মেহরীয়ান ও ইশতিয়াকের আয়োজনে ঘরোয়া খাবার পাচ্ছেন ব্র্যাকের শিক্ষার্থীরা
মেহরীয়ান মহসীন ও ইশতিয়াক আহমেদ দুই বন্ধু। পড়ছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে। এক বিকেলে বন্ধুদের সাথে আড্ডায় কথা ওঠে ক্যাম্পাসের খাবার নিয়ে। ক্যাম্পাসের আশেপাশে কম দামে ভালো মানের খাবার পাওয়া যায় না খুব একটা। সব ফাস্ট ফুড আর ফুচকা-চটপটির দোকান। এগুলো দিয়ে দুপুরের খাবার ভালোমতো হয় না তাদের। ক্যাফেটেরিয়ার দামি খাবারও প্রতিদিন খাওয়া সম্ভব না সবার পক্ষে।
কথায় কথায় দু'জন ভাবলেন এমন কিছু করা যায় কি না যেখানে বাসা থেকে খাবার এনে ক্যাম্পাসের আশেপাশে কোথাও বসবেন তারা। এতে সাধারণ শিক্ষার্থীরাও কম খরচে ঘরোয়া খাবার খেতে পাবে, আর তাদেরও আয় হবে।
যেই ভাবা সেই কাজ! মেহরীয়ান আর ইশতিয়াক মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন ব্র্যাকের পাশেই ঘরোয়া খাবারের আয়োজন করবেন। আশেপাশের বন্ধুরাও উৎসাহ দিয়ে বলল এমন কিছু করা গেলে সবার জন্যই ভালো হয়।
প্রথম দিন
১০ ফেব্রুয়ারি সকাল বেলা ব্র্যাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পকেট গেট থেকে একটু সামনের দিকে একটা জায়গায় টেবিল নিয়ে বসেন মেহরীয়ান ও ইশতিয়াক। আগের রাতে দু'জনে একসাথে বাজার করেছিলেন। সকালে মেহরীয়ানের বাসায় রান্না হয় খিচুড়ি, ডিম ভুনা, মুরগির মাংস আর স্পেশাল পেঁয়াজ-মরিচের ভর্তা। ডিম-খিচুড়ি ৭০ টাকা, মুরগি-খিচুড়ি ৯০ টাকা আর ভর্তা ফ্রি—এভাবে মেনু সাজিয়ে খাবার বিক্রি শুরু করেন তারা।
প্রথম দিনে শিক্ষার্থীদের থেকে খুব একটা সাড়া পাওয়া যায়নি। তাদের বন্ধু-বান্ধবরাই প্রথম দিন পাশে ছিলেন পুরো সময়। বন্ধুদের খাবার পরিবেশন করে, আড্ডায় কেটে যায় দুজনের সময়।
কিন্তু দ্বিতীয় দিন ঘটে এক দারুণ ঘটনা। সকালে বাসা থেকে খাবার এনে প্রথম দিনের মতোই বন্ধু ও পরিচিতদের কাছে বিক্রি শুরু করেন তারা। কিছুক্ষণ পরে একজন খাবার খেয়ে তাদের প্রশংসা করে ফেসবুকে পোস্ট দেন।
তারপর মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে যান তারা। সেদিনই ব্র্যাকের অনেক শিক্ষার্থী সেই ফেসবুক পোস্ট দেখে মেহরীয়ান-ইশতিয়াকের ঘরোয়া খাবারের স্বাদ নিতে ছুটে যান পকেট গেটে।
ইশতিয়াক বলেন, 'প্রথম দিন আমি খুব নার্ভাস ছিলাম। খাবার কেমন হবে, সবকিছু ঠিকমতো হবে কি না—এসব নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে করতে আমার শরীর খারাপ হয়ে গিয়েছিল প্রায়। দুশ্চিন্তায় হাত থেকে আমার মোবাইল ফোনটাও পড়ে ভেঙে গিয়েছিল সেদিন! কিন্তু দ্বিতীয় দিনে এত ক্রেতা আর পুরোটা সময় বন্ধুদের সমর্থন পেয়ে আমরা আত্মবিশ্বাস পাই। ওইদিন সব খাবার এক নিমেষে শেষ হয়ে যায়। এমনও হয়েছে যে একজন দাঁড়িয়ে পরপর তিন প্লেট খিচুড়ি খেয়েছেন।'
দুপুরের খাবারের সময়ে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঘরোয়া খাবারের স্বাদ পেয়ে মেহরীয়ান ও ইশতিয়াকের আয়োজনকে খুব দ্রুত আপন করে নিয়েছেন। প্রতিদিন সকাল নয়টা থেকে সাড়ে নয়টার মধ্যে তারা খাবার নিয়ে আসেন বাসা থেকে। সকাল এগারোটার মধ্যে তাদের এক হাঁড়ি খিচুড়ি শেষ হয়ে যায়। এরপরে সাড়ে এগারোটার দিকে ইশতিয়াক বাইকে করে আরেক হাঁড়ি খিচুড়ি নিয়ে আসেন। সেটাও দুপুরের আগেই শেষ হয়ে যায়। দুপুর ২টার দিকে নিয়ে আসা হয় খিচুড়ির তিন নম্বর হাঁড়ি—যা বিকালের মধ্যে শেষ হয়।
কেন বাসা থেকে একবারে তিন হাঁড়ি খিচুড়ি আনা হয় না?—এ প্রশ্নের জবাবে মেহরীয়ান বলেন, 'এখনো একবারে এত পরিমাণে খিচুড়ি রান্না করার মতো ব্যবস্থা নেই আমাদের বাসায়। আর কখনো যদি হয়ও, আমরা এভাবে বারবার যেয়েই খিচুড়ি নিয়ে আসব। কারণ ভাত-জাতীয় খাবার সকালে এতগুলো একসাথে এনে রাখলে বিকাল পর্যন্ত তা ভিজে যেতে পারে। এতে আমাদের খাবারের মান কমে যাবে। এখন আমরা সব বেলাতেই গরম খিচুড়ি পরিবেশন করতে পারি শিক্ষার্থীদেরকে। শুধু মুরগি আর ডিমের তরকারি সকালে একবারেই আনা হয়। সেটা আমরা ওভেনে গরম করে পরিবেশন করি। প্রতিবেলায় সবাইকে গরম আর তাজা ঘরোয়া খাবার পরিবেশন করাই আমাদের ব্যবসার মূল উদ্দেশ্য।'
শিক্ষার্থীদেরকে আকর্ষণ করতে মেহরীয়ান নিজ হাতে একটি মেনু কার্ড তৈরি করেন। আর তাদের খাবারের আয়োজনের নাম দেন 'সেভোরি কিচেন' (Savory Kitchen)।
পেছনের কারিগরের গল্প
'সেভোরি কিচেন শুরুর আইডিয়া আমার আর ইশতিয়াকের ছিল। কিন্তু এটা বাস্তবায়ন আর সফলভাবে চালানোর পেছনে অনেক মানুষ কাজ করেন। তাদের সাহায্য ছাড়া আমরা এটা করতে পারতাম না,' বলছিলেন মেহরীয়ান।
সেভোরি কিচেনের খাবারের সবগুলো আইটেমই মেহরীয়ান আর ইশতিয়াকের বাসায় রান্না করা হয়। দুই বাসায়ই তাদের মায়েরা সব রান্না করেন। প্রথমদিকে সবগুলো আইটেম মেহরীয়ানের বাসায় রান্না হতো। কিন্তু জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির সাথে সাথে চাপ বেড়ে যায়। খাবারের চাহিদাও বেড়ে যায়। তাই ২-৩ দিন পর থেকে ইশতিয়াকের বাসায় মুরগি আর ডিম রান্না শুরু হয়। আর মেহরীয়ানের বাসায় খিচুড়ি আর ভর্তা।
প্রতিদিন ক্লাস শেষে রাতে তারা একসাথে বাজারে যান। পরের দিনের রান্নার হিসাব অনুযায়ী বাজার নিয়ে বাসায় আসার পর রাত থেকেই শুরু হয় রান্নার প্রস্তুতি। ইশতিয়াক বলেন, 'রাতের বেলা এমনও হয় যে আমাদের মায়ের সাথে আমরা, আমাদের খালা-ফুফুরাও একসাথে পেঁয়াজ-রসুন-আদা ছিলতে বসে যাই। আর সকালে মা সবকিছু ফ্রেশ রান্না করেন। আগেরদিনের বেঁচে যাওয়া খাবার কখনোই আমরা পরেরদিনের জন্য নিই না। আর আমরা ফ্রিজেও কোনো কাঁচাবাজার কিনে জমাই না। প্রতিদিনের মুরগি তার আগের রাতেই কেনা হয়।'
প্রায় লাখখানেক টাকা পুঁজি নিয়ে সেভোরি কিচেনকে শুরু করতে হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, শুধু একটি টেবিল, ওভেন, কিছু বক্স, প্লেট-চামচ আর খাবার নিয়ে ব্যবসা শুরু করতে তো এত টাকা তো লাগার কথা না। কিন্তু তারা যেখানে বসেন, সেটা ব্র্যাকের জায়গা না। সেখানের সিকিউরিটি মানি আর মাসিক ভাড়া হিসেবে একটি বড় অঙ্কের টাকা খরচ হয়েছে তাদের।
সেভোরি কিচেনের ব্যবসা শুরু করার পুঁজি দুইজন মিলেই দেন। মেহরীয়ান আগে পড়ার পাশাপাশি চাকরি করতেন। সেখান থেকে তার জমানো টাকা পুঁজিতে লাগিয়েছেন। আর ইশতিয়াককে তার বাবা পুঁজি দিয়ে সাহায্য করেছেন। নানাভাবে পরিবারের সাহায্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সেভোরি কিচেন।
ভালো-মন্দ নিয়ে এগিয়ে চলা
মেহরীয়ান ও ইশতিয়াক দুজনই ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ ষষ্ঠ সেমিস্টারের শিক্ষার্থী। ব্যবসা চালানোর বিদ্যা রপ্ত করছেন বিধায় সেভোরি কিচেন চালাতে তাদের বেশ সুবিধা হয়।
কিন্তু সেমিস্টারের ব্যস্ত রুটিন, পরীক্ষা আর অ্যাসাইনমেন্টের মধ্যে আবার প্রতিদিন ব্যবসায় সময় দেওয়া, বাজার করা—এত চাপ কীভাবে সামলান তারা?
জবাবে মেহরীয়ান জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা অনেক সাহায্য করেছেন এ ব্যাপারে। কাজের চাপে কখনো অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিতে দেরি হলে সময় বাড়িয়ে দেন শিক্ষকরা। ঘরোয়া খাবারের এ আয়োজনের জন্য সব শিক্ষকের সমর্থন পেয়েছেন তারা। অনেক শিক্ষকই তাদের প্রশংসায় ভাসিয়েছেন।
খাবারের ব্যবসা মেহরীয়ান ও ইশতিয়াকের জন্য একদম নতুন একটি বিষয় ছিল। পরিচিত মানুষজনের সামনে ব্যবসা করা, পরিবারের সবাইকে নিয়ে একসাথে কাজ করা, প্রতিদিনের বাজার, সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত দোকান সামলানো আর পড়ালেখার চাপ—সবমিলিয়ে প্রচণ্ড মানসিক চাপ যায় দুজনের ওপর দিয়ে।
মেহরীয়ান বলেন, 'শুরু করার আগে থেকেই নিজেদের সামনে "আই ডোন্ট কেয়ার"-এর একটা ঢাল লাগিয়ে নিতে হয়েছে আমাদেরকে। আশেপাশে কে কী বলল বা ভাবল, এসব নিয়ে চিন্তা করলে আমরা সামনে আগাতে পারব না—এগুলো ভেবেই আমরা নিজেদের প্রস্তুত করছি।'
সেভোরি কিচেন শুরু করার জন্য সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং বিষয় ছিল বসার জায়গা ঠিক করা। প্রথমে তারা ব্র্যাকের মালিকানাধীন একটি জায়গায় বসার পরিকল্পনা করলেও পরে সেখানে বসা হয়নি। এখন যেখানে বসেন, সেখানে অন্য খাবারের দোকানও আছে। সেখানে ফুচকা-চটপটি ও বিভিন্ন ফাস্টফুডের দোকান বসে। সেদিকে একটিমাত্র জায়গা খালি ছিল, যা শেষ মুহূর্তে গিয়ে বুকিং দিয়ে পান তারা। বুকিং মানি হিসেবে সেখানকার কর্তৃপক্ষ একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকার কথা বলে, যা তখনই জমা দেওয়া মেহরীয়ান ও ইশতিয়াকের জন্য বেশ কঠিন ছিল। তবু তারা সাহস করে ও পরিবারের সমর্থন পেয়ে জায়গা বুকিং করে ব্যবসা শুরু করেন।
যে পরিমাণ পুঁজি বিনিয়োগ করে সেভোরি কিচেন শুরু হয়েছে, তা এখনো উঠে আসেনি। একে লাভজনক ব্যবসায় রূপান্তর করার জন্য আরো সময় লাগবে। কিন্তু সবার সমর্থন আর ভালোবাসায় সব বাধা পেরিয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য ঘরোয়া খাবারের আয়োজন করতে পেরেই সন্তুষ্ট মেহরীয়ান ও ইশতিয়াক।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
'আমরা এখন পর্যন্ত কোনো নেগেটিভ রিভিউ পাইনি খাবার নিয়ে। খাবারের মান, পরিমাণ, পরিবেশনা—সবকিছু নিয়েই সবাই সন্তুষ্ট। অনেকেই বেশি পরিমাণে খাবার পার্সেল করে নিয়ে যায়। আবার অনেকে আমাদের থেকে খাবার নিয়ে ক্যাফেটেরিয়ায় বসে খায়। এছাড়াও আমরা বিভিন্ন জায়গায় ক্যাটারিংয়ের অর্ডার পাওয়া শুরু করেছি। সেদিনও একটি অনুষ্ঠানে ২৮০ প্যাকেট খাবারের অর্ডার ছিল,' বলেন ইশতিয়াক।
সেভোরি কিচেন বর্তমানে যে অবস্থায় আছে, তাতে কিছুদিন পর ক্রেতাদের চাপ সামলানো কষ্ট হয়ে যাবে তাদের পক্ষে। প্রতিদিনই ৮০ থেকে ১০০ জন করে ক্রেতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এত মানুষের রান্নার আয়োজন করা সময়ের সাথে সাথে কঠিন হয়ে পড়বে দুই উদ্যোক্তার মায়েদের জন্য। সেজন্য বাসায় দুই-তিনজন অতিরিক্ত সাহায্যকারী রাখবেন বলে জানিয়েছেন তারা।
যেখানে খাবার নিয়ে বসেন, সেখানে গ্যাস সিলিন্ডার নেওয়ার অনুমতির জন্য আবেদন করেছেন তারা। এতে করে ওভেনে খাবার গরম না করে গরম তাওয়া থেকে খাবার পরিবেশন করা যাবে। ইতিমধ্যে চাপ কমানোর জন্য দোকান সামলানোর লোকের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
দোকানেই রান্না করে খাবার পরিবেশন করা শুরু করবেন কি না—এ প্রশ্নের জবাবে দুজনে বললেন, এটা সম্ভব হলেও তারা করবেন না। কারণ এখানে মায়ের হাতের রান্নার যে স্বাদ, তা দেওয়া সম্ভব হবে না আর। আর ঘরোয়া রান্না যথাযথ পরিচ্ছন্নতা বজায় রেখে করা হয়। বাইরে খোলা জায়গায় রান্না করলে সেটা করা যাবে না।
উদ্যোক্তা হলেও দুজনেই এখনো শিক্ষার্থী। লেখাপড়া শেষ হওয়ার পর সেভোরি কিচেনকে ছোট টেবিল থেকে বড় রেস্টুরেন্টে রূপ দেওয়ার দেখছেন মেহরীয়ান ও ইশতিয়াক। সেটা অবশ্যই হবে শিক্ষার্থীবান্ধব বাজেটে। আর ব্র্যাকের আশেপাশেই থাকার ইচ্ছা তাদের। রেস্টুরেন্ট খোলার পর তাদের মূল লক্ষ্য হবে মায়ের রান্নার রেসিপি অটুট রাখা। কারণ মায়ের হাতের রান্নার স্বাদই তাদের মূল চালিকাশক্তি।
দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসেই ভালো খাবারের অভাবে ভোগেন শিক্ষার্থীরা। ভাজা-পোড়া, ফাস্টফুড আর বাসি খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন অনেকেই। সেভোরি কিচেনের মতো ঘরোয়া খাবারের উদ্যোগ গড়ে উঠুক প্রতিটা ক্যাম্পাসে—এমনটাই চাওয়া মেহরীয়ান ও ইশতিয়াকের।