‘হবর একখান’ থেকে ‘স্বপ্নের বাড়ি যাওয়া’: ঈদ-বিজ্ঞাপন নিয়ে যত কথা
একুশ শতকের শুরু। বাংলাদেশে মধ্যবিত্তের ঘরে কিংবা চায়ের দোকানে এক বোকাবাক্স জায়গা করে নিচ্ছে — টেলিভিশন। নব্বই দশকের গোটা পাড়ার দু-এক বাড়িতে গোল হয়ে আসর জমিয়ে বোকাবাক্সের বায়োস্কোপ দেখার যুগ পেরিয়ে মানুষের জন্য তখন একটু সহজলভ্য হয়ে উঠেছে টেলিভিশন। বাড়ি বাড়ি আসছে নতুন নতুন টিভি, কারও বা সাদা-কালো, কারও রঙিন। অ্যান্টেনায় আসে শুধু বাংলাদেশ টেলিভিশন; মানুষ তখন বিজ্ঞাপনও দেখত পরম আগ্রহে। সে সময়েরই কোনো এক কোরবানির ঈদে ঢোলের বাদ্য বাজিয়ে এল এক বিজ্ঞাপন:
'ভাইসাব হবর একখান, হবর একখান, দেরি অইয়া যায়
আঁত্তুন লাগে ঈদের নমাজ হড়িও হালায়
ভাইসাব হবর একখান।
এক বছরে দুইয়ান খুশি, আমরা মুসলমান,
একখান হইল রমজানের ঈদ, আরেকখান কুরবান
ভাইসাব আরসি কোলা খান।'
ঢোলের বাদ্য, গোল হয়ে বসে গায়েনের গান শোনা, মেতে ওঠা, বাচ্চাদের হুটোপুটি, ঈদের নামাজ পড়ে বাড়ি ফেরার দৃশ্য, কোরবানির গরুর পিছে ছুটতে ছুটতে সবাই মিলে যাওয়া — শৈশবের চিরচেনা ঈদের দৃশ্যপট। বাঙালির ঈদ উৎসবের নিজস্ব আমেজকে ধারণ করে আঞ্চলিক ভাষার জিঙ্গেলের এ বিজ্ঞাপন তাই যেন চোখে লেগে থাকে, আজ এত বছর পরেও কোরবানির ঈদের কথা উঠলেই কানে বেজে ওঠে সেই সুর। ব্যাপক জনপ্রিয় এ বিজ্ঞাপনটির একটি অন্যতম বিশেষত্ব ছিল আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার, যা বিজ্ঞাপনটিকে মাটির নিজস্ব ঘ্রাণ দিয়েছে যেন। নোয়াখালীর ভাষায় তৈরি বিজ্ঞাপনটি পরবর্তীকালে সিলেট, বরিশাল, চট্টগ্রাম, রাজশাহীর ভাষায় পুনঃনির্মাণ করা হয়েছে।
ঈদকে কেন্দ্র করে বাঙালি মুসলমান সমাজের আবেগ ও উৎসবের আমেজের আবহকে ধারণ করে বিভিন্ন সময়ে তৈরি হয়েছে নানা বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপনী সংস্থা ও ব্র্যান্ডগুলো মানুষের নানা রঙের আবেগকে নিজেদের পণ্যের বিজ্ঞাপনী প্রচারণার মাধ্যমে তুলে ধরার চেষ্টা করেছে। ফলে একদিকে তারা নিজেরা লাভবান হয়েছে, মানুষও পর্দায় দেখেছে নিজেদের গল্প; আশপাশের চিরচেনা গল্পগুলোই যেন দৃশ্যপটে উঠে এসেছে।
স্বপ্ন যাবে বাড়ি আমার: অপেক্ষার গল্প, বাড়ি ফেরার গল্প
মানুষ যেখানেই থাকুক, দিনশেষে নিজের মানুষের কাছে ফিরতে চায়। বাড়ি মানে মাথার ওপর এক টুকরো ছাদ নয়, আমাদের মানুষেরাই আমাদের বাড়ি — তাদের ঘিরেই আমাদের শেকড়, আমাদের বাড়ি। সেই বাড়ি, বাড়ির মানুষদের ছেড়ে হাজার প্রয়োজনে আমাদের সবার একদিন বাড়ি ছাড়তে হয়। এ হাজার প্রয়োজন যেন হার মেনে যায় বাড়ির দাওয়ায় গরম ভাত বেড়ে অপেক্ষারত মায়ার টানের কাছে। আমাদের নানা রঙের সম্পর্কের নানা বর্ণের অপেক্ষা আর সেই অপেক্ষার টানে পথ পাড়ি দিয়ে বাড়ি ফেরার গল্পকেই ধারণ করে মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটর কোম্পানি গ্রামীণফোনের বিজ্ঞাপন 'স্বপ্ন যাবে বাড়ি আমার'।
প্রতিবছর শত বাঁধা-বিপত্তি পেরিয়ে বাড়ি ফেরার আকুলি-বিকুলি যেন আগলে নেয় বিজ্ঞাপনটি। নারকেল নাড়ু নিয়ে অপেক্ষায় থাকা মায়ের কাছে সন্তানের ফেরার গল্প, বাড়ির ছোট্ট পরীর জন্য ঈদের লাল টুকটুকে জামা নিয়ে বাবার ফেরার গল্প, অপেক্ষারত নববধূর একজোড়া চুড়ির গল্প — প্রিয় মুখ আর স্মৃতির সারি ফেলে স্বপ্নের টানে আপন ছাড়া মানুষদের উঠান-বাড়িতে ফেরার কথা বলতেই যেন এই গান:
'মন বলে চল ফিরে আবার
স্বপ্ন যাবে বাড়ি আমার।
এইতো সময় ফিরে আসার, স্বপ্ন যাবে বাড়ি আমার।'
বাড়ি ফেরার গল্পগুলো যেন পরম যত্নে তুলে ধরেছে বিজ্ঞাপনটি; নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের বাড়ি ফেরার গল্প। শুধু তা-ই নয়, যাদের বাড়ি ফেরা হয় না দিনশেষে, গল্প বলেছে তাদেরও। সেবাপেশায় নিয়োজিত ডাক্তার, বাড়ির কেয়ারটেকার, পরিচ্ছন্নতাকর্মীসহ বাড়ি ফিরতে না পারা মানুষদের নিয়ে বলা হয়েছে, 'কেউ রয়ে যাবে কেউ ফিরবে বাড়ি, তবু সবার স্বপ্ন যাবে বাড়ি।' করোনাকালীন সময়ে বাড়ি ফিরতে না পারা হাজারো মানুষ, বাড়ির মানুষ হারানো মানুষদের উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছিল, 'আপনি থাকুন ঘরের মাঝে, স্বপ্নটা যাক আপনজনের কাছে।' নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের নানা অপেক্ষাকে ধারণ করতে পেরেছে বলেই বিজ্ঞাপনটি হয়ে উঠেছে ঈদে বাড়ি ফেরার আকাঙ্ক্ষায় থাকা মানুষের বড্ড আপন।
লালটু: ভালোবাসা ও ত্যাগের গল্প
ভালোবাসার বন্ধন বাঁধতে পারে একটা অবলা জীবও, আর সেই পরম ভালোবাসার জীবকে স্রষ্টার উদ্দেশে ত্যাগই যেন কোরবানির ঈদের মাহাত্ম্য। এমনই এক গল্পকে তুলে ধরে মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটর কোম্পানি রবি আজিয়াটার ২০১৫ সালের বিজ্ঞাপনটি। ছোট্ট আফসানা বাড়ি এসে প্রথম দেখা পায় লাল টুকটুকে লালটুর। লালটুকে সে আদর করে, পানি খাওয়ায়, ঘাস খাওয়ায়, বই থেকে বর্ণমালা পড়ে শোনায়, ঈদের দিন ভোরেও লালটুকে আদর করে দিয়ে আসে। সেই লালটু কোরবানি হয়ে যাওয়ার পর যখন সে প্রথম জানতে পারে, তখন সে কান্নায় ভেঙে পড়ে। এমন পরম মমতার, ভালোবাসার গল্পটি যেন কোরবানির প্রকৃত বাণী, ভালোবাসা ও ত্যাগের কথাই তুলে ধরে।
বাড়ির মেয়েদের ত্যাগের গল্প
'কে যাস রে ভাটি গাঙ বাইয়া,
আমার ভাই ধনরে কইয়ো,
নাইওর নিতো বইলা
তোরা কে যাস, যাস রে…'
২০১৭ সালের বিজ্ঞাপনে মেরিল সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে 'ত্যাগ'-কে তুলে ধরে, যে ত্যাগ বছরের পর বছর ধরে এদেশের বেশিরভাগ মেয়েরা তাদের বিয়ের পর মেনে নেন। এমন অনেক মেয়েই আছেন, যারা বছরের পর বছর ধরে বিয়ের পর নিজের মা-বাবার সঙ্গে বাড়িতে ঈদ করতে পারেন না। অনেকে বিয়ের পর কখনোই আর বাড়িতে ঈদ করতে পারেন না। একজন স্ত্রী, বাড়ির বউ বা নিজে মা হওয়ার আগে সে নিজেও যে কোনো বাড়ির মেয়ে ছিল, তারও যে ইচ্ছে হয় মা-বাবার সঙ্গে ঈদ করতে, তা যেন একসময় তার নিজেকেই ভুলে যেতে হয়। এ বিষয়টিকে এ বিজ্ঞাপনে তুলে ধরা হয়েছে। বিজ্ঞাপনে এক ভাই তার বোন শিউলিকে ছাড়া ঈদের কথা বলতে গিয়ে বলে, বিয়ের পর তিন বছরে কখনো সে তাদের বাড়িতে ঈদ করতে পারেনি। সে তার স্ত্রী রানুকে নিয়ে সে বছর তার বাড়িতে ঈদে নিয়ে যাচ্ছে, কেননা রানুরও হয়তো শিউলির মতোই ইচ্ছে হয় নিজের পরিবারের সঙ্গে ঈদ করার। একটু নিজের করে, আপন করে ভেবে দেখার কথাই যেন অবলীলায় বিজ্ঞাপনটি তুলে ধরেছে।
অপেক্ষা ছাড়া কি বাড়ি ফেরা হয়?
এই যে বাড়ি ফেরার তাড়না, তা তো কারও না কারও অপেক্ষার টানে। চাতকের মতো চেয়ে থাকা বাড়ির মানুষগুলোর মুখে একটুখানি হাসি ফোটানোর শান্তি পেতেই তো এত সংগ্রাম শেষে বাড়ি ফেরা হয়। সেই হাসি ফোটানোর মানুষগুলোই যদি না থাকে, সে বাড়ি ফেরার মূল্যই খুচরো হয়ে যায়। ট্রেনের টিকিট না পাওয়া এক বাবাকে নিজের বাড়ি ফেরার টিকিটটা দিতে দিতে এক মাস আগে মা হারানো তরুণ বলে, 'আমার জন্য তো কেউ অপেক্ষায় নেই।' কিন্তু বাড়ি ফেরার তাড়না হারিয়ে ফেলা সেই মানুষটাও নিজের স্বার্থহীন কাজের মাধ্যমে যেন পায় শান্তি ও ভালোবাসা। ২০১৯ সালে বিকাশ ঈদ-উল-আযহা উপলক্ষ্যে বিজ্ঞাপনটি প্রচার করে।
কলুষতার ত্যাগে শুদ্ধতার জয়গান
কোরবানির মূলবাণী আত্মিক বিশুদ্ধতা অর্জন। সে বাণীকেই তুলে ধরা হয়েছে টেকনোর ২০১৯ সালের ঈদ-উল-আযহার বিজ্ঞাপনে। ছোট্ট রুবিদের বাড়িতে চলে আসে এক হারানো কোরবানির গরু, রুবি নাম রাখে তার নীলু। অভাবের তাড়নায় হারানো গরুটাকে রুবির বাবা বিক্রি করে দিতে চান, যে গরু কি না অন্য কারও কোরবানির পশু। শেষ অব্দি বিবেকের তাড়নায় মালিককে খুঁজতে বের হন। সত্যিকারের আত্মত্যাগ ভেতরের কলুষতা দূর করে নিজেকে শুদ্ধ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা, একেই ধারণ করে বিজ্ঞাপনটি।
সমতার জন্য ত্যাগ
কোরবানিকে ঘিরে তৈরি হয়েছে জাহির করা, দম্ভ দেখানোর প্রবণতা। কে সমাজের কত ওপরের স্তরে, কার কত সম্পদ তা জাহির করার মাধ্যম হিসেবে অনেকেই কোরবানিকে ব্যবহার করে থাকে। তাই যেন ফুটিয়ে তুলেছে খন্দকার সাহেবের দেখনদারীর কোরবানি। খন্দকার সাহেব তার এলাকার সবচেয়ে বড় গরুটি কিনেছে এলাকার সবাইকে তাক লাগিয়ে দিতে। অথচ, তার সেই গরুর ভাগে গরীব দুঃখীর ভাগে রেখেছেন কেবল হাঁড়, চর্বি। এমন দেখনদারির কোরবানি যে একপ্রকার অর্থহীন মাংস ভোজন, তাই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বিজ্ঞাপনটিতে। বিজ্ঞাপনটি গ্রামীণফোন ২০১৮ সালের ঈদ-উল-আযহা উপলক্ষে প্রচার করা হয়।
সবাইকে নিয়েই ঈদ
'আমার কোরবানি কি তোমাগো কোরবানি না?'
বুকে চাপা কষ্ট নিয়ে টানাপোড়েনের মাঝে অনেকেই কোরবানি দিতে পারেন না, মধ্যবিত্ত পরিবারের অবুঝ সন্তানকে বোঝানো যায় না সে টানাপোড়েনের বাস্তবতা। জায়িফের বাবা সে বছর কোরবানি দিতে পারে না, ছোট্ট জায়িফ সে অক্ষমতাকে বুঝতে না পেরে বাবার কাছে জানতে চায় কোরবানির কথা। বাবার কাছে অবুঝ সন্তানের উত্তর দেবার মতো বুলি জানা নেই। এ অসহায়ত্বে প্রতিবেশীর কাছে এগিয়ে আসেন বাড়ির মালিক, জায়িফকে কোলে তুলে আপন করে নিয়ে জানান দেন, ঈদ মানুষের জন্য, সবাইকে নিয়ে উদযাপনের জন্য। বিজ্ঞাপনটি প্রচার করে প্রাণ ফ্রুটো।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনা
কোরবানির বর্জ্য সঠিক স্থানে ফেলার ব্যাপারে সচেতনতা বাড়াতে প্রাণ আরএফএলসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সরকারি, বেসরকারি উদ্যোগে বিজ্ঞাপন প্রচার করে থাকে। এসব বিজ্ঞাপনে কোরবানি-পরবর্তী বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নিজেদের পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখার ব্যাপারে গুরুত্বারোপ দেখা যায়।
ঈদ-উল-ফিতরের বিজ্ঞাপন
ঈদ-উল-ফিতরকে কেন্দ্র করে আরও ব্যাপক পরিসরে বিজ্ঞাপনের দেখা মেলে। রমজানের পবিত্রতা ও মাহাত্ম্যকে ধারণ করে প্রচারিত হয় এসব বিজ্ঞাপন। রমজানের পবিত্রতা, সবাইকে নিয়ে সেহরি, ইফতার, ছোটদের স্বপ্নের ঈদের জামা, বাড়ি ফেরার টানকে ফুটিয়ে তোলা হয় এসব বিজ্ঞাপনে। বিজ্ঞাপনগুলোয় শ্রেণি, বর্ণ নির্বিশেষে সবার ভেতরে ঈদের আনন্দ ও ভালোবাসা ছড়িয়ে দেওয়ার ভিন্নধর্মী সব উপস্থাপনের দেখা মেলে।
ত্যাগ, পবিত্রতা, ভালোবাসায় আমাদের দেশের ঈদ ও ঈদের উদযাপনের রয়েছে নিজস্ব রং। ঈদকেন্দ্রিক বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে সে রংকেই ধারণ করে ভিন্ন আঙ্গিকে উপস্থাপনের চেষ্টা করে ব্র্যান্ডগুলো। ব্যবসায়িক প্রচারণার স্বার্থে হলেও এসব বিজ্ঞাপনগুলো যেন আপন করে নিয়েছে মানুষের আনন্দ, দুঃখ, বেদনা। এসব বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলো ভোক্তার সঙ্গে মানসিক সান্নিধ্য গড়ে তুলতে পেরেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের যুগে বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর মার্কেটিংয়ের কাঠামোগত ও কৌশলগত পরিবর্তন আনতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এ পরিবর্তনের মাঝে বিজ্ঞাপনের গল্পগুলো যেন ফিকে হয়ে পড়ছে কিছুটা। বাংলাদেশের বিজ্ঞাপনগুলোর মূল শক্তির জায়গা এর গল্প, তা যেন ফিকে না হয়, যেন তা-তে ধুলো না জমে, যেন কয়েক প্রজন্ম মনে রাখার মতো গল্পগুলো বিজ্ঞাপনে তুলে ধরা হয়, সংশ্লিষ্টদের এ ব্যাপারে প্রয়োজন সচেতনতা।