয়েছে? যারা মিম বানায়, আর যারা মিমের ভোক্তা, এই দুইয়ের মেলবন্ধন ঘটানোর উদ্দেশ্যেই আমাদের এই উদ্যোগ।"
মিমের নাড়িনক্ষত্র
গ্রিক শব্দ 'মিমেমা' (অনুকরণযোগ্য) থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ১৯৭৬ সালে তার বই 'দ্য সেলফিশ জিনে' মিম শব্দটির প্রচলন ঘটান রিচার্ড ডকিন্স। তবে ইন্টারনেট জনপ্রিয় হওয়ার পর থেকে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের কাছে মিম জনপ্রিয় হতে শুরু করে। এর প্রসার আরও বেড়ে যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের জনপ্রিয়তা বাড়ার পর, যখন একজন ব্যবহারকারী আরেকজনের কাছে নিজের মিম শেয়ার করার সুযোগ পান। বাংলাদেশে ইন্টারনেট সংযোগ সহজলভ্য হওয়ার সাথে সাথে বাংলাদেশের সাইবারস্পেসেও টেক্সট আর ছবির পাশাপ্সহি জায়গা পেতে শুরু করে এই দুইয়ের সংমিশ্রণে তৈরি কন্টেন্ট 'ইন্টারনেট মিম'।
যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিবর্তন এসেছে মিমের কন্টেন্ট, ফর্ম কিংবা ডিস্ট্রিবিউশনেও। একসময় কেবল ছবির ওপর লেখা এডিট করে মিম ছড়িয়ে দেওয়া হতো। ভিডিও আকারের মিমগুলো জনপ্রিয় হয়েছে শেষ অর্ধযুগে, যখন ভিডিও মিম বানানোর প্রযুক্তি আর ভিডিও আপলোড-ডাউনলোড করার ডেটার গতি ও খরচ সবার হাতের নাগালে চলে এসেছে।
সিমু নাসের বাংলাদেশে মিমের বিবর্তন নিয়ে বলেন, "২০১০ পরবর্তী সময়ে মিমগুলো ছিল বিদেশের মিম থেকে অনুপ্রাণিত। ট্রলফেস বা ঐ ধরনের মিমগুলোই বেশি চোখে পড়তো। তবে এখন এগুলোকে সরিয়ে বাংলাদেশি মিমগুলোই বাংলাদেশি সাইবারস্পেসে বেশি জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ এ দেশের কন্টেক্সটে তৈরি মিমগুলোর সাথেই আরও ভালোভাবে নিজেকে মেলাতে পারছেন। আর eআরকির লক্ষ্যও তাই, নিজেদের দেশি মিম টেমপ্লেটকে ছড়িয়ে দেওয়া।"
তবে মিম কেন এত জনপ্রিয়? এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রাজীব নন্দী মিমের বেশ কিছু বৈশিষ্ট্যের কথা বলেন। প্রথমত, এটি তৈরি ও শেয়ার করা সহজ। যে কেউ মিম টেমপ্লেট নিয়ে ছবি এডিট করে কিংবা ক্যাপশন বসিয়েই মিম তৈরি করতে পারেন। এত সহজ ও সস্তা মাধ্যম এখনো তৈরি হয়নি। তাছাড়া এগুলো সংক্ষিপ্ত ও হাস্যরসাত্মক হওয়ায় মানুষ সহজেই একে গ্রহণ করতে পারে। মিমের সফলতা সেখানেই, যখন এটি বোধগম্য হয়। এ সকল সুবিধার কারণেই মিম এত জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
এই জনপ্রিয়তার কারণেই বর্তমান সময়ে এসে মিমকে এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। চলমান ঘটনা থেকে খেলাধুলা কিংবা বিনোদন জগত হয়ে উঠেছে মিম টেমপ্লেট তৈরির মূল ভাণ্ডার। তবে এই প্রভাব বিস্তার যে কেবল একমুখী, তা নয়। মিমও অনেক সময় চলচ্চিত্র-ওয়েব সিরিজের গল্প বলায় প্রভাব ফেলছে; যেমনটা দেখা যায়, হইচইয়ের ওয়েব সিরিজের অদৃশ্যের 'নাম বললে চাকরি থাকবে না' বক্তব্যে কিংবা মহানগরের দৃশ্যে।
তবে মিমকে কি আর্ট বা শিল্প বলা চলে? সিমু নাসের এবং রাজীব নন্দী উভয়েই এ বিষয়ে একমত। শিল্প হওয়ার জন্য কোনো বিষয়কে যে গুরুগম্ভীর বা দীর্ঘ সময়ের প্রস্তুতি দরকার এমন নয়। সৃজনশীল কোনো কিছু প্রকাশই শিল্প হতে পারে। আর মিমই এমন একটি আর্ট ফর্ম, যা সহজ, সস্তা আর কম সময়ে তৈরি করা যায়।
একসময় সমাজে বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার একচ্ছত্র ক্ষমতা ছিল কেবল হাতেগোনা কিছু মানুষের হাতে। সামাজিক মাধ্যম সাধারণ মানুষের চিন্তা-ভাবনাকে সামনে নিয়ে আসার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। আর মিম হয়ে উঠেছে সহজ ভাষায় জটিল জিনিস ব্যাখ্যা করার হাতিয়ার। সিমু নাসের জানান, "সামাজিক মাধ্যমে মিমের সাহায্যে অনেক না বলা কথা ছড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে, যা অন্য কোনো নিয়ন্ত্রিত মাধ্যমে সম্ভব নয়।"
তাই সামাজিক মাধ্যম আর মিমের এই সুবিধা কাজে লাগাতে দেরি করেনি কেউই। মিম মার্কেটিং কিংবা রাজনৈতিক বার্তা ছড়ানো থেকে শুরু করে নিছক বিনোদন, সর্বত্রই মিম ব্যবহার করা হচ্ছে। একই কথা খাটে সামাজিক বা রাজনৈতিক সচেতনতার ক্ষেত্রেও। সিমু নাসের জানান, "হাস্যরসের মাধ্যমে সমাজের অসঙ্গতি দেখিয়ে দেওয়া কোনো নতুন বিষয় নয়। বহু শতাব্দী ধরেই এটা চলে আসছে। মিম কেবল নতুন এক ফর্ম। যা অন্য ফর্মে বলা যায় না, মিমের মাধ্যমে তা বুঝিয়ে দেওয়া যায় সহজেই।"
মিমকে শিক্ষা উপকরণ হিসেবেও ভালোভাবে ব্যবহার করা যায় বলে মনে করেন রাজীব নন্দী। তার মতে, নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের কাছে মিমের ব্যবহার একটি আকর্ষণীয় পদ্ধতি হতে পারে। গুরুগম্ভীর কোনো বিষয়কে হাস্যরসের মাধ্যমে তুলে ধরা, জটিল কোনো বিষয়কে মিমের মাধ্যমে সহজবোধ্য ভাষায় তুলে ধরা, কিংবা কেবল একঘেয়ে লেকচারের মধ্যে শিক্ষার্থীদেরকে খানিকটা বিশ্রাম দিতেও মিমকে ব্যবহার করা যেতে পারে। ডকুমেন্টারি, ছবি কিংবা ইনফোগ্রাফিকের পাশাপাশি মিমকেও রাখা যেতে পারে শিক্ষাকে আরেকটু আনন্দময় করতে।
মিম নিয়ে আছে যথেষ্ট সমালোচনাও। অনেকেই ইন্টারনেট মিম সংস্কৃতিকে হালকা বা অগভীর মনে করে থাকেন। এক অর্থে এই অভিযোগকে একেবারে উড়িয়েও দেওয়া যায় না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপরিমিত ব্যবহারে মানুষের মনোযোগ ধরে রাখার ক্ষমতা বা অ্যাটেনশন স্প্যান কমে এসেছে অনেকখানি, যার একটা বড় অংশ বর্তায় মিমের ঘাড়েও।
ট্রল বা সাইবার বুলিংয়ের ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা হচ্ছে মিমকে। তবে এক্ষেত্রে মিমের ঘাড়ে দোষ চাপাতে নারাজ সিমু নাসের। তার মতে, ভাব বা বক্তব্য প্রকাশের একটা উপায় মিম। যে কেউ একে যে কোনোভাবে ব্যবহার করতে পারে, যেমনটা অন্য মাধ্যমের ক্ষেত্রেও করা সম্ভব। আর স্যাটায়ারের বিষয়টিই হলো কোনো বিষয়কে প্রশ্ন করা। এখন কে কোন কন্টেক্সটে অনুভূতিতে আঘাত হিসেবে নেবে, তার কোনো নির্ধারিত মানদণ্ড নেই। তাই সহনশীলতা জরুরি।
নতুন কিছু যখন বাজারে আসে, তখন তার বিরুদ্ধাচরন করার একটা মনোভাব দেখা দেয় বলে মনে করেন সিমু নাসের। মিমকে যেভাবে বাঁকা চোখে দেখা হতো শুরুর দিকে, একই ধাপ পার করে এসেছে রেডিও, টেলিভিশনের মতো যোগাযোগ মাধ্যম। যোগাযোগের একটি মাধ্যম হিসেবে মিম কততা দুর্দান্ত তা ইতিমধ্যেই টের পাচ্ছে সবাই। আর একে আরও স্বাভাবিকীকরন করতেই মিম ফেস্টের মতো উদ্যোগ।
মিমের এই জয়যাত্রা নিয়ে আশাবাদী রাজীব নন্দীও। তার মতে, "যতদিন না পর্যন্ত মিমের চেয়েও আকর্ষণীয় কিছুর জন্ম না হচ্ছে, ততদিন যোগাযোগ বা বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে মিমের এই আবেদন কমবে না।"