বাংলা হরফের খোঁজে
আজকের শিশু, এমনকি তরুণের কাছেও মনে হতে পারে বাংলা হরফ খোঁজার কী আছে। অ আ ক খ দিয়ে তো প্রতিদিনই লক্ষ-কোটি বাক্য লেখা হচ্ছে। এগুলোর লিখিত রূপ যেমন পরিস্কার, যোগাযোগ দক্ষতাও দারুণ। সব্যসাচী হাজরার জিজ্ঞাসা হলো, শুরু থেকেই কি হরফগুলোর চেহারা এমন— নাকি দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়েছে আজকের পর্যন্ত আসতে?
তিনি বললেন, "অনেকেরই মনে হতে পারে এগুলো হঠাৎ পাওয়া। সত্যি হলো হরফগুলো মাটি ফুঁড়ে উঠে আসেনি বা আকাশ থেকেও পড়েনি। আড়াইশো বছর হতে চললো বাংলা হরফগুলো বিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সেইসঙ্গে বদলাচ্ছে বানান, পাল্টে যাচ্ছে বাক্যের বিন্যাস । স্বরবর্ণে লি বলে হরফ ছিল, বিসর্গ ছিল স্বরবর্ণের অন্তর্ভুক্ত।
১৮৫৫ সালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর 'বর্ণপরিচয়' প্রাইমারে এগুলোর শ্রেণীকরণ করলেন, লি বাদ দিলেন, বিসর্গ পাঠিয়ে দিলেন ব্যঞ্জনবর্ণে, ক্ষ হরফকে ব্যঞ্জনবর্ণ থেকে সরিয়ে যুক্তাক্ষরে যুক্ত করলেন। তার আগে ১৮৪৯ সালে মদনমোহন তর্কালঙ্কার তার 'শিশুশিক্ষা' প্রাইমারেও অনেক অব্যবহৃত যুক্তাক্ষর বাদ দিয়েছেন। তর্কালঙ্কার ও বিদ্যাসাগরের প্রাইমার দুটির একটি ছন্দে লেখা, অন্যটি গদ্যে।'
বস্তুত, বিদ্যাসাগরের আগে বাংলা আলাদা ভাষার মর্যাদাও পায়নি, গণ্য হতো সংস্কৃতের শাখা রুপে। ১৮১৬ সালে প্রথম বাংলা প্রাইমার বা শিশুশিক্ষার বই প্রকাশিত হয়। তারপর থেকে ঊনিশ শতকে পাঁচ শতাধিক প্রাইমার খুঁজে পেয়েছেন সমাজ ও সংস্কৃতি গবেষক আশিস খাস্তগীর। তিনি বাংলা প্রাইমার সংগ্রহ (১৮১৬-১৮৫৫) নামের একটি গ্রন্থ সংকলন করেছেন। এতে শিশুশিক্ষা ও বর্ণপরিচয়সহ ১৪টি প্রাইমার আছে।
সূচনায় খাস্তগীর লিখছেন, 'আমাদের স্বীকার করে নিতে হবে, বাংলা ভাষায় প্রথম প্রাইমার লেখার গৌরব বাঙালির প্রাপ্য নয়। সুনির্দিষ্ট নিয়ম-প্রকরণ মেনে ভাষা শিক্ষার গুরুত্বের দিকটি বাঙালি প্রথমে উপলব্ধি করেনি। যা আমরা ভাবিনি, সেই ভাবনা এদেশে পা-রাখা বিদেশি মিশনারিরা শুরু করলেন। তারা বুঝেছিলেন, ধর্মপ্রচার করার জন্য প্রয়োজন শিক্ষার প্রসার, শিক্ষার্থীর মাতৃভাষায় শিক্ষাবিস্তার।'
মিশনারিরা লক্ষ্য করেন, ছাপানো বইয়ের অভাবেই এদেশে শিক্ষার বিস্তার ঘটছে না। ১৮১৭-১৮ সালের মধ্যে তারা একশর বেশি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। ছাত্রসংখ্যা গিয়ে দাঁড়িয়েছিল ৭ হাজারের বেশি। ১৮২৩ সালে এসে দেখা যায়, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়ে ১৬০টি হয়ে গেছে। ১৮১৬ সালেই শ্রীরামপুরের মিশনারিরা প্রকাশ করেছিলেন ১২ পৃ্ষ্ঠার 'লিপিধারা' নামের প্রাইমার। এটাকেই বাংলায় বর্ণশিক্ষার প্রথম বই বলছেন খাস্তগীর।
এরপর কলিকাতা স্কুল বুক সোসাইটি ও কলিকাতা স্কুল সোসাইটি পাঠ্যপুস্তক লেখায় উৎসাহী হয়। বাঙালির লেখা প্রথম প্রাইমার পাওয়া গেল ১৮৩৫ সালে যার নাম শব্দসার। লিখেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বসু। ১৮৩৯ সালে হিন্দু কলেজ পাঠশালায় পড়ানোর জন্য লেখা হয় শিশুসেবধি। পরের বছর তত্ত্ববোধিনী সভার পাঠশালার জন্য লেখা হয়েছিল 'নতুন বর্ণমালা'।
বলে রাখা ভালো, এতদিন ধরে প্রকাশিত সব প্রাইমারই একই গোষ্ঠি পরিচালিত এক বা একাধিক স্কুলে প্রচলিত ছিল। প্রথম সর্বজনীন প্রাইমার এলো ১৮৪৯ সালে মদনমোহন তর্কালঙ্কারের শিশুশিক্ষা। ওই বছরই ক্যালকাটা ফিমেল স্কুল প্রতিষ্ঠা লাভ করে আর যে ১৬ জন বাঙালি তাদের কন্যাদের স্কুলে পাঠিয়েছিলেন তাদের মধ্যে তর্কালঙ্কার একজন। সেকারণেই শিশুশিক্ষার শুরুর পৃ্ষ্ঠায় লেখা থাকত, 'এতদ্দেশীয় বালিকা বিদ্যালয়ের ব্যবহারার্থ'। কিন্তু শুধু বালিকা বিদ্যালয় নয়, সবার জন্যই এটি আদর্শ শিক্ষাগ্রন্থ হয়ে উঠেছিল। শিশুশিক্ষা সমাদর পেয়েছিল ঘরে ঘরে। এতটাই যে ১৮৯৮ সালে প্রকাশিত হয়েছিল এর ১৫৩১তম সংস্করণ এবং শেষ দিকের সংস্করণগুলো ছাপা হতো ৩০ হাজার কপি।
এখানে প্রশ্ন জাগে, প্রাইমার তৈরি হওয়ার আগে বাংলা লোকে শিখত কীভাবে? খাস্তগীর লিখেছেন, 'একটা সময় ছিল (মধ্যযুগ), যখন বাঙালি বাংলা ভাষা শিখত মুখে মুখে। মা-ঠাকুমার মুখে শোনা ছড়ায়, গল্পে, প্রবাদ-প্রবচনে। একটু বড়ো হয়ে ভয়ংকর গুরুমশায়ের পাঠশালায় শুভঙ্করী আর্যা, নামতা চর্চা, জমির মাপজোখ, চিঠিপত্র লেখা, জটিল হিসেব-নিকেশ, নানারকম শ্লোক মুখস্ত করা, চৌত্রিশ অক্ষর, আঠারো ফলা ইত্যাদিতে শিশুর শিক্ষার প্রাথমিক পর্ব শেষ হত। পাঠশালায় ভাষাশিক্ষার থেকে জোর দেওয়া হত 'কাজের মানুষ' গড়ে তোলার দিকে।'
মিশনারিরা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আগে এ অঞ্চলে চালু ছিল টোল, মক্তব। গুরুমুখী বিদ্যা থেকে বের হতে গিয়েই প্রয়োজন পড়ল প্রাইমার আর প্রাইমার নিয়ে এলো অগণিত ছাপাখানা। বিদ্যালয়ের গণ্ডির বাইরেও লেখাপড়া চর্চার কাজটি সহজ করে দেয় প্রাইমার। খাস্তগীরের বইটি বাংলা প্রাইমার নিয়ে সব্যসাচীর কৌতূহল ও তাগিদ বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়।
চিত্রশিল্পী বলেই কি-না তিনি আরও বুঝতে চাইছিলেন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হরফের গড়নে পরিবর্তন এলো কতটা এবং এর পেছনে কী কী ভূমিকা রেখেছে। তাই 'বর্ণমালা: বাংলা বর্ণ পরিচয় (১৮৪৯-১৯৪৮)' শীর্ষক বাংলা প্রাইমার সংকলন গ্রন্থের প্রকাশনা উপলক্ষে সব্যসাচী ঢাকার আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে ১৫ দিনব্যাপী (৩ থেকে ১৮ মে ২০২৪) যে প্রদর্শনীর আয়োজন করেছেন, সেখানে একটি লেটার প্রেস রেখেছেন।
সব্যসাচী বলছিলেন, "প্রেসটাকে ঘিরেই প্রদর্শনী। এতে হরফ মুদ্রণের কৌশল ও কারিগরি দেখে নতুন প্রজন্মের পক্ষে জানার সুযোগ হচ্ছে কেবল বাটন চাপলেই হরফ তৈরি হয়ে যেত না। পুরো আয়োজনটা ছিল ব্যাপক ও বিস্তৃত। একটি ছাপা হওয়া বই এক জীবনের সমান দীর্ঘ। বই তাই যত্নে রাখা হতো, একই বই তিন-চার প্রজন্মের হাত ঘুরত।"
বইয়ের সম্পাদকীয়তে সব্যসাচী হাজরা লিখছেন, 'আধুনিক বাংলা ভাষার বিকাশ ও প্রায়োগিক গবেষণা বাংলা প্রাইমারের বিকাশের সমান্তরালে এগিয়েছে। এই অঞ্চলে মুদ্রণ ও প্রকাশনার বিকাশে বাংলা প্রাইমারের ব্যবসায়িক সফলতার গুরুত্ব কম নয়। প্রাইমারের বাজার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিস্তার ঘটেছে ছাপাখানার সংখ্যা ও মুদ্রণকৌশল।'
এ প্রসঙ্গে সব্যসাচী আরো বলছেন, "বইটি প্রকাশের মধ্য দিয়েই কাজটি শেষ করা যেত, কিন্তু দেখলাম প্রাইমারগুলির সঙ্গে ছাপাখানা হাতে হাত ধরে এগিয়েছে। ছাপাখানা যত উন্নত হয়েছে হরফ তত সুন্দর হয়েছে। তখন ভাবলাম কাঠের ব্লক, সীসার হরফ উপস্থাপন করতে পারলে আজকের শিশু বুঝতে পারবে কত প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে মুদ্রণশিল্পীকে, কত পরিশ্রম ছিল এতে। সেসময় ২০ হাজার, ৩০ হাজার বা ৫০ হাজার কপি প্রাইমার ছাপানো একটা ভয়াবহ কাজ, মানে বিপ্লবাত্মক কাজ। শিক্ষাকে তারা তখন ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছিলেন।"
সব্যসাচীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, বর্ণের পরিচয় জানা কেন জরুরি মনে করলেন? সুন্দর ও সুচিন্তিত উত্তর পাওয়া গেল সম্পাদকীয়তেই। একটু সোজা করে নিলে উত্তরটা এমন— বর্ণের সঙ্গে পরিচয় না ঘটলে ভাষা শেখার উপায় সীমিত হয়ে যায়, উপরন্তু ভাষার ওপর মালিকানা প্রতিষ্ঠা করাও মুশকিল হয়। তাই বর্ণপরিচয় ছাড়া মাতৃভাষা চর্চা সহজ হয় না, শিক্ষার মৌলিক অধিকারের বুনিয়াদও গড়ে ওঠে না।
সব্য বলছিলেন, "হরফ আমাকে ছাড়ে না। সেই যে দাদুর সঙ্গে বসে বসে তালপাতায় নলখাগড়ার কলম দিয়ে লিখতাম, সে থেকে ছোট শহরে দেওয়াল লিখন, উচ্চতর শিক্ষার্থে বড় শহরে গমন, চিত্রকলা অধ্যয়ন সমাপন, যৌবন ছেড়ে মধ্যবয়সে পদার্পন, সব হলো একে একে, হরফ কিন্তু আমাকে ছাড়েনি।"
"এক সময় ভাবলাম আমার সন্তানের জানা দরকার তার বাবা কী পড়ে বর্ণের সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন। আমার দাদু হয়তো শিশুশিক্ষা পড়েছেন, বাবা পড়ে থাকবেন বর্ণপরিচয়, আমি পড়েছি আদর্শলিপি। এই যে ধারাবাহিকতা যার মধ্য দিয়ে একেকটি প্রজন্ম গেছে, আর বর্ণমালাও সমৃদ্ধ এবং সম্পন্ন হয়েছে, এটা আমার সন্তানের জানা দরকার। আমি প্রাইমারের সংকলন করার প্রতি মনোযোগী হলাম," যোগ করলেন তিনি।
সব্যসাচীর জন্ম ১৯৭৮ সালে। একটু বড় হয়ে খুলনা শহরে পড়তে এসে তিনি দেওয়ালে লিখেছেন মেহনতী মানুষের দাবি দাওয়ার কথা। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে পড়েছেন চিত্রকলা। অধ্যয়ন শেষে কাজ-কর্মে তুমুল ব্যস্ত থেকেছেন। তবু বর্ণের সঙ্গে সম্পর্ক তার দিনে দিনেই নিবিড় হয়েছে। তিনি বলেন, "আমি ভাষাবিদ নই, মুদ্রণবিদও নই কিন্তু প্রেমী; বর্ণপ্রেমী। বর্ণের প্রতি ভালোবাসাই আমাকে এ কাজে অগ্রসর করেছে।"
গঠনশৈলী, নান্দনিকতা ও উপস্থাপনার বিশেষত্বের কারণে আটটি প্রাইমারকে তিনি সংকলনের জন্য নির্বাচন করেছেন। সময় ধরে (১৮৪৯ থেকে ১৯৪৮) বিন্যস্ত করেছেন। এগুলো হলো মদনমোহন তর্কালঙ্কারের শিশুশিক্ষা, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয়, রামসুন্দর বসাকের বাল্যশিক্ষা, সীতানাথ বসাকের আদর্শলিপি, যোগীন্দ্রনাথ সরকারের হাসিখুসি, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিত্রাক্ষর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহজ পাঠ— যা অলংকৃত করেছেন নন্দলাল বসু এবং সত্যজিৎ রায়ের অলংকরণে হাতেখড়ি যার রচয়িতা বিমলচন্দ্র ঘোষ।
এগুলোর মধ্যে বাল্যশিক্ষার সঙ্গে আদর্শলিপির কিছু পরিবর্তন সাদা চোখেই ধরা পড়ে। যেমন অ দিয়ে অসি শব্দ লিখে ছবিও দেওয়া হয়েছে, বাল্যশিক্ষায় কেবল হরফটিই ছিল। যোগীন্দ্রনাথের হাসিখুসিতে আবার অ তে অজগর দিয়ে পুরো একটি বাক্যই লিখা হচ্ছে- অজগর আসছে তেড়ে। অবনীন্দ্রনাথের চিত্রাক্ষর কিন্তু পুরোপুরি আলাদা। এখানে বিভিন্ন প্রাণীর ছবিতে অক্ষর বসিয়ে শিশুদের আকৃষ্ট করার প্রয়াস লক্ষনীয়।
১৯৩০ সালে রবীন্দ্রনাথ সহজ পাঠ লিখেছিলেন প্রথাগত শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে। তিনি মনে করতেন, ওই ব্যবস্থা যান্ত্রিক এবং পরিবর্তন প্রয়োজন। তার প্রাইমারে কোনো গুরুজন (এটা করো না, ওটা ভালো না বলার লোক) নেই, আছে পাঠক শিশুর সঙ্গে এক কথক শিশু।
বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেন, 'যে বয়সে ক খ শিখলেই যথেষ্ট, সে বয়সে সাহিত্য রসে দীক্ষা দেয় সহজ পাঠ।' সংকলনের শেষ প্রাইমার 'হাতে খড়ি' মূলত সত্যজিৎ রায়ের অলংকরণগুণে সমৃদ্ধ। এর রঙিন ছবিগুলো শিশুদের যথেষ্টই আকৃষ্ট করতে সক্ষম।
সব্যসাচী যোগ করলেন, "জীবনে শত সহস্র বই পড়ে মানুষ। শত শত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যায়, কিন্তু প্রাইমারের 'পাখি সব করে রব বা আলস্য দোষের আকর' কখনো ভোলে না। কারণ এটি তার প্রথম পাঠ আর তা সে নেয় মায়ের বা দাদীর কাছ থেকে।"
উনিশ শতকে দিন যত এগোচ্ছিল প্রাইমারের সংখ্যা বাড়ছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শব্দ চয়ন এবং দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিবর্তন লক্ষ্য করেছেন সব্যসাচী। বলছিলেন, "ধরা যাক আদর্শলিপিতে বলা হচ্ছে বিদ্যালাভে মহৎ হওয়া যায়, এর পূর্ববর্তী প্রাইমারটিতে হয়তো ছিল– লেখাপড়া করে যে, গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে। এতে কিন্তু লেখাপড়ার উদ্দেশ্য বলা হচ্ছে ধনবান হওয়া বা আরাম-আয়েশের জীবন-যাপন করা। বুঝতে কষ্ট হয় না যে, দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যাচ্ছিল দিনে দিনে। বইয়ের সজ্জাতেও পরিবর্তন এসেছিল এবং ওই পরিবর্তন ছিল পরিস্কার দৃশ্যমান। ছাপাখানা ও মুদ্রণকৌশলের উন্নয়ন এক্ষেত্রে বিরাট অবদান রেখেছে। আরেকটি বিষয় হলো, ফি বছর প্রাইমারের সংখ্যা বৃদ্ধি। এর অর্থ বছর বছর স্কুল ও ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছিল।"
প্রাইমারের সংখ্যা বৃদ্ধির একটি হিসাব খাস্তগীরের নিবন্ধ থেকে জানা যাচ্ছে। ১৯৫৫ এর পরের দশ বছরে নতুন পঁচিশটি প্রাইমার প্রকাশিত হয়েছে। এরমধ্যে ১৮৬২ সালে প্রকাশিত সাতকড়ি দত্তের প্রথম পাঠ বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। প্রথম পাঠের প্রতিটি সংস্করণ ১০ হাজার কপি ছাপা হয়েছিল।
১৮৭১-১৮৭৫ পর্যন্ত পাঁচ বছরের মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে আরো পঞ্চাশটি প্রাইমার। আগেরগুলোও পুনর্মুদ্রিত হয়েছে। ১৮৯০ এর দশকে প্রকাশিত হয়েছে সোয়াশ প্রাইমার। প্রাইমারগুলো নাম হতো শিশু পাঠ, শিশুবোধ, বর্ণবোধ, অক্ষর পরিচয়, নব শিশুশিক্ষা, বালক শিক্ষা, শিক্ষাসোপান, বর্ণবিবেক অথবা বর্ণরঞ্জন। এগুলোর পৃষ্ঠা সংখ্যা হতো ১০ থেকে ৫০। দাম ছিল ৩ পাই, ৯ পাই, ১ আনা বা সোয়া আনা।
সব্যসাচী তার সংকলনে যে ৮টি প্রাইমার স্থান দিয়েছেন তার মধ্যে ৩টি তাদের বাড়িতেই ছিল, বাকিগুলো কলকাতা থেকে নয়তো পরিচিত জনদের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছেন। প্রাইমার সংগ্রহ হয়ে যাওয়ার পর শুরু হলো আসল প্রস্তুতি। প্রদর্শনীর উপকরণ সংগ্রহ। একটি সচল লেটার প্রেস ও তার চালক প্রয়োজন। আরো প্রয়োজন ছাপার কাজে লাগে এমন ২১টি অনুষঙ্গ। কাঠের ব্লক, সীসার হরফও দরকার। খোঁজ খোঁজ চারদিকে। প্রায় দেড় বছর ধরে খোঁজ চলল। এক পর্যায়ে একুশটি অনুষঙ্গের (কুইনস, কুইনস কি, গ্যালি, ভ্রমর, হাতুড়ি, লাইন গেজ রুলার, ইংক নাইফ, টেস্টার, নিডল ইত্যাদি) সবই জোগাড় হলো— তবে ৭-৮টি জেলা ঘুরে।
পাশাপাশি লেটার প্রেসের অনুসন্ধানও চলছিল। আচম্বিত পাওয়া গেল হালিম হোসেনকে যিনি নীলক্ষেতের বাণিজ্য বিতান সুপার মার্কেটে তিন দশক ধরে লেটার প্রেস চালাচ্ছেন। তাকে পেয়ে সবাই খুশি হয়ে উঠল।
বই ও প্রদর্শনীর গবেষণা সহকারী এবং সমন্বয়কারী আলোকচিত্রী কামরুল হাসান মিথুন বলছিলেন, "হালিম ভাইকে পাওয়া ছিল আবিস্কারের মতো ব্যাপার। প্রায় ঠাহর করা যায় না এমন এক জায়গায় বসে তিনি কাজ চালিয়ে যান। তাকে পেয়ে আমরা হাফ ছেড়ে বেঁচেছিলাম। এরপর আবার দলবেঁধে সীসার হরফ খুঁজে বেড়াতে লাগলাম। ভাগ্য ভালো একজনের কাছে আধা কেজি সীসার হরফ পেলাম। কাঠের হরফ পেয়েছি এমন এক সেট, যেটি খোলাই হয়নি কারণ সেগুলো এসে পৌঁছানোর আগেই প্রেস বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এরপর একজন ব্লক নির্মাতা খুঁজে বেড়ালাম, যিনি আমাদের কিছু ব্লক নতুন তৈরি করে দিতে পারবেন।"
"নরসিংদীর মাধবদীতে খুঁজে পাওয়া গেল শীতল চন্দ্র ধরকে। তিনি আমাদের নতুন করে ১২টি ব্লক বানিয়ে দিলেন। এগুলোর মধ্য দিয়ে হরফ, মুদ্রণযন্ত্র, মুদ্রণশিল্পীকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা ছিল, সেসঙ্গে প্রাইমার রচয়িতা এবং শিল্পীদের সম্মান জানানো হয়েছে। তালিকায় আছেন কাঙ্গাল হরিনাথ, নন্দলাল বসু, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যজিৎ রায় প্রমুখ। সব্যদার (সব্যসাচী হাজরা) শৈশবের স্মৃতি একটি রকিং হর্সও (দোলায়মান ঘোড়া) প্রিন্ট করা হয়েছে যেটি ব্যবহৃত হচ্ছে প্রদর্শনীর লোগো বা প্রতীক হিসেবে," জানালেন তিনি।
সব্যসাচী প্রদর্শনীর নাম রেখেছেন 'প্রাইমার টু প্রেস'। হালিম হোসেন প্রতিদিন একটি করে প্লেট থেকে শতাধিক প্রিন্ট দিচ্ছেন। দর্শনার্থীরা তা সংগ্রহ করার সুযোগও পাচ্ছেন। সেইসঙ্গে লেটার প্রেসে হরফ ছাপানোর জটিল কলাকৌশল প্রত্যক্ষ করতে পারছেন।
গ্যালারির দেওয়ালে প্রাইমারগুলোর প্রচ্ছদ, রচয়িতা ও অলংকরণশিল্পীর ছবি এবং বিশেষ বিশেষ পৃষ্ঠা বাঁধাই করে প্রদর্শিত হচ্ছে। কাপড়ের ওপর প্রিন্ট করা আটটি দীঘল ব্যানারও প্রদর্শিত হচ্ছে। এর মধ্যে চারটি বাংলা অক্ষর লেখা মুক্তিযুদ্ধের সময়কালের একটি পোস্টারও আছে। তার স্লোগানটি পুনরুল্লেখের দাবি রাখে, এক একটি বাংলা হরফ এক একটি বাঙালীর জীবন।