এবারের রমজানে অনেক ক্রেতারই নাগালের বাইরে থাকবে খেজুর
চিত্র-১
সৌম্য চেহারার ষাটোর্ধ্ব এক বৃদ্ধ। স্ত্রীসহ প্রবেশ করলেন ধানমন্ডি-৪ এর নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দোকান সুপারশপ আগোরায়। একে একে ছোলা, মুড়ি, চিড়া, চিনি, দই, তেল ইত্যাদি কেনা শেষ করে খেজুর কিনতে সাজিয়ে রাখা বক্সের দিকে তাকালেন। এদিক-ওদিক দেখলেন কিছুক্ষণ। তারপর দোকানের কর্মীকে ডেকে কিনে নিলেন এক কেজি দাবাস খেজুর। উল্লেখ করা প্রয়োজন, আগোরায় দাবাস খেজুরের দাম কেজি প্রতি ৬৭০ টাকা, যা অন্যান্য খেজুরের তুলনায় সবচেয়ে কম।
চিত্র- ২
শাহবাগের মোড়ের কিছুটা আগে। ভ্যানভর্তি নানান ধরনের খেজুর সাজিয়ে রেখেছেন বিক্রেতা শফিক (ছদ্মনাম)। পথে যেতে যেতে ক্রেতাদের কেউ কেউ জিজ্ঞেস করে নিচ্ছেন কোন খেজুরের দাম কত। এই দাম শুনেই কিছুটা চিন্তার ছাপ পড়ে যাচ্ছে তাদের চেহারায়, কেউ কেউ আবার দামাদামি করছেন জোর খাটিয়ে। এতে একপক্ষ হাতভর্তি খেজুর নিয়ে ফিরছেন, কেউ কেউ খালি হাতেই। একদল আবার আধাকেজি থেকে শুরু করে ২৫০ গ্রাম করেও কিনছেন খেজুর।
এমন একজন ক্রেতা হলেন মাহবুব আলম। কাজ করেন একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে। অনেক দামাদামি করেই কিনলেন আধাকেজি বরই খেজুর।
আধাকেজিতে মাস চলবে কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, "কিছু তো করার নাই আসলে। সবকিছুর দাম বাড়ছে, কিন্তু আমাদের বেতন তো আর বাড়ে না। হঠাৎ করে যদি ২০০ টাকার খেজুর ৪০০ টাকা হয়ে যায়, আর ইনকাম আগের মতোই থাকে– তবে কেনার পরিমাণ তো কমাতে হবেই, তাই না? আগে এই টাকায় এক কেজি পেতাম। এখন পাই আধাকেজি। মানিয়ে চলতে হবে কোনোভাবে।"
চিত্র-৩
১০ মার্চ, বিকেল ৪টা বেজে ১৫ মিনিট। কাওরান বাজার এলাকায় তখন ক্রেতাদের উপচে পড়া ভিড়। একদিন পরেই পবিত্র রমজান শুরু। সে উপলক্ষে প্রয়োজনীয় বাজার সদাই কিনতে তাদের বাজারে আগমন। অন্যান্য জায়গার তুলনায় এখানে কম দামে কেনা যায় বলে অনেক দূর থেকেও এসেছেন কেউ কেউ।
বাজারের ভেতরে ঢুকতেই রাস্তার মুখে সারি সারি খেজুরের দোকান। বিক্রেতারা বক্সে সেসব সাজানোর কাজে ব্যস্ত। একটু পর পরই ক্রেতারা সেখানে এসে দেখছেন এবং দাম জিজ্ঞেস করছেন। দাম শুনে ফিরে গিয়ে অন্য দোকানে এসেও দেখে যাচ্ছেন কোন দোকানে খেজুরের কেমন দাম। যে দোকানটায় তুলনামূলক একটু কম মূল্যে পাচ্ছেন সেদিকে এগিয়ে যাচ্ছেন বেশিরভাগ ক্রেতা।
বেগম নূর জাহানও আছেন এই তালিকায়। গত ৪ বছর ধরে কাজ করছেন একটি গার্মেন্টস-কোম্পানিতে। বাজারে এসেছেন খেজুর কেনার উদ্দেশ্যে। তাই বেশ কিছু সময় নিয়ে অনেক দোকান ঘুরে ঘুরে দেখলেন। তারপর চিন্তাভাবনা করে ১০০ টাকায় কিনে নেন আধা কেজি বস্তা খেজুর। প্রায়ই এখানে এসে প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে নেন তিনি। কারণ, একটু কম দামে কিনতে পাওয়া যায়। ২২০ টাকায় এক কেজি না কিনে আধাকেজি খেজুর কেন কিনলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, "যে খেজুরডা কিনলাম, এইডার এত দাম ছিলো না। ৯০-১০০ ট্যাহা দিয়াই ১ কেজি কিন্না লইতাম। অহন পাই আধাকেজি। এইডা দিয়াই চালায়া নিমু এবার।"
উপরের চিত্রগুলোর স্থান ভিন্ন, মানুষ ভিন্ন, তাদের অবস্থানও ভিন্ন। তবে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই বাজারে তাদের সবাই একইভাবে ভুক্তভোগী। ফলে কোনো জিনিস কেনার আগে দুইবার করে ভাবছেন, কিনবেন কি কিনবেন না। কিনলেও কীভাবে খরচ কমিয়ে চাহিদা পূরণ করা যাবে সে চেষ্টাই করছেন নিম্ন আয়ের মানুষ থেকে শুরু করে মধ্যবিত্তরাও।
দিন দিন পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে সকল নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম। আর বাংলাদেশে রমজান মাসে তা হয় আকাশচুম্বী। এতে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বেড়ে হয় দ্বিগুণ। স্বল্প আয়ের লোকজনের কাছে পণ্যের এমন মূল্যবৃদ্ধি রীতিমতো মানসিক পীড়াদায়ক ব্যাপার হয়ে উঠেছে। সুস্থভাবে জীবন-যাপন করতে যতটুকু খাবার দরকার, সেটুকু নিশ্চিত করাই যেন এখন কষ্টসাধ্য ব্যাপার। রমজানে এ সমস্যা বেড়ে আরও তীব্র হয়। কাঁচামালের পাশাপাশি বেড়ে যায় প্রয়োজনীয় ইফতার সামগ্রীর দামও। এমনই উল্লেখযোগ্য একটি পণ্য হলো খেজুর। প্রতিটি রোজাদারের ইফতারে পছন্দের অন্যতম অনুষঙ্গ এটি। তাছাড়া, ইফতারে খেজুর মুসলিমদের জন্য আলাদা করে ধর্মীয় মূল্যও বহন করে। ফলে প্রতিটি মুসলমানের ঘরে রমজানে খেজুর থাকা চাই।
কিন্তু বাজার ঘুরে এই দ্রব্যের দাম শুনে হতাশ হওয়া ছাড়া উপায় রইলো না। নিম্ন মানের খেজুর থেকে উচ্চমান– সকল প্রকার খেজুরের দাম এতই বাড়তি, যা পূর্বের মূল্যের তুলনায় দ্বিগুণ। রমজানের বেশ আগে থেকেই বেড়ে গেছে খেজুরের দাম। এরই পরিপ্রেক্ষিতে স্বল্প আয়ের মানুষজন এই দ্রব্য কিনতে হিমশিম খাচ্ছেন। অতি মূল্যের এই বাজারে কারা, কীভাবে, কী পরিমাণ খেজুর কিনছেন সেটি জানতেই কাওরান বাজারে খেজুরের বিভিন্ন ক্রেতা-বিক্রেতাদের সাথে কথা বলেছে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড।
পূর্বে খেজুরের যে মূল্য ছিল তা আর টিকে নেই। সব ধরনের খেজুরের দাম বেড়েছে। পুরো কাওরান বাজার ঘুরে ৪০ ধরনের খেজুরের কথা জানা যায়। এরমধ্যে প্রতিটি খেজুরের দামই অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে বলে জানান বিক্রেতারা। কিছু কিছু খেজুরের দাম বেড়ে দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে বলে জানান তারা।
বাজারের এত সব খেজুরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি চাহিদা 'জাহিদি', 'বাংলা' এবং 'বরই' খেজুরের। দামে কম হওয়ায় এসব কেনার দিকে ঝুঁকছেন ক্রেতারা। বাজারে এসব খেজুরের দাম ৪০০-৪৫০ টাকা। তাছাড়া বর্তমানে ২০০ টাকা থেকে শুরু করে ৪০০ টাকা পর্যন্ত খেজুরের চাহিদাই সবচেয়ে বেশি বলে দাবি বিক্রেতাদের। গত বছর রমজানে এসব খেজুরের দাম ছিল ৮০ থেকে শুরু করে ১৫০ টাকা পর্যন্ত।
তাছাড়া, পূর্বে খালাস (২২০ টাকা), বাংলা (৮০/৯০ টাকা), তিউনিসিয়া (২৪০ টাকা), জিহাদি(১৪০ টাকা), দাবাস(২৬০ টাকা), মাসরুম মরিয়ম (৩০০ টাকা), ছাকাই(৪০০টাকা), আম্বার (৭০০ টাকা), মাসুক(৩০০ টাকা), নাখাল(৪০০ টাকা), ফরিদা(৪০০ টাকা), আজোয়া (৮০০ টাকা), মেদজুল (১২০০ টাকা), কালমি মরিয়ম (৫০০ টাকা) ইত্যাদি খেজুরের যে দাম ছিলো তা বেড়ে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে, খালাস- ৪০০ টাকা, বাংলা- ২০০ টাকা, তিউনিসিয়া- ৫০০ টাকা, জিহাদ- ৩৫০ টাকা, দাবাস- ৫৫০ টাকা, মাসরুম মরিয়ম- ৬০০ টাকা, ছাকাই- ৬০০ টাকা, আম্বার-১০০০ টাকা, মাসুক-৬০০ টাকা,নাখাল- ৭০০ টাকা, ফরিদা-৬০০ টাকা, আজোয়া- ১২০০, মেদজুল ১৬০০ টাকা এবং কালমী মরিয়ম- ১০০০ টাকায়।
এতে মধ্যবিত্তদের ভোগান্তির পাশাপাশি নিম্ন আয়ের মানুষের আছে খেজুর যেন হয়ে উঠেছে আরাধ্য পণ্য।
এমনকি, বাজারে আগের বারের মত খেজুরের ক্রেতা নেই বলেও দুঃখ প্রকাশ করেন অনেক বিক্রেতা। তাদের দাবি, অতিরিক্ত দামের কারণেই এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
কেনাবেচা কেমন চলছে জানতে চাইলে বিক্রেতা রবিন বলেন, "আগের মত বিক্রি নাই। লোকও নাই তেমন একটা। কয়েক বছর আগেও রোজার এক সপ্তাহ আগে থেকে ভিড় লেগে থাকতো। যে কয়েকজন কিনছে তারা অনেক কম করে নিচ্ছে। এক কেজি বা আধা কেজি পরিমাণে।"
খেজুরের দাম বাড়ার কারণ হিসেবে তিনি খেজুরের উপর সরকারের কর বৃদ্ধির কথা উল্লেখ করেন। অতিরিক্ত কর আরোপের কারণে আমদানীকারকদের অনেকেই এবার খেজুর আমদানী করা থেকে বিরত থাকেন। ফলে পরিমাণও আগের তুলনায় কমে যায়। এসব কারণে খেজুরের দাম এক বছরের মাথায় বেড়ে গিয়ে দ্বিগুণ হয়েছে বলে দাবি তার।
খেজুরের আরেক বিক্রেতা আলম বলেন, "অনেকেই একটু ভালো দেখে খেজুর কিনছে। তবে তা আধাকেজির মতই। অনেকক্ষণ দরদাম করে। দামে মিললে নিচ্ছে, নাহয় খালি হাতে ফিরে যাচ্ছে।"
এদিকে, আজ মঙ্গলবার (১২ মার্চ) খেজুরের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। অতি সাধারণ বা নিম্ন মানের খেজুরের প্রতিকেজির দাম ১৫০ থেকে ১৬৫ টাকা এবং বহুল ব্যবহৃত জায়দি খেজুরের দাম ১৭০ থেকে ১৮০ নির্ধারণ করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এই মূল্যের আলোকে খুচরা দাম নির্ধারণ করে ব্যবসায়ীদের বিক্রির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী হাসানুল ইসলাম টুটু বলেছেন, "সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করে খেজুরের মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে।"
যদিও বিলাশ গোল খেজুর বা দামি খেজুরের মূল্য নির্ধারণ করে দেয়নি মন্ত্রণালয়। এখন দেখার বিষয়, সরকার নির্ধারিত এই দাম বাজারে যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয় কি-না।
এদিকে রোজার দুইদিন আগে, গত ১০ মার্চ তারিখে সর্বাধিক বিক্রিত খেজুরের কথা জানতে চাইলে বিক্রেতা আলম বস্তা খেজুরের কথা জানান। বাজারে সবচেয়ে কম দামি খেজুরটিকে বিক্রেতারা বস্তা খেজুর হিসেবেই সম্বোধন করেন। এক দিনে এই খেজুর ৪০ কেজিরও বেশি বিক্রি হয়েছে বলে জানান তিনি। আরও কয়েকজন বিক্রেতার সাথে কথা বলে জানা যায়, বাজারে বস্তা খেজুর এবং বরই খেজুর বিক্রির হারই সর্বোচ্চ।
এ বিষয়ে আলম বলেন, "মনে করেন আমি ক্রেতা। আমিও নিজের জন্য খেজুর নিলে সবচেয়ে সস্তাটাই নিতাম। এত দাম দিয়ে আসলেই অনেকে কিনতে পারবে না।"
চল্লিশোর্ধ্ব ক্রেতা ফাতেমা দরদাম করে ১৮০ টাকায় কিনে নেন এক কেজি বস্তা খেজুর। তার ভাষ্যমতে, "না খাইলে কিছুই হইবো না। পেট ঠিকই ভরবো। কিন্তু কেমন জানি খালি খালি লাগে। এইজন্য দাম দিয়ে কিন্না নিসি।"
বাজারে যখন খেজুরের দামের চরম অবস্থা, তখন সুপার শপগুলোও যেন দাম বাড়িয়ে বিক্রিতে পিছিয়ে নেই। এই দোকানগুলোয় প্রতিটা খেজুরের দাম বাজারের তুলনায় ১০০-১৫০ পর্যন্ত বেশি। শুধু ৫০০ গ্রাম মেদজুলের দামই নেওয়া হচ্ছে ১১০০ করে। যেখানে বাজারে দাবাস খেজুরের দাম ৪০০ বা সর্বোচ্চ ৫৫০ করে সেখানে সুপার শপে সে দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৭০ টাকায়! আবার রাস্তায় যেসব ভ্যানে খেজুর বিক্রি হয় সেখানেও বাজারের তুলনায় খেজুরের দাম ৫০-১০০ টাকা বাড়তি।
প্রয়োজনীয় এসব দ্রব্যের দাম অনিয়ন্ত্রিত বলে পঞ্চাশোর্ধ স্কুলশিক্ষক লোকমান (ছদ্মনাম) আক্ষেপ করে বলেন, "আমরা যা-ই খেতে চাইবো, সেটার দাম বেড়ে যাবে। এটাই নিয়ম হয়ে গেছে আমাদের। আমি না হয় অল্প হলেও কিনতে পারবো, অনেকে তো একেবারেই পারবে না।"