আমার ভাষার চলচ্চিত্র: ভাষার মাসে মাতৃভাষায় চলচ্চিত্র
'আসিতেছে! আরে আরে আসিতেছে!
টিএসসি অডিটোরিয়ামে,
আমার ভাষার চলচ্চিত্র!
হ্যাঁ ভাই, আমার ভাষার চলচ্চিত্র!
টিকিট মূল্য মাত্র ৫০ টাকা! ৫০ টাকা! ৫০ টাকা!
বসন্তের দুপুরে মন যখন বিহুর নেশায় রঙিন, তখন তা আরো রাঙিয়ে দিতে ঢোলের বাদ্য বাজিয়ে কাগজে বানানো মাইক নিয়ে গলা ছেড়ে হাঁকডাক করছে একদল তরুণ-তরুণী। আশেপাশের মানুষ কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে: আসিতেছে চলচ্চিত্র, মাত্র ৫০ টাকায়। এ যুগেও ৫০ টাকায় সিনেমা দেখা যায়! তা-ও আবার সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত থেকে শুরু করে একদম ধ্রুপদি চলচ্চিত্র!
যায় বইকি, খুব যায়! আমাদের বাঙালির সিনেমা দেখার প্রকৃত আমেজ কী বলুন তো? নতুন সিনেমা এসেছে, পুরো শহর-গ্রাম ছেয়ে আছে পোস্টারে। মায়ের বকুনি থেকে বাঁচতে রাজ্যের দুরূহ পরিকল্পনা সেরে, টিফিনের টাকা বাঁচানো কোনো স্কুল-কলেজ পড়ুয়া, এলোমেলো বন্ধুরা, লুকিয়ে বাঁচিয়ে প্রেম করা কপোত-কপোতি, গ্রামের বয়স্ক বৃদ্ধ, খেটে খাওয়া মানুষ কিংবা সপ্তাহান্তে বা মাসে একবার পরিবারের সবাই মিলে ম্যাটিনি শো দেখা—একসময় চলচ্চিত্র সবার ছিল, মানুষের ছিল। মাঘ-ফাল্গুনের হাওয়ায় নতুন দিনে চলচ্চিত্রের আমাদের চিরপরিচিত সেই পুরোনো প্রিয় সুর ও ঘ্রাণ ফিরে আসে যেন 'আমার ভাষার চলচ্চিত্র' আয়োজনের মধ্য দিয়ে।
চারিদিকে পুরোনো দিনের চলচ্চিত্রের পোস্টার, পুরোনো গান, উৎসুক দর্শকের টিকিট কাউন্টারে টিকিটের অপেক্ষা, ঠেলাঠেলি করে লাইনে দাঁড়িয়ে সিনেমা দেখা—আমার ভাষার চলচ্চিত্র যেন প্রকৃত অর্থেই বাঙালির চলচ্চিত্রের উৎসব। গত ২২ বছর ধরে বাংলা চলচ্চিত্রকে ভালোবাসার চিরকুট দিয়ে যাচ্ছে এ চলচ্চিত্র উৎসব। আজ গল্পের আসর জমবে এ আয়োজনের গল্পকে ঘিরেই।
'চলচ্চিত্রে বাংলার মুখ' থেকে 'আমার ভাষার চলচ্চিত্র'
মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চাওয়ার আধিপত্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের মশাল জ্বালিয়ে ফাল্গুনে দ্বিগুণ হবার গল্প আমাদের ভাষা আন্দোলন। আমরা স্নেহের রোদে ভিটে ভরানো মায়ের ভাষাকে আদরে বুকে জড়াই। সেই মায়ের ভাষাকে ভালোবেসেই মায়ের ভাষার চলচ্চিত্রকে উদযাপনে যাত্রা শুরু করে 'আমার ভাষার চলচ্চিত্র'।
সালটা ২০০২। বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য সে এক অদ্ভুত সময়। একদিকে মাটির ময়নার (২০০২) মতো চলচ্চিত্রের আগমন, অন্যদিকে মেধাহীন 'কাটপিস' চলচ্চিত্রের রমরমা বাণিজ্যে মধ্যবিত্ত দর্শকের হলসংস্কৃতি থেকে দূরে সরে যাওয়া।
এমন এক সময়ে ভাষা আন্দোলনের ৫০ বছর পূর্তিতে একদল তরুণ-তরুণীর হাত ধরে শুরু হয় 'আমার ভাষার চলচ্চিত্র'। প্রতি বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদ এ চলচ্চিত্র উৎসব আয়োজন করে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) মিলনায়তনে চলচ্চিত্র প্রদর্শনী হয়।
শুরুতেই এর নাম 'আমার ভাষার চলচ্চিত্র' ছিল না। ক্ষুদ্র পরিসরে ২০০২ সালে এ চলচ্চিত্র উৎসবের প্রথম আসরের নাম ছিল, 'ভাষা আন্দোলনের ৫০ বছর: চলচ্চিত্রে বাংলার মুখ'। প্রথম বছরে 'মুখ ও মুখোশ', 'সূর্য দীঘল বাড়ি', 'ছুটির ঘণ্টা', 'মেঘের অনেক রং', 'সারেং বউ', 'হঠাৎ বৃষ্টি'সহ মোট ১৫টি চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়।
এ আয়োজনের সফলতায় পরের বছর এই উৎসব আয়োজিত হয় কিংবদন্তী নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের একগুচ্ছ চলচ্চিত্রের সমাহারে 'সত্যজিৎ-এর চলচ্চিত্র' নামে। এরপর 'বাংলা চলচ্চিত্র উৎসব (২০০৪)', 'বাংলার ছবি (২০০৫)' ইত্যাদি বিভিন্ন নামে আয়োজিত হয়ে ২০০৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত 'আমার ভাষার চলচ্চিত্র' নামে এটি আয়োজিত হচ্ছে।
প্রতি বছর ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিতে 'আমার ভাষার চলচ্চিত্র' উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি সেজে ওঠে চলচ্চিত্রের ঢংয়ে। 'বেহুলা' থেকে 'রূপবান', 'বারুদ' থেকে 'অঙ্গার'—যেদিকে চোখ যায়, বাংলা চলচ্চিত্রের সোনালি সময়ের সাক্ষ্য দেয় নানান পোস্টার।
ছেলেবুড়ো, শিক্ষার্থী, বন্ধু-বান্ধব বা পরিবার—সব বয়সের মানুষ নানান রঙের সমসাময়িক ও ধ্রুপদি একঝাঁক চলচ্চিত্র নামমাত্র মূল্যে দেখতে হাজির হয়। কখনো 'হাউজফুল' শোতে নিচে পাটিতে বসে, চেয়ারে বসে সিনেমা দেখার দৃশ্য যেন নব্বই দশকের শুক্রবারে বিটিভিতে দুপুরের সিনেমা দেখার স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। চলচ্চিত্র প্রদর্শনের সময় উপস্থিত থাকেন চলচ্চিত্রের নির্মাতা, অভিনয়শিল্পীসহ বিভিন্ন কলাকুশলী।
চলচ্চিত্র প্রদর্শনের পাশাপাশি চলচ্চিত্রকে কেন্দ্র করে আলোচনা সভা, 'যুক্তি, তক্কো, গপ্প' আয়োজন করা হয়ে থাকে। এছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদের পক্ষ থেকে স্বীকৃতিস্বরূপ বিগত বছরে মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রগুলোর মধ্য থেকে বিচার পর্ষদ-নির্বাচিত সেরা চলচ্চিত্রকে 'হীরালাল সেন পদক'-এ ভূষিত করা হয়। এভাবেই সফলভাবে বছরের পর বছর আয়োজনের মধ্য দিয়ে 'আমার ভাষার চলচ্চিত্র' হয়ে উঠেছে দুই বাংলার সর্ববৃহৎ চলচ্চিত্র উৎসব।
আমার ভাষার চলচ্চিত্র: এবারের আয়োজন
গত ১২ ফেব্রুয়ারি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পর্দা ওঠে ২২তম 'আমার ভাষার চলচ্চিত্র'-এর। 'কখনো আসেনি', 'ঘুড্ডি', 'রংবাজ', 'মনপুরা'র মত ধ্রুপদি বাংলা চলচ্চিত্রের সাথে 'মুজিব', 'আদিম', 'প্রিয়তমা'র মত সমসাময়িক চলচ্চিত্র, ম্রো ভাষায় নির্মিত 'কিওরি পেক্রা উয়্যু (ডিয়ার মাদার)' এর সমন্বয়ে পাঁচ দিনব্যাপী ২০টি চলচ্চিত্র নিয়ে 'আমার ভাষার চলচ্চিত্র ১৪৩০' অনুষ্ঠিত হয়।
১২ তারিখ (সোমবার) উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোভিসি (শিক্ষা) সীতেশ চন্দ্র বাছার,পরিচালক অমিতাভ রেজা চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টেলিভিশন ফিল্ম অ্যান্ড ফটোগ্রাফি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদ-এর সঞ্চালক হাবিবা রহমান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদের সাবেক সভাপতি এবং বাংলাদেশ ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক বিপ্লব মুস্তাফিজসহ অনেক কলাকুশলী এবং চলচ্চিত্র সংসদ কর্মী। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানসহ প্রতিদিনই উপস্থিত ছিলেন চলচ্চিত্র অঙ্গনের বিখ্যাত ব্যক্তিত্বসহ প্রদর্শিত চলচ্চিত্রগুলোর কলাকুশলীরা। নুসরাত ইমরোজ তিশা, চঞ্চল চৌধুরী, নুসরাত ফারিয়া, দিব্য জ্যোতিরা নিজেদের চলচ্চিত্র নিয়ে কথা বলতে দর্শকদের সামনে উপস্থিত হন। ১৬ ফেব্রুয়ারি আয়োজনটির সমাপনী অনুষ্ঠান ও হীরালাল সেন পদক প্রদানের মধ্য দিয়ে পর্দা নামে এবারের আসরের।
১২ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৬ ফেব্রুয়ারি—বছর ঘুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে বসন্তের হাওয়ায় হাওয়ায় ঢাকের তালে ভাসছে 'আসিতেছে…আরে আরে আসিতেছে!' আরে, আমার ভাষার চলচ্চিত্র এলো যে! আয়োজনের আমেজে মুখরিত পুরো টিএসসি এলাকা। এক কোণে বসেছে টিকিট কাউন্টার, পুরো টিএসসি আল্পনার রঙে মেতেছে। ১৪ ফেব্রুয়ারি একইসাথে পহেলা ফাল্গুন, ভালোবাসা দিবস ও সরস্বতী পূজা। আর ঠেকায় কে! উৎসবের উপলক্ষ যা-ই হোক, রং-বেরঙের শাড়ি-পাঞ্জাবি পরে সবার সিনেমা দেখা চাই।
সিনেমা দেখতে আসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী নাফিসা আলী প্রথমবারের মতো আমার ভাষার চলচ্চিত্রে সিনেমা দেখতে এসে উৎফুল্লতার সাথে জানান, 'আমার এ বছরের আয়োজনের থিম খুব ভালো লেগেছে, ঢাকঢোল পিটিয়ে আগেকার সময়ে গ্রামে আসিতেছে আসিতেছে বলে যেভাবে আহ্বান করা হতো, সেই আমেজটা পেয়ে খুব ভালো লাগছে। আর নতুন বাংলা সিনেমা এভাবে দেখতে পারছি, এরচেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে! আমি বারবার আসতে চাই।'
আমার ভাষার চলচ্চিত্র: বিশেষত্ব
চলচ্চিত্র নির্মাণ যে উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই করা হোক না কেন, দিনশেষে চলচ্চিত্র মানুষের জন্য। মানুষের জীবনবোধ, যাপিত জীবনের গল্পগুলোকে সযত্নে ধারণ করে মানুষের কাছেই পৌঁছে দেওয়া চলচ্চিত্রের কাজ। সেই অনুভবটাকে ধারণ করে বলেই আমার ভাষার চলচ্চিত্র অন্য অনেক চলচ্চিত্র উৎসবের চেয়ে মাটির ঘ্রাণকে বেশি ধারণ করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নিশাত সালসাবিল রব দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আমরা আমাদের ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে ধারণ করে আমাদের ভাষাসহ আমাদের ভূখণ্ডের যত ভাষা আছে, সব ভাষাকে ও চলচ্চিত্রকে আমার ভাষার চলচ্চিত্রের মাধ্যমে উদ্যাপন করে থাকি।' তিনি জানান, বাংলা চলচ্চিত্রের পাশাপাশি চাকমা ভাষায় নির্মিত চলচ্চিত্র 'মর ঠেঙ্গারি', রাজবংশী ভাষার চলচ্চিত্র 'সাঁতাও' এবং ম্রো ভাষায় নির্মিত 'কিওরি পেক্রা উয়্যু(ডিয়ার মাদার)' আমার ভাষার চলচ্চিত্রে প্রদর্শিত হয়েছে।
নিশাত সালসাবিল রব আরো জানান, 'আমাদের চলচ্চিত্র উৎসব নানা কারণে অন্য চলচ্চিত্র উৎসবের থেকে আলাদা। আমাদের চলচ্চিত্রের লাইন-আপে একইসাথে ধ্রুপদি ও সমসাময়িক বাংলা চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়। আমাদের টিকেটমূল্য সব শ্রেণি-পেশার মানুষ, বিশেষত শিক্ষার্থীদের সাধ্যের মধ্যে রাখা হয়। মানুষের জন্যই চলচ্চিত্র, আমরা সব ধরনের দর্শকের কাছেই এভাবে চলচ্চিত্রকে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করি। আমাদের বিভিন্ন দামের টিকেট নেই, কারণ আমাদের কাছে সব দর্শকই সমান।'
জানতে চাওয়া হয় সাবেকি ধাঁচের আয়োজন সম্পর্কে। তিনি বলেন, 'আমাদের হলে যাওয়ার চর্চা একপ্রকার হারিয়ে গেছে। আমরা গেলে সিনেপ্লেক্সে যাই। কিন্তু আমাদের বাংলা হলে যাওয়ার চর্চাকে বাঁচিয়ে রাখা জরুরি। পুরোপুরি পুরোনো দিনের হলসংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখতে যা যা করা দরকার, তার সবকিছু আমরা করে থাকি।'
'আমার ভাষার চলচ্চিত্র' আয়োজনের সবচেয়ে জোরের জায়গা এর আয়োজনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদকে আগলে রাখা সদস্যেরা। যে যার যার জায়গা থেকে সর্বোচ্চ যত্ন আর ভালোবাসা দিয়ে প্রতিটি কাজ করেন। আমার ভাষার চলচ্চিত্র এর প্রতিটি সদস্যের কাছে প্রাণের মেলা। এবারে প্রথমবারের মতো আয়োজক হিসেবে অংশ নেওয়া দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আনিয়া ফাহমি নিজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলেন, 'বাংলা ভাষার সর্ববৃহৎ চলচ্চিত্র উৎসব আয়োজন করতে পেরে দারুণ অভিজ্ঞতা হয়েছে। সেইসাথে দর্শকদের ভালোবাসাপূর্ণ প্রতিক্রিয়া আমরা পেয়েছি। এ ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে মনে হয়েছে আয়োজন সার্থক।'
সিনেমা বাছাই, থিম, প্রোমো, টাইপোগ্রাফি
'আমার ভাষার চলচ্চিত্র' দীর্ঘ ২২ বছর ধরে পরম যত্নে ধারণ করেছে বাংলা ও বাঙালিত্বকে। আয়োজনের প্রতিটি ক্ষেত্র যেন মায়ের হাতে পরম যত্নে বোনা নকশী কাঁথা, দেখেই মনে হবে, এ তো আমার মাটির, আমার মানুষের।
প্রথমত, চলচ্চিত্র বাছাইয়ের প্রক্রিয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ একটি দল সে বছরে মুক্তি পাওয়া ও ধ্রুপদি চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে থেকে চলচ্চিত্র নির্বাচন করে প্রযোজক, নির্মাতাদের সাথে প্রদর্শনীর ব্যাপারে যোগাযোগ করে। এক্ষেত্রে সব ধরনের দর্শকের কথাই মাথায় রাখা হয়।
প্রায় প্রতি বছরই আমার ভাষার চলচ্চিত্র কোনো না কোনো বিষয়বস্তুকে কেন্দ্র করে সে অনু্যায়ী পোস্টার, প্রোমোশনাল ভিডিও, টাইপোগ্রাফি করা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে বিষয়বস্তু অবশ্যই হয়ে থাকে যা কিছু আমাদের বাংলা ও বাঙালির একান্ত আপন, নিজস্ব।
এ বছর 'আমার ভাষার চলচ্চিত্র ১৪৩০'-এর বিষয়বস্তু ছিল আল্পনা। আমরা বাঙালিরা উৎসব ভালোবাসি, আমাদের ভেতরের সহজাত শৈল্পিকতার সহজ সুন্দর বহিঃপ্রকাশ আল্পনা। উৎসব এলেই বাড়ির আঙিনা থেকে শুরু করে মনের উঠোন, সর্বত্র আমরা ছড়িয়ে দেই আলপনার রঙিন সুখ। আমাদের এই হাজার বছরের সহজাত নান্দনিকতার ছাপ আজ একুশে ফেব্রুয়ারিতে এ মাটির সন্তানদের রাজপথের রক্তাক্ত স্মৃতিকে ধারণ করে। যে রাজপথ ভিজেছিল আমাদের হার না মানা সন্তানদের রক্তে, বহুরঙা আলপনা যেন রাজপথের সেই প্রাচীন ক্ষতে আশ্বাসের প্রলেপ দিয়ে যায়, অবিরাম।
একুশের চেতনা ও সহজাত নান্দনিকতাকে ধারণ করতে এ বছর 'আলপনা'কে মূল উপজীব্য করে নানা সাজসজ্জা করা হয়েছে। তেমনিভাবে আমার ভাষার চলচ্চিত্র ১৪২৯-এ বাংলা লিপি, আমার ভাষার চলচ্চিত্র ১৪২৮-এ বসন্ত, আমার ভাষার চলচ্চিত্র ১৪২৫-এ চর্যাপদসহ নানা সময়ে নানা কিছুকে ধারণ করেছে এ চলচ্চিত্র উৎসব।
আমার ভাষার চলচ্চিত্রের আয়োজনে প্রতি বছর চোখে পড়ার মতো নান্দনিক হয়ে উঠেছে এর টাইপোগ্রাফি। একেক বিষয়কে ধারণ করে পরম যত্নে ও সৃজনশীলতায় প্রতিটি বর্ণকে ফুটিয়ে তোলা হয় এর পোস্টারে। কখনো বর্ণমালা ফুল, পাতা, পাখিদের, কখনো তা আলপনায় রঙিন, কখনো লাটিম, কাঠবিড়ালি, বাঁশিতে বর্ণেরা যেন সুর তুলেছে। অবাক চোখে তাকিয়ে থাকা যায় তাদের পোস্টারের দিকে।
এ সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদের উন্মেষ আরিফ বলেন, 'আমাদের ডিজাইনিংয়ের টিম পোস্টারের কাজটা করে থাকে। পোস্টার যে বিষয়বস্তুর আলোকে হয়, উৎসবের সাজসজ্জা, টাইপোগ্রাফি, প্রোমো ভিডিও সর্বোপরি দর্শকের সাথে সে অনু্যায়ীই সংযোগ স্থাপিত হয়। এ বছরের পোস্টার, টাইপোগ্রাফি করেছেন আমাদের আরেক সদস্য অপূর্ব দাস শুভ্র। গত বছরের কাজটা আমার করা। আমাদের ইচ্ছা আছে আমার ভাষার চলচ্চিত্রের সবগুলো পোস্টার একসাথে করে ভবিষ্যতে একটি গ্রন্থনা প্রকাশ করার।'
শুধু কি পোস্টার? তাদের বিজ্ঞাপনচিত্রে ফুটে ওঠে আমাদের চিরচেনা গল্পগুলো, যা বারে বারে মনে করিয়ে দেয় চলচ্চিত্র কীভাবে আমাদের বাংলার মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমাদের লাটিম খেলা সহজ জীবন, বাড়ির ছাদে অভিমানিনীর অপেক্ষা, শূন্যপকেটের বেকার ভবঘুরে—আমাদের সব চিরপরিচিত গল্পগুলোকে ধারণ করে বিজ্ঞাপনগুলো। সাথে থাকে দিন যায় কিন্তু কথা না রাখার গান, দুরন্ত ঘূর্ণির পাকে আমাদের আবার সন্ধেতে শুধু দুজনের হারিয়ে যাওয়ার গান।
হীরালাল সেন পদক
আমাদের হীরালাল সেন, ভারতবর্ষের প্রথম রাজনৈতিক চলচ্চিত্র থেকে শুরু করে এ উপমহাদেশের চলচ্চিত্রকে পথ দেখান তিনি। বাংলা চলচ্চিত্রের আদিপুরুষ হীরালাল সেনের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদ প্রতি বছর আমার ভাষার চলচ্চিত্র উৎসবে 'হীরালাল সেন পদক' দিয়ে থাকে। ২০১৭ সালে এই নির্মাতার মৃত্যুশতবার্ষিকী উপলক্ষে উৎসবের ১৭তম আসরে প্রথমবারের মতো ঘোষণা করা হয় পদকটি। বিগত এক বছরের মধ্যে মুক্তিপ্রাপ্ত শ্রেষ্ঠ বাংলাদেশি চলচ্চিত্রকে হীরালাল সেন পদকে ভূষিত করা হয়।
'আমার ভাষার চলচ্চিত্র ১৪৩০'-এ হীরালাল সেন পদক পুরস্কার লাভ করে নির্মাতা যুবরাজ শামীমের চলচ্চিত্র 'আদিম' (২০২৩)। শুক্রবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) এই পুরস্কার বিতরণের মাধ্যমে উৎসবেরও পর্দা নেমেছে। সমাপনী সন্ধ্যায় যুবরাজ শামীমের হাতে 'হীরালাল সেন পদক' তুলে দেন সাবেক সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. কাবেরী গায়েন। এছাড়াও বিশেষ সম্মাননা পদক লাভ করেছে 'মুজিব: একটি জাতির রূপকার' (২০২৩)।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত অধ্যাপক ড. কাবেরী গায়েন বলেন, 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদ এবং আমার ভাষার চলচ্চিত্র একটি ইতিহাসের ধারা বহন করছে। আপনারা যারা এ আয়োজনের সাথে জড়িত, আপনাদের সকলের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা। আমি চাইব আপনারা চলচ্চিত্র দেখুন, আপনাদের ঘিরে চলচ্চিত্র নিয়মিত দেখা ও চলচ্চিত্র সমালোচনার সুস্থ ধারা গড়ে উঠুক।'
আমার ভাষার চলচ্চিত্র: ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এ চলচ্চিত্র উৎসবটি সর্বস্তরে পৌঁছে গেলে গ্রাম বাংলার সবাই এ উৎসবে শামিল হয়ে চলচ্চিত্রকে উদ্যাপন করতে পারত। কিন্তু তা কি আদৌ সম্ভব?
সম্ভব যদি না হয়, তবে তার পেছনে কীসের দায় বা তারা আদৌ এসব নিয়ে ভাবছে কি না, জানতে চাওয়া হলো সাধারণ সম্পাদক নিশাত সালসাবিল রবের কাছে। তিনি জানালেন, 'এটা তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদের আয়োজন। এটা আসলে বড় পরিসরে আমাদের একার পক্ষে করা বেশ চ্যালেঞ্জিং। আমরা অন্যান্য চলচ্চিত্র সংসদের সাথে যোগাযোগ করে তাদের এ ধরনের চলচ্চিত্র উৎসব আয়োজনে উৎসাহিত করি। আমাদের এখানে সমসাময়িক চলচ্চিত্রগুলোর পাইরেসি হওয়ার সম্ভাবনা থাকায়ও ঢাকার বাইরে আয়োজনে প্রতিবন্ধকতা রয়েছে।'
বাংলা চলচ্চিত্র আমাদের শূন্য বুকপকেটে জমিয়ে রাখা নিখাদ ভালোবাসা কিংবা কাজলে জমিয়ে রাখা দুঃখের মতো আপন। জীবন বাস্তবতার দুরন্ত ঘূর্ণির পাকে তবু বাংলা চলচ্চিত্র হাজার বছর পৃথিবীর বুকে ভালোবাসায় নিজের অস্তিত্বের জানান দিক, সেইসাথে ভালোবাসায় আয়োজিত হোক মাতৃভাষার চলচ্চিত্রের উদ্যাপন 'আমার ভাষার চলচ্চিত্র'।