‘পদ্মমণি চচ্চড়িতে লঙ্কা দিল ঠেসে’
কবিগুরু ১৯৪০ সালে উদয়নে বসেই টের পেয়েছিলেন। ঠাকুর বুঝেছিলেন, ৮৪ বছর পর ঢাকার আব্দুল গণি রোডে প্রসঙ্গটি আসবে। এক মন্ত্রী মরিচের দামের ঝাঁজ নিয়ে প্রশ্নে তেজ দেখাবেন। পালটা প্রশ্ন করে জানাবেন, তিনি তো অর্ধেকটার বেশি কাঁচা মরিচ খেতে পারেন না। মন্ত্রীকে আগাম সমর্থন জানাতে বিশ্বকবি তাই মাছ–মরিচ বেশি হলে কী যন্ত্রণা তা কাব্যে তুলে ধরেছেন।
তিনি লিখেছিলেন:
খেঁদুবাবুর এঁধো পুকুর, মাছ উঠেছে ভেসে;
পদ্মমণি চচ্চড়িতে লঙ্কা দিল ঠেসে।
আপনি এল ব্যাক্টিরিয়া, তাকে ডাকা হয় নাই।
হাঁসপাতালের মাখন ঘোষাল বলেছিল, ভয় নাই।
সে বলে, সব বাজে কথা, খাবার জিনিস খাদ্য—
দশ দিনেতেই ঘটিয়ে দিল দশ জনারই শ্রাদ্ধ।
শ্রাদ্ধের যে ভোজন হবে কাঁচা তেঁতুল দরকার,
বেগুন-মুলোর সন্ধানেতে ছুটল ন্যাড়া সরকার।
আসলেই তো তা-ই। দিনে আধেকটার বেশি মরিচ খেলে কিংবা চচ্চড়িতে মরিচ ঠেসে দিলে কী হয় সেটা সকলের জানা দরকার। বেশি খেলে বিনা আমন্ত্রণে ব্যাকটেরিয়া আসবে। ব্যাকটেরিয়ার দেখানো পথ ধরে হাসপাতালে, সেখান থেকে পরপার। তখন শ্রাদ্ধ আয়োজনে ছুটতে হবে। সেখানে আবার এলাহি খাবারের আয়োজন, যে খাবারে শুধু কাঁচা তেঁতুল বা বেগুন-মুলো হলেই চলবে না, সঙ্গে মরিচও লাগবে।
সত্য যে, কাঁচা মরিচে শর্করা, খাদ্য আঁশ, চর্বি, আমিষ, বিটা ক্যারোটিন, ভিটামিন এ-বি-সি, আয়রন, ম্যাগনেশিয়াম, পটাশিয়াম এবং ক্যাপসাইসিন আছে। এটাও সত্য যে, কাঁচা মরিচ দৃষ্টিশক্তি রক্ষা করে, পরিপাকতন্ত্রের কার্যক্ষমতা বাড়ায়, চুল-ত্বক-মাড়ির সুরক্ষা দেয়, উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে এবং এমনকি ক্যানসার প্রতিরোধেও কাজ করে। কিন্তু বেশি মরিচ খেলে? অতিরিক্ত কাঁচামরিচ আলসারের কারণ হতে পারে। উচ্চ পটাশিয়াম থাকায় কিডনি রোগীদের জন্যও অতিরিক্ত কাঁচা মরিচ ভালো কিছু নয়।
হয়তো এসব কারণেই মন্ত্রী মহোদয় সাংবাদিকদের জিজ্ঞেস করেছেন, তাদের কয়টা কাঁচা মরিচই কিনতে হয়? সঙ্গে তিনি এ-ও জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি তো অর্ধেকটার বেশি কাঁচা মরিচ খান না।
তা-ই তো। কাচ্চি বা এরকম কোনো খাবারে কাঁচা লঙ্কায় এক–দু কামড়ে যে রসনাবিলাস, তার বাইরে আর কাঁচা মরিচের কাজ কী? বাজারে তাই কাঁচা মরিচের কেজি এখনকার মতো দুইশ টাকা কিংবা গত কোরবানির ঈদের আগে আটশ ছুঁইছুঁই হলেও বা এ নিয়ে এত হইচই করার কী আছে! এমনকি জৈব কৃষি নিয়ে প্রাণপাত করেন এমন একজনের লেখাতেও দেখলাম, তিনি কাঁচা মরিচকে নিত্যদিনের বাজারের একটি গুরুত্বপূর্ণ আইটেম উল্লেখ করেও লিখেছেন: কিন্তু কাঁচা মরিচ পেঁয়াজের মতো মসলার অংশ নয় যে, কাঁচা মরিচ না পেলে এমন লঙ্কাকাণ্ড ঘটাতে হবে।
তবে লঙ্কা নিয়ে নিয়ে লঙ্কাকাণ্ড ঘটানোর মতো কারণও আছে অনেক। সেটা মন্ত্রী বাহাদুরের বাড়ির কাছে আরশীনগরের চা শ্রমিকেরা তো বটেই, যিনি তার বাড়িতে রান্না করেন শুধু তিনিই নন, যিনি পরিবেশন করেন তিনিও; এমনকি পাশে যিনি বসেন, তিনিও বলে দিতে পারবেন। পদ্মমণি বা পদ্মরাজেরা যদি তাঁর চচ্চড়ি বা সবজিতে কাঁচা মরিচ না দেন, মাছ-মাংসে কাঁচা মরিচের রূপান্তরিত রূপ শুকনো মরিচ বা আরও রূপান্তরিত মরিচ গুঁড়ো না দেন; তাহলে তিনি বুঝবেন নুনের মতো ভালোবাসার পথ ধরে ঝালের ভালোবাসার কী গুণ!
পাঁচ হাজার বছর আগে মায়া, ইনকা বা অ্যাজটেক সভ্যতার সময় দক্ষিণ আমেরিকায় পবিত্র বস্তু হিসেবে যে মরিচের যাত্রা শুরু, কলম্বাস-উত্তর যুগে সেটা ইউরোপে এসেছে। আর পর্তুগীজদের হাত ধরে ভারতবর্ষসহ এ বঙ্গে। কালক্রমে এ ভূখণ্ডে মরিচ এমন এক প্রয়োজনীয় উপকরণে পরিণত হয়েছে যে, লঙ্কা না মিললে মন্ত্রীর বাড়িতেও লঙ্কাকাণ্ড ঘটে যাবে।
কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, দেশে ২০২৩ সালে নয় লাখ ৮৫ হাজার ২৫০ মেট্রিক টন মরিচ উৎপাদন হয়েছে। দেশে বছরে যে পরিমাণ মরিচ উৎপাদন হয়, তার ৬০ শতাংশই আমরা কাঁচা মরিচ হিসেবে খাই। বাকি ৪০ শতাংশ শুকনো মরিচ বা মরিচের গুঁড়ো হিসেবে ব্যবহার হয়।
তাই মরিচের দাম বাড়লে সাধারণ মানুষের কোথায় গিয়ে তা আঘাত করে, সেটা মরিচভর্তা খেয়ে দিন পার করা চা শ্রমিকদের ভোটে নির্বাচিত এমপি হিসেবে মন্ত্রীর না জানার কথা না। সেই বাড়তি দাম যে আবার মন্ত্রী যাদের জন্য নিয়োজিত, সেই কৃষকদের বাড়তি মুনাফা দেয় – এমনও না। লাভ যা, তা ফড়িয়া আর ব্যবসায়ীদের পকেটেই ঢুকে। সেটা কখনো বর্ষাকালে টানা বৃষ্টির অজুহাতে, কিংবা কখনো বাড়তি পরিবহন খরচ অথবা অন্য কোনো অজুহাতে।
এত সব না দেখেও সহজভাবে বললে বলা যায় — যেটা মন্ত্রী বাহাদুরও জানেন — মরিচ হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থকরী এক ফসল। দুধের স্বাদ আপনি ঘোলে মেটাতে পারবেন, ফুটবলে ব্যর্থতা হয়ত ক্রিকেটেও; কিন্তু ঝালের স্বাদ মরিচ ছাড়া কিসে?