ঘোড়া কেনাবেচার রাজধানী তুলসীপুর হাটে একদিন
শৈশবে আলী হোসেন সবসময় একটি ঘোড়া কেনার স্বপ্ন দেখতেন। তিনি এখন কৈশোরের সুখস্মৃতি পেরিয়ে মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ। তিন সন্তানের জনক এই ব্যক্তি পেশায় একজন ট্রাক ড্রাইভার। সময়ের সাথে সাথে তার জীবনে বহু শখ মিলিয়ে গেলেও ঘোড়া কেনার স্বপ্নপূরণের ইচ্ছা তার আজও রয়ে গেছে।
এমতাবস্থায় আলী ভাবলেন, তার স্বপ্নপূরণের হয়তো এটিই হয়তো সঠিক সময়। সেক্ষেত্রে ঘোড়া কীভাবে কেনা যায় সেটি জানতে তিনি অনলাইনে খোঁজ করতে থাকেন। তখন তিনি জামালপুর জেলার তুলসীপুরে সাপ্তাহিক ঘোড়ার বাজার সম্পর্কে জানতে পারেন। তখন তিনি ঐ এলাকায় গিয়ে একটি ঘোড়া কেনার পরিকল্পনা করেন।
খালের ধারে একটি রেইনট্রি গাছের নিচে বসে আলী ব্যবসায়ীদের বাজারে আসার অপেক্ষায় ছিলেন। আমাদের মতো সেও খুব ভোরে বাজারে পৌঁছে গিয়েছিলেন। এক্ষেত্রে কখন হাট শুরু হবে সে সম্পর্কে ধারণাই ছিল না। আমাদের সামনে একটা মাঝারি আকারের মাঠ ছিল। ভোরে সেটি প্রায় ফাঁকা ছিল, যার তিন দিকে দালান দিয়ে ঘেরা।
হাটটি মূলত প্রতি বৃহস্পতিবার দুপুরের খাবারের পর শুরু হয়। বিকেল চারটার দিকে এটি সবচেয়ে ব্যস্ত থাকে। এটি ঘোড়া, গাড়ি এবং এর সাথে সম্পর্কিত জিনিসপত্রের জন্য বিখ্যাত।
আমরা যেদিন গিয়েছিলাম সেদিন বিকেলে ব্যবসায়ীরা প্রায় ২৫০টি ঘোড়া এবং ১০০টি গাড়ি নিয়ে এসেছিলেন। ঘোড়াগুলোকে গাড়িতে বাঁধার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনার জন্য একটি-দুটি দোকানও বসানো হয়েছিল।
মোটরচালিত যানের তুলনায় এখনও বেশি লাভজনক
আলী হোসেন একটি ঘোড়া এবং একটি গাড়ি কেনার পরিকল্পনা ছিল। এটি দিয়ে মূলত গ্রামে পরিবারের সাথে আনন্দ করে ঘুরে বেড়াবেন বলে মনস্থির করেছিলেন।
তবে সব ক্রেতাই এই আলীর মতো ঘোড়ার প্রতি নির্মোহ আবেগ লালন করেন না। তাদের বেশিরভাগই পণ্য পরিবহনের কাজে ঘোড়া ব্যবহার করে। এক্ষেত্রে বেশিরভাগই বিভিন্ন ঋতুতে ফসল টানার জন্য এবং কেউ কেউ দৌড় প্রতিযোগিতার জন্য ঘোড়ার খোঁজ করে থাকে।
তুলসীপুর হাটে ঘোড়ার ক্রেতারা রাজশাহীর মতো দূরবর্তী জেলা থেকেও আসে। তবে ব্যবসায়ীরা বেশিরভাগই পার্শ্ববর্তী জেলা যেমন ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল এবং বিশেষ করে জামালপুর থেকে এসেছে।
ওবায়দুল্লাহ নামের এক বিক্রেতা জামালপুর জেলার মেলানদাহা উপজেলা থেকে এসেছে একটি গাড়ি বিক্রি করতে। বাড়িতে তার আরেকটি গাড়ি ও ঘোড়া রয়েছে। যেটি সে মালামাল পরিবহণের জন্য ব্যবহার করেন।
ওবায়দুল্লাহ বলেন, "এই গাড়িটা অতিরিক্ত হিসেবে ছিল। আমার এলাকায় তিন চাকার ভটভটি ও নসিমন (ডিজেল ইঞ্জিনসহ স্থানীয়ভাবে তৈরি বিভিন্ন যান) বাড়ছে। তাই ঘোড়ার গাড়ির চাহিদা বেশি নেই। আমি এইটাকে বিক্রি করছি কেননা আমি ফসল কাটার সময় অন্য গাড়িটি ব্যবহার করতে পারবো।"
ওবায়দুল্লাহ জানান, তিনি ১৫ বছর ধরে ঘোড়ার গাড়ি চালাচ্ছেন। মোটরচালিত যানবাহন থাকা সত্ত্বেও ঘোড়ার গাড়িগুলি এখনও লাভজনক হওয়ার প্রধান কারণ এর রক্ষণাবেক্ষণ খরচ কম।
ওবায়দুল্লাহ গত আট দিন ধরে ঘোড়াটিকে শুধু ঘাস খাওয়াচ্ছিলেন। তিনি ফসলের ক্ষেত এবং নদীর তীরের আইল থেকে বিনামূল্যে ঘাস কাটেন। তার কাছে ধানের তুষও নেই; কেননা এটি কিনতে কিছু টাকা খরচ করতে হবে।
এভাবে একটি ঘোড়াকে খাওয়াতে প্রতিদিন মালিকদের ৫০ থেকে ৬০ টাকা খরচ করতে হয়। এক্ষেত্রে ফসল তোলার মৌসুমে তারা ঘোড়ার গাড়িতে ফসল বহন করে দৈনিক দেড় হাজার থেকে দুই হাজার টাকা আয় করতে পারে। ফলে ঐ সময়ে বেশ ভালোই লাভ হয় বলে জানান তিনি।
ময়মনসিংহ থেকে আসা আরেক ঘোড়ার মালিক জানান, চাষের আগে কৃষিজমি তৈরিতেও ঘোড়া ব্যবহার করা হয়। এদিকে দৌড় প্রতিযোগিতায় ব্যবহৃত ঘোড়াগুলোকে অবশ্য ছোলা জাতীয় কিছু অতিরিক্ত খাবার দেওয়া হয়। সেক্ষেত্রে প্রতিটিকে দৈনিক প্রায় এক কেজি ছোলা খাওয়ানো হয়। আর দৌড় প্রতিযোগিতায় জিতলে মোটা অঙ্কের টাকাও পাওয়া যায়।
জামালপুর সদর থেকে রেসের ঘোড়া কিনতে এসেছিলেন মোহাম্মদ সেলিম। দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘোড়দৌড় হলেই তিনি অংশ নেন। তার ১১ বছর বয়সী ছেলে জকির ভূমিকায় থাকে। বর্তমানে ছেলেটি এটিই করছেন কেননা তাকে স্কুলেও পাঠানো হয় না।
সেলিম বলেন, "বিজয়ীরা ফ্রিজ ও টেলিভিশনের মতো পুরস্কার পেলেও মূল আয় আসে বাজি থেকে। ঘোড়ার মালিক বাজির একটি অংশ পায়; প্রায়শই সেটা কয়েক লাখ টাকা মূল্যের হয়ে থাকে।"
সেলিম কৃষিকাজের পাশাপাশি একজন ঘোড়ার রেসার হিসাবে তার দাদা এবং পিতার উত্তরাধিকার পেশা বহন করে চলছেন। বর্তমানে তার চারটি ঘোড়া রয়েছে। আর তার বাবার এখনো দুটি ঘোড়া রয়েছে।
তার ছেলে মোহাম্মদ জিসান খুব অল্প বয়স থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত ১০ থেকে ১২টি রেসে অংশ নিয়েছেন। সেলিমের মেয়ে আঁখিও বিয়ের আগ পর্যন্ত জকির ভূমিকায় থেকে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
সকলের জন্য যে ঘোড়া
গাড়ি টানার জন্য ব্যবহৃত ঘোড়াগুলো খুব বেশি দামি নয়। একটি 'ভালো' ঘোড়া বিক্রি হয় প্রায় ৩০ হাজার টাকায়। তবে শক্তি ও উপযোগিতার উপর ভিত্তি করে এই দাম আরও বৃদ্ধি পায়।
বাজার কমিটির সদস্য ফয়সাল টিবিএসকে বলেন, "কিছু ঘোড়া যেগুলোর এখন খুব একটা উপযোগিতা নেই সেগুলো এমনকি ২০০ থেকে ৫০০ টাকায়ও বিক্রি হয়। আর কিছু মালিকরা ঘোড়া বিক্রি করতে না পেরে সেগুলোকে বাজারে পরিত্যক্ত অবস্থায়ই ফেলে যায়।"
আমরা দেখেছি যে, জামালপুর সদরের দুই লোক তাদের নাতি-নাতনির জন্য মাত্র ১ হাজার টাকা এবং ১,৫০০ টাকায় দুটি কমবয়সী ঘোড়া কিনেছেন।
তাদের মধ্যে লাল মিয়া (৬০) নামের এক কৃষক বলেন, "আমার তিন বছর বয়সী নাতি কিছু দিন ধরে একটি ঘোড়ার জন্য কান্নাকাটি করছে। অবশেষে আমি তার জন্য এই ছোট ঘোড়াটি নিয়ে যাচ্ছি।"
ঘোড়াটির বয়স মাত্র এক মাস। এটির মতো ছোট ঘোড়াগুলো বেশ দ্রুত বৃদ্ধি পায়। এগুলো ১৮ মাস বয়সে গাড়ি টানা শুরু করতে পারে।
তবে ঘোড়াটি কেনার সময় কিছু পথচারীকে বেশ চিন্তিত মনে হলো। কেননা তারা আশঙ্কা করছে যে, বাচ্চা ঘোড়াটি হয়তো এটির মা ছাড়া বাঁচবে না।
বগুড়ার আরেক ব্যক্তি মাত্র ১৬ হাজার টাকায় বাচ্চাসহ একটি ঘোড়া কিনেছেন। তিনি জানান, এটি তার জন্য খুব সুবিধাজনক একটা দাম ছিল। কারণ তিনি শীঘ্রই একটি পুরুষ বাচ্চা ঘোড়া কিনতেন।
তুলসীপুরের মজনুর মতো স্থানীয় ব্যবসায়ীরা ৮ থেকে ১০ লাখ টাকার দামি ঘোড়াও বিক্রি করেন। তিনি বলেন, "এই ধরনের বিশেষ ঘোড়াগুলি প্রধানত সরকারি সংস্থা এবং পুলিশ কিংবা সেনাবাহিনীর মতো বাহিনী থেকে কিনে আনা হয়"
মজনু জানান, তিনি ভারত থেকেও ঘোড়া আমদানি করেন৷ তবে তুলসীপুর ঘোড়ার বাজারে তিনি মূলত স্থানীয় জাতের ঘোড়া বিক্রি করেন। এ হাটে দামি ঘোড়া আনা হয় না।
একটি ঘোড়া কতটা ভালো মানের সেটির ক্ষেত্রে শক্তিমত্তা অন্যতম মাপকাঠি হিসেবে কাজ করে। তাই ব্যবসায়ীরা ঘোড়াগুলোর শক্তিমত্তা প্রদর্শনের চেষ্টা করে।
শক্তি পরীক্ষার সময় গাড়ির চাকাগুলি দড়ি দিয়ে বেঁধে দেওয়া হয় যাতে সেগুলো আর না ঘোরে। তারপর ঘোড়াগুলিকে মাঠের মাঝখানে বৃত্তাকার অবস্থায় রেখে গাড়িটিকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়।
ভিন্ন পন্থা হিসেবে ঘোড়াগুলি ৮ থেকে ১০ জনের মতো মানুষকে চাকা ছাড়া গাড়িতে বহন করে। কিছু ব্যবসায়ী ঘোড়ার গাড়িটি লোকজনসহ খালে নিয়ে যায়। তখন কিছু ঘোড়া যাত্রীসহ উপরে উঠতে সক্ষম হয়। আর বাকিগুলো যাত্রীসহ খাড়া পাড়ে উঠতে ব্যর্থ হয়।
কয়েক দশকের পুরোনো বাজার
আদিকাল থেকেই বাজারটির আশেপাশের স্থানীয়রা ঘোড়া ব্যবসার সাথে যুক্ত। তবে পুরোনো ব্যবসায়ীরা জানান, আগে তারা টাঙ্গাইলের গোপালপুরের একটি বাজারের ওপর তারা নির্ভরশীল ছিল। এক্ষেত্রে গোপালপুরের রাস্তা ছিল অনিরাপদ, ঘোড়া ব্যবসায়ীরা ডাকাতির শিকার হতেন। তাই ১৯৯০ সালে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা তাদের নিজস্ব একটি হাট শুরুর সিদ্ধান্ত নেয়।
রশিদপুর ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের সামনে সাপ্তাহিক হাটে প্রথমে ঘোড়ার বাজারটি বসতো। বাজার বড় হওয়ার সাথে সাথে এটি ১৯৯৬ সালে কয়েকশ মিটার দূরে তুলসীপুর ডিগ্রি কলেজের সামনে সরিয়ে নেওয়া হয়।
ব্যবসায়ীরা জানান, সারা দেশে বর্তমানে হাতেগোনা কয়েকটি ঘোড়ার বাজার রয়েছে। জয়পুরহাটে 'গোপীনাথের মেলা' নামের একটি বার্ষিক মেলা হয়। যেখানে গরু ও মহিষসহ হাজার হাজার ঘোড়া বিক্রির জন্য আনা হয়।
এছাড়া নাটোর ও বগুড়ায় ছোট ছোট মিশ্র বাজার রয়েছে যেখানে অন্যান্য গৃহপালিত পশুর সাথে ঘোড়া বিক্রি হয়। বেশ কয়েকটি ঘোড়া ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতার আশেপাশেও বিক্রি করা হয়।
ব্যবসায়ীরা জানান, প্রতি সপ্তাহে ঘোড়ার জন্য উৎসর্গ করা শেষ হাট হলো এই তুলসীপুর হাট। গভীর রাত পর্যন্ত বাজারটিতে চলে লেনদেন।
হাটের দায়িত্বে থাকা কর্মীরা অস্থায়ী বাঁশের খুঁটিতে রাখা বৈদ্যুতিক বাল্বগুলি চালু করা শুরু করে। তখন ঠিক সন্ধ্যার পরে আমরা সেখান থেকে চলে আসি।
ট্রাকচালক আলী হোসেন তখনও ভালো মানের একটি ঘোড়ার সন্ধান করছিলেন। পরবর্তীতে তিনি জানান, রাত ১০ টায় তিনি একটি ঘোড়া কিনতে পেরেছিলেন। যখন মাত্র ১০ থেকে ১৫ জন বিক্রেতা বাকি ছিল।
আলী ঘোড়া ও গাড়ি নিয়ে কুমিল্লায় পৌঁছানোর দু'দিন পর বলেন, "আমার বাচ্চারা ঘোড়াটিকে একা থাকতে দিচ্ছে না। তারা খুব আনন্দিত। এমনকি এখন তারা মাঠেই আছে, ঘোড়াটিকে খাওয়াচ্ছে।"
এছাড়াও তিনি জানান, ঘোড়াটি গর্ভবতী ছিল এবং প্রাণীটির পরিবারটি সম্পূর্ণ করতে তিনি আরেকটি ঘোড়া কেনার পরিকল্পনা করছেন।