‘বাংলার মিস্টার বিন’ জাদুও জানেন
বিশ্ববিখ্যাত কৌতুক অভিনেতা 'মিস্টার বিন'কে ঢাকার একুশে বইমেলায় হেঁটে-চলে বেড়াতে দেখে দর্শনার্থীরা বেশ অবাক। ছোটছোট বাচ্চারা এক ঝলকেই চিনে নিচ্ছে মিস্টার বিনকে। বাবা-মায়ের কাছে বায়না করছে মিস্টার বিনের কাছে যাওয়ার। বাবা-মাও বাচ্চার আবদার মেটাতে সামনে তাকিয়ে হকচকিয়ে উঠছেন। এ কী চোখের ভুল? মিস্টার বিন ঢাকায় এলেন কেমন করে? ঝরঝরে বাংলা ভাষায় আবার কথাও বলছেন! ব্যাপারখানা কী?
ভদ্রলোকের নাম রাসেদ শিকদার। তবে মানুষ তাকে চেনে মিস্টার বিন নামেই। তিনি শুধু চেহারাতেই মিস্টার বিন নন, তার আরেকটি পরিচয়ও আছে — তিনি একজন ম্যাজিশিয়ান এবং কমেডিয়ানও।
কেমন করে মিস্টার বিন?
১৯৯৮ সালে রাসেদ শিকদার জন্ম নেন পাবনা জেলার খানপুরা গ্রামের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে। শৈশব ও কৈশোর কেটেছে পাবনাতেই। তিন ভাই এক বোনের পরিবারে তার বেড়ে ওঠা। ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখতেন ম্যাজিশিয়ান হওয়ার।
'ছোটবেলা থেকেই কেউ কেউ আমাকে বলত, আমার মুখখানা মিস্টার বিনের মতন। তখন আমি সেভাবে বুঝতাম না। কিন্তু যখন আমি মিস্টার বিনের ভিডিও দেখা শুরু করি, তখন বুঝতে পারি সত্যিই আমার চেহারার সঙ্গে কিছুটা মিল রয়েছে। ক্লাস সিক্স-সেভেনে পড়বার সময় থেকে বন্ধুরা আমাকে মিস্টার বিন বলে ডাকতে শুরু করে।
'আমার মনে হতো, আমি তো রাসেদ শিকদার। আমাকে মিস্টার বিন কেন বলবে? এক ধরনের পরিচয় সংকটে ভুগেছি সে সময়টাতে। পরবর্তীতে আমি ম্যাজিক শেখা শুরু করি। কোর্ট-টাই পরে ম্যাজিক দেখাবার সময়েও শুনতে হতো, আরে এ তো মিস্টার বিন। হাসাহাসিও করত অনেকে,' বলেন রাসেদ।
একটা সময়ে এসে রাসেদের মনে হলো, মানুষের এ ধরনের তীর্যক মন্তব্যকে গায়ে না মেখে এটাকেই তো অনুপ্রেরণা হিসেবে নিতে হবে। 'মিস্টার বিনের সঙ্গে যদি সত্যিই আমার মিল থেকে থাকে, তবে মিস্টার বিনের মতো কিছু করার চেষ্টা করে দেখা যাক,' এভাবেই রাসেদ শিকদার থেকে মিস্টার বিন হয়ে ওঠার গল্প বলছিলেন তিনি।
শিখলেন ম্যাজিক
ছোটবেলা থেকেই ম্যাজিকের প্রতি আগ্রহী ছিলেন রাসেদ শিকদার। একবার স্কুলে এক ম্যাজিশিয়ান এসে মাটির দলাকে ক্যান্ডিতে রূপান্তরিত করলেন। দেখেই রাসেদের চকচক করে উঠল। ম্যাজিশিয়ান সেই ক্যান্ডি ছড়িয়ে দিলেন স্কুলের ছাত্রদের মাঝে। একটা ক্যান্ডি খেলেন রাসেদও।
'মনে হলো, ইশ আমিও যদি ম্যাজিশিয়ান হতে পারতাম! ম্যাজিশিয়ান হলেই মাটির দলা থেকে এরকম ক্যান্ডি বানাতে পারব ভেবেই ভালো লাগা কাজ করত,' এভাবেই ছোটবেলার কথা বলতে বলতে নস্টালজিক হয়ে পড়ছিলেন রাসেদ শিকদার। ৯ বছর বয়সে একটা ম্যাজিকের বই হাতে পান তিনি। ১০ টাকা দামের সেই ছোট্ট বই থেকে ম্যাজিকের হাতেখড়ি।
২০১০ সালে প্রিন্স আকাশ নামক এক ম্যাজিশিয়ানের হাত ধরে আনুষ্ঠানিকভাবে ম্যাজিক শেখা শুরু রাসেদের। সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে কখনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি তার পরিবার। জাদু শেখার ক্ষেত্রে সবসময় পেয়েছেন মা-বাবার অনুপ্রেরণা।
ছোটোবেলা থেকেই রাসেদ দূর-দূরান্তে ম্যাজিক শো করেছেন। রাসেদ শিকদার ২০১৭ সাল থেকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে (বিটিভি) জাদু বিষয়ক ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান 'চোখের পলকে'-এ নিয়মিত জাদু দেখান। বর্তমানে তিনি ম্যাজিক ফেডারেশন এবং বিশ্বের জাদু শিল্পীদের বৃহত্তম সংগঠন 'ইন্টারন্যাশনাল ব্রাদারহুড অভ ম্যাজিশিয়ানস'-এর সদস্য।
ম্যাজিশিয়ান নাকি মিস্টার বিন?
মানুষ সবসময় নিজের নাম পরিচয়ে পরিচিত হতে চায়। রাসেদ শিকদারও তার ব্যতিক্রম নন। ম্যাজিশিয়ান রাসেদ শিকদার হিসেবে পরিচয় দিতেই তিনি বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। তবে মিস্টার বিন হিসেবে পরিচয় দিতেও লজ্জাবোধ করেন না কখনো। তিনি মনে করেন, মিস্টার বিনের মতো করে তিনি কাজ করতে পারেন দেখেই মানুষ তাকে বাংলার মিস্টার বিন বলে। শুরুতে বিনের চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলতে মুখ, কপাল বাঁকাতে গিয়ে অনেক কসরত করতে হতো তাকে। অবশ্য এখনো প্রতিনিয়ত মিস্টার বিনের ভাবভঙ্গির ওপর তাকে রীতিমতো গবেষণা করতে হয়।
ম্যাজিশিয়ান যখন লেখক
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির বাস স্কুলে আসত। সেখান থেকে বই নিয়ে পড়তেন রাসেদ শিকদার। 'বই পড়ে বই পুরস্কার' প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে অনেক বই জিতেছেন তিনিও। আস্তে আস্তে নিয়মিত পাঠক হয়ে ওঠা এভাবেই।
বইয়ের শেষ পাতায় কবি কিংবা লেখক পরিচিতি পড়তে গিয়ে মনের মধ্যে লেখক হওয়ার বাসনাও উঁকি দিয়েছে অনেকবার। রাসেদের সেই ইচ্ছে পূরণ হলো অবশেষে। ২০২৪ সালের বইমেলায় তার লেখা বই দ্য পাসওয়ার্ড অব সাকসেস প্রকাশিত হয়েছে। সামনে লিখতে চান আরও বই।
ম্যাজিশিয়ান হিসেবে স্মরণীয় ঘটনা
কমেডি আর ম্যাজিকের সমন্বয়ে নতুনত্বের সঙ্গে পারফরম্যান্স দেখান রাসেদ শিকদার। এটিই তার বিশেষত্ব। পাবনার একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে ম্যাজিক দেখাতে গেলেন সেবার। রোমাঞ্চকর একটি ম্যাজিক দেখাচ্ছিলেন তিনি। স্কুলের একটি বাচ্চা তার মায়ের হাত ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। অভিভাবকটি খুব মনোযোগ দিয়ে ম্যাজিশিয়ানের কাণ্ডকারখানা দেখছিলেন। এদিকে তার বাচ্চা ম্যাজিক দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে যাবার যোগাড় — মায়ের সেদিকে খেয়াল নেই।
কিছুক্ষণ পর বাচ্চাটির অসুস্থতা নজরে আসায় একটা ছোটখাটো ভিড় জমে যায়। শেষ পর্যন্ত বাচ্চাটিকে হাসপাতালে নিতে হয়। পরে অবশ্য সুস্থ হয়ে যায়। সেই থেকে রাসেদ শিকদার ছোটদের স্কুলে এমন রোমাঞ্চকর ম্যাজিক দেখানো থেকে বিরত থাকেন।
কেমন লাগে খ্যাতির বিড়ম্বনা?
বাংলার মিস্টার বিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে ওপার বাংলাতেও বেশ জনপ্রিয়ই বলা যায়। রাসেদ শিকদার বিভিন্ন সময়ে তিনবার পশ্চিমবঙ্গে গিয়েছেন কলকাতার ম্যাজিশয়ান বীর সুপ্রিয়র আমন্ত্রণে। কলকাতা, মুর্শিবাদসহ নানা জায়গায় শো করেছেন। ওপার বাংলার কোনো দর্শনীয় স্থানে ঘুরতে গেলে সেখানেও তাকে ঘিরে ভিড় জমে যায়।
চেহারায় মিস্টার বিনের ছাপ, অনেক সাধনা ও পরিশ্রমে রপ্ত করা নানা ধরনের ভাবভঙ্গি, আর ম্যাজিকের সংমিশ্রণ; সুতরাং সবসময় একটা ভিড়ভাট্টা লেগেই থাকে রাসেদ শিকদারের আশেপাশে। এই যে সবসময় জনগণের উৎসাহ কিংবা নানা ধরনের প্রশ্ন, ছবি তুলতে চাওয়ার আবদার, কেমন লাগে ব্যক্তি রাসেদ শিকদারের?
'সত্যি বলতে সবসময় কারওরই ভালো লাগে না। হয়তো জরুরি কোনো কাজে বেরোচ্ছি, তখন কেউ একজন এসে ছবি তুলতে চাইছেন। অথচ না বলবার জো নেই। অনেকক্ষেত্রেই যিনি আমাকে ব্যক্তিগতভাবে চেনেন না, তাকে 'না' বললে আমার সম্পর্কে একটা বিরূপ ধারণা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অথচ একজনের সঙ্গে ছবি তোলার জন্যে দাঁড়ালেই আরও পাঁচজন এসে একই ধরনের বায়না করেন,' বলেন রাসেদ।
অনুকরণ নয়, উদ্দেশ্য সুস্থ বিনোদন
বিশ্ববরেণ্য কৌতুক অভিনেতা রোয়ান সেবাস্টিয়ান অ্যাটকিনসনের অভিনীত চরিত্র মিস্টার বিনের সঙ্গে চেহারায় এতখানি মিল থাকা রাসেদ শিকদারের প্রাণের ইচ্ছে এ কৌতুক অভিনেতাকে একবার নিজ চোখে দেখার। মিস্টার বিনকে অনুসরণ করতে করতে তার প্রতি আলাদা এক ধরনের শ্রদ্ধাবোধ তৈরি হয়েছে রাসেদের মাঝে।
রাসেদ শিকদার মিস্টার বিনের অনুকরণকে দেখেন ইতিবাচকভাবে। কোনো ব্যক্তির ভালো কোনো গুণকে অনুসরণ দোষের কিছু নয় বলে মনে করেন তিনি। মিস্টার বিনের চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশে সুস্থ ধারার বিনোদনের অংশ হতে চানম দিতে চান নৈতিক শিক্ষার বার্তা।
ছবি: সৌজন্যেপ্রাপ্ত